• অন্যান্য

পাঁচ মিশালী স্বাদে প্যাভিলিয়নের পাঁচালি

পোস্টটি ৩৭০৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

এ যেনো গন্ডারের তিনদিন বাদে হাসি দেয়ার গল্প।                            

গল্পটা জানে সবাই। গন্ডারের চামড়া এত মোটা যে তাকে কাতুকাতু দেয়ার তিনদিন পর তার অনুভূত হয় তা। ফলে সে হাসে দিন-তিনেক বাদে। ভরা আসরে জোকস বললেন একটা, দারুণ মজার জোকস, একজন বাদে হো হো করে হেসে উঠল সবাই। মিনিট কয়েক বাদে ঐ বাদ পড়া একজন হাসতে শুরু করলেন। কারণ, জোকসটা সে বুঝতে পেরেছে ততক্ষণে। খানিকটা বেখাপ্পা ঠেকলেও মন্দ নয় কিন্তু ব্যাপারটা। তবুও তো হাসা হচ্ছে, মুখ গোমড়া তো আর থাকছে না। মুখে আষাড়ের মেঘ জমে থাকলেই দেখতে খারাপ দেখায়, মেঘ কেটে গিয়ে জোছনার খেলা কিন্তু দেখতে ভালোই লাগে। হাসি-ই আনন্দ, তিনদিন পর হোক কিংবা খানিক দেরীতে।

আমাদের আজকের গল্পও অনেকটা তেমনি বেখাপ্পা ঠেকতে পারে আপনার। এখানে তো আর মিনিট কয়েক বা দিন তিনেকের ব্যাপার নয়, পুরো পাক্কা প্রায় তিন মাসের বিলম্ব। বিলম্বে হলেও এই গল্পটা পাড়তে পারছি, এতেই আমার আনন্দ। বইয়েরই তো গল্প, না-হয় একটু দেরী হলোই বা, ক্ষতি কি!

 

হ্যাঁ, এ্যাঁদ্দিন বাদে এসব না পাড়লেই হতো। কিন্তু পাঁচমিশালী স্বাদের ‘প্যাভিলিয়নের পাঁচালি’ পাঠে পরিতৃপ্তির যে ঢেঁকুর তুলেছি, তা না বললে যে ঠিক জমছে না। অনেকটা যেনো সার্থক ভোজন শেষে পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বলা- আহ! কী খেলাম ভাই! সত্যি বলছি, এমন খাবারের কোনো তুলনা হয় না!

সময়ের অভাব, ব্যস্ততা বা আলস্য কিংবা অন্যকিছু, যে কারণেই হোক পরিতৃপ্তির প্রতিক্রিয়া এ্যাঁদ্দিন আটকে থাকলেও, অবশেষে যে আটকমুক্ত হচ্ছে তা-ই মহা আনন্দের। এও একরকম পরিতৃপ্তি। পাঠ পরিতৃপ্তির পূর্ণতা যেনো এতে। অনেকটা গলা পর্যন্ত গেলার পরে আবার ডেজার্ট খাওয়ার মতো হয়তো।

যাক, প্যাঁচাল অনেক হলো। অবশ্য বিষয়বস্তু যখন ঐ পাঁচালি-ই, তা এক-আধটু প্যাঁচাল মন্দ নয় কিন্তু!

 

শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গোগ্রাসে গিলেছি। দম ফেলার ফুরসত মিললেও মনে হয়েছে যেনো সময় নষ্ট। ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিস মিলিয়ে হরেক স্বাদের পাঁচমিশালী গল্পে টইটম্বুর পুরোটা। কোথাও কোথাও কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে আটকে থাকেনি তা, পুরো ক্রীড়াক্ষেত্রটাই যেনো উঠে এসেছে, আবার কোথাও স্পোর্টস ছাড়িয়ে আরো বিশাল কোনো প্রেক্ষাপটে অঙ্কিত হয়েছে চিত্র। শব্দের গাঁথুনি, গল্পের বুনন, বলার ভঙ্গি, পরিবেশনার ঢঙ... সব মিলিয়ে জমজমাট অবস্থা।

