আইপিএলের বারোয় বারোয়ারি ক্রিকেট রচনা
পোস্টটি ৫৩৬৩ বার পঠিত হয়েছেঅ.
চট্টগ্রামের শহরতলির কোনো এক বিল্ডিংয়ের নীচতলায়, এক ফার্মেসীর সামনে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ক্রিকেট আলোচনায় মগ্ন কয়েকজন কিশোর। সকালের এই ক্রিকেট আড্ডায় নায়কের আসনে আসীন, কলকাতা নাইট রাইডার্সের শোয়েব আকতার। আলোচ্য বিষয়- শোয়েবের আগুনে বোলিং; যার দরুন জয় তুলে নিতে সক্ষম হয়েছে কলকাতার ঘোড়া সওয়ারীরা। দোকানের বিক্রিবাট্টা বন্ধ রেখে প্রবল আগ্রহে আলোচনায় যোগ দিয়েছেন কিশোরদের খুব পরিচিত ফার্মেসী দোকানদার, কানু আঙ্কেল। কিশোরদের আলোচনায় উঠে আসে পত্রিকা মারফত জানা শোয়েবের বুলি- কলকাতায় এলে আমার মনে হয় নিজের ঘরে ফিরেছি। এটা আমার দ্বিতীয় বাড়ি।
কেকেআর সমর্থক ‘কানু আঙ্কেল’ ভীষণ আপ্লুত হন তা শুনে।
হায়দরাবাদ ডেকান চার্জাসে একসাথে খেলেন তিন-তিনজন মারকুটে- অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস, এ্যাডাম গিলক্রিস্ট, শহীদ আফ্রিদী। ওদিকে আবার মুম্বাইয়ের হয়ে ওপেনে নামছেন সনাৎ আর শচীন। প্রায় এক বছর পর রাজস্থানের হয়ে ক্রিকেটে ফিরেছেন ‘দ্য ম্যাজেশিয়ান’ শেন ওয়ার্ন। অদ্ভুত ক্রিকেটানন্দ যেন আকাশে বাতাসে। কিশোরদের উত্তেজনা যেন ধরে না। রঙ বেরঙের আকাবাঁকা স্কোর কার্ড, গ্যালারীভর্তি দর্শক, নানান দেশের নানান ক্রিকেটারের অনন্য সম্মিলন... এ যেন ক্রিকেট চমৎকারিত্বের অনন্য আয়োজন। কে কবে দেখেছে এমন? কে কবে শুনেছে এমন? রোমাঞ্চ, উত্তেজনা, আনন্দ, উৎসাহ, উদ্দীপনা... নানান অনুভূতি মিলেমিশে বুঝি একাকার!
আ.
স্প্যানিশ লা লিগার স্বর্ণযুগ আসি আসি করছে। ইতালিয়ান সিরি আ আলোচনায় আছে বেশ ভালোভাবেই। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইতালি, ওদের দেশে বিশ্বের নামজাদা ফুটবলারের ভিড়ও খুব। জার্মান বুন্দেসলীগা খবরে আসে মাঝেমধ্যে। ফ্রান্সের লীগ ওয়ানের চেয়ে মনে হয় পর্তুগালের পোর্তো-বেনিফিকাও বেশী আলোচনায় আসে। আর ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের উত্তাল জোয়ার তো আছেই। চ্যাম্পিয়ন্স লীগেও ওদের দখলদারিত্ব, ওদের লীগটাও ভীষণ জমজমাট। লিভারপুলের রাফায়েল বেনিতেজ, চেলসির হোসে মরিনহো, আর্সেনালের আর্সেন ওয়েঙ্গার, ম্যানইউর স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন। খবরে থাকেন চারজনই। একে অপরকে কথার চাবুকে রক্তাক্ত করেন হরহামেশা।
কিশোরদের আলোচনার আসর সরগরম করে ফুটবলও।
আইপিএলের উদ্ভুত ক্রিকেট আয়োজনের নতুনত্বে চক্ষু ছানাবড়া হওয়া কিশোরদের মস্তিষ্কে নানান খেয়াল খেলা করে তখন। ক্রিকেটেও কী তবে ফুটবলের মতো এমন ক্লাব-উত্তেজনা চলে আসবে? ঘর ও পর (অন্য অর্থে হোম এন্ড এ্যাওয়ে) দারুণ রোমাঞ্চকর হয়ে উঠবে?
