• ক্রিকেট

অধিনায়ক,নেতা,কিংবদন্তী- মাশরাফি!

পোস্টটি ৩১৫৫ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

মাশরাফি নামের অর্থ 'উচ্চ স্হান সম্বন্ধীয়'। নিজের নামের সাথে নিজের পুরো জীবনটার 'সারাংশ' মিলে যায় এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল। মাশরাফি সেই বিরল মানুষদেরই একজন। মাশরাফি ছাড়িয়ে ক্যাপ্টেন মাশরাফিকে বিবেচনায় আনলে মাশরাফি নামের অর্থ হবে আরো পরিষ্কার, আরো যথার্থ!

২০১০ সাল! প্রথমবারের মত লাল সবুজ জার্সিতে টস করতে নামছেন পাগলাটে এক যুবক। অধিনায়কত্বের ব্যাটন হাতে নেবার আগেই যার দৃঢ়চেতা মনোভাব জানা হয়ে গেছে আপামর বাংলাদেশী ক্রিকেট সমর্থকদের৷ সে বছর সাতটি ওয়ানডেতে টস করতে নেমেছিলেন ম্যাশ। এরপরই ইঞ্জুরির সখ্যতা!

অধিনায়ক হিসেবে এরপর আর বহুদিন মাশরাফিকে দেখা যায়নি৷ মুশফিকুর রহিমের অধীনে জিতেছেন, খেলেছেন সাকিব আল হাসানের অধীনেও। এরপর যে সময়টায় মাশরাফি ছাড়িয়ে 'ক্যাপ্টেন মাশরাফি' কে ফেরানো হয়, খুব সম্ভবত সে সময়টার চাইতে পারফেক্ট টাইমিং আর মাশরাফির জন্যে হতে পারত না৷

২০১৪ সালে একের পর এক ম্যাচ যখন হারছে বাংলাদেশ, অন্তর্বর্তীকালীন কোচ বদলে পুরো মেয়াদে নতুন এক কোচ যখন দায়িত্ব নিলেন, হচ্ছিল যখন ক্যাপ্টেন মুশফিকুর রহিমের রক্ষণাত্বক কৌশলের সমালোচনা... বাংলাদেশ ক্রিকেট তখন রীতিমত ধুঁকছে। অথচ কয়েক মাস বাদে বিশ্বকাপ, যেটি কিনা আবার অস্ট্রেলিয়াতে, উপমহাদেশের সাথে যার কোনই মিল নেই!

এরকম একটা সময়ে পুরো দলের খোলনলচে বদলে অধিনায়কত্বের ব্যাটনটা মাশরাফি বিন মুর্তজার হাতে তুলে দেওয়া হয়৷ এমন একটি সময়ে যেকোন খেলোয়াড়ই অধিনায়কত্বের দায়িত্ব নিতে চাইবেন না। কিন্তু বিশ্বকাপের মাত্র কয়েক মাস আগে অধিনায়কত্বের এই দায়িত্ব মাশরাফি নিয়েছিলেন। নেবেন নাই বা কেন? যার আত্মাজুড়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সখ্যতা, সেই মাশরাফি বিন মুর্তজা কিভাবে এই ডাক উতরে যেতে পারেন? বিসিবিও নিজেকে ভাগ্যবান মানতে বাধ্য, তাদের সেই সময় একজন মাশরাফি বিন মুর্তজা ছিল!

অনেকে বলে থাকেন, পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একটি ভাগ আইন্সটাইন আসার আগে, আরেকটি ভাগ আইন্সটাইন আসার পর৷ ক্লাসিক্যাল ফিজিক্সের সমস্ত ধারণাকে পাল্টে দিয়ে পদার্থবিজ্ঞান নতুন এক যুগে প্রবেশ করেছিল আইন্সটাইন, ম্যাক্স প্লাংকের হাত ধরে৷

চাইলে বাংলাদেশ ক্রিকেটকেও আমরা দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। একটি পুরো মেয়াদে ক্যাপ্টেন মাশরাফি আসার আগে, আরেকটি মাশরাফি আসার পর! দায়িত্ব নেবার পর প্রথম এসাইনমেন্ট ছিল জিম্বাবুয়ের সাথে হোম সিরিজ৷ জিম্বাবুয়ের সাথে বাংলাদেশ জিতবে সে সময় অনুমেয় থাকলেও নিশ্চিত ছিল না৷ তবু বাংলাদেশের জয়টা যত না নজর কেড়েছিল, তার চাইতেও নজর কেড়েছিল দলের শরীরি ভাষা। মিড অন থেকে লং অন, কাউ কর্নার থেকে সিলি মিড অফ.. প্রত্যেক পজিশনে প্রতিটি খেলোয়াড়ের শরীরি ভাষা, জেতার ক্ষুধা টিভির সামনে বসে অব্দি টের পাওয়া যাচ্ছিল। ক্রিকেট দলে একজন অধিনায়ক ঠিক কতটুকু অবদান রাখতে পারেন কিংবা দলকে বদলে দিতে পারেন তার উদাহরণ যদি কেউ আমার কাছে কখনও চায়, আমি উত্তরে সব সময়ই মাশিরাফি বিন মুর্তজাই বলব!

অধিনায়ক মাশরাফির প্রতি মুগ্ধতা বেড়ে যাচ্ছিল দিন কে দিন! জিম্বাবুয়ে সিরিজের পর বিশ্বকাপ সে মুগ্ধতাকে সপ্তমে চড়িয়ে দিচ্ছিল। তবে তার চাইতেও বদল মাশরাফি আমাদের জন্যে অপেক্ষা করিয়ে রেখেছিলেন! পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ? না! সে তো বাংলাদেশের প্রাপ্যই ছিল৷ বদলটা ছিল এরপরের সিরিজে৷ টিম ইন্ডিয়ার সাথে। বিশ্বকাপের কন্ট্রোভার্স নো বলের জন্যে ভারত - বাংলাদেশ ইস্যু ততদিনে 'জাতীয়' ইস্যুর মত ব্যাপার৷ এর মধ্যেই মাশরাফি নামিয়ে দিলেন গুণে গুণে চার পেসার... উপমহাদেশের পিচে, মিরপুরের উইকেটে!

