এতটা প্রাপ্য ছিলনা আমাদের সুপারম্যানের
পোস্টটি ৩৭৯১ বার পঠিত হয়েছেএরকম সন্ধ্যাও বাংলাদেশের ক্রিকেটে কখনো আসবে এটা বিশ্বাস করা খুব কঠিন, এমন ঘটনাগুলো স্রেফ বাকরুদ্ধ করে দিয়ে যায়। সাকিব যদি ম্যাচ ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকতেন, তাহলেও বাতাসে নিশ্বাস নিতে তেমন কষ্ট হতোনা, কিন্তু একেবারেই নির্দোষ হওয়ার পরেও যেই গুরুদণ্ডের মুখোমুখি হতে হচ্ছে সাকিবকে, এটা নৈতিকতার দিক দিয়ে সম্পূর্ণ অবিচার, বাড়াবাড়িই। পুরো জাতিকেই এতটা হতবিহ্বল এই ভালোবাসার ক্রিকেট কখনোই যে করেনি সেটা নির্দ্বিধায় বলাই যায়, ভালবাসার ক্রিকেটটা মঙ্গলবারের সন্ধ্যায় যতটা ধংসলীলা চালিয়ে দিয়ে গেল বাংলাদেশের ক্রিকেটে, সেটা কখনোই প্রাপ্য ছিলনা ক্রিকেটপাগল এই জাতিটার, প্রাপ্য ছিলনা দেশের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠা সাকিব আল হাসানের।
কত শত স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠছে, তাতে মনের অজান্তেই ঝাপসা হয়ে উঠছে চোখদুটো। কি দুর্দান্ত ফর্মেইনা ছিলেন আমাদের সুপারম্যান, সামনের একটা বছরে আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ আর ওয়ানডে লিগ নিয়ে বড় স্বপ্ন তাই দেখতেই চেয়েছিল বাংলাদেশ। দুদিন পরেই ভারতে প্রথমবার পূর্ণাঙ্গ সিরিজ, জুনে অস্ট্রেলিয়া আসবে দেশে, আগস্টে সাকিবের প্রিয় নিউজিল্যান্ডের সাথে কতদিন পর দেশে আবার সেই বাংলাওয়াশের স্মৃতি ফিরিয়ে আনার হাতছানি- এতকিছু স্রেফ ম্লান হয়ে গেল আইসিসির অবিশ্বাস্য রকমের একটা বাড়াবাড়িতে। কিন্তু এমনতো হওয়ার কথা ছিলনা, মাস তিনেক আগেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের দলগত ব্যার্থতা ছাপিয়ে সাকিব নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন বিশ্বতারকাদের কাতারে, তারপর এক সপ্তাহ আগেই যখন ক্রিকেটার আন্দোলনে সত্যিকারের নেতা হয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটের জঞ্জাল সাফের মিশনে নেমেছিলেন- তখন কে ঘুনাক্ষরেও বা কল্পনা করতে পেরেছিল কত বড় এক দুর্যোগে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেট!
ঘটনার সূত্রপাত ২০১৭ সালের নভেম্বরে, বিপিএল চলাকালীন সময়ে দীপক আগারওয়াল নামের একজন সাকিবকে হোয়াটসঅ্যাপে দেখা করতে চান বলে কিছু টেক্সট দিয়েছিলেন। দীপক সাকিবের নাম্বারটা সাকিবেরই পরিচিত একজনের কাছ থেকে পেয়েছেন, আর ব্যাপারটা তখন হয়ত ভক্তের দেখা করার আকুতি হিসেবে নিয়েই এড়িয়ে গিয়েছেন সাকিব। দুই মাস পর যখন দেশের মাটিতে ত্রিদেশীয় সিরিজের আসর বসে, দীপক আবারো সাকিবকে নক করেন হোয়াটসঅ্যাপে, এবার সাকিব বুঝতে পারেন এই ব্যক্তি আসলে বুকি! ১৯ জানুয়ারি শ্রীলঙ্কার সাথে ম্যাচে সাকিব ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হওয়ার পরে এই দীপক সাকিবকে কংগ্রাচুলেট করে টেক্সট পাঠান, সাথে সাকিবকে প্রলোভন