সরল কিশোর মগজে কিছুতেই ক্রিকেটের মোড়কে বণিকদের বাণিজ্যের ব্যাপার ধরা পড়ে না!
ই.
একবার আইপিএল উড়াল দিল দক্ষিন আফ্রিকায়। কোন দেশের ঘরোয়া আসর কখন, কীভাবে কোন পরিস্থিতিতে দেশান্তরী হয়েছিল সে ইতিহাস জেনে পন্ডিত হয় কিশোরের দল। ক্রিকেট বাদে অন্য কিছু ভাবার ফুরসত মেলেনি তখনো। বরং দলগুলোর সঙ্গে একেকটা শহর জুড়ে দিয়ে ঘর ও পর কেনো করল না, ভাবনার জগৎ ঘিরে থাকে তা-ই। কলকাতা নাইট রাইডার্স (ডারবান), মুম্বাই ইণ্ডিয়ান্স (জোহান্সবার্গ), (পোর্ট এলিজাবেথ) কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব করলেই তো জমতো ভালো? ওদিকে আবার পাঞ্জাব-কলকাতার টানাপোড়েনে, প্রীতি-জুহির নিলাম লড়াইয়ে, ছয় লাখ ডলারে মাশরাফি যোগ দিয়েছেন ওপার বাংলায়। আশরাফুলের ঠিকানা মুম্বাই। আগের আসরে আব্দুর রাজ্জাক তেমন কিছু করার সুযোগ পাননি বেঙ্গালুরুয়। এবার কী হবে?
ম্যাচের পর ম্যাচ যায়। কিশোরদের ক্রিকেট আড্ডায় ক্ষোভ, হতাশা, বিরক্তি জমা হয়। ম্যাককালাম, বুকানন, সৌরভ বাদ যান না কেউই। মোজেস হেনরিকস নামের এক অস্ট্রেলিয়ান তরুণও থাকেন ঘৃণার প্রথম সারিতে। নানান মাধ্যমে কিশোরের দল খবর পেয়েছে তাকে জায়গা দিতেই নাকি মাশরাফির সুযোগ হয় না দলে! ম্যাককালাম দলে থাকতে উইকেট কিপার মর্নে ভ্যান উইক নামের আফ্রিকানটাকে একাদশে রাখা যে বিশাল এক ষড়যন্ত্র, তা ঠিক বুঝে যায় তারা; সদ্য গজানো দাড়ি-গোঁফের মুখটায় জমা হয় নানান অনুভূতি। আসলে কেউই দেখতে পারে না বাংলাদেশীদের, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ান, ইন্ডিয়ান... সবাই শত্রু, সকলে শত্রু। সবাই দমিয়ে রাখতে চায় বাংলাদেশকে, মাশরাফিকে। কৈশোরের গন্ডী না পেরোনো ওরা যেন বুঝে ফেলে সব।
অবশেষে এক ম্যাচে সুযোগ পান মাশরাফি। সব কাজ রেখে, সব পড়া ফেলে, সেই ম্যাচ দেখা কিশোরেরা হতাশার সাথে আবার খুঁজে পায় আরো একটি চক্রান্ত; ইচ্ছে করে শেষে বোলিং দেয়া হয়েছিল তাঁকে- যেনো বোঝানো যায় এ্যাঁদ্দিন মাশরাফিকে বসিয়ে রাখাই ঠিক ছিল আসলে!
বুকাননের (উঁহু! তিনি বোকা নন!) বহু অধিনায়ক তত্ত্বের পরও কলকাতা নাইট রাইডার্স যে সেবার তলানীর দল হয়ে আসর শেষ করলো- তা শুধুই ক্রিকেটীয়? নাকি বাংলাদেশী দর্শককুলের দীর্ঘশ্বাসেরও ফল?
ঈ.
শেন ওয়াটসন পেটালেন নিষ্ঠুর-পাষাণের মতো। ম্যাচ শেষে আবার গালভর্তি হাসি নিয়ে বলেন- গরমে অতিষ্ঠ হয়েই নাকি অমন ক্ষ্যাপামি উঠেছিল তাঁর!
