ইউএস ওপেন, একটি দশক ও ফেদেরার
পোস্টটি ১৮৪০ বার পঠিত হয়েছে
ইউএস ওপেনে ফেদেরারের টানা পাঁচটি শিরোপার পর কেটে গেছে প্রায় ১২ বছর। এর মাঝে নতুন করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন ডেল পোত্রো, নাদাল, জোকোভিচ, মারে, সিলিক ও ভাভরিঙ্কা। কিন্তু অদ্ভুতভাবে কেউই ফেদেরারের পরে এখন পর্যন্ত টাইটেল ডিফেন্ড করতে পারেন নাই। ফেদেরারও ২০০৮ সালের পর আর ইউএস ওপেন জিততে পারেননি। গত ১০ বছরে শিরোপার সবচেয়ে কাছাকাছি এসেছিলেন ২০১৫ সালে। যেখানে ফাইনালে নোভাক জোকোভিচের কাছে পরাজিত হন।
ইউএস ওপেন বছরের শেষ গ্রান্ড স্লাম টুর্নামেন্ট। বছরের শুরু থেকে টুর্নামেন্টের আগ পর্যন্ত বেশিরভাগ প্লেয়ারই প্রায় ৪০/৫০ টি করে ম্যাচ খেলে আসেন। প্রায় সব প্লেয়ারই এই সময়টায় ক্লান্ত থাকে আর টুর্নামেন্ট জুড়ে ইঞ্জুরি প্রবণতাও দেখা যায়। এজন্য পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে অন্যান্য গ্রান্ড স্লামের মতো টপ সীডের প্লেয়ারদের ডমিনেন্স কম থাকে এবং উপরের র্যাঙ্কিং এর প্লেয়ারদের অপ্রত্যাশিত পরাজয় এর ঘটনা অন্যান্য গ্রান্ড স্লামের থেকে বেশি হয়ে থাকে। অন্যদিকে এই টুর্নামেন্ট যেই সময়টায় অনুষ্ঠিত হয় উত্তর গোলার্ধে তখন গ্রীষ্মকাল। গ্রীষ্মের তাপ দাহ গরম আর আদ্রতার সাথে 'আর্থার অ্যাশ' স্টেডিয়ামের বন্ধ ছাদ মিলিয়ে পুরো স্টেডিয়াম যেনো একটা তপ্ত ওভেন হয়ে ওঠে। দিন ও রাতের সেশনের মধ্যে স্টেডিয়ামের ভেতরের পরিবেশও পরিবর্তিত হয়, যার কারণে খেলোয়াড়দের রিদম ধরে রাখা বেশ কঠিন হয়ে দাড়ায়। এছাড়াও বর্তমানে ইউএস ওপেনের কোর্ট আগের তুলনায় বেশ ধীরগতির করে ফেলা হয়েছে। ফলে লম্বা র্যালি বা লম্বা ম্যাচের কারণে খেলোয়াড়দের পুরো টুর্নামেন্ট এ তাদের পারফর্মেন্সে প্রভাব পড়ে। মেডিক্যাল টাইম-আউট এর ঘটনা তো এখন হরহামেশাই দেখা যায়। ম্যাচ থেকে রিটায়ার করা বা ওয়াক-অভার দেওয়ার ঘটনাও অন্যান্য গ্রান্ডস্লাম থেকে বেশি দেখা যায়।
'ওপেন এরা'তে অন্যান্য গ্রান্ড স্লাম টুর্নামেন্টে কোনো সেট না হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ঘটনা থাকলেও ইউএস ওপেনে এখন পর্যন্ত কেউ এটি করে দেখাতে পারেননি। গত দুই দশকে ছেলেদের এককে কোনো সেট না হারিয়ে ফাইনাল পর্যন্ত যেতে পেরেছেন মাত্র দুইজন। ২০১০ সালের চ্যাম্পিয়ন রাফায়েল নাদাল সেমিফাইনাল পর্যন্ত কোনো সেট না হারালেও ফাইনালে একটি সেট হারেন। এরপর ২০১৫ সালে রজার ফেদেরার সব ম্যাচ সরাসরি সেটে জিতে ফাইনালে আসেন কিন্তু জোকোভিচ এর কাছে পরাজিত হন।
