কাজী কামাল: ক্র্যাক প্ল্যাটুনের সেই দুর্ধর্ষ খেলোয়াড়-যোদ্ধা
পোস্টটি ৩৮৭৫ বার পঠিত হয়েছেবিশেষণের মালাদিয়ে তাকেই বিশেষায়িত করা যায় যিনি বিশেষণ মালার যোগ্য। হ্যাঁ-এই প্রয়াত ক্ষণজন্মা ব্যক্তির নাম কাজী কামালউদ্দীন বীর বিক্রম।
তার জন্ম হয়েছিল ১৯৪৬ইং সালের ১১ ই জুলাই পুরাতন ঢাকার মালিটোলায়। পরে শৈশব কাটে ১৩ নং কৈলাস ঘোষ লেনে(জজকোর্ট) পুরাতন ঢাকায়। ১৯৫২ইং সালে তিনি ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপিঠ ঢাকার সেন্ট গ্রেগরীজ হাই স্কুলে ভর্তি হন ও এস.এস.সি পাশ করেন ১৯৬৩ ইং সালে । তার পর ঢাকা কলেজ থেকে এইস.এস.সি পাশ করেন ১৯৬৫ইং সালে। কিন্তুু ইতিমধ্যেই ১৯ বছর বয়সেই সে তৎকালিন ঢাকাতে তার বাস্কেটবল দক্ষতার মাধ্যমে (অর্থাৎ-স্পীড , স্কীল, স্ট্যামীনা, স্ট্রেন্ত, ন্সেস, সিসটেমাটিক ইত্যাদি) তুখোড় খেলোয়াড় হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। পরবর্তীতে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আই বি এ-তে বি,বি,এ কোর্সে । আই বি, এ এবং ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব তার এই দুই আস্তানায় চলত লেখাপড়া ও খেলাধুলা। ১৯৬৩-১৯৭০ইং সাল পর্যন্ত তিনি পূর্বে পাকিস্থানের নিয়মিত জাতীয় বাস্কেটবল দলের খেলোয়াড় ছিলেন।
১৯৭০ইং সালে তিনি পূর্বে পাকিস্তান আর্মির বাস্কেটবল কোচ নিযুক্ত হন। ১৯৭১ ইং সালে তিনি সম্পূর্ণ পাকিস্তান (পূর্বে-পশ্চিম) আর্মির বাস্কেটবল কোচ নিযুক্ত হন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের দামামার সংঙ্গে সংঙ্গে সে তা প্রত্যাখান করেন।
মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং আগারতলাতে নেয়ার জন্য সদরঘাটে বাবার দামী ঘড়ি মাত্র ১৭০রুপিতে বিক্রি করে পাড়ি জমান আগরতলার উদ্দেশ্যে, ট্রেনিং শেষে দেশে ফিরেই প্রয়াত শহীদ জননী জাহানারা ইমামের পুত্র শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা রুমী (রেফারেন্স-একাত্তরের দিন গুলি), মোফাজ্জ্বল হোনেস মায়া (এম.পি), শহীদ ক্রিকেটার জুয়েল, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বদি এবং আরও প্রমুখকে নিয়ে গড়ে তোলেন ক্রাক প্লাটুন নামের এক গেরিলা মুক্তিবাহিনী।
কৈলাসঘোষ লেনের ১৩ নং বাড়ী ছিল কাজী কামল উদ্দীনদের, তারই সংলগ্ন একই হোল্ডিং নম্বরে আরেক বীর বিক্রম মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তার নাম ছিল স্বপন । তাদেরই প্রায় সমসাময়িক সহোদর ভ্রাতৃদ্বয় বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম কুদরত-ই-এলাহী পনির ও মরহুম ফজলে-ই এলাহী মোহনদের বাড়ী ছিল ১৪ নং কৈলাস ঘোষ লেনে। উভয়েই ভিন্ন ভিন্ন টার্মে ঢাকা জগন্নাত ডিগ্রি কলেজের (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ছাত্র সংসদের সাধারন সম্পাদক ছিলেন।৮-১০ সপ্তাহের মধ্যে ক্রাকপ্লাটুন ঢাকা শহরে ও আশেপাশে ৪টি দুর্ধষ কমান্ডো স্টাইলে অপারেশন চালিয়ে পাকবাহিনীর রাতের ঘুম হারাম করে দেয়। এগুলো যথাক্রমে-(১) ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে পাকবাহিনীর কনভয় গ্রেনেড মেরে উঠিয়ে দেয়। (২) ধানমন্ডিতে আট জন পাক সিপাহিকে ব্রাশ ফায়ার করে মেরে ফেলে । (৩) সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে রকেট লাঞ্চার মেরে প্রচন্ড ক্ষতি সাধন করা। (৪) কাঁচপুরে পাকবাহিনীর জীপে গ্রেনেড হামলা করা ইত্যাদি।
