• ক্রিকেট

জার্মানে ক্রিকেট নিষিদ্ধ করেনি হিটলার, বরং খেলেছেন!

পোস্টটি ৭৬৭৫ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

বিশ্বের একজন কুখ্যাত মানুষ অ্যাডলফ হিটলার। জার্মানির বাহিরে পুরো বিশ্বে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে হয়েছিলেন খলনায়ক। রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন এবং একক আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে সৃষ্টি করে বিশ্ব দ্বিতীয় ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধের। ইহুদি নিধন ও ইউরোপের রাজত্ব গ্রহণ করার নেশায় আসক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। হিটলার নিজে কোনো খেলাধুলার সাথে জড়িত ছিলো কিনা তার কোনো সঠিক সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

images (4)

জার্মান নাৎসিবাদের জনক অ্যাডলফ হিটলার  

জার্মানিতে ক্রিকেট নিষিদ্ধ করেছে এমন কথা প্রায় সবার মুখেই শুনা যায়। শুধু বাংলাদেশ নয়,  বিশ্বজুড়েও ধারনা ক্রিকেট খেলা থেকে বিরত রাখার একমাত্র বাধাগ্রস্ত করেছিলেন হিটলার। এই গল্পটা বহুলভাবে প্রচলিত সবার মুখেমুখে। ক্রিকেট এবং হিটলার নিয়ে জনপ্রিয় গল্পটা ঠিক এরকম। একবার হিটলার একটা মাঠের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলেন একদল লোক ক্রিকেট খেলছিলো। বিকেলে একই রাস্তা দিয়ে ফেরার সময় দেখলেন তারা তখনো খেলছে। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন, এই খেলা কখনো কখনো ১০/১২ দিনও চলে (তখন টেষ্ট ক্রিকেটের নির্দিষ্ট সময় দেয়া ছিলো না)। খেলা শেষে জানতে পারেন ম্যাচটি ড্র হয়েছে তথা কেউই জিতেনি। এতদিন একটি ম্যাচ খেলেও ম্যাচের ফলাফল হয়েছে কেউই জিতেনি, তাই বিরক্ত হয়ে হিটলার ঘোষনা দিলেন, “জার্মানিতে ক্রিকেট খেলা নিষিদ্ধ।”

সেই কুখ্যাত হিটলারের অধঃপতন হয়েছে ৮০ বছরের বেশি হয়েছে। একই সাথে তার নাৎসি জাতিয়তাবাদও বিদায় নিয়েছে বহু আগেই। অন্যদিকে ক্রিকেটেও এসেছে আমুল পরিবর্তন। টেষ্ট থেকে ওয়ানডে হয়ে এখন টি-টুয়েন্টির যুগে প্রবেশ করেছে ক্রিকেট। এটি এখন বিশ্বের সবচাইতে জনপ্রিয় স্পোর্টসগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। এ যুগে হিটলার থাকলে ক্রিকেটের এই আধুনিকায়ন, জনপ্রিয়তা ও বানিজ্য দেখে নিশ্চয়ই তার দেশে আবার চালু করে দিতেন। জার্মান দল বিশ্বকাপ না জিতলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধও লাগিয়ে দিতেন কি না কে জানে। 

জার্মান দেশে প্রথম ইংল্যান্ডের  সাথে ম্যাচ  

হিটলারের দেশে ক্রিকেট খেলার জন্য গিয়েছিল স্বয়ং যে দেশে ক্রিকেট আবিষ্কার হয়েছে। হ্যাঁ, জার্মানেই তিন ম্যাচের সিরিজ খেলার জন্য ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী ক্লাব জেন্টলমেন অব ওরচেস্টারশায়ার ক্রিকেট ক্লাব গিয়েছিল ঠিক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দুই বছর আগে। হিটলার এবং জার্মানির ক্রিকেট নিষিদ্ধ ঘোষণার গল্প নিয়ে বিস্তর গবেষণার পরে কিছু তথ্য খুঁজে পাই ইন্টারনেট দুনিয়ায়। ভয়াবহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দাবানলে শুধুমাত্র জার্মান-ই নয় জ্বলেছিলো পুরো বিশ্ব। সেসব বিষয় এবং জার্মানির ক্রিকেট নিয়ে গতকয়েক বছর আগে প্রকাশ হয়েছে দুইটি বই। কিন্তু এই বিষয়ে বিস্তর গবেষণার পর ভিন্ন এক তথ্য উঠে এসেছে। জার্মানির ক্রিকেট নিয়ে বেশ কয়েক বছর আগে দুইটি বই প্রকাশ হয়। এর একটি ছিল ড্যান ওয়াডেলের ‘ফিল্ড অব শ্যাডোস’ এবং দ্বিতীয়টি বিবিসির ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্সের ব্রডকাস্টার জন সিম্পসনের ‘আনরিলাইয়েবল সোর্স’। বই দুইটিতে জার্মানিতে নাৎসি যুগে ক্রিকেটের বেশ কিছু ঘটনা উঠে এসেছে। 

