নাগেলসমান এর নান্দনিকতায়
পোস্টটি ২৩৩৮ বার পঠিত হয়েছেবয়স মাত্র ৩৩। কত খেলোয়াড়ই তো এই বয়সে খেলে গেছেন সাফল্যের সাথে। খেলোয়াড় হিসাবে এখনো থাকলে হয়তো আজ সেন্টার ব্যাক হিসাবে নেইমার কিংবা এমবাপ্পেকে মার্ক করার গুরু দায়িত্ব তার কাঁধেই থাকতো। কিন্তু হাঁটুর ইনজুরির কারণে মাত্র ১৯ বছর বয়সেই খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি টানতে বাধ্য হয়েছিলেন। শুরু করেছিলেন কোচিং জীবন। আর তাতেই করে ফেলেছেন রেকর্ড। সর্বকনিষ্ঠ কোচ হিসাবে পৌঁছে গেছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমি ফাইনালে। বলছিলাম আরবি লাইপজিগ এর কোচ ইউলিয়ান নাগেলসমান এর কথা। ১৮৯৯ হফেনহেইম এর সহকারী কোচ থাকাকালে গোলরক্ষক টিম ভিসে তাকে অভিহিত করেছিলেন “মিনি মরিনহো” নামে।
অগসবার্গে পিএসজি এর বর্তমান কোচ টমাস তুখেলের সহকারী হিসাবে কোচিং ক্যারিয়ার শুরু। এরপর হফেনহেইমে সফল তিন মৌসুম কাটিয়ে চলতি মৌসুমেই লাইপজিগে এসে চমক দেখালেন। দলকে তুললেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমি ফাইনালে। সেমিতে মুখোমুখি হবেন তার একসময়কার গুরু টমাস তুখেলের। গুরু মারা বিদ্যা শেষ পর্যন্ত কতটুকু দেখাতে পারবেন তা সময়ই বলে দেবে। তবে তার আগে নাগেলসমানের ট্যাকটিকস নিয়ে কিছু ধারণা নেওয়া যাক।
ফর্মেশন এবং ট্যাকটিকসে ক্রমাগত পরিবর্তনঃ
কোচ ইউলিয়ান নাগেলসমান এর সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব খুব সম্ভবত প্রতিপক্ষ অনুযায়ী এবং ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে ক্রমাগত নিজের ফর্মেশন এবং ট্যাকটিকসে পরিবর্তন আনা। এই সিজনে এখন পর্যন্ত দলকে ৪-৪-২, ৩-৫-২, ৪-২-২-২, ৫-৩-২, ৩-৪-২-১, ৩-৩-৩-১ এরকম বিভিন্ন ফর্মেশনে খেলিয়েছেন। তবে এটি নির্ভর করে মূলত নাগেলসমান দলকে থ্রি ম্যান ব্যাক সিস্টেমে নাকি ফোর ম্যান ব্যাক সিস্টেমে খেলাবেন তার উপর।
ফোর ম্যান ব্যাক সিস্টেমে লাইপজিগ
থ্রি ম্যান ব্যাক সিস্টেমে লাইপজিগ
যদিও ৪-২-২-২ এবং ৩-৫-২ এই দুই ফর্মেশনেই বেশী খেলিয়েছেন দলকে কিন্তু সবই নির্ভর করে প্রতিপক্ষের সম্ভাব্য ট্যাকটিকসের উপর। সর্বশেষ অ্যাটলেটিকোর বিপক্ষের ম্যাচেই দেখুন না। সিমিওনের দলের ভার্টিক্যাল প্রেসিং সামাল দিতে ৩-৩-৩-১ এ নামালেন দলকে।
অ্যাটলেটিকোর বিরুদ্ধে ৩-৩-৩-১ ফর্মেশনে
দলকে কতটা রোটেশন করে খেলান তার প্রমাণ পাওয়া যাবে পরিসংখ্যান একটু ঘাঁটলেই। এই মৌসুমে সব ধরণের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে লাইপজিগের হয়ে স্টার্ট করেছেন ২৬ জন। আর কমপক্ষে ১০ ম্যাচে শুরুর একাদশে ছিলেন এমন খেলোয়াড়ের সংখ্যা ১৮ জন।
অ্যাটাকিং বিল্ডআপঃ