গরমের জ্বুলুনি মেটাতে এমন জুলুম? হাড্ডিসার বঙ্গদেশীয় বোলারদের উপর অমন দৈত্যকায় দেহে ঝাঁপিয়ে পড়া? ৯৬ বলে ১৮৫? ১৫ চার, ১৫ ছয়? বাংলাদেশে ছোট্ট ভ্রমণটায় একটু ঘুরবেন-ফিরবেন তা না, পিটিয়ে পিঠের (পড়ুন, বলের) ছাল তুলতে নেমে পড়লেন!
সেই ওয়াটসন বাংলাদেশে অমন লঙ্কাকান্ড ঘটিয়ে গেলেন ভারতে, রাজস্থানের হয়ে আইপিএল খেলতে। বাংলাদেশ থেকে গেলেন সাকিবও। কলকাতার হয়ে খেলবেন বলে। আইপিএলের চতুর্থ বাংলাদেশী।
কিশোরের দল তখন কৈশোরত্বের ইতি ঘটিয়ে তারুণ্যের চৌকাঠে, প্রশ্ন চোখে অপেক্ষায়- সাকিবের সঙ্গে কী মাশরাফির ব্যবহারটাই করবে কেকেআর?
কেকেআর ঢেলে সাজিয়েছে পুরোটা। সব উল্টে-পাল্টে গেছে। বাংলার ‘প্রিয় দাদা’ আর নেই বাংলায়, দিল্লীর গৌতম গম্ভীর বাংলার নতুন অধিপতি। সব ফ্র্যাঞ্জাইজির চেনা-মুখ আর নেই চিরচেনা, কম-বেশি বদলে গেছে সবগুলোই। যুবরাজ, দ্রাবিড়, শেওয়াগসহ ঠিকানা বদলের হিড়িকে যোগ দিয়েছেন অধিকাংশই।
গম্ভীরের নেতৃত্বে প্রথম সুযোগেই একাদশের অংশ হলেন সাকিব। প্রতিপক্ষ রাজস্থান। পড়লেন ওয়াটসনের সামনেও। টেনে ছয় হাঁকানোর পরই আড়াআড়ি ডেলিভারিতে বোল্ড করে গলা কেটে দেয়ার মতো ভঙ্গি করলেন সাকিব, কী মধুর সেই দৃশ্য! সেই উদযাপন!
সাকিবকে বসিয়ে রাখে কার সাধ্যি? সাকিব খেললেন, খেলতেই থাকলেন, হলেন চ্যাম্পিয়নও।
তারুণ্যের আড্ডা অনেকটা দখল করে রাখেন সাকিব। জন্ম যে তাঁর বিজয়ী হতে! আলোচনার আসর জমাতে!
উ.
সময়ের সাথে গতরে বেড়ে উঠা তরুণের মগজও বাড়ে। অনেক কিছু জানে, বোঝে, শোনে। মগজ বৃদ্ধির সুফলের সঙ্গে কুফল এই যে- জগতের অনেক ঘোলাটে ব্যাপার স্যাপার বোধগম্য হয়। অসুন্দর, অসঙ্গত, অশোভন ব্যাপার দৃষ্টিগোচর হলে কিংবা বোধের আলয়ে এলে, জাঁকালো আয়োজনটাও কেমন যেন পানসে ঠেকে।
এই পর্যায়ে তরুণের দল বুঝি আইপিএলকে তেমনভাবেই দেখে। আইপিএলের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে, ক্রিকেট ভাঙিয়ে কেমন বেহায়ার মতো পয়সার পসার জমায়, নির্লজ্জের দল; তাতে ওদের যেমনই লাগুক, বোধ-সম্পন মানুষজনের কেমন যেন লাগে! আগুনে ঘি ঢালার মতো তাতে ঘি ঢালে বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ।
অবশ্য পরের আসরেই মুস্তাফিজ নামের এক বিস্ময় বালক দখল করে নেন সমস্ত মনযোগের কেন্দ্রবিন্দু। ডেভিড ওয়ার্নারের মারণাস্ত্র, টম মুডির প্রিয় ছাত্র, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ভিভিএস লক্ষ্মণ যেখানটায় হারিয়ে বসেন স্তুতির ছত্র। মায়ের ছোট্ট মুস্তাফিজ, বাংলাদেশের প্রিয় কাটার মাস্টার, সেখানে সবার মন জয় করে, সকলের চোখের মণি হয়ে, বনে যান ‘দ্য ফিজ’। ফিজ-মোহে মোহগ্রস্থ হয়ে বৃদ্ধ-শিশু-কিশোর-তরুণ তো বটেই, পুরো বিশ্বই কেমন এক ঘোরে বুঁদ হয়ে যায়!
