• অন্যান্য

ক্রীড়াবিদদের মানসিক চাপ

পোস্টটি ২২২৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

আমার এই লেখাটায় হয়তো অনেকের হাসি পাবে এবং হয়তো বলবেন খেলোয়াড়কে মৌসুমের পারিশ্রমিক বাড়িয়ে দিতে পারি না আবার খেলোয়াড়ের মানসিক চাপ নিয়ে ডাক্তারের চিন্তাভাবনা। পাগল নাকি? অথবা বলবেন আমেরিকাতে বসে বসে এগুলো চিন্তা করা যায়।


তবে একটু ভেবে দেখুন- এদেশের মাটিতেই কিন্তু একদিন জাদুকর সামাদের মতো ফুটবল জিনিয়াস জন্ম নিয়েছিলেন। তাঁর প্রতিভার উৎস খুঁজে বের করে সেটাকে দিয়ে কীভাবে পরবর্তী প্রজন্মকে উৎসাহিত করে ক্রীড়ায় বা ক্রীড়াবিজ্ঞানে আরও সমৃদ্ধ করা যায় তার কথা কেউ ভাবেননি। সৎ মানসিকতা নিয়ে ভাবলে নিশ্চয় সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হতে দেড় যুগের বেশী সময় লাগতো না; কারণ বাংলাদেশীদের প্রতিভা এত খারাপ হলে নিশ্চয়ই স্বাধীনতা উত্তর বিধ্বস্ত বাংলাদেশের খেলোয়াড় সালাউদ্দিন সিঙ্গাপুরের ফুটবলে অংশ নিতে পারতেননা সেইসময়।


ক্রীড়া জগতে অর্থাৎ খেলোয়াড়দের মানসিক চাপকে বাড়ানো বা কমানোর মূল চাবিকাঠির (জাতীয় দল পর্যায়ে বা প্রিমিয়ার ডিভিশন পর্যায়ে) ৬০% নির্ভর করে ক্রীড়াসংগঠক অর্থাৎ ক্লাব বা ফেডারেশন কর্মকর্তাদের উপর। ফুটবল ফেডারেশনের কোন বড় কর্মকর্তা অফিস করতেন রাত নয়টা থেকে রাত দুইটা পর্যন্ত; আবার কোন কোন বড় কর্মকর্তাকে আমি দেখেছি ফুটবল ফেডারেশনের অফিসকে রাজনৈতিক চেম্বার বানিয়ে ফেলেছেন; ঐ বেচারাকেও দোষ দিয়ে লাভ নেই কারণ আমাদের দেশে তো ফুটবল বা অন্য কোনো খেলার ফেডারেশেনের কর্মর্কতারা পুরো পেশাদার বা আধা পেশাদার না ।আর যিনি পুরো পেশাদারের ভাব নিয়ে সারাদিন ফেডারেশনে বসে থাকতেন তার একক ছোট বা বড় কোন সিদ্ধান্ত দানের ক্ষমতা নেই- শুধু বলতেন “অমুক র্কমর্কতা অমুক জায়গা থেকে আসুক তার পর বলে দেখব”- তখন বিকেএসপি ক্যাম্প থেকে টেলিফোনে খেলোয়াড়েরা বলে “ফোন করে ফেডারেশনে তাকে পাওয়া যায়, কিন্তু কোনো লাভ হলো না। ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা নাকি?’


আমি যেহেতু ১৯৯৩- ১৯৯৯ পর্যন্ত ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিলাম তাই ফুটবল ফেডারেশনের বাস্তব চরিত্রটাই বর্ণনা করেছি। কোনো মনগড়া কথা বলছি না। এই কথাগুলো অপ্রাসঙ্গিক নয় কারণ একটা বাড়িতে আমাদের দেশে বাবার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ওপর সন্তানদের মনমানসকিতা ও র্কাযক্ষমতা বা জীবন সাফল্য নির্ভর করে।


জাতীয় ফুটবল দল যখন মিরপুর বা বিকেএসপিতে অনুশীলনরত তখন ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকত মি. নোমান। অথচ নোমান সাহেবের ফুটবল ফেডোরশেনের পক্ষ থেকে নিজস্ব কোনো পোর্টফোলিও নেই তাই দায়িত্ব থেকেও খেলোয়াড়দের সুবিধা অসুবিধার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা নেই। যদি দায়িত্বেই তাকে দেওয়া হলো তাহলে অফিসিয়াল সিস্টেমে অ্যাপয়েনমেন্ট দিয়ে দেওয়াই ভালো ছিল, তাহলে সবার জবাবদিহিতা থাকত।