ইউলিয়ান নাগেলসমান এর দল খেলা সবসময় ডিফেন্ডার থেকেই বিল্ডআপ করতে শুরু করে। শর্ট পাসিং ই বিল্ডআপের ক্ষেত্রে মূল শক্তি। শুধুমাত্র হাই প্রেসিং করে এমন দলের বিরুদ্ধে খেলার সময়েই লং পাসে খেলিয়ে থাকেন দলকে। বুন্দেসলিগায় এই সিজনে দলগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন লং পাসের রেকর্ডও এই সাক্ষ্যই দেয়।
নাগেলসমান এর বিল্ডআপ কে আপনি তুলনা করতে পারেন সিম্ফনির সাথে। প্রথমে থাকবে লাইট ভায়োলিন এবং বেস ড্রাম এর গভীর টেম্পো। যা দর্শককে আচ্ছন্ন করবে শান্ত ও স্নিগ্ধ মোহনীয়তায়। তারপর হুট করেই হাজারো ড্রাম এবং ইলেকট্রিক গিটারের সমন্বয়ে হেভি মেটাল। একইরকম লাইপজিগ নিজেদের মধ্যে ছোট কিছু পাস খেলে খুব দ্রুত খেলার গতি পরিবর্তন অল্প কয়েকটি পাসের মাধ্যমে আক্রমনে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে প্রতিপক্ষ কিছু বুঝে উঠার আগেই। বিল্ডআপের সময় দুই উইং কিংবা ফুলব্যাক কিছুটা উপরে উঠে যান এবং দুইজন সেন্টারব্যাক দুইপাশে কিছুটা সরে এসে বল প্লেয়িং এর কাজ করেন। এক্ষেত্রে একজন সেন্টার মিড কিছুটা নিচে নেমে পাসিং অপশন বাড়াতে সহায়তা করেন। ফলে ডিফেন্ডার এর কাছে ফুলব্যাক, সেন্টার মিড এবং ফরোয়ার্ড, তিনটি পাসিং অপশন থাকে।
নিচ থেকে খেলা বিল্ড আপ করছেন ডিফেন্ডার
কিন্তু যদি কোনোভাবে ওই ডিফেন্ডার এর পাসিং লেন ব্লক করে দেয় প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়, বল সুইচ করে অপর পাশের সেন্টার ব্যাককে বল পাস করে দেন। এই ডিফেন্ডারও আবার একইভাবে খেলার বিল্ডআপ করেন।
বল শিফট করে অন্য সেন্টারব্যাক এর বিল্ড আপ শুরু
বুন্দেসলিগায় লাইপজিগ এর তরুণ ফ্রেঞ্চ ডিফেন্ডার ঊপামেকানোর পাস সংখ্যা প্রতি ৯০ মিনিটে ৭৪ টি। নাগেলসমান এর খেলার বিল্ড আপের জন্যে ডিফেন্ডাররা কততা গুরুত্বপূর্ণ তা এ থেকে বোঝাই যায়।
ডাবল পিভটের ব্যবহারঃ
হফেইনহেম এর কোচ থাকাকালীন নাগেলসমান একজন হোল্ডিং মিডফিল্ডার ব্যবহার করতেন। তবে লাইপজিগের হয়ে থ্রি ম্যান বা ফোর ম্যান যেই ব্যাক সিস্টেমেই খেলান না কেন, ডাবল পিভট সিস্টেমে দুইজন মিডফিল্ডার খেলানোটা অব্যাহত রাখেন। এই দুইজন আবার কখনো একই লাইনে থাকেন না। বল পজেশনে থাকলে একজন কিছুটা এডভান্স পজিশনে এবং আরেকজন ডিপার পজিশনে গিয়ে ট্রায়াঙ্গেল তৈরি করে পাসিং লেইন বাড়ান।
ডাবল পিভট এর একজন এডভান্স ও একজন ডিপার রোলে
ডাবল পিভট একদিকে যেমন প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ড এবং মিডফিল্ডের মধ্যে পাসিং লেইন বন্ধ করে মিডফিল্ড জমাট রাখতে সহায়তা করেন, আবার এডভান্স পজিশনে শিফট করে রোটেশনাল ফুটবলেও সাহায্য করেন। নিচের ছবিতেই দেখুন না, বল যে প্লেয়ারের কাছে আছে, পিভটের একজন পজিশন পরিবর্তন করে তার মার্কারকে জায়গা থেকে সরিয়ে দিচ্ছেন। ফলে পিভটের অন্যজন ফাঁকা জায়গা পেয়ে যাবেন। এর ফলে একদিকে যেমন বল মাঠের আরেকপাশে পাঠানোর জায়গা সহজে পাওয়া যাচ্ছে, আবার ভার্টিকেল পাসিং এর জন্যেও নতুন একজন অপশন যোগ হচ্ছে।
