ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো নামের একজন সুপারহিরোর গল্প
পোস্টটি ৩২০৪ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না।
ব্লগের নীতিমালা
ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
রোনালদোর একটা বিখ্যাত উক্তি দিয়েই শুরু করা যাক-
"Your Love Makes me Strong,
Your Hate Makes me Unstoppable"
নিজের কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিজেকে তৈরি করেছেনও সেভাবেই। ভক্তদের আনন্দে ভাসানোর পাশাপাশি নিন্দুকদের গালে চটোপঘাতও পড়েছে প্রতিনিয়ত, তবে সেটা আক্ষরিক অর্থে হয়ত নয়, করেছেন মাঠের পারফরম্যান্স দিয়েই।
পর্তুগিজ সুপারস্টার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর উঠে আসার গল্পটা জানতে হলে পেছন ফিরে যেতে হবে অনেকটা। ১৯৮৫ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি পর্তুগালের ছোট্ট দ্বীপশহর মাদেইরাতে পৃথিবীর আলো দেখেন রোনালদো। রোনালদোর বাবা ছিলেন মালি আর মা রাঁধুনি। স্বাভাবিকভাবেই রোনালদোর ছোটবেলা কেটেছে অনেক কষ্টে। স্কুলের বন্ধুরাও প্রায়ই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত রোনালদোকে কারণ তার বাবাকে স্কুলের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবেও দেখা যেত মাঝেমধ্যে। মালির ছেলে রোনালদো দারিদ্র্যতার জীবন থেকে উত্তরণ করেছেন ফুটবল দিয়েই।
পড়াশোনাতে একেবারেই অমনোযোগী রোনালদোকে চুম্বকের মত টানত ফুটবল। এতটাই যে, ঘুমানোর সময়ও ফুটবলটাকে নিয়েই ঘুমাতে যেতেন। স্থানীয় ক্লাবে দারুণ খেলার সুবাদে নজর কাড়েন পর্তুগালের নামকরা ক্লাব স্পোর্টিং লিসবনের। মাত্র ১২ বছর বয়সেই খেলার সুযোগ পান সেখানে। প্রথমবারের মত মা-বাবাকে ছেড়ে পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে গিয়ে থাকতে হয় রোনালদোকে। মা-বাবার কথা মনে করে প্রায় প্রতি রাতেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো।
পড়ালেখাতে একেবারেই মন বসত না রোনালদোর। এক শিক্ষককে চেয়ার ছুঁড়ে মারার দায়ে বহিষ্কৃত হন স্কুল থেকে, মাত্র ১৪ বয়সেই পাঠ চুঁকে যায় পড়াশোনার। কিন্তু একবছর পরেই কঠিন এক অসুখ ধরা পড়ে রোনালদোর, যার নাম " Racing Heart Disease " যার মানে হচ্ছে রোনালদোর হার্টবিট স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি থাকে। এই রোগ থাকলে আর ফুটবল খেলার কথা চিন্তা করা যায় নাকি? ডাক্তাররা বলে দিলেন আর চলবে না ফুটবল। রোনালদোর মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। পরে ঝুঁকি নিয়ে লেজার সার্জারি করালেন রোনালদো এবং সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় ফিরেও আসলেন ফুটবলের মাঠে।
এরপর আর পেছন ফিরে তাকানোর প্রয়োজন পড়ে নি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর। ২০০৩ সালে ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে নাম লেখান রোনালদো। সেখানে কোচ হিসেবে পেয়েছিলেন স্যার এলেক্স ফার্গুসনকে, একেবারে যেন সোনায় সোহাগা। আজকের রোনালদোকে গড়ে তোলার অন্যতম কারিগর ছিলেন এই ফার্গুসনই। রোনালদো নিজেই অনেকবার প্রশংসায় ভাসিয়েছেন ফার্গিকে। তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং অনুপ্রেরণাময় একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন স্যার এলেক্স ফার্গুসন। রোনালদোর তারকা হয়ে ওঠার শুরুটা এই ম্যানইউতে, ফার্গুসনের অধীনেই। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে তিনটি প্রিমিয়ারলীগ, একটি এফএ কাপ, একটি ইউয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, একটি ফিফা ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপের শিরোপা জেতেন রোনালদো। ২০০৮ ফিফার বর্ষসেরা পুরস্কার ফিফা ব্যালন ডি অর জেতেন প্রথমবারের মত। ম্যানইউতে রোনালদোর এমন অসাধারণ পারফরম্যান্স নজর কাড়ে স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদের। ২০০৯ সালে তৎকালীন ট্রান্সফার ফির বিশ্বরেকর্ড গড়ে প্রায় ৯৪ মিলিয়ন ইউরোর চুক্তিতে রোনালদো নাম লেখান রিয়াল মাদ্রিদে। নিজের স্বর্ণালি সময়টা এখানেই কাটিয়েছেন রোনালদো।
স্পেনে শুরুর পথটা মসৃণ ছিল না মোটেই। প্রথম মৌসুমেই চ্যাম্পিয়ন্স লিগের রাউন্ড অফ ১৬ তেই বাদ পড়ে রিয়াল। প্রথম সিজনটা ট্রফিশুন্যই কাটে রোনালদোর। স্পেনে রোনালদো প্রথম ট্রফির দেখা পান পরের সিজনে, জেতেন কোপা ডেল রের শিরোপা। ২০১১-১২ মৌসুমে নিজের প্রথম লালিগা জেতেন রোনালদো। চার বছরের মধ্যে সেটাই ছিল রিয়ালের প্রথম লালিগা, রেকর্ড ১০০ পয়েন্ট তুলে সেবার লিগ জিতেছিল রিয়াল মাদ্রিদ। ধীরে ধীরে দাপুটে দল হয়ে ওঠা শুরু হল রিয়াল মাদ্রিদের। রিয়ালের হয়ে নিজের প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপাটার দেখা যেন পেতে পেতেও পাচ্ছিলেন না রোনালদো। ২০১২-১৩ মৌসুমে বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের কাছে দুই লেগ মিলিয়ে ৪-৩ গোলে হেরে সেমিফাইনাল থেকে বাদ পড়ে রিয়াল মাদ্রিদ। এরপর ভক্তদের উদ্দেশ্যে রোনালদো বলেছিলেন, "তোমরা আমার কাছে একটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ পাওনা আছো।" নিজের কথা রেখেছেন রোনালদো। পরের মৌসুমেই জিতিয়েছেন রিয়ালের বহু আরাধ্য লা ডেসিমা। এরপরের গল্পটা একদমই রোনালদোসুলভ। মাঝে এক মৌসুমের বিরতির পর টানা তিন মৌসুম টানা তিন-তিন বার রিয়ালকে ইউসিএল জেতালেন রোনালদো। ইউয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ নামধারণ করার পর যেখানে টানা দুইবারই শিরোপা জিততে পারে নি কোনোদল, সেখানে রোনালদো রিয়ালকে জিতিয়েছেন টানা তিনবার, ভাবা যায়!! একেবারে প্রতিপক্ষকে দুমড়েমুচড়ে দিয়ে, ফুটবলের মাঠে একের পর এক মহাকাব্য লিখে চোখের পলকে কেবল জিতেই গেলেন রোনালদো। শুরুর দিকের ইউসিএল জিততে না পারার সেই হতাশা মিটিয়ে দিলেন সুদেআসলে, ভক্তদের পাওনা থাকা একটা ইউসিএলের জায়গায় জেতালেন চারটা! এভাবেই হয়ত ফিরে আসতে হয়। ক্যারিয়ারে এমন অসংখ্যবার, অনেক কঠিন পরিস্থিতি থেকেও কামব্যাক করেছেন রোনালদো। রোনালদোর কঠোর পরিশ্রমের কথা কার না জানা? হার না মানসিকতা, কঠোর পরিশ্রম, দলের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনের সময়ে নিজের সেরাটা বের করে এনে প্রতিপক্ষকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলা- এইসবকিছুর একটা কমপ্লিট প্যাকেজ যেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। আর এসবকিছুই যেন রোনালদোকে করেছেন মহিমান্বিত। ২০১৭-১৮ মৌসুমের শেষে সবাইকে হতবাক করে দিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে জুভেন্টাসে পাড়ি জমান ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, এখনো পর্যন্ত আছেন জুভেন্টাসেই। রিয়াল মাদ্রিদ ক্যারিয়ারে ২টি করে লালিগা, সুপারকোপা, ইউয়েফা সুপার কাপ, কোপা ডেল রে জেতেন রোনালদো। এছাড়াও তিনটি ক্লাব বিশ্বকাপের পাশাপাশি জিতেছেন চারটি ইউয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। ২০১৩-১৭ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের মধ্যে চারবার জিতেছেন ফিফা ব্যালন ডি অর। ব্যক্তিগত কিংবা দলীয় সম্ভাব্য সকল অর্জনের দেখাই রোনালদো পেয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদ ক্যারিয়ারে।
জুভেন্টাস ক্যারিয়ারে ইউসিএলের দেখা না পেলেও ২টি করে কোপা ইতালিয়া আর সিরি আ জিতেছেন ইতোমধ্যে। আর নিজের দেশ পর্তুগালকেও এনে দিয়েছেন নিজেদের ইতিহাসের প্রথম বড় ট্রফির স্বাদ। ২০১৬ সালের ইউরোর পর ইউয়েফা ন্যাশনস লিগও জিতেছে পর্তুগাল, রোনালদো যেখানে রেখেছেন বিরাট অবদান। ইউরো শুরুর আগে পর্তুগালের দল নিয়ে বাজি ধরার মত কেউ ছিল না, সেই পর্তুগালই শেষপর্যন্ত জিতেছে শিরোপা। ফাইনাল ম্যাচে ইঞ্জুরিতে খেলতে না পারার সাইডলাইন থেকে রোনালদোর উত্তেজনার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে আপনাদের? থাকারই কথা। বিরতির সময় এডারকে সাহস যোগানো রোনালদোর অনুপ্রেরণাই যেন ইউরো জয়ের রাস্তা খুলে দিলে পর্তুগালের জন্য, সেই এডারের গোলেই নিজেদের ইতিহাসের প্রথম বড় ট্রফি জিতল পর্তুগাল, জিতলো ইউরোর শিরোপা। ইঞ্জুরিতে পড়েও হাল ছেড়ে না দেওয়া রোনালদোর জন্যও সেটি ছিল প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপার স্বাদ।
মাঠের বাইরের মানুষ রোনালদোও অসাধারণ। রক্ত দান করেন বলে ট্যাটু আঁকান না শরীরে। তিনটি মেজর চ্যারিটির (ইউনিসেফ, সেইভ দ্য চিলড্রেন, ওয়ার্ল্ড ভিসন) এম্বাসেডর রোনালদো। অনেক দাতব্য সংস্থাতে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কল্যাণের উদ্দেশ্যে নিজের অর্জিত বোনাসের বিপুল পরিমাণ অর্থ দান করেছেন রোনালদো। নিজের অনেক তরুণ ভক্তের সঙ্গেও দেখা করেছেন বহুবার। মাঠের বাইরে এমনসব দৃষ্টান্ত অবশ্যই অনুপ্রেরণা জোগায় ভক্তদের, আর রোনালদোকে করে অন্যদের থেকে আলাদা।
এক ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোতেই বুঁদ হয়ে থাকে বিশ্বের এই প্রান্ত থেকে অই প্রান্ত। রোনালদোর গোল ভক্তদের মনে জাগায় উষ্ণতা, শিহরণ। বিউটিফুল গেইমের মাঠে অসংখ্য মহাকাব্য আর রূপকথা লিখে ইতোমধ্যেই নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়, নিজের কীর্তির মাধ্যমেই রোনালদো বেঁচে থাকবেন ভক্তদের মাঝে, হয়ত আজ থেকে শত বছর পরেও। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ভবিষ্যৎের জন্য রইল অনেক শুভকামনা।
- 0 মন্তব্য