• ফুটবল

জিজু

পোস্টটি ২৮৩৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
জিনেদিন ইয়াজিদ জিদান - ভক্তদের প্রিয় "জিজু", ১৯৭২ সালের ২৩ শে জুন ফ্রান্সের মার্শেইয়ে বাবা স্মাইল এবং মা মালিকার ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। জিদান আলজেরিয়ান বংশোদ্ভূত। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট জিদান। আলজেরিয়ান যুদ্ধের আগে জিদানের পরিবার আলজেরিয়া থেকে ফ্রান্সে চলে আসে। বাবা ছিলেন একটি দোকানের গুদামের কর্মচারী ও পাহারাদার। তখনকার মার্শেইয়ের অপরাধ প্রবণতা এবং বেকারত্ব সমস্যা সত্ত্বেও তাদের পরিবার মোটামুটি ভালোভাবেই চলছিল। কড়াকড়ির মাঝে বড় হতে থাকা জিদান নিজের জীবনের পথনির্দেশক বলেছেন বাবাকেই।

জিদানের ফুটবলের হাতেখড়ি পাঁচ বছর বয়সেই। কাস্তেয়ানে স্থানীয়দের সাথেই নিয়মিত ফুটবল খেলতেন। সেখানকারই এক ক্লাব ইউএস সেইন্ট হেনরির জুনিয়র দলে প্রথমবারের মত পেয়ে যান ফুটবলারের লাইসেন্স, দশ বছর বয়সে। সেইন্ট হেনরিতে প্রায় দেড় বছর কাটানোর পর আরেক ক্লাব সেপ্টেমেসে যোগ দেন জিদান। চৌদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত ছিলেন সেখানেই। ফ্রেঞ্চ ফুটবল ফেডারেশন কর্তৃক পরিচালিত একটি ফুটবলীয় প্রতিষ্ঠান CREPS এর তিন দিনের ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দেয়ার পর এএস ক্যানেস এর স্কাউটের চোখে পড়ে যান জিদান। ক্যানেসের ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দেয়ার সুযোগ পান এবং সেটা লুফেও নেন। ছয় সপ্তাহের জন্য ক্যানেসে যান জিদান। কিন্তু মজার ব্যাপার হল ক্যানেসে এক প্রতিপক্ষকে ঘুষি মারার কারণে প্রথম সপ্তাহে শাস্তি হিসেবে পরিচ্ছন্নতা কর্মীর দায়িত্ব পালন করতে হয় জিদানকে।

ছয় সপ্তাহের জন্য ক্যানেসে গেলেও জিদান সেখানে কাটিয়ে দিলেন চার বছর। পেশাদার ফুটবলের শুরুটাও এই ক্যানেসের হয়েই। ১৯৮৯ সালে ফ্রেঞ্চ ডিভিশন ওয়ানের এক ম্যাচে ক্যানেসের হয়েই অভিষেক হয় জিদানের। '৯২ সালে ক্যানেস ছেড়ে পাড়ি জমান আরেক ফ্রেঞ্চ ক্লাব বোর্দোতে। '৯৬ সালে বোর্দো ছেড়ে জুভেন্টাসে যোগ দেন জিদান। প্রথম মৌসুমেই সিরি আ'র সেরা বিদেশি খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতেন জিজু। জুভেন্টাসের হয়ে জেতেন দুটি সিরি আ, একটি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ। টানা দুইটি চ্যাম্পিয়নস লীগের ফাইনালে জুভেন্টাসকে তুললেও জিদান জুভেন্টাসের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লীগ জিততে পারেননি, দুইবারই হয়েছেন রানার্স আপ। ১৯৯৮ সালে ফিফার বর্ষসেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হওয়ার পাশাপাশি ব্যালন ডি অরও জিতে নেন জিদান। ২০০১ সালে দ্বিতীয়বারের মত সিরি আ'র সেরা বিদেশি খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। সেবছরই তখনকার সময়ের ট্রান্সফার ফির বিশ্বরেকর্ড গড়ে ৭৭.৫ মিলিয়ন ইউরোতে জিদানকে দলে ভেড়ায় স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদ। জিদান তাঁর ক্যারিয়ারের মধুরতম সময়টাও খুব সম্ভবত কাটিয়েছেন সেখানেই।