মাশরাফি-রুবেল-তাসকিন পেসত্রয়কে আমরা ততদিনে উপভোগ করতে শুরু করেছি, পেস বোলিং দেখতেই ভাল লাগছে এমন একটা অবস্থায় যখন বাংলাদেশের পেস বোলিং লাইনআপ পৌছে গেছে, মাশরাফি বিন মুর্তজা তখন আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন মুস্তাফিজুর রহমানের।

বলতে গেলে, মাশরাফি বিন মুর্তজার বিচক্ষণতাই আমাদের একজন মুস্তাফিজকে এনে দিল। নেট বোলার থেকে সরাসরি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের তখনকার রাজা, মুস্তাফিজুর রহমান মাশরাফির প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবেন নিশ্চিত!

সে বছর মাশরাফির হাত ধরে আমরা পেয়েছিলাম রূপকথার মত একটি বছর। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল, পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ, ভারতের সাথে সিরিজ জয়, সাউথ আফ্রিকাকে হেসেখেলে হারিয়ে দেওয়া, একটি ক্রিকেট সমর্থকগোষ্ঠী একজন অধিনায়কের কাছ থেকে যতকিছু চাইতে পারে মাশরাফি আমাদের তার সবটাই দিয়েছিলেন।

অথচ অক্টোবর ২০১৫ থেকে কেউ যদি জুন ২০১৪ তে ফিরে যায়, ভবিষ্যদ্বাণী করতে বসে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের, ঘুণাক্ষরেও কি আন্দাজ করতে পারবে বাংলাদেশ ক্রিকেট কি পেতে যাচ্ছিল? অথচ কি উৎকণ্ঠিতই না আমরা হচ্ছিলাম। এজন্যেই বোধহয় বলা হয়, 'রিল্যাক্স, গ্রেট থিংস টেক টাইম'!

বাংলাদেশ ক্রিকেটের পালাবদলে মাশরাফি বিন মুর্তজার নাম সবসময়ই সবার আগে উচ্চারিত হবে। কবিতা বলে, 'ছোট ছোট বালুকণা বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল'। মাশরাফিও ব্যাটন হাতে নিয়ে রাতারাতি সব বদলে দেননি। ছোট ছোট জিনিস তিনি বদলেছেন, বড় বড় ইস্যু খেলার মাঠে এমনিই বদলে গেছে৷ স্লিপে সাত ফিল্ডার রাখার সাহস তিনি করেছেন, চার পেসার নিয়ে মিরপুরের উইকেটে খেলতে নামার আগ্রাসন তিনি দেখিয়েছেন, বিপক্ষ দলের দুর্বলতা বুঝে পাওয়ারপ্লেতে দুই পাশ থেকে স্পিন আক্রমণের বাহাদুরি তিনি দেখিয়েছেন, বদলেছে দল, বদলে গেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট!

বিপক্ষ দলের দুর্বলতার কথা বলছিলাম। এর আগে দেখা যেত, বাংলাদেশ দলের ম্যাচ পরিকল্পনাতে মুখস্থ ধাঁচের প্রচলন ছিল। প্রতিপক্ষ দলের দুর্বলতা হোক বা সবলতা, দল খেলতে নামত একই পরিকল্পনায়, একই একাদশে!

মাশরাফি বিন মুর্তজা বদল এনেছেন সেখানেও। নিজেদের শক্তির জায়গা স্পিন ছিল ভারতের সবলতা। মাশরাফি নামিয়ে দিয়েছিলেন চার পেসার। আবার নিজেদের পেসাররা যখন ফর্মের তুঙ্গে তখন সাউফ আফ্রিকা বধের পরিকল্পনা সেই পেস আক্রমণ দিয়ে করতেও মাশরাফি বিন মুর্তজা পিছপা হননি৷
মোটা দাগে, মাশরাফি বিন মুর্তজা 'সুইট্যাবল অফ সুইটনেস' , একজন পার্ফেক্ট ক্যাপ্টেন, দলের প্রয়োজনে যখন যেটি প্রয়োজন তিনি সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

মাশরাফিকে নিয়ে চড়াই উৎরাই আলোচনা রয়েছে অনেক। সেসব আলোচনায় ক্যাপ্টেনের বিদায়বেলায় তোলা থাক শোকেজে। একটি জাতির একটি আবেগের খেলায় বদলের শুরু করার জন্যে মাশরাফি একটি স্যালুট পাবেন নিশ্চিত!

কমলাপুর স্টেশনে বসে আছি। সিলেট যাব, মাশরাফি বিন মুর্তজার অধিনায়কত্বের শেষ ম্যাচটি দেখব। একের পর এক ট্রেন এসে থামছে, যাত্রীরা নামছে, নতুন যাত্রী নিয়ে পুরনো ট্রেন চলে যাচ্ছে উদ্দেশ্যের পানে৷ প্লাটফর্ম বদলাচ্ছে, যাত্রী বদলাচ্ছে, ট্রেনটির লক্ষ্য বদলাচ্ছে না। বদলের শুরু এনে দেওয়া ক্যাপ্টেনের শেষবেলায় আমাদের চাওয়া মাশরাফির এনে দেওয়া বদলের ট্রেন যেন নতুন কোন উদ্দেশ্যে পৌছে যায়....!