tyr

ইংল্যান্ডের ক্রিকেট ক্লাব ওরচেস্টারশায়ার   

১৯৩৭ সালে উইলম্বডনে ডেনিস কাপের সেমিফাইনালে যুক্তরাষ্ট্র বনাম জার্মানির ম্যাচ দেখার সুবাদে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান নাৎসি সরকারের রাইকস্পোর্টস ফুয়েরার(ক্রীড়া মন্ত্রী) হ্যান্স ভন চ্যামার। একই সাথে তাকে ঐতিহাসিক লর্ডসে শ্রীস্মকালীন স্পোর্টস ইভেন্ট দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমন্ত্রনে সাড়া দিয়ে সেখানে যায় ক্রীড়া মন্ত্রী, তখন সেখানে মিডলসেক্স বনাম ওরচেস্টারশায়ারের মধ্যকার ক্রিকেট ম্যাচ দেখেন। ম্যাচ চলাকালীন সময়ে ভন চ্যামার ওরচেস্টারশায়ারের সাবেক খেলোয়াড় ও ক্লাব নেতৃত্বের অন্যতম সদস্য ম্যাজ মাওরিস জুয়েলের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তখন তিনি জুয়েলকে তার দল নিয়ে বার্লিন সফরে যাওয়ার অনুরোধ করেন। জেন্টলমেন অব ওরচেস্টারশায়ার সেই সময়ের অন্যতম পুরনো ক্লাব। ১৮৪৮ সালে তারা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে যাত্রা শুরু করে। নাৎসি মন্ত্রীর অনুরোধে জার্মান যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ওরচেস্টারশায়ার ক্লাব কর্তৃপক্ষ। ম্যাজ মাওরিস জুয়েলের নেতৃত্বে ১৯৩৭ সালের আগস্ট মাসে জার্মানির বার্লিন শহর সফরে যায়। বার্লিনে পৌছার সাথে সাথেই বিশেষ অভ্যর্থনায় স্বাগতম জানানো হয় এবং নাৎসি বাহিনীর প্রতীক স্বস্তিকার গাড়ি বহর করে হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। জেন্টলম্যান অব ওরচেস্টারশায়ার ক্লাব জার্মানে আসার খবরটি বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিলো সংবাদমাধ্যম। প্রতিদিন তাদের নিয়ে বিশেষ বুলেটিন প্রকাশ করা হতো। 

_74435627_german-paper

জার্মানের একটি পত্রিকায় ওরচেস্টারশায়ার ক্লাবের খবর   

তিন ম্যাচের সিরিজ খেলার উদ্দ্যেশ্যে জার্মানিতে এসেছিলো। তিন ম্যাচই জার্মানদের সহজেই হারায় মাওরিস জুয়েলের নেতৃত্বে ওরচেস্টারশায়ার। সিরিজের প্রত্যেক ম্যাচ হারার পরেও জার্মান দল তাদের সেরা খেলোয়াড় আলবার্ট শিমিটকে খেলায়নি। কারণ ছিলো একটাই, সে ইহুদি। হিটলারের নাৎসি বাহিনী তখন ইহুদিদের ব্যাপারে ছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীত। সেসময় বার্লিনের শহরে ছিলো রাজনৈতিক ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার অস্থিতিশীল পরিস্থিতি।

_74439932_berlin-august-1937

আগস্ট, ১৯৩০ সাল:  বার্লিন শহরের ৭০০তম বর্ষপূর্তি উদযাপন    

খেলা শেষ ওরচেস্টারশায়ার ক্লাব বার্লিন শহরে দেখে বিশাল আকারে উৎসব চলছে। মূলত বার্লিন শহরের ৭০০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে উদযাপন করে আর নাৎসি সরকার তাদের শক্তিমত্তা দেখানোর উদ্যোগে অনেক অস্ত্রসস্ত্রসহ নিয়ে সৈন্যদের একাধিক প্যারেড করায়। এটা পুরোটাই ছিলো ইংল্যান্ডের ক্লাব সদস্যদের দেখানো। অন্যদিকে ক্লাবের খেলোয়াড়দের জন্য এটা ছিলো উদ্ভট আর ভয়ভীতি প্রদর্শন তাই খেলা শেষে দ্রুত ব্রিটেনে ফেরার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে চলে যায়।

