• ক্রিকেট

যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে...

পোস্টটি ৮৮৬৪ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

৫০তম ওভারের ৪র্থ বলটা ডট দিলেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। ২ বলে দরকার ২ রান। কান পাতলে পাশের জনের হৃৎস্পন্দন শোনার সম্ভাবনাটাই বেশি। শেষ বলে দরকার ১ রান। ক্রিজে ‘এক পা’-য়ের কেদার যাদব, যার ‘পচা শামুক’ বোলিংয়ে আবারও চ্যাম্পিয়নস ট্রফির মত পা কাটল আমাদের। পর্বতসম স্নায়ুচাপের সে সময়টায়ও ক্রিজ থেকে সরে ক্যামেরা এক মুহূর্তের জন্য চলে গেল তাঁর দিকে। মাথা উঁচিয়ে তাকালেন উপরে, বিড়বিড় কী যেন একটা বললেন। এক মুহূর্তের ব্যাপার, কিন্তু তা-ই যেন পুরো বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।

রিয়াদ পারলেন না, পারল না বাংলাদেশ। তার লেগের বলটা সপাটে চালিয়ে কিপারের পেছনে পাঠালেন যাদব। আবারও তীরে এসে তরী ডোবানো। কিন্তু প্রতিবার মত এবার হারের পর আর অশ্রু নয়, বরং গর্বের হাসিই ছেয়ে গেল আমাদের ঠোঁটে। বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটিং লাইনআপের বিপক্ষে ২২৩ রান করে ম্যাচ নিয়ে গিয়েছি শেষ ওভারে- এই বা কম কী! মাঠের সবাই তখন হতাশ। মিরাজ, সৌম্যরা শূন্যদৃষ্টিতে কান্না লুকোনোর চেষ্টা করছেন হয়ত। তিনি এগিয়ে এলেন। একে একে জড়িয়ে ধরলেন সবাইকে। শোকের কালো চাদরটা উবে গেল কিছুটা। সবাই মিলে দর্শকদের কৃতজ্ঞতা জানালেন করতালি দিয়ে, করজোড়ে ক্ষমাও চেয়ে নিলেন কেউ কেউ। কিন্তু এই টুর্নামেন্টে রানার্স-আপ হওয়ার পরও কি ক্ষমা চাওয়াটা আমাদের বীরদের মানায়?

না, মানায় না। দুবাইয়ে এশিয়া কাপ, কন্ডিশন প্রায় অচেনা। মরুভূমির খরতাপ যেখানে পাকিস্তান, আফগানিস্তানদের প্রায় ‘হোম কন্ডিশন’ই বলা চলে; সেখানে আমরা তো শুরু থেকে কিছুটা ব্যাকফুটেই। কিন্তু তেমন আশা-প্রত্যাশা না থাকা সেই টুর্নামেন্টটিই হয়ে গেল সবচেয়ে স্মৃতিময়, সবচেয়ে আপন। মাঠের খেলার চেয়েও দাঁতে দাঁত চেপে ধরা সংকল্প, দৃঢ়প্রতিজ্ঞা যে ঠিক কতটা কার্যকরী, তা-ই যেন শিখিয়ে দিয়ে গেল ২০১৮ এশিয়া কাপ। অনেকেই হয়ত বলবেন; তামিমের সেই এক হাতে ব্যাটিং, সাকিবের ভাঙ্গা আঙ্গুল নিয়ে খেলা যাওয়া, বা পাজর ভাঙ্গা মুশফিকের বা হাসি-ঠাট্টার পাত্র লিটনে সেই অকুতোভয় সেঞ্চুরিই আমাদের ‘হাইলাইট’। কিন্তু এই আত্মত্যাগগুলোর পেছনে যিনি জ্বালানী হয়ে কাজ করেছিলেন- তিনিই কি সবচেয়ে বড় সঞ্জীবনী শক্তি নন?

 

 

