ক্রিকেট দর্শকের ম্যারাডোনা মুগ্ধতা
পোস্টটি ১২১১ বার পঠিত হয়েছে'ক্রিকেটে শচীন ফুটবলে ম্যারাডোনা। ওফ!'
শৈশবে শোনা এক বাংলা ছায়াছবির সংলাপ। সিনেমার নাম, গল্প, কলাকুশলী কিছুই মনে নেই। শুধু সংলাপ আর অভিনেত্রী মনে আছে। তাও মনে থাকার কারণ, সেই অভিনেত্রীর সংলাপ বলার হাস্যকর ঢঙ ও কিম্ভূতকিমাকার অভিব্যক্তি। তারপর সেই অনুকরণে ঘরোয়া আড্ডার কত প্রহরে হেসে উঠা হয়েছে!
শুক্রবারের দুপুর পুরো বিল্ডিং যেন বিটিভিময়। যারা নতুন ডিশ সংযোগ নিয়েছেন, সেই তারাও বিটিভির বাংলা ছায়াছবির প্রেম ছাড়তে পারেন না। শুক্রবারে ঠিক দেখেন।
ম্যারাডোনা-উত্তর সময়ে ক্রিকেট খেলায় শচীন মহাতারকা। 'ওরে ভাই শচীন এলো' বিজ্ঞাপনে শচীনের স্ট্রেইট ড্রাইভ আম্পায়ারের ক্যাপ-সহ উড়িয়ে নেয়। শচীনের সঙ্গে ইনিংসের উদ্বোধন করেন সৌরভ গাঙ্গুলি। সেই সৌরভ আবার শচীনকে ডাকতেন 'ক্রিকেটের ম্যারাডোনা' বলে। সৌরভের ফুটবল প্রেমের অনেকট জুড়ে ম্যারাডোনা আছেন, তিনি একবার পাজর চেপে শুয়ে পড়তে বাধ্য হন শোয়েবের লাফিয়ে উঠা গোলার আঘাতে। শোয়েব তখন গতির রাজা। রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস। বছর কয়েকের মধ্যে বাংলাদেশও একজন 'এক্সপ্রেস' পেয়ে গেল। নড়াইল এক্সপ্রেস। মাশরাফি মর্তুজা। তিনিও গতি ভালোবাসেন। ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি এন্ডি রবার্টস মুগ্ধ নড়াইল এক্সপ্রেসে। মাশরাফি মুগ্ধ অন্যজনে, নড়াইলে কাটানো শৈশবের উত্তুঙ্গ দিনগুলোয় তিনি মজেছিলেন ম্যারাডোনায়। ম্যারাডোনার দেশ আর্জেন্টিনা ফেভারিট তার। তাই প্রিয় দলের বিশ্বকাপ ম্যাচের দিন, বোর্ড পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে পড়েন উত্তরপত্র অর্ধেক লিখেই। প্রিয় দলের ম্যাচ মিস করা যাবে না। এই পাগলামো ধরণের ভালোবাসার কারণ ঐ একজনই-- ম্যারাডোনা।
ক্রিকেটের দুই দুইটা বিশ্বকাপ প্রবল আগ্রহে দেখে ফেললেও ফুটবলে আগ্রহ হয়নি খুব একটা। জাপান-কোরিয়া বিশ্বকাপ ম্যাচ দুপুরের দিকে হয়, বা বিকেলে। ফাঁকে ফাঁকে এক-আধটু দেখা। পতাকার ছড়াছড়ি, সমর্থকদের রেষারেষি দেখা হয়। পাড়ার খেলাধুলায় কেউ পাস না দিলে বা বল নিয়ে একা এগোলে বা মাত্রাতিরিক্ত কারিকুরি দেখালেই বিরক্তি মেশানো ঝাঁজ নিয়ে তাকে বলা হয়-- ম্যারাডোনা হয়েছিস নাকি তুই? বল নিয়ে যত কারিকুরি আর একা এগুনো কেবল ম্যারাডোনার জন্যেই বরাদ্দ। অন্য কারো সঙ্গেই যেন তা যায় না!