প্রায় সব লেখকই আমার চেনা, অধিকাংশ লেখাই আমার পড়া। তবু আবার পড়েছি, এবং বারবার পড়েছি। প্রিয় ম্যাচটা যেমন বারবার হাইলাইটস দেখতে ইচ্ছে করে, প্রিয় ইনিংসটা, প্রিয় খেলোয়াড়ের অবিশ্বাস্য কীর্তিটা যেমন যতবার দেখি, শিহরিত হই ততবার, ঠিক তেমনি প্রতিটা লেখা বারবার পড়তে একটুও বিরক্তি আসে না। উলটো মনে হয়- লেখক আরেকটু দীর্ঘ করলেই পারতেন।

 

শুরুটা করেছেন সুহান রিজওয়ান। শেষটাও তিনি। এই লেখক একজন ক্ল্যাসিক রাইটার। তিনি কোনো স্পোর্টস আর্টিক্যাল লিখেন না, স্রেফ সাহিত্য রচনা করেন। তাঁর লেখার মুন্সিয়ানা আমাকে হতবাক করে প্রতিবার। গত ফুটবল বিশ্বকাপ শেষের পর ‘পর্দা নামার পরে...’ লিখেছিলেন প্যাভিলিয়নে, বিশ্বাস করুন ভয়াবহ ঈর্ষান্বিত হয়েছিলাম। এখানেও তাঁর দুটি লেখা-ই পড়ে ঈর্ষান্বিত হয়েছি। পাঠককে এমন চমৎকারিত্বের স্বাদ দেয়ার উৎসমূল কোথায় আসলে?

আচ্ছা, ‘ঈর্ষান্বিত’ শব্দটা কী বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে? তাহলে পাঠক ক্ষমা চাই। অধমকে ক্ষমা করুন। ‘যে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে’ আর ‘লাল সবুজের পাগলা’ দুটো পড়ার পর ঈর্ষার চেয়ে কঠিন কিছু খুঁজতে যাবেন না তো আবার?

‘লাল সবুজের পাগলা’ পুরোটাই ফ্যান্টাসি। যেখানটায় শেষ করেছেন, যেনো রবিঠাকুরের ছোটো গল্প- শেষ হইয়াও হইলো না শেষ। প্রতি মুহূর্তে শব্দগুচ্ছের চিত্রপটে আপনাকে লাইভ ম্যাচ দেখিয়ে, একটা দাঁড়ি টেনে শেষ করে দেবেন, এদিকে অসম্ভব মুগ্ধতা আর ঘোর লাগা মন নিয়ে আপনি লেখককে এমনিই ছেড়ে দেবেন- তা কী হয় কখনো? জয় গোস্বামীর কবিতার সঙ্গে লেখনীর অসাধারণ শক্তিতে আপনাকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের একটুকরো পথচলা শোনাবেন, শব্দের ঠাসা বুননে বর্ণনার অভিনবত্বে, উত্তেজনায় কাঁপা আপনি আচমকা আবিষ্কার করবেন লেখাটা শেষ- ঠিক ঐ মুহূর্তে কী মনে হবে আপনার?

‘ভদ্রলোক বড্ড ভালো লেখেন’ বলেই ছেড়ে দেবেন তাঁকে? আপনার কী গলা ছেড়ে বলতে ইচ্ছে হবে না- লেখক হয়েছেন ভালো কথা, তা এতটা ভালো লাগা ছড়ানোর অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে? এতো ভালো লেখেন কেনো আপনি?  

ফিরে যাই ঈর্ষা প্রসঙ্গে। হ্যাঁ, আমি ঈর্ষান্বিত হয়েছি। সেটা লেখকের লেখনীর গুণে নয়, পাঠকের মনে অদ্ভুত দখলদারিত্ব আর মুগ্ধতার আবীর ছড়ানোর গুণে। এবং এটাও সত্যি, এই ঈর্ষা, এই বইয়ের অনেক লেখকের প্রসঙ্গেই এসেছে।

সাইফুল্লাহ বিন আনোয়ার তেমনই একজন।

উনার সঙ্গে পরিচয় প্রায় বছর পাঁচ-ছয়। শুরু থেকেই তাঁর মুগ্ধ পাঠক আমি। উনার অনেক অনেক লেখাই আমি বিরতিহীন বলে যেতে পারি, বারবার পড়া লেখাও আছে কতো! শুধু উনার লেখা দিয়েই পাঁচ-সাতটা বই করা যায়। সেখানে কি-না মাত্র তিনটে লেখা নেয়া হয়েছে এখানে!