দুই মাস আগে ক্যাম্প শুরু হলে হয়তো হঠাৎ কোন এক সময় ফোন পেতাম কোন এক বড় কর্মর্কতার কাছ থেকে, ‘ডাক্তার সাহেব আপনি একটু মাঝে মাঝে ক্যাম্পে আসবেন খেলোয়াড়দের দেখার জন্য। কিন্তু কোনো চিঠির মাধ্যমে না- কারণ চিঠি দিয়ে ডাক্তারকে দুই মাস আগে থেকে বললে যদি আবার কোন রাজনৈতিক দল ক্ষেপে ওঠে। সুতরাং আমিও যেতাম দায়সারাভাবে কারণ আমার তো অ্যাপয়েনমেন্ট, রিনিউমারেশন, ফেডেরাল ট্রান্সপোর্ট, ফেডারেশন অ্যালাওয়েন্স নেই । কারণ আমি যাই – নিজের গাড়িতে, নিজের পয়সার পেট্রোল জ্বালিয়ে এবং নিজের যন্ত্রপাতি দিয়ে। হয়তো দেখা গেছে আমি যেদিন গেলাম না সেই দিনই কোন ইনজুরি হলো- অথচ মাঠে ডাক্তার নেই। খেলোয়াড়রা হতাশ,অনিবার্যভাবে সেটা মানসিক চাপের সৃষ্টি করেছে। শুধু ডাক্তারের অনুপস্থিতিতেই শেষ না- অনুশীলনকালীন সময়ে ফেডারেশনের কোন যাতায়াত ব্যবস্থাও ছিল না। কারণ যাতায়াতের জন্য বরাদ্দ গাড়ি হয়তো কোন বড় কর্মকর্তার স্ত্রী বা বাচ্চার ডিউটি করছে আর আহত খেলোয়াড়কে চ্যাংদোলা করে উঠিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জাতীয় দলের খেলোয়াড় তখন হতাশায় ভোগে আর বলে ‘শালা ক্লাবে খেললে তো অন্তত পয়সাটা পাই আর যাই হোক- জাতীয় দলের ক্যাম্পে পয়সাও নাই, সুযোগ সুবিধাও নাই- পুরাই এতিম।’


আমাকে ফোন করলে আমি বলতাম “আমি কোন অফিসিয়াল নিয়োগ পাই নি”। কারণ আমাকে অফিসিয়াল নিয়োগ দেয়া মাত্রই আমি বলবো ক্যাম্প এ সকল কর্মচারীসহ খেলোয়াড়দের Deworming(কৃমি) করার ঔষধ দেন এবং Centrum Tablet দেন। অর্থাৎ খরচ বাড়বে। এগুলো কথা বাইরে যাতে না বলি সেজন্য ফেডারেশনের এক কর্মকর্তা আছেন যিনি আমাকে প্রায়ই বলতেন “সাংবাদিকদের কিছু বলবেন না”। আমি ডাক্তার তখন মনস্তাত্ত্বিক চাপে ভুগতাম- আর চিন্তা করতাম “আসলে কি তাহলে কর্মকর্তা কি সাংবাদিকদের স্বাভাবিক যেকোনো নিয়মের বাইরে যখনই কোন ছন্দপতন হয় তখনই মানসিক চাপ বাড়ে সেটা শারীরিক, মানসিক বা মনস্তাত্ত্বিক যাই হোক না কেন। মানসিক চাপ নিয়ে হয়তো বা রোমান্টিক হওয়া যায় কিন্তু ক্রীড়া বা অন্য কোন বিষয়ে জয়ী হওয়া যায় না। এতক্ষণ ফুটবল ফেডারেশন- এর যে বাস্তব চিত্রের উদাহরণ সহ আলোচনা করলাম- তা সাইকোলজির ভাষায় cronic stress এর মাধ্যমে তৈরি করে- আর সেখান থেকে সৃষ্টি হয় Less Affinity(অসখ্যতা)-Reluctantness (অনাগ্রহতা)- Less Efficiency (অদক্ষতা)-Disorder of Worker(অসুচারু কাজ)-Failure(পরজয়ী)।