২০০৯ সালে ধারণা করা হচ্ছিলো ফেদেরার তার টানা ইউএস শিরোপা পাঁচ থেকে ছয়ে উন্নিত করতে যাচ্ছেন। কিন্তু দেল পোত্রো অসাধারণভাবে পাঁচ সেটের ফাইনাল জিতে নেন। ২০০৯ সালের চ্যাম্পিয়ন ডেল পোত্রো পরের বছরের টুর্নামেন্ট থেকে প্রত্যাহার করে নেন কব্জির ইঞ্জুরির কারণে। ২০০৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত প্রতিবছরই নতুন চ্যাম্পিয়ন পেয়েছে ইউএস ওপেন।
২০১০ সালে রাফায়েল নাদাল চ্যাম্পিয়ন হন আর রানারআপ হন জোকোভিচ। ২০১১ তে নোভাক জোকোভিচ প্রথম ইউএস ওপেন জেতেন নাদালকে ফাইনালে হারিয়ে। ২০১০ থেকে ২০১৩ এর মাঝে টানা চারটি ফাইনালে জোকোভিচ উঠলেও শিরোপার স্বাদ পান মাত্র একবার। ২০১২ তে অ্যান্ডি মারে জোকোভিচকে শিরোপাচ্যুত করেন প্রায় পাঁচ ঘন্টার ম্যারাথন ফাইনালের পর। পরের বছর মারে কোয়ার্টার ফাইনালে স্তান ভাভরিঙ্কার কাছে হেরে যান। চ্যাম্পিয়ন হন নাদাল (২০১৩)। ২০১৪ তে নাদাল ইঞ্জুরির কারণে শেষ মুহূর্তে টুর্নামেন্ট থেকে সরে দাঁড়ান।
২০১৪ সালের ইউ এস ওপেন এ ফাইনালে ম্যারিন সিলিক, কেই নিশিকোরিকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হন। ২০১৫ সালে সিলিক জোকোভিচের কাছে সেমিফাইনালে সরাসরি সেটে হেরে যান। ফাইনালে জোকোভিচ ফেদেরারকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হন। পরের বছর ২০১৬ তে টুর্নামেন্ট জুড়েই জোকোভিচকে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছিলো। জোকোভিচ ফাইনালে প্রথম সেট জিতলেও পরের তিন সেটে ভাভরিঙ্কার কাছে হেরে যান। ফাইনালে তো এক পর্যায়ে দাঁড়াতেই বেশ কষ্ট হচ্ছিলো তার। খেলার মাঝে দুইবার মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট এর জন্য টাইম আউট চেয়ে নিয়েছিলেন।
২০১৭ তে ভাভরিঙ্কার হাটুর ইঞ্জুরির জন্য উইম্বলডনের পরেই তার সিজন শেষ হয়ে যায়। ফাইনালে নাদাল তার তৃতীয় ইউএস ওপেন শিরোপা জেতেন। ২০১৮ তে নাদাল সেমিফাইনালে রিটায়ার করেন। ফাইনালে দেল পোত্রোকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হন জোকোভিচ। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৯ এ জোকোভিচ চতুর্থ রাউন্ডে ভাভরিঙ্কার বিপক্ষে রিটায়ার করেন। ফাইনালে নাদাল, ড্যানিয়েল মেদভেদেভ'কে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হন।
একটা সময়ে ইউএস ওপেন মানেই ছিলো রজার ফেদেরার এর একক কতৃত্ব। ২০০৪ থেকে ২০০৯ এর ফাইনাল এর আগে পর্যন্ত টানা ৪০ ম্যাচ জিতেছিলেন। এর মাঝে পাঁচ সেটের ম্যাচ খেলতে হয়েছিলো দুইটি, একটি সেই ২০০৪ সালের কোয়ার্টার ফাইনালে আন্দ্রে অ্যাগাসি'র সাথে। পরেরটি ২০০৮ সালে চতুর্থ রাউন্ডে আগোর আন্দ্রিভ এর বিপক্ষে। জিতেছেন টানা পাঁচটি ইউএস ওপেন শিরোপা। ওপেন এরা'তে যা আর কেউ করতে পারেনি এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট চিন্তা করলে কারোর পক্ষে ভাঙ্গা বেশ কঠিন। কিন্তু এরপর আর একবারও এই শিরোপা জিততে না পারা ফেদেরারের জন্য একটা আক্ষেপেরই বিষয়।