অস্ট্রেলিয়া বধের রাত্রিতে ‘ও আমার সাকিব পঙ্খীরে’ পড়েছিলাম, প্রতিটা লাইন কী অসম্ভব শিহরণ জাগাচ্ছিল! সেই লাইনগুলো মলাটবদ্ধ বইয়ে পড়তে গিয়ে অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করলাম, সেই একই শিহরণ ফিরে এসেছে আবার! লেখকের লেখনীর কী অসাধারণ শক্তি!

পাড়ার ক্রিকেটে প্রায় আম্পায়ার হিসেবে দাঁড়াতাম। সত্যি কথা (!) বলি বলে একটা সুনাম ছিল, তাই দুইপক্ষই বোলিং এন্ডের স্ট্যাম্পের পেছনটায় আমাকে দাঁড় করিয়ে স্বস্তি পেত। এমনকি লেগ বিফোরের মতো গোলমেলে সিদ্ধান্তও অকপটে মেনে নিত তাঁরা। বড় ভাই, ছোটো ভাই, বন্ধু... তিন শ্রেণি থেকেই সমান সমাদর পেতাম এই জায়গায়। এক বন্ধুর স্টেডিয়াম পাড়ায় কোন এক রেফারী পরিচিত আছে শুনে তাকে বলেছিলাম- আম্পায়ার হতে গেলে কী করতে হবে একটু খোঁজ লাগাও তো ভাই।

দুঃখের ব্যাপার, সে কোনো খোঁজ এনে দিতে পারেনি। আমারও তাই আর ওপথ মাড়ানোর সুযোগ হয়নি। সাইফুল্লাহ ভাইয়ের ‘কাকতাড়ুয়া, সাদা হ্যাট আর কয়েকটি স্বপ্নের গল্প’ যেনো সেই স্মৃতিই ফিরিয়ে এনেছে। সেই নির্মম সত্যিটাই তুলে ধরেছে। আমাদের দেশে আসলেই আম্পায়ারিং নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কাজ হয় না।

দুঃখজনক!

‘শিব-শ্রমিকের গান’ নিয়ে আগেই অনেক কথা হয়েছে। সাইফুল্লাহ ভাইয়ের কথা উঠলে যে ক’টা লেখা অনায়াসে সামনে চলে আসে তার মধ্যে এটি একটি। এই নিয়ে অধমের শব্দ ব্যয় বিপজ্জনক হতে পারে, আমি হয়তো দু’লাইন লিখলাম, কিন্তু আপনার মনে হতে পারে- হতচ্ছাড়া জানেই না কোন লেখা কেমন সমাদর পাওয়ার যোগ্য! তবে এটুক বলতে পারি- চন্দরপলের সংযম, দৃঢ়চেতা আর হার না মানা মনোভাব যেমন আপনাকে তাজ্জব করে দেয়, ঠিক তেমনি এই লেখার প্রতিটি লাইন আপনাকে আশ্চর্য্য করবে। চন্দরপলকে এর চেয়ে ভালো গুছিয়ে এবং সাজিয়ে বর্ণনা করা বোধহয় সম্ভব না।

 

ফাহিম মাশরুর, রিমন ইসলাম, মেহেদী হাসান রোমেল কারো সাথেই ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। তবে প্রত্যেকের মুগ্ধ পাঠক আমি। কলকাতার এক রাজ্য ক্রিকেটারের গল্প শুনিয়েছেন একজন, আরেকজন গল্প করেছেন গ্লেন ম্যাকগ্রার, আর অন্যজনের গল্প ‘পেলাডা’ নিয়ে। ‘পেলাডা’ চমৎকৃত করবে খুব। বেশ ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। যেমনটা চমক জাগাবেন পাপ্পু, কলকাতার ফুটপাথ থেকে উঠে আসা এক ক্রিকেটার। আর ম্যাকগ্রা মানুষটাই তো অনন্য, তাঁকে নিয়ে লেখাটাও তা-ই।

