• ক্রিকেট

তুমি আসবে বলে.....!

পোস্টটি ২৭৮৫ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

নিস্তব্ধ এক সন্ধ্যা ছিল। আগের রাতেই একটা পত্রিকা থেকে জানতে পেরেছিলাম- ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত হতে যাচ্ছেন সাকিব আল হাসান। তড়িঘড়ি করে ইএসপিএন ক্রিকইনফো তে ঢুকে দেখলাম- কিছুই নেই! সেই রাতটা গেল অনিশ্চয়তার ঘোড়ায় চড়ে। অনিশ্চয়তায় কেটেছিল তার আগের কয়েক দিনও, তবে সে অনিশ্চয়তা ক্রিকেটের নবাবকে হারিয়ে ফেলার নয়, ভারত সফর হবে কিনা তার। কয়েকদিন আগে থেকেই ক্রিকেট পাড়ায় দাবি আদায়ের আন্দোলন চলছিল, নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন খোদ সাকিব আল হাসান। তার আগে তিনি কাটিয়ে এসেছেন স্বপ্নের মত এক বিশ্বকাপ, অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে করে এসেছেন এমন কিছু যা কোন চোখ কোনদিন দেখেনি, যা কোন কান কোনদিন শোনেনি, ক্রিকেট বিশ্বে কোন অলরাউন্ডার যা কোনদিন করেনি। সেই সাকিব আল হাসান নাকি নিষিদ্ধ হবেন!

সকালের ভোর দেখেই নাকি দিন চেনা যায়। পরদিন চিনে ফেলেছিলাম আগের মাঝ রাতেই। পরদিন কাটল ভীষণ উৎকণ্ঠায়। ক্রিকেটের সুপারম্যান নিষিদ্ধ হবেন? কেন হবেন? কত দিনের জন্যে হবেন?………  আসলেই এমন কিছু ঘটেছে?

সারাটাদিন অস্থিরতা,উৎকণ্ঠার পর অফিশিয়াল ঘোষণা- ফিক্সিং-এর প্রস্তাব না জানানোয় নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছেন সাকিব আল হাসান। সত্যি বলতে, সাকিবের মত স্মার্ট ক্রিকেটার ফিক্সিংএর প্রস্তাব পেয়ে জানাননি এটা যতটা দুঃখজনক, নামটা ‘সাকিব আল হাসান’ হওয়ায় শাস্তির মেয়াদ কম দিয়েছে আইসিসি- এসবও সত্যি।

তা যতটা সত্যিই হোক- সব সত্যির দুয়ার নীলনয়না হয়ে আসেনা, ক্রন্দনরতা হিসেবেও আসে। যেমনটা হয়েছে সাকিব আল হাসানের ক্ষেত্রে। একজন বাংলাদেশী ক্রিকেটপ্রেমী হিসবে ওরকম ফর্মে থাকা ক্যাপ্টেন সাকিব আল হাসানকে হারিয়ে ফেলার বেদনা আর কিছুর সাথেই তুলনাযোগ্য না। তখন স্রেফ মনে হচ্ছিল-

একটা বছর লাল সবুজ জার্সিতে একটা দল ক্রিকেট খেলবে , ব্যাটিং এ একটা উইকেট পড়ে যাবে, ক্রুশাল মোমেন্টে উইকেট নেওয়ার জন্যে একজন বোলার লাগবে, কিন্তু পিঠে ৭৫ লেখা কাউকে পাওয়া যাবেনা। কোন মানে হয়?

সাকিবের রেখে যাওয়া শূন্যস্থান পূরণে টি-২০ তে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে কাপ্তানী দেওয়া হয়েছে, টেস্টে ব্যাটন নিয়ে নিয়েছেন মুমিনুল হক। ওয়ানডেতে সাকিবের শূন্যস্থান পূরণের আগেই একটা শূন্যস্থান তৈরি করে দিয়েছেন মাশরাফি বিন মোর্ত্তজা।

এরপর থমকে দাঁড়িয়েছে বিশ্ব!