হিটলার ক্রিকেট খেলে এবং গবেষণা করেন      

যার ভিতরে প্রেম-ভালোবাসার মায়া কাজ করে, ক্যানভাসে ছবি আকার মনোভাব তৈরি হয়, বই লিখে পুরো জার্মানিকে এক কাতারে উগ্রবাদী করতে পারেন আর তিনিই বুঝি ক্রিকেট খেলেনি? তৎকালীন ডানপন্থী ব্রিটিশ এমপি অলিভার লকার ল্যাম্পসন ছিলেন হিটলারের ঘনিষ্ঠ এবং একনিষ্ঠ সমর্থক। তিনি ‘অ্যাডলফ হিটলার অ্যাজ আই নো হিম’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন, যা ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি হিটলারের ক্রিকেট প্রেম সম্পর্কে তুলে ধরেন। অলিভার লকার ল্যাম্পসনের সেই প্রবন্ধের আলোকে জন সিম্পসন তার ‘আনরিলাইয়েবল সোর্স’ বইতে হিটলারের ক্রিকেটীয় বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন।

হিটলার সবসময়ই ছিলেন তার এবং তার দেশের জন্য কিভাবে লাভ হবে সে বিষয়ে। যদিও শেষপর্যন্ত তার কর্মের ফলাফলের কসরত দিতে অনেক হিমসিম খেতে হয়েছে জার্মানিকে। তিনি ক্রিকেট খেলাকে তার সেনাদের প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। এজন্য ক্রিকেট নিয়ে গবেষণাও চালিয়েছেন কিভাবে এই খেলাকে নিজের কাজে লাগানো যায়। হিটলার তখন জার্মান সেনাবাহিনীতে ল্যান্স করপোরাল হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। একবার এক হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তখন পাশেই দেখতে পান কয়েকজন ক্রিকেট খেলছেন। তখন সেই হাসপাতালে কিছু ব্রিটিশ কর্মরত ছিলেন। হিটলার সচরাচর এই খেলা তার দেশে খেলতে দেখা যায়না তাই তিনি খেলার নিয়ম-কানুন জানেন না। হিটলার তাদের কাছে খেলার নিয়ম সম্পর্কে জানতে চান। তারা হিটলারকে নিয়ম বুঝিয়ে দেন এবং ক্রিকেট খেলার নিয়ম লিখে দিয়ে যায়। কয়েকদিন পরে হিটলার তাদের সাথে খেলার জন্য আমন্ত্রণ জানান। সে ম্যাচে কিছু সূত্রমতে জানা যায় হিটলার শুন্য রানে আউট হন। জার্মানির জন্য ক্রিকেট আক্রমনাত্মক নয় তাই এই খেলা নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন কিভাবে আরো পরিবর্তন করে খেলার নিয়ম-কানুন বদলে দিতে। সেসময় কিছু নিয়ম বদলানোর প্রস্তাবও রাখেন। কিন্তু যেখানে রক্তের সাথে মিশে আছে ফুটবল সেখানে নতুন করে এই ৪/৫ দিনের ক্রিকেট খেলায় কার আগ্রহই বা প্রকাশ পাবে? সেই হিটলার পতন থেকে আজ পর্যন্ত জার্মানে ক্রিকেট জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি ফুটবলের ভালোবাসার ভিড়ে। হিটলার তোহ সেই রণক্ষেত্র যুগের, আজ আধুনিক যুগেই কি সেখানের মানুষের মস্তিষ্কে ক্রিকেটের প্রকাশ পায়নি? নাকি হিটলারের নিষিদ্ধ গল্প নিয়ে বসে আছে। হিটলারের আঁকা ছবি বিক্রি হচ্ছে। বিক্রি হচ্ছে জার্মানির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত হিটলারের লেখা বই ‘মেইন ক্যাম্প’। 

ফুটবল পাগল জার্মান জাতি কখনো ক্রিকেট খেলাকে মন থেকে গ্রহণ করেনি৷ আজ থেকে ২৮ বছর আগে ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক সংস্থা আইসিসির কাউন্সিলর সদস্য হলেও সেখানে নেই ক্রিকেটের প্রতি কোনো জনপ্রিয়তা। জার্মান জাতীয় ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন ভারতের একজন ইঞ্জিনিয়ার। এছাড়া দলে রয়েছে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারতও ইত্যাদি দেশের শরণার্থী। আফগানিস্তানের প্রায় ৫০ হাজার শরণার্থী রয়েছে জার্মানে যারা নিয়মিত ক্রিকেট খেলছে সেখানে বিকালের অবসর সময় কাটাতে। ক্রিকেট নিয়ে হিটলারের যে গল্পটি ছড়িয়ে আছে সেটির কোনো সত্যতা নেই। এটাও কোথায়ও খুঁজে পাওয়া যায়নি হিটলার কোনো ক্রিকেটারকে হত্যা করেছিলো কিনা। কেননা একক আধিপত্য বিস্তারের জন্য তিনি সেসময় অনেক মানুষ হত্যা করেছিলেন যেটি সত্য।

[Featured photos & news source : BBC Magazine]