ফারেগ ইউসুফের ‘লেডি ইন রাস্টি আর্মার’ আপনাকে নিয়ে যাবে প্রথাগত ধারার বাইরে। সেরেনার গল্পটা এভাবে আগে কেউ শুনিয়েছেন বলে তো মনে হয় না। “সেরেনা রাজপ্রাসাদে বসে ছড়ি ঘোরান না, নাইটদের মতো ডুয়েলে নামেন।” এই একটি লাইনেই যেনো অনেক কথা বলা হয়ে গেছে। অকুতোভয়, দুঃসাহসিক এক নারীর গল্প আপনাকে কেবল চমৎকৃত করবে না, ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জ্বালানি হিসেবেও কাজ করতে পারে।

দ্য ব্লন্ড অ্যারো। লিখেছেন- ইমতিয়াজ আজাদ। আলোচ্য- আলফ্রেডো ডি স্টেফানো। ইমতিয়াজ আজাদের আগ্রহ সম্ভবত স্পোর্টস ইতিহাস, তাঁর যতগুলো লেখা পড়েছি, মোটাদাগে বললে সবই ইতিহাস খুঁড়ে আনা। ক্রিকেট ইতিহাস বললে আরো একটু নির্দিষ্ট হয়। তবে এটা ছিল ডি স্টেফানো ঘিরে। বার্সেলোনা সমর্থক হিসেবে আফসোসই বেরিয়ে এসেছে একটা- ইশ! অল্পের জন্য বার্সা মিস করে গেল তাঁকে! টানা পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জেতা রিয়াল মাদ্রিদ স্টেফানো ছাড়া ঐ অসুরে-কীর্তি কি করে করতো? ভাবুন তো, এই সময় যদি তিনি বার্সার হয়ে খেলতেন... আহা! কী মিস, কী মিস!

ইতিহাস কপচানো খানিকটা কঠিন। কারণ, পাঠকের বিরক্তি উদ্রেকের সমূহ সম্ভাবনা। কিন্তু ইমতিয়াজ আজাদ ভাইয়ের মুন্সিয়ানা এখানেই যে, তিনি ইতিহাস এমনভাবে তুলে ধরেন- যেনো তিনি কোনো গল্প বলছেন, এবং ঐতিহাসিক প্রত্যেকটা চরিত্রই তাঁর হাতে গড়া। এই লেখাটা শেষ হয়েছে স্টেফানোর “ইট ইজ জাস্ট আ ফিলিং” উক্তি দিয়ে। কোন প্রসঙ্গে তা এসেছে, যারা পড়েছেন তাঁরা তো জানেনই, আর যারা পড়েননি এখনো তাঁরাও না-হয় পড়েই জানবেন!   

‘দ্য ব্লন্ড অ্যারো’ পাঠ শেষে আপনার প্রতিক্রিয়াও হবে অনেকটা এমন- ইট ইজ জাস্ট আ ফিলিং!

 

মাহেলা জয়াবর্ধনের ব্যাটিং দেখার মতো দৃষ্টিসুখকর ব্যাপার খুব কমই আছে ক্রিকেটে। শেখ মিনহাজ হোসেন আপনাকে জানাবে, জয়াবর্ধনেকে নিয়ে লেখাও কতটা পাঠ আনন্দ দিতে পারে! প্রতিটি শব্দে যেনো মাহেলার মতো আলতো পরশ বুলিয়ে লেখক শব্দগুচ্ছকে সাজাচ্ছেন সম্ভব সর্বোচ্চ দৃষ্টিনন্দন (পড়ুন, পাঠ-নন্দন) উপায়ে। মাহেলা যেমন প্রতিটি শটে বলকে বলতেন ‘আবার এসো কেমন?’ ঠিক তেমনি লেখকও যেনো শব্দগুচ্ছকে বলছেন- কলমের ডগায় আবার এসো সোনা!

‘২২ গজে তুলির আঁচড়’ পড়ে দুটো ব্যাপার সম্পর্কে নিশ্চিত হবেন আপনি। ২২ গজে আসলেই ব্যাটের বদলে তুলি হাতে নামা যায়। এবং তা প্রকাশে কলমের (কী-বোর্ড যদি বলেন, তবে তা-ই) পরিবর্তে তুলির ব্যবহারও কেউ কেউ করেন কিন্তু!