গত দশকের শুরুতে ফেদেরার ২০১০, ২০১১ সালে টানা দুইটি সেমিফাইনাল জোকোভিচের কাছে হেরে যান। যেখানে ২০১১ সালের সেমিফাইনালে প্রথম দুই সেট জেতার পরেও শেষ তিনটি সেট হেরে ম্যাচ হেরে যান। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে অসাধারণ খেললেও ফাইনালে এসে আবার জোকোভিচ এর কাছে পরাজিত হতে হয়।
২০১৭ তে পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই পিঠের ইঞ্জুরি বেশ ভুগিয়েছে ফেদেরারকে। এর মাঝেই প্রথম ও দ্বিতীয় রাউন্ডে দুইটি পাঁচ সেটের ম্যাচ খেলার পর কোয়ার্টার ফাইনালে এসে দেল পোত্রো'র কাছে হেরে যান। পিঠের ইঞ্জুরির জন্য ফেদেরার ২০১৬ সালেও টুর্নামেন্ট স্কিপ করেছিলেন। ২০১৪ তে সেমিফাইনালে সিলিকের কাছে সরাসরি সেটে হেরে যান। ২০১৮ তে চতুর্থ রাউন্ডে অস্ট্রেলিয়ার জন মিলম্যানের কাছে এবং ২০১৯ এ কোয়ার্টার ফাইনালে গ্রেগর দিমিত্রভের কাছে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিতে হয়।
ফেদেরারের বয়স এখন চলছে ৩৮। আগস্টের ৮ তারিখে পা রাখবেন ৩৯ এ। এ বছরের প্রথমের দিকে হাঁটুর অস্ত্রোপচার থেকে সেরে উঠার জন্য ২০২০ সালের সকল টুর্নামেন্ট থেকে সরে এসেছেন। অর্থাৎ আগামী বছর যদি ইউএস ওপেনে অংশগ্রহণ করেন তখন ফেদেরারের বয়স হবে ৪০। ইউএস ওপেনের শিরোপা আরেকটিবার কি তুলে ধরতে পারবেন কি না সে আলোচনা তোলাই থাকুক। কিন্তু নিউইয়র্কবাসীদেরকে অন্তত একটিবার সম্ভাব্য 'ফেদেরার-নাদাল' ম্যাচ দেখার জন্য আরো এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। কেননা বাকি তিনটি গ্রান্ড-স্লামে তাদের দেখা হলেও ইউএস ওপেনে যে এখনো পর্যন্ত তারা মুখোমুখি হননি।
বছরের শেষ গ্রান্ড স্লাম, স্লো হয়ে যাওয়া কোর্ট, লম্বা র্যালীর ম্যাচ, গরম আবহাওয়া, বছরের দ্বিতীয় ভাগে ইঞ্জুরির প্রবনতা বেশী থাকা, টুর্নামেন্ট জুড়ে ক্লান্তি ধরে বসা, ম্যাচের মাঝে ছন্দপতন এবং আরো বেশ কিছু প্রতিকূলতার কারণে গত কয়েক বছরে ইউএস ওপেন অন্যতম কঠিন টুর্নামেন্টে হয়ে উঠেছে। বর্তমান খেলোয়াড়দের মধ্যে শুধুমাত্র ফেদেরার ইউএস ওপেনে টানা চ্যাম্পিয়ন হলেও 'ওপেন এরা' যুগে আরো বেশ কয়েকজন এই টুর্নামেন্টে টানা চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন।
জন ম্যাকেনরো - ১৯৭৯, ১৯৮০,১৯৮১
জিমি কনর্স - ১৯৮২, ১৯৮৩
ইভান লেন্ডেল - ১৯৮৫, ১৯৮৬, ১৯৮৭
স্টেফান এডবার্গ - ১৯৯১, ১৯৯২
পিট সাম্প্রাস - ১৯৯৫, ১৯৯৬
প্যাট রাফ্টার - ১৯৯৭, ১৯৯৮
রজার ফেদেরার - ২০০৪, ২০০৫, ২০০৬, ২০০৭, ২০০৮
- 0 মন্তব্য