দেখাতেও শুরু করেন। এবার তার জিজ্ঞাসা আমরা কি এই সিরিজে কাজ করব নাকি আইপিএল পর্যন্ত অপেক্ষা করব! সাকিব যথারীতি সেটায় রেসপন্স তো করেনইনি, সেটা এড়িয়েই যাচ্ছিলেন। কয়েকদিন পর, জানুয়ারির ২৩ তারিখে সাকিবের কাছে ভেতরের খবর জানতে চেয়ে আবারো টেক্সট করেন দীপক, এবার জিজ্ঞাসা ভাই এই সিরিজে কি কিছু আছে কিনা! এইযে তিন বার সাকিব দীপকের কাছ থেকে মেসেজ পেয়েছেন, সাকিব সেটা একবারও আকসুকে জানান নি- হয়ত তুচ্ছ ঘটনা মনে করেই এড়িয়ে গিয়েছিলেন। এখানে সাকিব কোন ধরনের ইতিবাচক সাড়া দেখাননি- এটা স্পষ্ট, সুতরাং নৈতিকভাবে সাকিবকে কোন দায়ই এখানে দেয়া যায়না। স্রেফ এড়িয়েই গিয়েছেন, এরকম কতো মেসেজইতো থাকে ক্রিকেটারদের ইনবক্সে, এই যুগে এসে হয়ত প্রতিদিনই জুয়াড়িদের দৌরাত্ম্যের মুখে পড়তে হয় তাদেরকে।
ঘটনা এখানেই থেকে থাকেনি, দীপক সাকিবকে বিরক্ত করেছেন, প্রলোভন দেখিয়েছেন আইপিএলের সময়ও। ২০১৮ সালের ২৬ এপ্রিলে পাঞ্জাবের বিপক্ষের ম্যাচের দিন সাকিবকে দীপকের জিজ্ঞাসা ছিল একজন পার্টিকুলার ক্রিকেটার ওই ম্যাচে খেলছেন কিনা, সাথে সাকিবের বিটকয়েন ওয়ালেট, ডলার একাউন্ট নিয়েও জানতে চায় সে। সাকিব যথারীতি পরিষ্কারভাবেই সেটা প্রত্যাখান করে যান, সাথে দূর্ভাগ্যবশত আকসুকে জানাতেও ভুলে যান, ব্যাপারটাকে পাত্তা না দেয়াটাই হয়ত কাল হয়েছে সাকিবের জন্য।
সাকিব আইসিসিকে ইমিডিয়েটলি না জানানোয় আইসিসিও সাথে সাথে কিছু জানতে পারেনি, জানতে পেরেছে আরো অনেক পরে। এই দীপক আইসিসির এনলিস্টেড জুয়াড়ি হওয়ার কারনে তাকে সবসময়ই নজরদারিতে রাখে আইসিসি, কিন্তু আইসিসি যেহেতু কোন রাস্ট্র নয়, সেহেতু তাদের সীমাবদ্ধতার কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। সেই নজরদারিতেই হয়ত কোনভাবে আইসিসি সাকিবের সাথে টেক্সট চালাচালির কথা জানতে পারে, যেহেতু সর্বশেষ ঘটনাটি ২০১৮ সালের প্রায় মাঝামাঝিতে ঘটেছে, তাতে দেরির অজুহাতে আইসিসিকে দোষ দেয়ার খুব সুযোগ নেই। তাঁরা সাকিবকে ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি আর ২৭ আগস্টে এই নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে, যেখানে সাকিব খুব অকপটেই নিজের ভুলের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন৷ এটাকে আসলে দোষ কিংবা অপরাধের মধ্যে ফেলার প্রশ্নই আসেনা, এটাকে ভুল বলা হলেও এটা যে আহামরি বড় কোন রকমের ভুল, সেটাও বলার কোন সুযোগ নেই।
সাকিবের বিরুদ্ধে ফিক্সিংয়ের কোন অভিযোগ না পাওয়ার পরেও দুই বছরের নিষেধাজ্ঞার (১ বছর স্থগিত) মত শাস্তি রীতিমতো অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয়। এইরকম প্রস্তাব সাকিব অহরহ পেয়ে থাকেন, সব ক্রিকেটাররাই পেয়ে থাকেন। ২০১৮ সালের ত্রিদেশীয় সিরিজ চলার সময়ই সাকিব ইঞ্জুরড হন, সেই থেকে প্রায় দেড় বছরের বেশি সময় নিজের আঙুল নিয়েই লড়তে হয়েছে সাকিবকে। এত চাপের মধ্যে থেকে এরকম ছোটখাট ব্যাপার অত বড় করে দেখলে নিজের স্বস্তির জায়গাটাই হারিয়ে ফেলতে হবে ক্রিকেটারদের, কোনরকম অপরাধ না করা আর আইসিসির দুর্নীতি দমনে দারুন রেকর্ড থাকার পরেও সাকিবকে যেই শাস্তি দেয়া হল সেটা খুব বাজে এক দৃষ্টান্তই হয়ে থাকবে।