মিনহাজ ভাইকে জানি বলেই বলতে পারি, ক্রিকেট খেলাটাকে তাঁর মতো করে ভালোবাসতে পারেন খুব কম মানুষই। এবং সেই ভালোবাসা প্রকাশ শেষে, তাঁর মতো করে পাঠকের মুগ্ধতা অর্জন করতে পারেন আরো কম মানুষ। মিনহাজ ভাই সেই অল্প মানুষদের একজন।

 

রিজওয়ান আবীর আরেকজন মাস্টার রাইটার। তাঁর ‘সাদা ক্রিকেট কালো ক্রিকেট’ কতবার যে পড়েছি! এই তো ক’দিন আগে প্যাভিলিয়নের ফিচার বিভাগে লিখেছিলেন- ‘লিভারপুলের অন্দরমহলে’। গোগ্রাসে গিলেছি শুধু। আহ, লেখা কাকে বলে!

এখানেও বরাবরের মতো মুগ্ধ হয়েছি উনার লেখায়। ‘ঈশ্বরের হাত এবং ৪ সেকেন্ডের জাদু’ একটু যে আপ্লুত করেনি তা বলবো না, ম্যারাডোনা আর আর্জেন্টিনা যখন আছে, আপ্লুত না হয়ে উপায় কি! আমার অতি পছন্দের ক্রীড়া লেখকদের একজন তিনি, তাঁর কাছ থেকে আস্ত একটা বই-ই আশা করি।

লেস্টারের না-বলা গল্প বলেছেন শামীম হোসেইন। সেই গল্প কখনো রুপকথার মতো মনে হলেও আসলে যে সত্যি তা আপনি তো জানেনই। কিন্তু লেখকের কারসাজি এখানেই যে, এই গল্পটা আপনাকে এমনভাবে বলা হচ্ছে- আপনি প্রতি মুহূর্তে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করবেন!

ফুয়াদ বিন নাসের আপনাকে অদ্ভুত, অনন্য এক গল্প শোনাবেন। কেমন এক বিষাদ আর মন খারাপের গল্প, যেখানে আবার টুকরো টুকরো আনন্দের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। আপনি মুগ্ধ হবেন, অবাক হবেন, আশ্চর্য্য হবেন, সবশেষে কেমন এক হাহাকারও অনুভূত হবে আপনার। আপনি ঠিক করতে পারবেন না- ক্যাপ্টেন ভিলাপ্পাঁ আসলে কী? ভিলেন নাকি হিরো?

 

দুঃখী রাজকুমারের গল্প বলতে গিয়ে মাইকেল বালাকের জন্য কেমন এক দরদ বোধ জাগ্রত করেন, নাজমুস সাকিব। অথচ আর্জেন্টিনা ফুটবলের ভক্ত হিসেবে এই বালাক সবসময়ের জন্য আমার কাছে একজন ভিলেন, একজন শেষ মুহূর্তের স্বপ্ন হন্তারক। ২০০৬ বিশ্বকাপে, তাঁর সেই অদম্য লড়াই, তাঁর সেই পাস, পেকারম্যানের গোছানো আর্জেন্টিনার বিদায়... কখনোই ভোলার নয়। অথচ এখানে বালাকের জন্য কেমন এক মায়া লাগে! আসলেই তো বেচারা, একটা ট্রফি জিততে পারলো না! লেখকের শক্তির জায়গাটা বুঝতে পারছেন তো?

আফগান ক্রিকেটের উত্থানের গল্পটা শুনিয়েছেন মহিবুল্লাহ ত্বকি। একদম গোড়া থেকে শুরু করেছেন তিনি, বলেছেন আফগানদের সংগ্রাম আর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প।

রিফাত মাসুদও আইসল্যান্ডের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর গল্পটা শুনিয়েছেন চমৎকার দক্ষতায়। কীভাবে একদম ধীরে ধীরে ভিত্তি আর কাঠামো গড়েছে আইসল্যান্ডের ফুটবল, আর তার স্বরুপ কেমন নিদারুণ চমৎকারিত্বে তুলে এনেছেন তিনি। আর বলেছেন ‘শুদ্ধ’ কাতালুনিয়ার গল্প। যুগ যুগ ধরে স্বাধিনতাকামী, মুক্তিকামী মানুষগুলোর স্বপ্ন-আকাঙ্খা শাসকগোষ্ঠী জোর জবরদস্তি করে চেপে রাখলেও, বার্সেলোনার মাধ্যমে কীভাবে তা প্রতিনিয়ত প্রাণ পাচ্ছে, স্বপ্নের চারাগাছে সঞ্চার করছে স্পন্দন, সাবলীল আর স্বচ্ছন্দ আঙিকে বলেছেন তিনি। আপনার ভালো লাগবে, খারাপও লাগবে। আবার ভাবাবেও খুব।