মাশরাফি বিন মর্তুজা আমাদের ক্রিকেটের জন্য, আমাদের ক্রিকেটারদের জন্য কী- তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এই টুর্নামেন্টে মাশরাফি যেন ছাড়িয়ে গেলেন নিজেকেও। প্রায় দেড় যুগ ছুঁইছুঁই ক্যারিয়ারে দেশের জন্য বুকটা পেতে দিয়েছেন দ্বিতীয়বার না ভেবে, অধিনায়ক হওয়ার পর দলকে গেঁথেছেন এক সূতোয়। দ্বাদশ ওভারের প্রথম বলেই যখন রবীন্দ্র জাদেজাকে দুর্দান্ত স্কোয়ার ড্রাইভ মেরে নিজের প্রথম অর্ধশতক পূরণ করলেন লিটন, তখন ক্যামেরা চলে গেল বাংলাদেশ ড্রেসিং রুমে। আমরা দেখলাম, মাশরাফি হাততালি দিয়ে দু’হাত দিয়ে টানার ইশারা করছেন; ইনিংসটা বড় কর- জানালেন এমনটাই। বলেই ডানহাত দিয়ে বুকের ঠিক বাঁ-পাশে, আমাদের লোগোর উপর দুবার মুষ্টিবদ্ধ আঘাত হানলেন ‘ম্যাশ’। সেই লোগো, যেটিকে আপন সন্তানের জন্য মতই আজীবন আগলে রেখেছেন প্রিয় নড়াইল এক্সপ্রেস। একই ভঙ্গিতে অধিনায়ক জবাব দিলেন লিটন।

কয়েক সেকেন্ডের একটা দৃশ্য। হয়ত অনেকের কাছেই কিছু না। কিন্তু আমাদের কাছে? চোখের কোণ ভিজিয়ে দেওয়া, গর্বে বুক দশহাত ফুলিয়ে দেওয়া এক দৃশ্য। ফলাফল? যাওয়া আসার মহড়ায় মাতা মুশফিকদের মাঝে একপ্রান্ত আগলে রেখে লিটন করলেন ১২১ রান, যা কোনো টুর্নামেন্টের ফাইনালে আমাদের প্রথম শতক। অবশ্যই নিজের ক্ষমতার জোরেই রানগুলো করেছেন তিনি। কিন্তু হাতের জোরের সাথে বুকে মাশরাফির সেই মুষ্টিবদ্ধ আঘাত যেন লিটনকে এনে দিল অসুরের শক্তি, আমরা পেয়ে গেলাম অনবদ্য এক ইনিংস।

অধিনায়ক হওয়ার পর থেকে এমনটা যে কতবার করেছেন, সে কথা লিখতে বসলে হয়ত আগামী বইমেলায় একখান বই-ই প্রকাশ করা যাবে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মুস্তাফিজ যখন রানআউট হলেন, সবাই প্রস্তুত ইনিংস বিরতির। হঠাৎই একহাতে কাটা গ্লাভস পড়ে নেমে আসলেন তামিম ইকবাল, যার এশিয়া কাপ শেষ খবরে ততক্ষণে ছেয়ে গেছে ফেসবুক। তামিম বল মোকাবেলা করলেন একটি। সেই ছবিই হয়ে গেল অমর। আমরা পেলাম ম্যালকম মার্শাল, গ্রায়েম স্মিথদের বাঙ্গালি সংস্করণ। ম্যাচ শেষে তামিম বলেছিলেন, “ভাই বলেছে নামতেই হবে। ইনিংসের সময় গ্লাভসটা তিনিই কেটেছিলেন। প্যাডও পড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনিই।”

 

 

ভাই। বড় ভাই। আমাদের অভিভাবক। যিনি নিজের কথাটা ভাবেননি কখনও। দলের সবাই-ই যেন লাল-সবুজের পতাকার তরে বিলিয়ে দেয় নিজেদের- এমনটা নিশ্চিত করতে যা যা প্রয়োজন, করেছেন সবই। হাঁটুর ইনজুরি তার কাছে নস্যি। যেখানে খেলোয়াড়েরা একবার ছুরির নিচে যাওয়ার পরই হারিয়ে ফেলেন পুরনো জৌলুস, সেখানে তিনি ফিরে এসেছেন সাত সাতবার। এ ব্যাপারে কথা উঠতেই প্রতিবারই প্রকাশ পায় দেশের প্রতি এক ক্ষতবিক্ষত যোদ্ধার অপার ভালবাসা, "ম্যাচ জিতলে সবাই বলে আমরা নাকি বীর। আসল বীর তো তাঁরা (মুক্তিযোদ্ধা)। তাঁরা দেশের জন্য কী করে গেছেন আর আমরা কী করছি? তাঁদের জন্যই তো আমরা আজ অন্যের জুতা পরিষ্কার করছি না। বারবার ইনজুরি থেকে ফিরে আসার প্রেরণাও পাই সেসব বীর মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকেই। এমনও ম্যাচ গেছে আমি হয়তো চোটের কারণে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলাম না। দুই-তিনটা বল করেই বুঝতে পারছিলাম সমস্যা হচ্ছে। তখন তাঁদের স্মরণ করেছি। নিজেকে বলেছি, "হাত-পায়ে গুলি লাগার পরও তাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন কীভাবে? তোর তো একটা মাত্র লিগামেন্ট নেই! দৌড়া...।"

পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের আগের দিনও খুঁড়িয়ে হাঁটছিলেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব সেই স্বভাবসুলভ হাসি দিয়েই জানালেন, “ও আল্লাহ! জানেন না? পায়ের তলা থেকে মাথা পর্যন্ত সারা শরীরে ব্যথা।” কে বলবে, এই মানুষটিই পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন একাই। শুরুর বিপর্যয় সামলে সেট হয়ে যাওয়া শোয়েব মালিক তখন চোখ রাঙ্গানি দিচ্ছেন জয় ছিনিয়ে আনার। রুবেলের লেগের বলটাও ক্লিপ করলেন তিনি।

হঠাৎই আম্পায়ার এবং মিড অনের ফিল্ডারের মাঝ থেকে প্রচন্ড ক্ষীপ্রতায় কে যেন শূন্যে ভেসে তালুবন্দি করলেন বলটা। মালিকের ব্যাটে বল লাগা থেকে মাশরাফির তালুবন্দি করার মাঝের সময়টা মাত্র ০.৮৪ সেকেন্ড। এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে বাংলার প্রিয় ‘পাগলা’ তোয়াক্কা করলেন না কোনো কিছুর। বেকায়দায় পড়লে শরীরের ওপর দিয়ে কী বয়ে যেতে পারে- তা মাথায় আনলেন না একবারও। শোয়েব মালিক অবাক চোখে তাকালেন, যাবার বেলায় ক্ষীণ এক হাসি মুখে নিয়েই করলেন প্রস্থান। মাশরাফির পুরো ক্যারিয়ারই দেখেছেন তিনি, দু’বছর আগে পরেই তো অভিষেক। হয়ত জানেন ইনজুরির সাথে তার ‘সখ্যতা’র বিষয়টাও। সেই শোয়েব মালিক সেদিন খেলেছেন নিজের ২৭৪তম ওয়ানডে ম্যাচ। আর মাশরাফি? মাত্র ১৯৫তম। তবে ক্যারিয়ারের স্বর্ণযুগটা ইনজুরির কাছে হারানোর ক্ষোভটা এখন আর গায়ে লাগান না তিনি। যা দিয়ে যাচ্ছেন, তাই কি সে দুঃখ ভুলিয়ে দেওয়ার সর্বোৎকৃষ্ট দাওয়াই নয়?

 

 

মালিকের সেই ক্যাচ নিয়েই হাতের ব্যথায় মাঠ ছাড়লেন। পরে অবশ্য ফিরেছিলেন হাতে ব্যান্ডেজ করে। মাঠ ছেড়েছেন দলকে ফাইনালে নিয়েই। ভারতের বিপক্ষেও খেলেছেন আঙ্গুলে ব্যান্ডেজ নিয়ে। ফিজিওর ধারণে, হয়ত ফ্র্যাকচারও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ফাইনালের আগ পর্যন্তও ম্যাশ এটা নিয়ে ভাবেননি। এমনকি স্ক্যানও করেননি। দলকে অযথা চাপে ফেলতে চান না, হোক তা দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করে। গত দেড় যুগে কম তো বিসর্জন দেননি। দিলেন আরেকবার। অন্যদের চিন্তিত অভিব্যক্তির বিপক্ষে তার কথা একটাই, “আরে ভাই, সাকিব ভাঙা আঙুল নিয়া এতগুলা ম্যাচ খেলে গেল, আমি একটা পারুম না!”

হাতের ইনজুরির কারণে যে সাকিব খেলবেন না পাকিস্তানের বিপক্ষে, তা আগেই জানতেন মাশরাফি এবং ম্যানেজমেন্ট। কিন্তু মাশরাফির বারণেই খেলোয়াড়দের জানানো হল না। কারণ? অহেতুক চাপে পড়ে যাওয়া, মানসিকভাবে কিছুটা হলেও দূর্বল হয়ে যাওয়া। জানানো হল ম্যাচের দিন সকালে। তখন ভেঙ্গে পড়ার সময়টাও নেই বাংলাদেশের। ফলাফল? ৩২ রানের জয়ে এশিয়া কাপের গত চার সংস্করণে আমাদের তৃতীয় ফাইনাল। ম্যাচ শেষে ৯৯ করা মুশফিক জানালেন ‘ভাই’-এর অনুপ্রেরণার সারমর্ম, “আমাদের জানানোর পর (সাকিব না খেলার সংবাদ) ভাই বললেন, এটা যুদ্ধের ময়দান। একবার যখন এসেছি, তখন পেছনে ফিরে তাকাবার সুযোগ নেই। হয় মারব, নয়য় মরবো।” ম্যাশের এই রক্ত গরম করা অনুপ্রেরণা যেন আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতকে সেই ম্যাচের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে, যেদিন ২৪ বছর বয়সী মাশরাফি বলেছিলেন, “উইকেট ভেজা থাকলে আর আমরা আগে বোলিং করলে ওদের ধরে দেবানি।” সেই ‘ধরে দেবানি’ আজও আমাদের কানে বাজে সুধার মত, অনুপ্রারিত করে অসম্ভব কিছুকে সম্ভব করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে…

