২০-২১ মৌসুমে আলেকজান্ডার-আর্নল্ডঃ ফর্মহীনতা নাকি অন্যকিছু?
পোস্টটি ২৮১৯ বার পঠিত হয়েছেগত মৌসুমের প্রিমিয়ার লিগ জয়ী লিভারপুল যে প্রাধান্য দেখিয়েছিলো মৌসুম জুড়ে এই মৌসুমের তাদের খেলায় স্পষ্টতই তার অভাব দেখা যাচ্ছে। এর পেছনে যদিও একক কোনো খেলোয়াড়কে দায়ী করা যাবে না, তবে ট্রেন্ট আলেকজান্ডার-আর্নল্ড এর ফর্মহীনতাকে এর অন্যতম কারণ হিসাবে ধরাই যায়। গত দুই সিজন ধরে প্রিমিয়ার লিগের ডিফেন্ডারদের মধ্যে সর্বোচ্চ অ্যাসিস্টধারী এই মৌসুমে এখন পর্যন্ত অ্যাসিস্ট করেছেন মাত্র দুইটি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বার্নলির কাছে ১-০ গোলে হেরে যাওয়া ম্যাচে ১৮টি ক্রস করেছিলেন। বিষ্ময়কর হলো এর একটিও সতীর্থদের খুঁজে পায়নি।
কিন্তু আর্নল্ডের হলোটা কি? করোনা পরবর্তী ঠাসা সময়সূচির কারণে ফ্যাটিগকে দায়ী করতে পারেন। গ্রীষ্মে আর্নল্ড নিজেও কোভিড পজিটিভ হয়েছিলেন, সাথে ছিলেন ইনজুরি আক্রান্ত। ফলে দলের প্রাক-মৌসুম প্রস্তুতি আর কমিউনিটি শিল্ড এর ম্যাচ মিস করেছেন। লিভারপুল কোচ ক্লপ এই মাসের শুরুতেই বলেছেন, “কোভিড-১৯ এবং ইনজুরির কারণে তার প্রাক-মৌসুম প্রস্তুতিতে ব্যাঘাত করেছে। ফলে সে আশানুরূপ পারফর্ম করতে পারেনি। তবে ধীরে ধীরে ফিরে পাচ্ছে নিজেকে। তবে ভালো বিষয়, শারীরিকভাবে সে সুস্থ আছে এবং নিজের সেরা ফিটনেস ফিরে পেয়েছে। খুব শীঘ্রই আমরা তাকে আগের রূপে দেখবো।”
তবে একটু বিশ্লেষণ করলেই দেখা যাবে, কেবল ফিটনেস নয়, আলেকজান্ডার আর্নল্ড এর এই ফর্মের আরো যুক্তিযুক্ত ট্যাকটিকেল ব্যাখ্যা রয়েছে।
ভ্যান ডাইকের ইনজুরিঃ
ভার্জিল ভ্যান ডাইক কেবল লিভারপুলের সেরা ডিফেন্ডারই নন, থিয়াগো আলকান্ত্রা আসার আগ পর্যন্ত তিনি দলের সেরা ডীপ লাইং প্লেমেকার ছিলেন বলা যায়। সেন্টারব্যাক হিসাবে তার পাসিং রেঞ্জ এবং শতকরা সফল পাসের হার ঈর্ষনীয়। সেটা মানে কিংবা সালাহ এর উদ্দেশ্যে লম্বা পাস হোক কিংবা ডায়াগোনাল পাসের ক্ষেত্রেই হোক। এই ডায়াগোনাল পাসগুলোর একটা বড় অংশই আবার আর্নল্ডের উদ্দেশ্যে হতো। দ্রুত খেলাকে রাইট ফ্ল্যাংকে সুইচ করার ক্ষেত্রে ডাইক-আর্নল্ড জুটি দুর্দান্ত ভূমিকা রাখেন। ফাঁকা স্পেসে আর্নল্ডকে খুঁজে নেওয়া, স্ট্রাইকারদের ডি-বক্সে স্প্রিন্ট এবং আর্নল্ডের ক্রস, লিভারপুলের বেশ কয়েকটি গোলের দৃশ্যপট এমনই ছিলো।
গত মৌসুমে আর্সেনালের সাথে ম্যাচে আর্নল্ডের উদ্দেশ্যে বাড়ানো লং পাস, যেটি ট্রেন্ট চমৎকার কন্ট্রোল করে সালাহকে ক্রস করেছিলেন। যদিও সালাহর শট প্রতিহত হয়েছিলো।
বোর্নমাউথের সাথে ম্যাচের আরেকটি উদাহরণ, যেখানে ভ্যান ডাইকের পাস, প্রতিপক্ষের ডিফেন্স ভেঙ্গে TAA কে খুঁজে নিয়েছে।
যদিও এই লো ক্রসটিও ক্লিয়ার করেছিলেন প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডার।
এবার গত সিজনের সাথে এই সিজনে সেন্টারব্যাক থেকে রাইটব্যাকের দিকে পাসের একটা এভারেজ চিত্র দেখি।
গত মৌসুমের পরিসংখ্যান
এই মৌসুমের পরিসংখ্যান
পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এই সিজনে আর্নল্ড অনেক নীচেই পাস রিসিভ করছেন। স্পষ্টতই ভ্যান ডাইকের অভাব লিভারপুল এবং ট্রেন্ট আলেকজান্ডার-আর্নল্ড অনুভব করছেন।
ডিফেন্সে বাড়তি মনোযোগঃ
অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকেই ভ্যান ডাইক ইনজুরির জন্যে দলের বাইরে। নভেম্বরের শুরু থেকে নেই জো গোমেজ। ফলে আর্নল্ড এই সিজনের অনেক ম্যাচেই ওভারল্যাপ না করে ডিফেন্স আঁটসাঁট করতে মনোযোগী হয়েছেন। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এর সাথে 0-0 গোলে ড্র করা ম্যাচেও রবার্টসন যেখানে ওভারল্যাপ করছিলেন, ট্রেন্ট নিচে নেমে থার্ড সেন্টারব্যাকের ভূমিকা নিয়েছিলেন। অথচ পগবা যথেষ্ট স্পেস ছেড়ে গিয়েছিলেন রাইট ফ্ল্যাংকে। কিন্তু মারশিয়ালের কাউন্টার অ্যাটাক রুখতেই তার এই ভূমিকা।
গত সিজনের সাথে তার এই সিজনের প্রতি ৯০ মিনিটের টাচম্যাপের তুলনা দেখলেই বুঝবেন রাইট ফ্ল্যাংকের টাচের সংখ্যা কমেছে, সেন্ট্রালি টাচের সংখ্যা বেড়েছে।
মিডফিল্ডে ফাবিনহো এবং হেন্ডারসনের অনুপস্থিতি
মূল ডিফেন্ডারদের অনুপস্থিতিতে সেন্টারব্যাক হিসাবে ফাবিনহো এবং জর্ডান হেন্ডারসনকে খেলাতে বাধ্য হচ্ছেন ক্লপ। ফলে তারা ডিফেন্সে যে বাড়তি শিল্ড দিতেন, যার সুবিধা নিয়ে আর্নল্ড উপরে উঠতেন, সেটি আর হয়ে উঠছে না। গত বছর নরউইচ সিটির সাথে ম্যাচের উদাহরণ দেখি। হেন্ডারসন নিচে নেমে ভ্যান ডাইক থেকে স্কয়ার পাস রিসিভ করলেন।
ইতোমধ্যে ট্রেন্ট সামনে সমুদ্র সমান ফাঁকা জায়গায় নিজেকে নিয়ে গেছেন। হেন্ডারসনের কাজ শুধু তাকে সঠিকভাবে বলটি পৌঁছে দেওয়া, যা সফলতার সাথেই করলেন তিনি।
মিডফিল্ডে ফাবিনহো কিংবা হেন্ডারসনের উপস্থিতি কেবল আর্নল্ডকে ফরোয়ার্ড পাসই যোগাতো না, আর্নল্ড বরং নির্ভয়ে ওভারল্যাপ করতেন নিশ্চিন্তে কারণ তার রেখে আসা স্পেস পূরণ করার যোগ্য মানুষ আছে। কিন্তু শেষ দুই ম্যাচে রাইট সেন্টার-মিড হিসাবে খেলা শাকিরির কাছে নিশ্চয়ই আপনি একই রকম ডিফেন্সিভ ওয়ার্করেট আশা করতে পারেন না।
বক্সে এরিয়াল টার্গেটের অভাবঃ
ট্রেন্ট আলেকজান্ডার-আর্নল্ডের করা অ্যাসিস্টগুলোর একটা মূল উৎস ছিলো সেটপিস। ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০ মৌসুমে সাদিও মানের পরে ভার্জিল ভ্যান ডাইককে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অ্যাসিস্ট করেছিলেন তিনি। গত মৌসুমেই ব্রাইটনের সাথে জোড়া গোল করেছিলেন ডাইক। যার একটির উৎস ছিলো ট্রেন্টের ফ্রি-কিক।
অপরটির উৎস ছিলো ট্রেন্টেরই নেওয়া কর্নার।
এই সিজনে ভ্যান ডাইকের পরিবর্তে যারা সেন্টারব্যাকে খেলছেন, কেউই এরিয়ালি তার মত পারদর্শীতা দেখাতে পারেননি। আবার সালাহ, মানে বা ফিরমিনোও হেডে এক্সট্রা অর্ডিনারি কিছু নন। কাজেই এর প্রভাব পড়েছে লিভারপুল রাইটব্যাকের অ্যাটাকিং রিটার্নে।
সর্বশেষ বার্নলি ও ম্যান ইউনাইটেডের সাথে লিগে দুই ম্যাচ মিলিয়ে আর্নল্ড ২৭টি ক্রস করেছেন। কিন্তু ক্রস অ্যাকিউরেসি ০। বার্নলির সাথে প্রথমার্ধে ডিপ থেকে ট্র্যাডিশনাল লঙ ক্রসই করছিলেন। শারীরিক উচ্চতায় এগিয়ে থাকা বার্নলির ডিফেন্ডাররা যেগুলো ফিরিয়ে দিয়েছেন সহজেই। দ্বিতীয়ার্ধে সম্ভবত ক্লপের ইন্সট্রাকশনে তূলনামূলকভাবে অ্যাডভান্স পজিশনে গিয়ে লো-ক্রস করছিলেন।
যদিও তাতেও সফল হননি, তবে দ্বিতীয়ার্ধের অ্যাপ্রোচই যুক্তিযুক্ত বলা যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে আবার একই সমস্যা, ডিফেন্সের ফাঁকা স্পেসটা পূরণ করার মত কেউ আছে কি?
ট্রেন্ট আলেকজান্ডার-আর্নল্ড এর সেরাটা তখনি দেখা যায় যখন তিনি অ্যাডভান্স পজিশনে গিয়ে খেলতে পারেন। কিন্তু এই সিজনে ভ্যান ডাইকের অভাবে সেটা যথাযথভাবে করতে পারছেন না। কাজেই যতদিন ভ্যান ডাইক ফেরত না আসছেন, কিংবা ভালো আরেকজন ব্যাক আপ সেন্টারব্যাক না কিনছে লিভারপুল, আর্নল্ড এর আগের মৌসুমের ফর্ম ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা কমই বলা চলে।
Disclaimer: লেখাটি দ্যা অ্যাথলেটিকে প্রকাশিত লেখা থেকে ভাবানূদিত
- 0 মন্তব্য