ক্রিকেট-মুগ্ধ তরুণের দলও ‘দ্য ফিজ’ নামের মোহে মোহান্ধ হলে, তাতে চোখ থাকিতে অন্ধ বলা চলে কী?
ঊ.
গঙ্গার ঢেউ থেমে থাকে না। বয়ে চলে। পদ্মার উপর বিশাল বিশাল পিলার বসে, তাতেও থেমে নেই ঢেউ। নদীর ঢেউয়ের মতো, জোয়ার-ভাটার মতো বয়ে চলে সময়ও।
প্রায় অর্ধযুগের সম্পর্ক চুকিয়ে, দল বদলে সাকিব কলকাতার ঘোড় সওয়ারী থেকে হায়দরাবাদের নতুন উদিত সূর্যে পরিণত হন। ‘দ্য ফিজ’ কে টেনে নেয় মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফেরে চেন্নাই। পুরনো সতীর্থদের সঙ্গে নিয়ে দলের পুরোধা হন মাহেন্দ্র সিং ধোনী। ভারতীয়দের প্রিয় মাহি, চেন্নাইবাসীর প্রিয় ‘থালা’। তামিল ভাষা থালা, যার অর্থ নেতা বা মাথা।
সেই থালা বা নেতার নেতৃত্বে তৃতীয় শিরোপা ঘরে তোলে চেন্নাই।
শুরুর সেই আটটি শহর ঘিরে ফ্র্যাঞ্জাইজি থাকলেও নাম বদলেছে কারো কারো। গুজরাট লায়ন্স, পুনে ওয়ারিয়র্স, রাইজিং পুনে সুপারস্টারস, কোচি টাস্কার্স কেরালার মতো দলগুলো এসেছে, আবার চলেও গেছে। যেমনটা এই লীগ থেকে অনেক ক্রিকেট-তারকা উঠেছে আর মিলিয়ে গেছে! হয়তো বাকী সময়টা কাটছে তাদের ক্ষণিকের প্রদর্শনটাই সম্বল করে।
খেলাটাই তো ক্ষণিকের। জীবনটাও কী নয়?
ঋ.
সেই কিশোর দলের ধুন্ধুমার কৈশোর বিদায় নেয়। তারুণ্যের সময়টাও বয়ে চলে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে। তবুও আড্ডা জমে, আসর বসে। কিশোর দলের আলোচনাও এখনো আওয়াজ তোলে খুব।
ক্রিকেটটা এখন সুন্দর। তর্কসাপেক্ষে বলা যায়, আগের চেয়েও সুন্দর। ক্রিকেটটা এখন অনিন্দ্য সুন্দর। সময়ের সাথে যেন এর সৌন্দর্য্য, রুপ-লাবণ্য উপচে পড়ছে। ক্রিকেট বুঝি অনন্ত যৌবনা, সময়ের সাথে ক্লান্ত হয় না, বরং রুপে-রসে গন্ধে-ছন্দে অপরুপ সৌষ্ঠবে সৌরভ ছড়ায়।
সব ক্রিকেটই সুন্দর। আইপিএল। বিপিএল। বিগ ব্যাশ। সিপিএল। পিএসএল। রাম স্ল্যাম। সুপার স্ম্যাশ। টি টুয়েন্টি ব্লাস্ট। এপিএল। সব সুন্দর। চমৎকার। বাহারী ক্রিকেটের বাহারী পরিবেশন।
অসুন্দর শুধু- লোভী আর অসাধু কিছু মানুষের ক্রিকেট ভাঙিয়ে পয়সা লূটার চেষ্টা!
- 0 মন্তব্য