 

 

পুরোটা টুর্নামেন্টে আমাদের ব্যাটিং যাচ্ছেতাই হলেও বোলিং ছিল দারুণ। ২০১৬ থেকে শেষ দশ ওভারে আমাদের চেয়ে ভাল ‘পেস এটাক’ নেই বিশ্বে কোনো। মুস্তাফিজ, রুবেলরা উইকেটের টালিটা ভারী করলেও এদের আগলে রেখেছেন একজনই। চকিত বুদ্দিদীপ্ত ফিল্ডিং সাজিয়ে ব্যাটসম্যানকে ঘায়েল করিয়েছেন একজনই। এমনকি গতকালও ধোনি-কার্তিক জুটি যখন দলের মূল বোলাররাই ভাঙ্গতে পারছিলেন না, তখন বোলিংয়ে আনলেন মাহমুদুল্লাহকে। সুনীল গাভাস্কার পর্যন্ত বললেন, এমন সেট ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে পার্টটাইম বোলার আনা কতটা বুদ্ধিমানের কাজ- তা জানা নেই তার। ‘সানি’ তা জানলেন একটু পরেই। রিয়াদের বলেই এলবিডব্লিউ হয়ে সাজঘরে ফিরলেন কার্তিক। আবারও মাশরাফির জুয়াতে ঘায়েল প্রতিপক্ষ। এমনকি গত বছর চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডকে হারানো ম্যাচে হঠাৎই মোসাদ্দেককে

বোলিংয়ে এনেছিলেন। ফলাফল? ওয়ানডেতে নিজের প্রথম বলেই উইকেট পাওয়া একমাত্র বোলার হয়ে গেলেন সৈকত, নিলেন তিন উইকেট। এমন হাজারটা উদাহরণ বের করা যাবে তার। কিন্তু সেই কেতাবী পরিসংখ্যান তোলা থাক আরেকদিনের জন্য।

আফগানিস্তানের সাথে মুস্তাফিজও যখন ক্র্যাম্পের কারণে দাঁড়াতে পারছিলেন না, তখনই তাকে বুকে জড়িয়ে কী যেন বললেন মাশরাফি। সেই ‘ফিজ’ শেষ ওভারে ৮ রান ডিফেন্ড করলেন। ম্যাচ শেষে বললেন, “ভাইকে বলেছিলাম, আর পারছি না। ভাই বললেন, তোর পারতেই হবে। তুই-ই পারবি। যেমনে হোক, জিতায়ে দিস।” বুক যার বাংলাদেশের হৃদয়, সে যখন এমন রক্ত গরম করা অনুপ্রেরণা দেয়, তখন না পেরে উপায় আছে?

 

 

দেশের প্রতি তার টান যে কতটা বেশি- তা না বললেও চলে। তবে গতকাল আবারও আমাদের জানান দিলেন তা। ফাইনালের আগে সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিক মাশরাফিকে প্রশ্ন করেছিলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের বিপক্ষে বেশ কিছু ম্যাচ হেরেছেন। এর মধ্যে ফাইনালও ছিল- এশিয়া কাপ, নিদাহাস ট্রফি। এছাড়াও অনেকবার ফাইনাল খেলেও জিততে পারেননি। আপনার ব্যক্তিগত ভাবেও ট্রফি জেতার একটি সুযোগ কালকের ম্যাচ।” প্রত্যুত্তরে নিঃস্বার্থ ম্যাশ বললেন, “প্রথমত দেখেন, আমি নিজেকে এতো সস্তা মনে করি না। মাশরাফিকে আপনি একটা ট্রফি দিয়ে বিচার করতেই পারেন, কিন্তু আমি করি না। ক্রিকেট কখনও ট্রফির জন্য খেলিনি। হ্যাঁ এটা ঠিক যে বাংলাদেশের জন্য ট্রফি জেতাটা সময়ের দাবী। আমার বিশ্বাস, একদিন বাংলাদেশ ট্রফি জিতবেই। আর ট্রফির কথা বললাম কারণ এখনকার তরুণরা একটা ট্রফি পেলে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে। কিন্তু সেটা কালকেই পেতে হবে বা কালকে না পেলে সমস্যা এটা মনে করি না।”