ডাবল পিভটের একজন সরে এসে আরেকজনকে ফাঁকা করে দিচ্ছেন
ভার্টিক্যাল ট্রানজিশনঃ
নাগেলসমান এর ট্যাকটিকসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল ভার্টিকাল ট্রানজিশন। বলের দখল পাওয়ার পর ল্যাটারাল পাসিং এর চেয়ে ভার্টিকাল পাসিংই অগ্রাধিকার দেন বেশী। এসময় ফরোয়ার্ড এবং উইং ব্যাক রা মিলে প্রতিপক্ষের ডিফেন্সিভ এবং মিডফিল্ড লাইনের মাঝখানে উঠে অ্যাটাকিং থার্ডে ওভারলোড সৃষ্টি করেন।
প্রতিপক্ষের দুই সারি ডিফেন্সিভ শিল্ড এর মাঝখানে ওভারলোড তৈরি
এরপর দ্রুতগতির কিছু ওয়ান টাচ ফুটবল এবং প্রতিপক্ষ কিছু বুঝে উঠার আগেই বিহাইন্ড দ্যা ডিফেন্স এ এক ফরোয়ার্ডের রান এবং একজন প্লে মেকারের থ্রু বল। স্লো টেম্পো থেকে হুট করে হেভি মেটাল এবং গোলের সুযোগ।
মুহুর্তের ভার্টিকাল ওয়ান টাচ পাসের মাধ্যমে স্পেস তৈরি
এরকম হঠাত খেলার গতি পরিবর্তন করে ভার্টিকাল ট্রানজিশনে নাগেলসমান এর শিষ্যরা এতই দক্ষ হয়ে গেছেন যে প্রতিপক্ষ ছাতার মত ঘিরে থাকলেও মুহুর্তে জায়গা বের করে গোলের সুযোগ তৈরিতে সক্ষম তারা। নিচের ছবিতেই দেখুন, প্রতিপক্ষের দশজন খেলোয়াড় ডিপ ব্লকে এসে ডিফেন্স করছেন। ডিফেন্ডার প্রথমে ভার্টিকাল পাস দিলেন ফরোয়ার্ডকে, ফরোয়ার্ড ব্যাকপাস করে প্লেমেকার কে এবং প্লেমেকারের ডিফেন্সচেরা থ্রু থেকে অপর ফরোয়ার্ডের গোলের সুযোগ। প্রতিপক্ষ কিছু বুঝে উঠার আগেই মাত্র তিনটি পাস খেলেই গোল।
প্রতিপক্ষের ডিপব্লক ডিফেন্স এর মাঝেও গোলের সুযোগ তৈরি
নাগেলসমান এর দল আক্রমণের শুরু টা হাফস্পেস বা উইং দিয়ে করলেও ন্যারো ফর্মেশনের কারণে চুড়ান্ত শট সেন্টার থেকে নিতেই পছন্দ করে। হুস্কোরড এর তথ্য অনুযায়ী বুন্দেসলিগা ১৯-২০ মৌসুমে লাইপজিগের মোট আক্রমণের ৭৩% এর সূচনা দুই পাশ থেকে হলেও মোট শটের ৭১% ই নিয়েছে সেন্টার স্পেস থেকে।
আরবি লাইপজিগের অ্যাটাক স্ট্যাটিসটিকস
আরবি লাইপজিগের শট স্ট্যাটিসটিকস
ভার্টিকাল ট্রানজিশনের সময় আরেকটা বিষয় লক্ষণীয় যে দুই ফরোয়ার্ডের একজন (সাধারণত সদ্য চেলসিগামী ভার্নার) উইং এর দিকে সরে এসে তার মার্কার কে জায়গা থেকে সরিয়ে দেন এবং বল হোল্ড করেন। এই সুযোগে অপর ফরোয়ার্ড (পোলসেন কিংবা শিক) অথবা এটাকিং মিডদের একজন (সাবিৎজার, এনকুংকু কিংবা ফোরসবার্গ) ফাঁকা জায়গার সুযোগ নিয়ে থাকেন।
প্রতিপক্ষের ডিফেন্সের ফাঁকা জায়গার সুযোগ নিচ্ছেন অপর ফরোয়ার্ড
ভার্নারের ক্রিয়েট করা স্পেসের সুবিধা নিতে এনকুংকুর ফরোয়ার্ড রান
ফ্রন্টলাইন প্রেসিংঃ