প্রথম মৌসুমেই চ্যাম্পিয়নস লীগের ফাইনালে লেভারকুসেনের বিপক্ষে বাম পায়ের ভলিতে দারুণ এক গোল করেন জিদান। সেই গোল এখনো চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনালের বিখ্যাত গোল হিসেবে স্মরণীয় ভক্তদের কাছে। পরের মৌসুমেই জিতেন লিগ টাইটেল, তৃতীয়বারের মত নির্বাচিত হন ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার। ২০০৬ বিশ্বকাপের পরই ফুটবলকে বিদায় বলে দেন জিজু। ফ্রান্সের হয়ে চতুর্থ সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলেছেন জিদান। ১৯৯৮ সালে জিতেছেন বিশ্বকাপ, ২০০০ সালের ইউরো জয়ের পাশাপাশি টুর্নামেন্ট সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতে নেন তিনি। ২০০৬ বিশ্বকাপ ফাইনালে ঢুসকান্ডে লাল কার্ড দেখেই জিদানের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সমাপ্তি, যদিও সেবার গোল্ডেন বল জিতেছিলেন জিদান।

ফুটবল ছাড়ার পর জিদান নাম লিখিয়েছেন কোচিংয়ে। খেলোয়াড়ি জীবনের মত কোচিংয়েও দারুণ সফল ফ্রেঞ্চ তারকা। ২০১৩ সালে মূলদলের কোচ আনচেলত্তির সহকারী ছিলেন। ২০১৪ সালে রিয়াল মাদ্রিদের 'বি' দল কাস্তিয়ার প্রধান কোচের দায়িত্ব পান জিদান। ২০১৫-১৬ মৌসুমের মাঝপথে রাফা বেনিতেজকে সরিয়ে টালমাটাল, বিধ্বস্ত এক রিয়াল মাদ্রিদের দায়িত্ব দেয়া হয় জিদানকে। দায়িত্ব নিয়েই যেন বদলে দিতে শুরু করলেন রিয়ালকে। দায়িত্ব নেয়ার সময় বার্সার চেয়ে ১২ পয়েন্ট পিছিয়ে থাকা রিয়াল মাদ্রিদ মৌসুম শেষ করে বার্সার চেয়ে এক পয়েন্ট পিছিয়ে থেকে। দায়িত্ব নেয়ার ছয় মাসের মধ্যেই ট্রফির দেখা পেয়ে যান জিদান, সেটাও আবার ইউরোপের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা।

ধীরে ধীরে রিয়াল মাদ্রিদ হয়ে উঠতে থাকল নিখুঁত, অসাধারণ। পরের মৌসুমে রিয়াল জিতে নেয় লিগ টাইটেল। সেই সাথে টানা দ্বিতীয় চ্যাম্পিয়নস লিগ, উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ নামকরণের পর যা করতে পারে নি আর কোন ক্লাব। পরের মৌসুমে সবাইকে হতবাক করে আবারো চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতে রিয়াল। প্রথম কোচ হিসেবে টানা তিন চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের কৃতিত্ব আছে জিজুর। এর পাশাপাশি কোচ হিসেবে রিয়ালের হয়ে জিদান জিতেছেন ১ টি লা লিগা, ২ টি সুপারকোপা, ২ টি উয়েফা সুপার কাপ, ২ টি ক্লাব বিশ্বকাপ। এখন পর্যন্ত কোনো টুর্নামেন্টের ফাইনালে কোচ হিসেবে হারেন নি জিদান। সবচেয়ে বড় কথা রাফা বেনিতেজের পর দায়িত্ব নিয়ে তেমন বড় কোন ট্রান্সফারও করেন নি। কার্যকরী, তরুণদের বেশি সুযোগ দিয়েছেন, পুরো স্কোয়াডকে খেলিয়েছেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, বিশ্রাম দিয়ে। সদ্ব্যবহার করেছেন রোনালদোর। খেলোয়াড়ি জীবনে দারুণ সফল জিজু কোচিংয়ে এসেও লিখেছেন রূপকথার গল্প, একদম যেন এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। ২০১৮ সালের ৩১ শে মে তৃতীয় চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের পাঁচ দিন পর রিয়াল মাদ্রিদের কোচের পদ থেকে সরে দাঁড়ান জিদান।

পরের মৌসুমে হুলেন লোপেতেগুই, সান্তিয়াগো সোলারির পর ২০১৯ সালের ১১ই মার্চ আবারো রিয়ালের দায়িত্বে ফিরেন জিদান। রোনালদোর ক্লাব ছাড়ার পর পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে যেতে থাকা প্রিয় ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদকে ট্র‍্যাকে আনার দায়িত্বটাও এখনো জিদানের কাঁধেই। ভালো খেলোয়াড়ের পর ভালো কোচ হয়ে ইতোমধ্যে ভক্তদের মন জয় করে ফেলেছেন জিজু। জিদানের ভবিষ্যৎের জন্য রইল অনেক অনেক শুভকামনা।