ভারত, এশিয়া কাপ, শেষ বলে স্বপ্নভঙ্গের ‘ট্রেন্ড’টা বজায় থাকল গতকালও। হতাশ হলেও ভেঙ্গে পড়েননি মাশরাফি। হয়ত গতকালই ইতি টেনেছেন নিজের এশিয়া কাপ অধ্যায়ের। বছর দুয়েক বাদে ২০২০ এশিয়া কাপ হবে টি-২০ ফরম্যাটে, যেখান থেকে বছর দেড়েক আগেই বিদায় নিয়েছেন ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’। ওয়ানডে ফরম্যাটে পরের এশিয়া কাপ ২০২২ সালে, তখন বয়সটা হবে ৩৯। না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু ক্যারিয়ারজুড়ে যা দেখিয়েছেন, তাতে ২০২২-এও মাশরাফিকে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হলেও উড়িয়ে দেওয়া যায়না একেবারেই। তাই ট্রফি জেতার এতটা কাছে এসেও বিদায়- একটু তো অপ্রাপ্তি জেঁকে বসতেই পারে তাকে।

হয়ত বসেছেও, কিন্তু যথারীতি বুঝতে দেননি কাউকে। পাছে দলের ছোটরা কষ্টে আত্মবিশ্বাসটাই হারিয়ে ফেলে! এমন ভাঙ্গাচোরা এক দলকে যেভাবে সামনে থেকে বুক চিতিয়ে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন মাশরাফি, তা মনে থাকেব আজীবন। হৃদয়ের মানসপটে সেই হাওয়ায় ভেসে ক্যাচ ধরার পরমুহূর্তেই ‘স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’-র মত বল হাতে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যটা ভাসবে দীর্ঘদিন। আরও ভাসবে প্রায় প্রতি বলে রানআপে এসে হাঁটুর স্ট্র্যাপটা ঠিক করার দৃশ্য। একদিন তিনি ছেড়ে যাবেন, কিন্তু বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে। কোনো বড় ম্যাচে দীর্ঘ সময় উইকেট না পাওয়ার সময় মনে পড়বে তার কথা। আহা! পাগলাটা যদি থাকত। নিজের বলে, বা কোনও এক জুয়াতে ঠিকই পরাস্ত করত প্রতিপক্ষকে।

 

ব্যাটিংয়ের শেষদিকে নেমে আর কারও লম্বা হাতলের সেই বিশাল ছক্কায় বুনো উল্লাসে মাতবো না আমরা। কোনও একদিন হয়ত দেখা যাবে, নড়াইলেরই কোনও এক টেলিভিশন দোকানের সামনে আমজনতার সাথে গলা ফাটাচ্ছেন। এতশত অর্জনের পরও যিনি এখনও সেই মাটির মানুষটাই রয়ে গেছেন- তার থেকে তো এতটুকু প্রত্যাশা করতেই পারি। এবারের এশিয়া কাপ আমাদের স্বপ্ন দেখায় ২০১৯ বিশ্বকাপে দারুণ কিছু করার। তার অধীনে শেষ বিশ্বকাপে এমন আত্মপ্রত্যয়ী পারফরম্যান্সেরই অপেক্ষায় তীর্থের কাক হয়ে থাকবে ষোল কোটির দেশটা।

ইউটিউবে এইচটিএম রেকর্ডসের ‘মাশরাফি’ গানটা শোনেননি- এমন খুব কম মানুষই আছেন। হয়ত এক ভরদুপুর বা বৃষ্টিস্নাত রাতে আপনাই বেজে উঠবে গানটি। ক্ষণিকের জন্য থমকে যাব আমরা। গানের কলিগুলো যেন হৃদয়ে বিঁধবে কাঁটার মত। গর্বে ঠোঁটের কোণে মিলবে হাসির আভা, আর চোখের কোণে চিকচিক করবে অশ্রুকণা। আর মুখে ফুটবে গানের সেই বুলি,

“তুমি প্রিয়, তুমি সেরা,

তুমি আগামীর প্রত্যাশা,

মাশরাফি! মাশরাফি!! তুমি কোটি প্রাণের আশা,

মাশরাফি! মাশরাফি!! তুমি লাল-সবুজের ভালবাসা…”