ডিফেন্স এবং প্রেসিং এর সময় ইউলিয়ান নাগেলসমান পুরোপুরি জার্মান স্টাইল ফলো করেন। এই প্রেসিং এর পুরোভাগে থাকেন ফরোয়ার্ডরা। প্রতিপক্ষের কিপার কিংবা ডিফেন্ডারদের পায়ে বল থাকা অবস্থায়ই দুই ফরোয়ার্ড প্রেস শুরু করেন। সাথে পিছনে দুইজন মিড নিশ্চিত করেন যাতে ডিফেন্ডার থেকে মিড এর মধ্যে পাসিং লেইনও বন্ধ থাকে।
লাইপজিগের ফ্রন্টলাইন প্রেসিং
এর ফলে প্রতিপক্ষের হাতে থাকে দুইটি অপশন। হয় লং শট নিয়ে প্রতিপক্ষের সীমানায় বল পাঠাও, এতে বল লাইপজিগের দখলে আসার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অথবা বল দুই উইং এ পাঠাও। যেখানে আবার রাইটব্যাক কিংবা লেফটব্যাক প্রেস করার জন্যে তৈরি থাকেন। ফলে নিচ থেকে খেলার বিল্ড আপ করাটা লাইপজিগের বিপক্ষে কিছুটা কঠিনই হয়।
আবার খুব ভালো নাম্বার ৬ আছে, এমন দলের বিপক্ষে নাগেলসমান একজন অ্যাটাকিং মিড বেশী খেলান প্রতিপক্ষের ডিফেন্সিভ মিডের সাথে ম্যাচ করার জন্যে। এতে মিডে একদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছে, আবার একজন ফরোয়ার্ডকে একই সাথে উইং এ ঠেলে দিয়ে ওভারলোড তৈরি করছেন। এই অতিরিক্ত একজন মিডের প্রেসে প্রতিপক্ষ বল উইং এ পাঠালে দ্রুত কাউন্টার প্রেসিং করে বল নিজেদের দখলে নিয়ে পাল্টা আক্রমণ।
উইং ওভারলোড করে প্রেসিং
ইউলিয়ান নাগেলসমান যেরকম ক্রমাগত ট্যাকটিকস এবং ফর্মেশনে পরিবর্তন আনেন তাতে এমন কিছু খেলোয়াড় প্রয়োজন যাতে বিভিন্ন পজিশনে খেলতে পারেন। ক্লস্টারমানকে ফর্মেশন অনুযায়ী রাইটব্যাক কিংবা সেন্টার ব্যাক, লাইমার কে তার পছন্দের রাইটব্যাক পজিশন থেকে সরে এসে ডাবল পিভট হিসাবে, মুকিয়েলকে সেন্টার ব্যাকের যায়গায় রাইটব্যাক পজিশনে অহরহই দেখা যায়। আবার সাবিৎজার কিংবা এনকুংকু কে কখনো উইং বা কখনো অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসাবে পরিস্থিতি অনুযায়ী খেলাচ্ছেন। কোচের চাহিদা অনুযায়ী তারা যে নতুন পজিশনে মানিয়ে খেলতে পারছেন তার প্রমাণ হিসেবে মৌসুমে আরবি লাইপজিগের পারফরম্যান্স তো আছেই। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ট্যাকটিকসে আহামরি কোনো নতুনত্ব নিয়ে না আসলেও প্রতিপক্ষ অনুযায়ী সঠিক ট্যাকটিকসের ব্যবহার করে দলকে সাফল্য এনে দিয়েছেন নাগেলসমান।
ফুটবলবোদ্ধাদের মতে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ফুটবল ট্যাকটিকসে একটা বড় মাপের পরিবর্তন আসতে পারে যার পথিকৃৎ হিসেবে হয়তো থাকবেন ইউলিয়ান নাগেলসমান এর মতন তরুণ কোচরাই। গার্দিওলা মাত্র ৩৮ বছরে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছিলেন। আন্দ্রে ভিলাস-বোয়াস ইউরোপা লিগ জিতেছিলেন ৩৪ বছর বয়সে। ইউলিয়ান নাগেলসমান শেষ পর্যন্ত কি গার্দিওলা হবেন নাকি ভিলাস-বোয়াস এর মত সময়ের পরিক্রমায় হারিয়ে যাবেন তা ভবিষ্যতেই জানা যাবে। আপাতত সাধারণ ট্যাকটিকস এর অসাধারণ ব্যবহার উপহার দেওয়া নাগেলসমান এর নান্দনিক ফুটবলটাই উপভোগ করা যাক।
- 0 মন্তব্য