শূন্যস্থান পূরণের কথা বলছিলাম। কাপ্তানীটা বন্টন করা হলেও পারফর্মার সাকিব আল হাসানের আসন নিতে পারেনি আর কেউই। সাকিব যাওয়ার পর বাংলাদেশ ম্যাচ খেলেছে অনেক কম। এই কম ম্যাচেই যেমন কেউ তিন নম্বরে নেমে আশা জাগাতে পারেননি, বাঁহাতি স্পিনের ঐ আস্থাও দেখাতে পারেনি আর কোন বোলার। সাকিবের রেখে যাওয়া শূন্যস্থান থেকে গেছে ফাঁকাই।

এই ফাঁকা আসনের কথা বারবার মনে পড়েছে আমাদের। শুরুটা তো ঐ ভারত সফরেই। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে টস করতে দেখেই হঠাৎ মনে পড়ে- সাকিব আল হাসান আর থাকবনে না এক বছর। এরপরও যখন ইন্ডিয়ার মিডল অর্ডারের উইকেট পড়ছিল না, পার্ট টাইম বোলার দিয়েও কাজ হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল- ইশ যদি একজন সাকিব আল হাসান থাকত।

কিংবা ভারত সফরেই টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে যখন খেলতে গেল বাংলাদেশ। মনে পড়ছিল- এই টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ নিয়েই না রাসেল ডমিঙ্গোর সাথে কত আলোচনা হচ্ছিল সাকিবের? এই নিষেধাজ্ঞার মাসখানেক আগেই না শেরে বাংলায় সাকিবের সাথে আলোচনায় ছিলেন কোচ নির্বাচক উভয়েই? সেই টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপই মাঠে গড়াচ্ছে- নেই শুধু যাকে অধিনায়ক ভেবে সাজানো হচ্ছিল গোটা পরিকল্পনাটাই।

শুধু কি আমরা? মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ যখন দল সাজাচ্ছিলেন তিনিও কি মনে করেননি? সাকিব আল হাসান মানে একজন বাড়তি ব্যাটসম্যান কিংবা একজন বাড়তি বোলার পাওয়া। সাকিব আল হাসান দলে নেই মানে মাঠে একটা দারুণ উদ্যমী শরীর নেই, একটা ক্ষুরধার মস্তিষ্ক নেই- তাতে তিনি অধিনায়ক হন আর না হন। এমনকি ইডেন গার্ডেনে যখন টেস্ট খেলছে নামছে বাংলাদেশ , মুমিনুল হক কিংবা রাসেল ডমিঙ্গো কি ভাবেননি সে খেলোয়াড়টাই তার দলে নেই- এই ইডেন গার্ডেন যার সবথেকে বেশি চেনা!

কিংবা তারও মাস কয়েক পর মাশরাফি বিন মোর্ত্তজা যখন টসে নামলেন, টিমশিট হাতে তিন নম্বরে বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেওয়া সেই বিশ্বকাপবাজির খেলোয়াড়কে তিনি মনে করেননি? অথবা ধরুন, যখন তিনি ছেড়ে দিলেন অধিনায়কত্ত্বের  ব্যাটন , সেই ব্যাটন হাতে নেওয়ার জন্যে সবচেয়ে যোগ্য হাতটাকে তিনি হাতড়ে খোঁজেননি?

সাকিব আল হাসান এমনই। চলে যাওয়ার সময় তিনি ছিলেন আইসিসি অলরাউন্ডার র‍্যাংকিং-এ সেরাদের কাতারে। নিষেধাজ্ঞার সাথে সাথে আইসিসি তার নাম মুছে ফেলেছে লিস্ট থেকে, এরপর বেন স্টোকস নিজের অলরাউন্ডার স্বত্তাটা আরো বড় করে চেনাতে শুরু করেছেন, ক্রিকেট থেমে যাওয়ার আগে মোহাম্মদ নবীও উঠেছেন্ অলরাউন্ডার র‍্যাংকিংএ ওপরে । তবে এদের কেউই কি আর এই যুগে সাকিব আল হাসানের কাতারে পড়েন? তর্কযোগ্যভাবে সাকিব আল হাসানের সাথে হয়ত বেন স্টোকসের তুলনা আমরা দিতে পারি, কিন্তু শেন ওয়াটসনের অবসরের পর সাকিব তার প্রতিদ্বন্দী আর পাননি, আইসিসি অলরাউন্ডার র‍্যাংকিং-এর নামগুলির দিকে তাকালেই তা পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা।

একটা তথ্য দিই। ক্রিকেট সর্বশেষ ভরা গ্যালারীর ম্যাচ দেখেছে শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়াম, মিরপুরে। এই মিরপুরেই এক বিকেলের সংবাদ সম্মেলন দিয়ে শুরু হয়েছিল এই অপেক্ষার।