সাকিবের এই শাস্তিকে অনেকেই আন্দোলনের প্রতিশোধ হিসেবেই দেখছেন, পাপনের বিরুদ্ধে ছড়ানো হচ্ছে সীমাহীন ঘৃনা! আন্দোলনের সময় আর তার পরের কয়েকটা দিন পাপনের কথাবার্তা চরম রকমের অপেশাদারিত্বের পরিচয় দেয়, আর গ্রামীনফোনের সাথে সাকিবের চুক্তি নিয়েও যা তা বলে গিয়েছেন গণমাধ্যমে, যেটা স্রেফ হাস্যকর। কিন্তু এই ঘটনার সাথে পাপনের কোন সম্পর্ক আছে বলে আমি বিশ্বাস করতে চাইনা, বিশ্বাস করার কোন কারনও খুঁজে পাইনি। দুটো পুরোপুরিভাবে আলাদা দুটো ইস্যু, আইসিসি পাপনের কথায় সাকিবকে শাস্তি দিবে- এতটা ক্ষমতা বাংলাদেশের নেই।
প্রশ্ন উঠতে পারে টাইমিংটা নিয়ে, এই সময়েই কেন! এখানে কোন ষড়যন্ত্র আছে বলে বিশ্বাস করতে চাইনা! আইসিসি চাইলেই দুইদিনে কাউকে নিষিদ্ধ করতে পারবেনা, এটা অসম্ভব। যেহেতু সাকিবকে আগস্ট মাসেও ইন্টারোগেট করা হয়েছে, তার পর অনেক যুক্তি তর্কের ব্যাপার রয়েছে, তদন্তের ব্যাপার রয়েছে। এটা নিতান্তই কাকতালীয় যে আন্দোলনের ঠিক পরেই এটা দেখতে হয়েছে আমাদের, কিন্তু ভারত সফরের মাত্র এক দিন আগেই কেন? এখানে বড় কোন ষড়যন্ত্র থেকে থাকলেও থাকতে পারে, যেটায় পাপনের যুক্ত থাকার কোন প্রশ্নই আসেনা। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান ক্রিকেট বাজার ধংসের ষড়যন্ত্র, এক সাকিবকে মেরে ফেললেই যে মারা পড়বে বাংলাদেশের ক্রিকেট- সেটা বড় মোড়লগুলোর ভাল করেই জানা! এটা কি তাহলে খুব বড় কোন কন্সপিরেসি?
আরো প্রশ্ন আসে, কোন ভারতীয় ক্রিকেটার যদি এমন সিলি মিসটেকে ইনভলভড থাকতেন, আইসিসির কতটুকু সাধ্য ছিল এত বড় কিছু করার! এই সামান্য ভুলের জন্য যদি দুই বছর ব্যান করা হয়, ফিক্সিংয়ের জন্য তাহলে তো মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা উচিত আইসিসির! কেন নেই আপিল করার সুযোগ, এই আপিলের সুযোগ না থাকাটাই বোধহয় সবচাইতে বড় ধাক্কা।
সাকিব কোন দোষ করেননি, তার ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই আসেনা। ভালবাসার সাকিবের পাশে যেভাবে দাড়াচ্ছে পুরো দেশের মানুষ, তাতেই সাকিবের মহানায়ত্বের ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যায়। দেশের ক্রিকেটের ভার বয়ে চলা মানুষটার ভার একটা বছর অন্তত বয়ে নিক ষোল কোটি মানুষ, এই একটা বছরে কোথায় কিভাবে কে দলটার ভার বইবে সেটা জানা নেই কারোর। খুব কঠিন সময়ই আসতে যাচ্ছে আমাদের ক্রিকেটে, দেশের ক্রিকেটের হৃদপিণ্ডটাকে ছাড়া কিভাবে শ্বাস নিবে বাংলার বাঘেরা!
সাকিব ফিরে আসবেন, আরো দোর্দণ্ড প্রতাপে, আরো বেশি ক্ষিপ্রতায়। ভাল থাকুন সাকিব আল হাসান, আপনার ফিরে আসার অপেক্ষায়...
- 0 মন্তব্য