নতুন এক ফুটবলারের আবির্ভাব হয়েছে বিশ্বে। খেলেন অনেকটা ম্যারাডোনার মতো। লিওনেল মেসি।
মাশরাফি আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে গেলেন সাকিবের পাড়ায়। সাকিব তখন খুব ছোট। মাশরাফি তখন তারকা। সাকিব সেই 'নতুন ম্যারাডোনা' খ্যাত মেসি-ভক্ত।
জার্মানি-বিশ্বকাপ, ২০০৬। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে বুঁদ হওয়া। ম্যারাডোনায় মজে যাওয়া। একটা লোক কতটা প্রভাববিস্তারি ও অনন্য চরিত্র হলে ম্যারাডোনা-উত্তর প্রজন্মের কৈশোরেও আলোড়ন তুলতে পারেন?
কোডেসালকে ক্ষমা করা হয় না কোনোদিন, তার প্রশ্নবিদ্ধ রেফারিংয়ে যে দ্বিতীয়বারের মতো ট্রফি তোলা হয় না ম্যারাডোনার! লোথার ম্যাথিউস হয়ে যান অপছন্দের একজন, উঁচিয়ে ধরা দু'হাত ম্যারাডোনার না হয়ে তার হয়েছে যে! জার্মানির জন্য বরাদ্দ থাকে বিতৃষ্ণা, ওদের কারণে ম্যারাডোনার আকাশে-নীল বঞ্চিত হলো যে! কিশোর বুকে স্থায়ী আসন গাড়েন বহু বছর আগে খেলা ছাড়া একজন, যাকে সরাসরি দৌড়তে না দেখেও পৃথিবীতে মুগ্ধ হয় কেউ কেউ। যার অনিয়ন্ত্রিত ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনাচার পরও গণমানুষের প্রিয় চরিত্র তিনি। মানুষ তার জন্য কাঁদে, মানুষ তার জন্য অনুভব করে।
ম্যারাডোনা কোচ হয়েছেন স্বদেশের। মেসির সঙ্গে জুটি বেঁধেছেন। আর্জেন্টাইন সমর্থকদের বুক ভরা আশা বসত গেড়েছে। গুরু-শিষ্য একত্রে মিলেমিশে 'মেসি-ডোনা' হয়েছেন। ডাগআউটে কেমন সব পোষাক পরে উপস্থিত হন! তার মেয়ে নাকি তাকে স্যুটেড বুটেড করে তৈরী করে দেন। তিনি মেয়ের আদেশ-নিষেধ মেনে নেন বিনাশর্তে। যেন এক ছোট্ট শিশু। শিশুই তো, ম্যারাডোনা বুড়ো হয়েছিলেন কবে?
মেসি-ডোনা বিশ্বকাপ হতে ফেরেন শূণ্য হাতে। সেই বিশ্বকাপের ডামাডোলেই বাংলাদেশ হারিয়ে দেয় ইংল্যান্ডকে। মাশরাফি নেতৃত্বে তখন, শফিউলের জাদুকরি শেষ ওভারে ৫ রানের জয়। মাশরাফির ম্যারাডোনা-প্রেম জানা আছে, শফিউলেরটা জানা নেই। সেই ইংল্যান্ড, যাদের বিপক্ষে হাত দিয়ে গোল করাকে 'হ্যান্ড অব গড' অভিহিত করেছিলেন ম্যারাডোনা। শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ গোলটির সৃষ্টিও মিনিট কয়েকের ভেতর।
ইংল্যান্ড প্রতিপক্ষ ছিল শেন ওয়ার্নেরও। 'বল অব দ্য সেঞ্চুরি' অবশ্য বয়সে ছোট 'গোল অব দ্য সেঞ্চুরি'র চেয়ে। ওয়ার্ন আর ম্যারাডোনাতে আর কত মিল! নিয়ম ও শৃঙখলাকে বরাবরই বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়েছেন দু'জনে, কিন্তু নিজের কাজে ছিলেন আনপ্যারালাল জিনিয়াস। অন্য যে কারো চেয়ে অনেকটা এগিয়ে থাকা চরিত্র। মাদক ও নারী; দুইজনেরই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দুইজনেরই নামের পাশে একটি বিশ্বকাপ এবং আরেকবার কাছে পেয়েও না-পাওয়ার গল্প।
ওয়ার্নের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন শচীন। সৌরভের মতে, যিনি ক্রিকেটের ম্যারাডোনা। তারও একবার করে অর্জন বিশ্বকাপ ও রানার্স-আপ। শচীন রগচটা নন, কাউকে চটানও না। ক্ষমতার সঙ্গে সরাসরি লড়াইয়ে নামেন না। কিন্তু ম্যারাডোনা নামেন। তিনি আমেরিকার মতো প্রবল প্রতাপশালী রাষ্ট্রকে গোণেন না, ইসরাঈলকে 'ধুচ্ছাই' বলে ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামে সংহতি প্রকাশ করেন। ফিদেল কাস্ত্রো তার বন্ধু, হুগো শ্যাভেজের সঙ্গে গলায় গলায় দোস্তি; যেন তিনি পৃথিবীর যত শোষিত-বঞ্চিতের কন্ঠস্বর। যা অন্যরা বলতে ভয় পায়, সংকোচ করে, ভদ্রতার জ্ঞান ঠিক রাখে, তিনি সেসবের থোড়াই কেয়ার করেন। কাউকে পরোয়া করেন না। মুখে যা আসে, মনে যা বিশ্বাস করেন তা প্রকাশে অসঙ্কোচ।
'বিদ্রোহী মানে কাউকে না-মানা নয়, বরং যা বুঝি না মাথা উঁচু করে তা বুঝি নাই বলা।'
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলে ইসলামের এই সংজ্ঞানুসারে তিনি কী বিদ্রোহী তাহলে?
তিনি একগুঁয়ে, তিনি রগচটা, তিনি জেদী। সৌজন্যতাবোধের ধার ধারেন না। শচীন যেমন লারাকে এগিয়ে রাখেন, লারা যেমন শচীনের প্রশংসায় হন পঞ্চমুখ। অথবা ওয়ার্নের কাছে মুরালি যেমন বন্ধুর মতন, আবার মুরালিও শেখেন ওয়ার্ন থেকে। অতসব ভদ্রতা-জ্ঞান নেই ম্যারাডোনার। তিনি স্পষ্ট সুরে জানিয়ে দেন-- এই গ্রহের শ্রেষ্ঠতম ফুটবলার তিনিই। সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই।
'আমার মা বলতেন, আমিই পৃথিবীর সেরা। সুতরাং, আমার চেয়ে সেরা আর কেউ নেই।' মায়ের অনুভূতিকে এভাবে ধারণ করা ক্ষ্যাপাটে না হলে সম্ভব নয়। ক্ষ্যাপাটে না হলে জনতার এত প্রিয় হওয়াও সম্ভব নয়। এত এত ভুল সত্ত্বেও মানুষের হৃদয়ে সম্রাটের আসন অলঙ্কৃত করা চাট্টিখানি কথা নয়। তিনি গণমানুষের ফুটবলার। মানুষ তাকে নিজেদের একজন মনে করে। আপন ভাবে।
ক্রিকেট অন্যতম নিয়ন্ত্রিত শৃঙখলিত খেলা। তবে ক্রিকেটেও নিয়ম না-মানা ও উচ্ছৃঙ্খল খেলোয়াড় আছে। কিন্তু ম্যারাডোনার মতো কেউ নেই। যাকে সারাবিশ্বের সাধারণ জনতা প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে, যার অমার্জনীয় ক্ষ্যাপাটেপনা শিশুতোষ ভুল ভেবে অনায়াসে ক্ষমা করে দেয়। ফুটবল পায়ে কারিকুরি কতজনই তো দেখায়, কিন্তু এমন উজার করা ভালোবাসা সবার জোটে না। ম্যারাডোনা শুধুমাত্র ফুটবলার নয়, বুঝি তার চেয়েও বেশি কিছু!
- 0 মন্তব্য