শুরুতেই বলেছি, নিস্তব্ধ এক সন্ধ্যা ছিল। বিসিবির সাথে সাকিবের অবস্থান তার কিছুক্ষণ আগ অব্দি ‘মুখোমুখি’ । সারাটা দিনের পর সূর্য যখন অস্ত গেল, আইসিসি আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিল তাদের সিদ্ধান্ত। বিসিবির সাথে বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে দাঁড়ালেন সাকিব আল হাসান, পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন নাজুমুল হাসান পাপন। সাকিবকে দেখেই বুঝতে পারছিলাম তার মনের অবস্থা, চোয়াল কেমন শক্ত, পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলে চলেছেন বিসিবি সভাপতি, চুপচাপ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন সাকিব আল হাসান। ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে কেউ যদি নিষিদ্ধ হয়, তবে আর কেমনই বা লাগতে পারে?

তবে এও সত্যি, শাস্তিটা সাকিব আল হাসানের প্রাপ্য ছিল, যেমনটা উচিত ছিল ফিক্সিং এর প্রস্তাব পেয়ে আইসিসি কে জানানো। এই শাস্তি বরং আরো বেশিই হতে পারত। তাহলেও সেটাকে ‘অনৈতিক’ কিংবা ‘ভুল বিচার’ বলার কোন উপায় ছিল না। তবুও, নামটা তো সাকিব আল হাসান। ক্রিকেট দেবী যাকে তৈরি করেছেন ক্রিকেটের সবচেয়ে খামখেয়ালী এক যুবক হিসবে। যে যুবক চাইলেই এক বিশ্বকাপে ক্রিকেট রেকর্ডের সব খেরোখাতা পাল্টে দিতে পারেন ব্যাটের জাদুতে, পারেন সাউথ আফ্রিকার ঘাসে নিজের স্পিন ভেলকি দেখাতে, আবার যে যুবক নিশ্চিত জয়ের টেস্টে মইন আলীর বলে দিনের শুরুতেই ক্যাচ তুলে দিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ব্যাট দোলাতে দোলাতে ফিরে আসেন ড্রেসিং রুমে….দলকে ম্যাচ হারিয়েই!

ক্রিকেট দেবীর সেই ‘চাইলেই করতে পারি যেকোন কিছু’ ছেলেটা নির্বাসনে চলে গেল!

সাকিব আল হাসানের নির্বাসনের সাথে সাথে পুরো বিশ্বও নির্বাসনে চলে গেল কয়েক মাস পরেই। একটা আস্ত এশিয়া কাপ , গোটা কয়েক সিরিজ আর টি-২০ বিশ্বকাপ সাকিব আল হাসানকে মিস করতে হয়নি। সে কারণে হয়ত আমরাও সাকিবের অনুপস্থিতিটা এই কয়েকটা সিরিজে অনুভব করেছি কম।

তারপর? তারপর মাশরাফি বিন মোর্ত্তজা চায়ের শহরে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিলেন, ,মহেন্দ্র সিং ধোনী আকস্মিকভাবে ছেড়ে দিলেন গোটা ক্রিকেটটাই, করোনা ভাইরাসে স্থবির হয়ে গেল বিশ্ব, নাড়ির টান বার্সা ছাড়তে চাইলেন লিওনেল মেসি, ফ্রেঞ্চ ওপেনে জোকোভিচকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হলেন রাফায়েল নাদাল, আইপিএল এর সাথে মাঠে ফিরেছে শেরে বাংলার ক্রিকেট-  তবুও ফেরেননি সাকিব।

তবে এবার….. নটে গাছটি মুড়িয়েছে, নির্বাসনের গল্পটি ফুরিয়েছে। ফুরিয়েছে আমাদের অপেক্ষার পালা, যে অপেক্ষায় আমরা হয়ে ছিলাম তৃষ্ণার্ত চাতকের মত। চাতকের অপেক্ষা সিদ্ধিতে সাকিব আল হাসানও হয়ে উঠুন ফিনিক্স পাখির মত নিজেকে পালটে দেওয়া যোদ্ধা।

শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়াম যেদিন শেষবার ছেড়ে গেলেন সাকিব আল হাসান, সংবাদ সম্মেলন শেষে দেখা গেল ঠোঁটের কোণায় এক টুকরো হাসি। এই হাসি আনন্দের নয়, ভীষণ আক্ষেপের। সাকিব আল হাসানের ঠোঁটে এই হাসি মানায় না, এই হাসি আমরা আর দেখতে চাইনা।  

‘তুমি আসবে বলে’ তো এটাই আমাদের চাওয়া….. সাকিব আল হাসান!