এবার আসা যাক অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকর হঠাৎ মানসিক চাপ বা প্রসঙ্গে। হঠাৎ মানসিক চাপ তৈরি হওয়ার কারণ সমূহ যেমন-
· বিশাল দর্শক
· অত্যাধিক কাজ
· অত্যাধিক তাপমাত্রা
· অধিক ঠাণ্ডা
· পথে প্রচণ্ড ট্র্যাফিক জ্যাম
· খ্যাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন
· অনাহূত ঘটনা
· অনাহূত কোন ব্যাক্তিকে দেখা
· পুরাতন ব্যাথা হঠাৎ শুরু হলে
· হঠাৎ রক্তচাপ বাড়লে
Chronic বা Acute Stress হলে শরীরের ভিতরে যে সকল পরিবর্তন হয়-
· এককালীন গ্রন্থি থেকে এডরালিন নিঃসৃত হয়।
· রক্তচাপকে বাড়িয়ে দেয়
· হার্টরেট বাড়ে
· মাসল টেনশন বাড়ে
· পরিপাকতন্ত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়
· রিজার্ভ স্টোর থেকে শর্করা ও চর্বি জাতীয় খাদ্য উপাদান রক্তে চলে আসে
· রক্তে কোলেস্টোরেল মাত্রা বেড়ে যায়
· ‘Psycritry’- এর পরিভাষায় দেহের ভিতরে এই পরিবর্তনকে বলা হয় Fight or Flight, যা আসন্ন কোন শারীরিক পরিবর্তনের সংকেত দেয়।

· মনস্তাত্ত্বিক দীর্ঘদিনের চাপের ফলে পরিমিত আহার সত্ত্বেও শরীরের ভিতরে পুষ্টিহীনতা শুরু হয়। কারণ Adrenaline যখন রক্তে বেড়ে যায় তখন- Protin, Fat ও Carbohydrate ইত্যাদির Metabolism বেড়ে যায়। ফলে শরীর থেকে Amino Acid, Potassium ও Phosphorus নিঃসৃত হয় এবং পক্ষান্তরে পেশীতন্ত্র থেকে Magnasium বেরিয়ে চলে আসে।

ফলে ক্যালসিয়াম মাত্রা কমে যায়। এমন অবস্থায় শরীর আর খাদ্য থেকে খাদ্য উপাদান তথা পুষ্টি সংগ্রহ করতে পারে না। দীর্ঘদিন এই অবস্থা চলার ফলে শরীর ভিতরে ভিতরে ক্ষয় বা দুর্বল হতে থাকে এবং হঠাৎ এক পর্যায়ে এসে স্বাভাবিক Performanceথেকে অনেক দূরে সরে যায়।
আর বাংলাদেশে এই Long Term Stress খেলোয়াড়দের উপর তৈরি হওয়ার আরও একটি কারণ কোচ আর অফিসিয়ালদের দ্বন্দ্ব। যে ঘটনা ঘটল গর্ডন গ্রিনিজ, অটো ফিস্টারের বেলায়, সেই একই ঘটনা যাতে না ঘটে সে জন্য সামির শাকির ফুটবল দলকে সাফ চ্যাম্পিয়ন করে করে সোজা ইরাক চলে গিয়েছিলেন। বিওএ এবং বিএফএফ এর কোন কর্মকর্তার কোন আদেশ বা অনুরোধের ধার ধারেননি। কাঠমুণ্ডুর বৈশালী হোটেলের অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সেটা জানেন। সামির বলেছিলেন- জনসভা করে আমাকে ফুলের মালা দেওয়ার দরকার নেই আবার পরের দিন জুতার মালার দরকার নেই। পরে মন্ত্রী মহোদয়ের স্বয়ং ফোন করে অনুরোধক্রমে সামির সরকার ঢাকায় এসেছিলেন- এই শর্তে যে সে আর ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে কাজ করবেন না, কাজ করবেন বি. কে. এস. পি.র সাথে।
সুতরাং আমার দৃষ্টিতে খেলোয়াড়দের বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদী স্ট্রেস সংক্রান্ত প্রধান অবিসংবাদিত, কারণ কর্মকর্তাদের আন্তরিকতার অভাব। শুধুমাত্র এই অবস্থা যে ফুটবল ফেডারেশনেই কেবল বর্তমান তা না, সব ফেডারেশনে একই অবস্থা বিরাজমান।

লেখকঃ ডিরেক্টর, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ,  প্রাক্তন স্পোর্টস মেডিসিন কন্সাল্ট্যান্ট (বাংলাদেশ অলিম্পিক এ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন )