• ক্রিকেট

বাংলাদেশের ক্রিকেট: হাঁটছে কোন পথে?

পোস্টটি ৮১২১ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

অনেকদিনের মধ্যে বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে আর কোনো মতামত প্রকাশ করব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি; অন্তত এই শ্রীলংকা সিরিজ বা এভাবে দল-একাদশ নির্বাচন করতে থাকলে তো আর নয়ই। এই সিরিজে লঙ্কানদের ওয়াইটওয়াশ করলেও কিছু যায় আসেনা, তাদের কাছে ওয়াইটওয়াশ হলেও কিছু আসে যায় না। বটম লাইন হবে, আমরা এই বিশ্বকাপে অষ্টম হওয়া দল।
 
আমার এই মতামত বা অনুভূতি প্রকাশ না করার সিদ্ধান্তের পেছনে কিছু যুক্তি তুলে ধরছি:
 
১) একাউন্টেবিলিটি বা জবাবদিহিতার অভাব:
 
দলের সদস্যদের মধ্যে কোনোরকম একাউন্টেবিলিটির লেশমাত্র নেই, সিনিয়রদের মধ্যে দল থেকে বাদ পড়া বা বিশ্রামের অজুহাতে বাদ পড়ার ভয়ও নেই। তামিম দিব্যি বিশ্বকাপে ত্রিশ গড় নিয়ে অখুশিও নয়, আবার শ্রীলংকা সিরিজে ভাল কিছু করে দেখাবার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেছে দল ঘোষণার আগেই; অর্থাৎ সে জানেই সে পরের সিরিজে দলে থাকবেই, আগের সিরিজে পারফরম্যান্স যা-ই হোক না কেন! দলের অধিনায়ক মাশরাফিরও একই দশা! ক্যারিয়ারের সাঁঝবেলা ঘনিয়ে এসেছে তাঁর, বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সও ছিল হতাশাজনক। অথচ তিনিও ঘোষণা দিলেন আগেভাগে, পরের সিরিজেও অধিনায়ক থাকবেন তিনি। অর্থাৎ, তাঁরও কোনো জবাবদিহিতার জায়গা তৈরি হয়নি। মুশফিক কিপিংয়ে বছরের পর বছর শিশুসুলভ ভুল করে গেলেও তিনিই থাকবেন উইকেট আগলে রাখতে।
 
পৃথিবীর সব খেলাতেই খেলোয়াড়দের দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহিতা করা লাগে। আপনি মেসি-রোনালদো হলে আলাদা কথা! আর আমাদের দলে বা বোর্ডে কোথাও জবাবদিহিতা বা পদত্যাগ এসবের কোনো চর্চা নেই। দেশের কোথাও অবশ্য নেই, এদের থেকে তাই আশা করাও বাতুলতা।
 
২) মাথাব্যথায় মাথা কেটে ফেলা:
 
বলির পাঁঠা হিসেবে কোচিং স্টাফদের ছাঁটাই করা হল বিশ্বকাপ শেষে। রোডসের বিদায় আসন্ন মনে হলেও তড়িঘড়ি করে তাকে বাদ দেয়াটা স্রেফ আইওয়াশই মনে হয়েছে। এই খারাপ পারফরম্যান্সের পেছনে একশ' একটা কারণ থাকলেও সব দোষ কোচের ঘাড়ে চাপানো হাস্যকরই বটে, তার মধ্যে তিনি মাঠে নেমে খেলেনই নি। অথচ অনেক খেলোয়াড়ই বাদ পড়তে পারত।
 
৩) ইনসিকিউরিটি কমপ্লেক্স:
 
শ্রীলংকা সিরিজের দলে বিশ্বকাপে কোনো ম্যাচ না খেলা রাহিকেই কেবল রাখা হয়নি; অথচ খারাপ পারফরম্যান্স করা বাকি সবাই বহাল তবিয়তে আছে। অন্তত বিশ্রাম দেয়া হচ্ছে বলে তামিম-মুশফিক-রিয়াদ-মাশরাফি-সাব্বির-রুবেল-মিঠুন এরকম অনেককেই বসিয়ে রেখে নতুন দল ঢেলে সাজানো যেত চার বছর পরের বিশ্বকাপের চিন্তা মাথায় রেখে।
 
নতুনদের দলে সুযোগ দিলে সবচে খারাপ ফলাফল কী হতে পারে? ওয়াইটওয়াশ? এই তো? নাকি এরচেয়েও খারাপ কিছু হত? কিন্তু ভাল দিক যেটা হত, নতুনরা অন্তত সুযোগটা পেত! এই সিরিজে ৩-০ তে জিতলেও কিচ্ছু আসে যায়না। নাকি সিনিয়রদের বা বোর্ডের চুক্তিবদ্ধদের ভয় কাজ করে যে একবার দল থেকে বাদ গেলে নতুনরা জায়গাটা নিয়ে নিতে পারে?
 
এমনকি আয়ারল্যান্ডের ত্রিদেশীয় সিরিজে আইরিশদের বিরুদ্ধে 'ডেড রাবার' ম্যাচে, যে ম্যাচে হারলেও ফাইনাল খেলতাম, সে ম্যাচেও পূর্ণশক্তির স্কোয়াড নামিয়েছিলাম আমরা; অথচ বেঞ্চে ইয়াসির আলি-নাঈমকে বসিয়ে রাখা হয়। এ থেকে মাঝেমধ্যে মনে হয়, খেলোয়াড়েরা প্রচুর 'ইনসিকিউরিটি কমপ্লেক্স'-এ ভুগে হয়ত!
 
৪) পেছনের দিকে চলতে থাকা:
 
২০০৭ বিশ্বকাপে ভারত কিংবা ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের ভরাডুবির কথা ভাবুন। খোলনলচে দল পালটে ফেলে, ভবিষ্যতের কথা ভেবে দল সাজিয়ে পরের আসরে দুই দলই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এমনকি মরগ্যান এবার চ্যাম্পিয়ন ক্যাপ্টেন হয়েও পরের ওয়ানডে সিরিজে ক্যাপ্টেন্সি করবেন কীনা সেটাই এখনও নিশ্চিত না; কারণ তারা চার বছর পরের কথা ভাবছে এখন থেকেই, পরের বিশ্বকাপের কথা ভাবছে।
 
অথচ এরা যাদের কাছে হেরে ক্রিকেট অবকাঠামো ঢেলে সাজাতে উদ্যোগী হয়েছিল, সেই বাংলাদেশই হাঁটছে উলটো পথে। পরের সিরিজে আবার দলে নিচ্ছে ফরহাদ রেজা-বিজয়-তাইজুলদের; হয়ত ইমরুলকেও নেয়া হবে আবার কোনো এক ওয়ানডে সিরিজে। অথচ যেখানে সুযোগ দেয়া দরকার ছিল আফিফ-শান্ত-জাকির-সোহান-সাইফ-খালেদ-নাঈম-রনি-মেহেদী এসব তরুণদের। অন্তত টি-টোয়েন্টি ম্যাচে মুশফিক-রিয়াদ-তামিম-সাকিবদের খেলার দরকার দেখিনা আর আমি; সেখানে নতুন খেলোয়াড়দেরই সুযোগ দেয়া হোক কেবল।
 
আর যদি আপনি অজুহাত দেন, তরুণরা এখনও তৈরি হয়নি, পুরানোদের দিয়েই সবসময় দল সাজাতে হবে, তাহলে জেনে রাখবেন এই দলের কোনো ভবিষ্যত নেই। আমাদের সর্বোচ্চ সান্ত্বনা হবে সেমিফাইনাল খেলার স্বপ্নের হাওয়াই-মিঠাই বানানোতে, কোন খেলোয়াড় কী বলেছে আমাদের নিয়ে সে দোষ খুঁজে মুন্ডুপাত করাতে আর অন্য কোনো দলের বাদ পড়াতে খুশি হওয়া পর্যন্তই।
 
৫) মধ্যবিত্ত মেন্টালিটি:
 
শেষ কথাটা হল, দলের মেন্টালিটিতে আমূল পরিবর্তন আনা লাগবে। যদি সাইকোলজিস্টদের সাথে নিয়মিত বসতে হয়, তাও করা লাগবে। আমরা বেশকিছু ম্যাচ হেরে যাই স্রেফ মানসিকতার জন্য। অস্ট্রেলিয়ার সাথে খেলছি এদের হারানো যাবেনা, ইন্ডিয়ার সাথে খেলছি এদের হারানো যাবেনা, ইংল্যান্ডের সাথে খেলছি এদের হারানো যাবেনা, এসব ডরপুক মনোভাবের জন্যই হেরে যাই অনেক ম্যাচ।
 
বড় দলের সাথে জিততে 'ফিয়ারলেস ক্রিকেট' খেলতে হবে। বারবার বিট হয়ে কোনরকমে ২৫-৩০ রান করে দিয়ে যায় আর দলের উপর প্রেসার ক্রিয়েট করে এরকম ব্যাটসম্যান দলে দরকার নেই। স্টক বোলারের কাজ ৫-৭ ওভার করে স্ট্রাইক বোলারদের রেস্ট দেয়া। তাই বলে স্ট্রাইক বোলারকে বসিয়ে রেখে ব্যাটিং জানে বলে স্টক বোলারকে দিয়ে দশ ওভার করানোর মত ডিফেন্সিভ স্ট্র্যাটেজি নিলে প্রতি ম্যাচেই ৩৫০ করবে অপোনেন্ট। ফাইনালে নিউজিল্যান্ডের ডি গ্র্যান্ডোম চমৎকার বল করে দিনের সেরা বোলার ছিল; তাই বলে ব্যাটিংটাও পারে বলে পরের ম্যাচ থেকে তাকে ১০ ওভার করিয়ে বোল্ট-ফার্গুসন-হেনরির মত স্ট্রাইক বোলারকে বসিয়ে রাখার মত কাঁচা কাজ কিউইরা করবেনা কখনোই।
 
হার্শা কমেন্ট্রিবক্সে একদিন বলছিলেন, "Bangladeshi Players are too emotional to play a big match." এসব ইমোশনাল খেলোয়াড় যতদিন প্রফেশনাল অ্যাটিচ্যুড শো না করবে সাকিবের মত, ততদিন এরকম মিডিওকোরই থেকে যাবে দল। সোশ্যাল মিডিয়াতে কে কী বলল, প্রেস কনফারেন্সে এসে সেসবের জবাব দেয়া কোনো খেলোয়াড়ের সাজেনা। আবেগ থাকবে আবেগের জায়গায়, প্রফেশনালিজমের জায়গায় প্রফেশনালিজম। সত্যি বলতে কী, লর্ডসে যেরকম ফাইনাল ম্যাচ হল, এরকম ম্যাচ খেলার মত নার্ভ বা এবিলিটি আমাদের ক্রিকেটারদের নেই।
 
আর আমাদের দর্শকদের কথা তো বলাই বাহুল্য। এখনও ৯৮ ভাগ লোক স্কোরকার্ড দেখে খেলা বুঝে গিয়েছে মনে করে, আর চার-ছয় দেখেই কেবল হাততালি দিতে পারে; নিয়মিত বদলে যাওয়া ক্রিকেটের নিয়মের খোঁজখবর রাখা আর ম্যাচ ইমপ্যাক্ট-স্ট্র্যাটেজি এসব বোঝা তো দূরে থাক। অ্যালেক্স ক্যারির চোয়াল থেকে রক্ত ঝড়লেও সে ব্যান্ডেজ বেঁধে ইনিংস ক্যারি করে নিয়ে যায় সামনে; তার জন্য তামিমের মত দেশপ্রেমের স্লোগান বয়ে যায়নি অজি মিডিয়াতে, স্টেডিয়ামের সামনে স্ট্যাচু বসানোর জন্য মানববন্ধনও হয়নি। সে প্রফেশনাল প্লেয়ার, নিজের প্রফেশনালিজমই দেখিয়েছে স্রেফ। আর, ফাইনালের শেষ ওভারে ওভারথ্রোতে চার হবার ঘটনা যদি এই সাবকন্টিনেন্টের কোনো দলের ম্যাচে হত, তাহলে মজা বুঝতেন। ষড়যন্ত্র-ফিক্সিং-জোচ্চুরি ইত্যাদির চানাচুর মাখিয়ে ফেলত সবাই।
 
মোদ্দা কথা, দলের মেন্টালিটি বা প্লেয়িং এপ্রোচে যতদিন বদল না আসবে, ততদিন এরকম ছয়-সাত নম্বর দলই থেকে যাব আমরা। তাই প্রত্যাশার বেলুন ফুলিয়ে আর লাভ নেই বুঝে গিয়েছি। ঘরোয়া ক্রিকেটের সামগ্রিক অবকাঠামোর বদল না হলে তো কেনিয়া-জিম্বাবুয়ের মত অবস্থা হয়ে না যায় আবার আমাদের!
 
আর ততদিন পর্যন্ত আমরা দর্শকরা আয়ারল্যান্ডে ট্রফি জিতে আর শ্রীলংকা-ওয়েস্ট ইন্ডিজ-জিম্বাবুয়ে-আফগানিস্তান-আয়ারল্যান্ড এদের সাথে জিতে বা মিরপুরে ঘূর্ণিট্র্যাক বানিয়ে দুয়েকটা টেস্ট জিতে রতিসুখ পেতে থাকি!
 
মোদ্দা কথা, দলের মেন্টালিটি বা প্লেয়িং এপ্রোচে যতদিন বদল না আসবে, ততদিন এরকম ছয়-সাত নম্বর দলই থেকে যাব আমরা। তাই প্রত্যাশার বেলুন ফুলিয়ে আর লাভ নেই বুঝে গিয়েছি। ঘরোয়া ক্রিকেটের সামগ্রিক অবকাঠামোর বদল না হলে তো কেনিয়া-জিম্বাবুয়ের মত অবস্থা হয়ে না যায় আবার আমাদের!
 
আর ততদিন পর্যন্ত আমরা দর্শকরা আয়ারল্যান্ডে ট্রফি জিতে আর শ্রীলংকা-ওয়েস্ট ইন্ডিজ-জিম্বাবুয়ে-আফগানিস্তান-আয়ারল্যান্ড এদের সাথে জিতে বা মিরপুরে ঘূর্ণিট্র্যাক বানিয়ে দুয়েকটা টেস্ট জিতে রতিসুখ পেতে থাকি!