হারিয়ে যাওয়া ‘বাসবি বেবস’ ফিরিয়ে আনেন মাহফুজ সালেকীন বর্ষণ। ওদের গড়ে উঠার আগে, গড়ে উঠার সময়, আর হারিয়ে যাওয়া, এবং তারপর শোককে শক্তি করে আবার ঘুরে দাঁড়ানো... একসাথে অনেক অনেক গল্প আপনার সামনে উঠে আসবে। আপনি ম্যাট বাসবির প্রখর ফুটবল মস্তিষ্ক সম্পর্কে জানবেন, চিনবেন জ্যাক মারফি নামের আরেকজন দুর্দান্ত ফুটবল চিন্তককে। আর জানবেন, দুর্দান্ত একটি ফুটবল প্রজন্মের চিরতরে হারিয়ে যাওয়া। অবশ্য বাসবির পরের প্রজন্মের ছানাপোনারা হয়তো কিছুটা হলেও প্রলেপ দেবে আপনার বিষাদময় চিত্তে।

শ্যাপকোইন্স ট্র্যাজেডিও আবার ফিরিয়ে আনে, বাসবি বেবসদের। সেই দুঃখময় গল্পই আপনাকে জানাবেন অম্লান মোসতাকিম হোসেন। অম্লান ভাই যেনো শব্দ নিয়ে খেলেন, তাঁর লেখায় ব্যবহৃত শব্দগুলোও কেমন যেনো আভিজাত্য লালন করে। ‘ক্রুইফের কাছে খোলা চিঠি’ লেখাটি পড়ে পাঠক মাত্রই অভিভূত হবেন নিশ্চিত। আর ক্রুইফ-ভক্ত যে কারো জন্য তা তো অমৃত। পাঠ অমৃত। চিঠির ফাঁকে ফাঁকে ক্রুইফের বর্ণাঢ্য জীবনের গল্পও বলা হয়ে যায়। পরিবেশনার এই বিশেষ আঙিকও লেখনীতে মোহিত হওয়ার অন্যতম কারণ।

আর আছেন প্রিয়ম মজুমদার। কীভাবে হয় কিংবদন্তি? প্যাভিলিয়নের ফিচার বিভাগের যে ক’টা লেখা আমার মনে স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে তার মধ্যে এটা একটা। সাধারণ একটা সত্যি- কিংবদন্তি হতে ট্রফির দরকার পড়ে না, তা কী সহজ ঢঙে আর বলেছেন! লেখকের অসাধারণত্ব এখানেই। পাঠকের মুগ্ধতার কারণও হয়তো এটিই।

 

এমনিতেই কলেবর অনেক দীর্ঘ হয়ে গেছে। আর দীর্ঘ করতে চাইছি না। শেষের আগে একটু নিজের কথা বলি। প্রথম যখন শুনি, ২২টি লেখাকে মলাটবদ্ধ করার প্রয়াস নিয়েছে প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ। তখনই কিছু লেখার ব্যাপারে পূর্বানুমান ছিল। বলাই বাহুল্য, সেই পূর্বানুমান সবটা না হলেও খানিকটা সত্যি হয়েছে।

হুঁ! নিজেকে কেমন ফেলুমিত্তির ভাবতে বসে গেছি, না?

ফেলু দা যখন এলেনই, শেষটাও তবে সেই সূত্র ধরেই করি। ফেলুমিত্তিরের স্রষ্টা বিভুতিভূষনের ‘পথের পাঁচালি’ তে প্রাণ দিয়ে স্বতন্ত্র সত্যাজিতের ‘পথের পাঁচালি’ সৃষ্টি করেছিলেন। ‘পাঁচালি’ বললেই এতদিন আমাদের মানসপটে ভেসে উঠত এসবই। তবে এখন থেকে হয়তো আরো একটি সৃষ্টি ঝট করে উঁকি দিয়ে যাবে মন-বারান্দায়। মলাটবদ্ধ সেই সৃষ্টির নাম নিশ্চয় বলে দিতে হবে না আর?

তবে আমাদের আশা ও আকাঙ্খা, বাংলা ক্রীড়া সাহিত্যে এই যাত্রা থেমে যাবে না কখনোই...।