• ফুটবল

নাগরিগ থেকে এনফিল্ড: মোহামেদ সালাহ

পোস্টটি ১৯১৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

মোহামেদ সালাহ কে?? পাঁচ বছর আগেও এই প্রশ্নের উত্তর ঠিকভাবে দিতে পারবে এমন মানুষ ছিল হাতে গোনা অল্প কয়েকজন। কিন্তু ভোজবাজির মত পাল্টে যাওয়া সালাহর জীবনের কারণে ইউরোপিয়ান ফুটবল অনুসরণ করেন অথচ সালাহকে চেনেন না, এখন এমন মানুষ খুঁজে পাওয়াই হয়ে যাবে কষ্টকর। ১৯৯২ সালের ১৫ ই জুন মিশরের নাগরিগ গ্রামে জন্ম সালাহর। ছোটবেলায় পড়ালেখায় তেমন একটা পারদর্শী ছিলে না সালাহ। আগ্রহ ছিল ফুটবলের প্রতি। পড়ালেখার প্রতি সালাহর অনাগ্রহ চিন্তিত করে তুলেছিল সালাহর মা-বাবা কে। তারা চাইতেন পড়ালেখা শিখে চাকরি-বাকরি করবে ছেলে। কিন্তু ফুটবলের প্রতি সালাহর প্রচন্ড আগ্রহ দমাতে পারে নি সালাহকে। ফুটবল আর পড়ালেখা দুটোকেই একইসাথে ভালোভাবে চালিয়ে নিতে চেয়েছিলেন সালাহ, কিন্তু সেই খেলায় বারবার হেরেছে পড়ালেখা, জিতেছে ফুটবল। গ্রামের রাস্তাঘাটে বন্ধুদের সাথে ফুটবল পায়ে নিয়মিতই দেখা যেত সালাহকে। অন্যান্য সময় টিভির সামনে বসে থাকতেন ফুটবল খেলা দেখার জন্য। ছোটবেলায় চ্যাম্পিয়নস লিগের খেলা দেখে জিনেদিন জিদান, রোনালদো লিমা, ফ্রান্সেকো টট্টি দেরকে আইডল মানতেন। তাছাড়া কিছু আরব খেলোয়াড়ও ছিলেন সালাহর আইডল। স্থানীয় অনেক টুর্নামেন্টেও অংশ নিতেন সালাহ। সেরকমই একটা টুর্নামেন্ট ছিল শিশুদের জন্য আয়োজিত পেপসি লিগ। গ্রাম থেকে ৩০ মিনিটের দূরত্বের টান্টা শহরে আয়োজিত সেই টুর্নামেন্টে অংশ নেন সালাহ। সালাহর খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে যান কায়রো ভিত্তিক এল মোকাউলুন ক্লাবের একজন স্কাউট। সালাহকে চুক্তির জন্য প্রস্তাব দেন সেই স্কাউট। সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে স্থানীয় ক্লাব এল মোকাউলুনের একাডেমিতে যোগ দেন সালাহ। গ্রাম থেকে ক্লাব অনেক দূরে হওয়ায় ট্রেনিং ক্যাম্পে যাওয়ার সময় পাঁচটি বাস পরিবর্তন করতে হত সালাহকে। ট্রেনিং শিডিউল আর লম্বা ভ্রমণের ধকলের কারণে শৈশবের বন্ধুদের সাথে আর খেলা হয়ে উঠত না সালাহর। ফুটবলের সাথেই বড় হতে থাকলেন সালাহ। মনের মধ্যে পুশে রাখা ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নটাও যেন ধীরে ধীরে বাস্তবে পরিণত হচ্ছিল। ২০১০ সালের মে মাসে ক্লাবের সিনিয়র দলে যাত্রা শুরু সালাহর। শুরুর দিকে বদলি হিসেবে নামলেও ধীরে ধীরে উন্নতি করে ক্লাবের মূল দলেই জায়গা পাওয়া শুরু করেন সালাহ। ২০১২ সালের দিকে চরম বিশৃঙ্খলার কারণে টুর্নামেন্টটি বন্ধ হয়ে যায় এবং এর ফলেই ইউরোপে আসেন সালাহ। ওই বছরের এপ্রিল মাসে সুইস ক্লাব এফসি বাসেলের করা ৪ বছরের চুক্তির প্রস্তাবে রাজি হয়ে বাসেলে যোগ দেন মিশরীয় ফরওয়ার্ড। বাসেলে প্রায় দুই বছর কাটানোর পর ২০১৪ সালের জানুয়ারির দিকে ইংলিশ ক্লাব চেলসির নজরে আসেন সালাহ। ফেব্রুয়ারি মাসে চেলসির হয়ে সালাহর অভিষেক হয়, নিউক্যাসেল ইউনাইটেডের বিপক্ষে। এর কিছুদিন পর বাধ্যতামূলক সেনা প্রশিক্ষণের কারণে সালাহকে মিশরে ফিরে যেতে হয়। কিন্তু সালাহকে খেলার জগৎের একজন তারকা বিবেচনা করে মিশর সরকার সালাহর সেনা প্রশিক্ষণ মওকুফ করে দেয়। ফলে লন্ডনে ফিরে আসেন সালাহ। চেলসিতে খুব বেশি সু্যোগ না পাওয়ার কারণে নিজেকে ঠিকভাবে মেলে ধরতে পারেন নি সালাহ। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সালাহকে ফিওরেন্টিনাতে লোনে পাঠায় চেলসি। পরে ফিওরেন্টিনা ঘুরে আরেক ইতালিয়ান ক্লাব রোমায় পারি জমান সালাহ। রোমায় ১৫ গোল করে সর্বোচ্চ গোলশিকারি হয়ে যান। সালাহর পারফরমেন্স দেখে সালাহকে স্থায়ী চুক্তির প্রস্তাব দেয় রোমা। সালাহর পারফরম্যান্সের উন্নতি অনেক ক্লাবকেই সালাহর প্রতি আগ্রহী করে তোলে। ২০১৭ সালের জুনে রোমা ছেড়ে আবারো ইংল্যান্ডে পারি জমান সালাহ, তবে এবার লিভারপুলের জার্সিতে। লিভারপুলে খেলা প্রথম মিশরীয় ফুটবলারও মোহামেদ সালাহ। লিভারপুলে এসেই যেন নতুন জীবন পেয়ে গেলেন সালাহ। একের পর এক রেকর্ড ভেঙ্গেছেন, গড়েছেন, রেকর্ড বইয়ের পাতায় পাতায় নিজের নাম তুলেছেন। অভিষেক মৌসুমটা বলতে গেলে কাটিয়েছেন স্বপ্নের মত। প্রথম মৌসুমেই সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে সালাহ গোল করেন ৪৪ টা। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পর প্রথম প্রিমিয়ার লিগ ফুটবলার সালাহ যিনি কিনা এক মৌসুমে ৪০+ গোল করতে সক্ষম হন। ওই মৌসুমে লিগে ৩০ গোল করে প্রিমিয়ার লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতাও হন। প্রথম মিশরীয় হিসেবে গায়ে জড়িয়েছেন লিভারপুলের জার্সি। প্রথম আফ্রিকান হিসেবে প্রিমিয়ার লিগে এক সিজনে করেছেন সবচেয়ে বেশি গোল। প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসের সর্বোচ্চ মিশরীয় গোলদাতাও সালাহ। প্রথম মিশরীয় হিসেবে করেছেন প্রিমিয়ার লিগে হ্যাটট্রিক, খেলেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে। সে বছরের ফাইনালটা সালাহর অশ্রুতে শেষ হয়ে গেলেও পরের সিজনেই জিতেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা। তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছেন সমর্থকদের কাছে। প্রিয় মোসালাহকে নিয়ে গানও বানিয়েছেন লিভারপুল ভক্তরা..... Mosalah Mosalah Mosalah Running down the wing Salaaahhhh la la la la The Egyptian king....... মিশরের লোকজনের কাছেও জনপ্রিয়তার তুঙ্গে মোহামেদ সালাহ। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে শেষ মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল করে মিশরকে নিয়ে গেছেন বিশ্বকাপে, ২৮ বছর পর। মিশরের মানুষের জীবনে সালাহ যেন হয়ে উঠেছেন ফুটবলের প্রতিশব্দ। এমনকি মিশরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রায় ১০ লাখেরও বেশি মানুষ মোহামেদ সালাহর নাম লিখে দিয়ে আসে, যদিও পরে সেই ভোটগুলো স্বাভাবিকভাবেই বাতিল হয়ে যায়। ভবিষ্যৎে আরো সফলতা আসুক সালাহর ক্যারিয়ারে, মানুষের জীবনে এভাবেই আনন্দ দিতে থাকুক মোহামেদ সালাহ।images