একদিন রাতে তিনি ক্লান্তদেহে ইস্কাটনে এক বন্ধুর বাসায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু মাঝ রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে দেখেন দুই পাকআর্মি অফিসার ও চার পাকসিপাহী তাকে ও তার কয়েক বন্ধুকে ঘিরে ফেলেছে, মৃত্যু অবস¤া¢বী কিন্তু অকুতোভয় প্রত্যুত্তপন্নমতি কাজী কামালউদ্দীন চোখের পলকে এক সিপাহীর হাত থেকে স্টেনগান ছিনিয়ে নিলেন, ব্রাশফায়ারে চারজনকে ধরাশায়ী করলেন কিন্তু পাক আর্মিরাও পাল্টা গুলি চালিয়ে তাঁর দুই সহযোদ্ধাকে মেরে ফেলে। ইতমধ্যে আরও পাক বাহিনীর উপস্থিত টের পেয়ে তিনি মুহূর্তের মধ্যে দোতলার কাঁচেরে জানালা ভেঙ্গে ঝাপিয়ে পড়লেন পাশের বাড়ীর এক তলায়। তৎকালে ঢাকা শহরে পুরাতন টয়লেট যার উপরে ছিল টিনের চাল ও নীচে মলমুত্রের গামলা । তিনি সেই রকম এক টয়লেটের চাল ভেঙ্গে মলের গামলায় যেয়ে পড়ে আহত হন। তড়িৎ গতিতে উঠে বিষাক্ত দুর্গন্ধময় লুঙ্গি খুলে উলঙ্গ আহত অবস্থায় এক মাইলের মত দৌড়ে আর এক বন্ধুর বাসায় পৌঁছান। বন্ধু ভোর ৪টায় তাকে এ অবস্থায় দেখে সম্পর্ণ হত-বিহŸল। শুধু গোসলখানা দেখিয়ে দিয়ে দরজা ও ঘরের আলো বন্ধ করে দিলেন।আধ-ঘন্টা গোসল করে গামছা পরে বেরিয়ে এসে অঝরে বন্ধুদের জন্য কাঁদলেন কিন্তু ততক্ষনে সে পাকবাহিনীর হিটলিষ্টে মোষ্ট ওয়ানটেড হয়ে গেছেন তিনি ।
তিনি যেমনি ছিলেন র্দুধর্ষ যোদ্ধা তেমনি ছিলেন পরোপকারী। যুদ্ধকালীন সময়ে এদেশে আটকে পড়েন মেজর শাফায়েত জামিল ও মেজর নরুল ইসলাম শিশুর (পরবর্তীতে কর্ণেল শাফায়েত ও মেজর জেনারেল নরুল ইসলাম শিশু) দুই পরিবার। সন্তানদের সহ দুই পরিবারকে ওপার বাংলায় পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব এলো তার উপর। তিনি প্রথমে মিসেস শাফায়েতকে সন্তান সহ পার করে দেন ।কিন্তু মুসকিলে পড়লেন মিসেস শিশু পরিবারকে নিয়ে কারন মিসেস শিশু ছিলেন অন্তঃস্বত্তা। কিন্তু ১০০% সুচারুভাবে তিনি তাদেরকে ওপারে পৌঁছে দেন। অন্তঃস্বত্তা মিসেস শিশু তখন তাঁকে কথা দিয়েছিলেন----*আমার পুত্র সন্তান হলে তার নাম রাখব কামাল *, পরবর্তিতে তার পুত্র সন্তান হয়েছিল এবং নামও রেখেছিলেন কামাল । সর্বশেষ সংবাদানুযায়ী এই ভদ্রলোক যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওতে ছিলেন ।
১৯৭১ইং সালে দেশে স্বাধীন হলো, বাস্কেটবল সুপার স্টার থেকে কাজী কামালউদ্দিন নতুনভাবে পরিচিত হলেন সিভিলীয়ান কমান্ডো হিসাবে। ১৯৭২ইং সালে বাংলাদেশ আর্মিতে বাস্কেটবল কোচ হিসাবে যোগদান করেন, বীরবিক্রম খেতাব পেলেন, কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই জার্মান বৃত্তি নিয়ে জার্মানীর দ্বিতীয় প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় লিপাজিং-এ চলে গেলেন বাস্কেটবলে উন্নতর প্রশিক্ষনের জন্য। জার্মানীতে যাওয়ার সময় তৎকালীন বাসেস্কটবল ফেডারেশনের সাধারন সম্পাদক মরহুম রিয়াজউদ্দীন আহ্মদ ও তার বন্ধু বঙ্গবন্ধু তনয় শেখ কামাল তাঁকে হাত খরচের জন্য ৫০০ ডলার দেন। কিন্তু সেই ৫০০ ডলার তিনি কলকাতায় রানা নামে এক অবাঙ্গালীকে দিয়ে চলে যান,যিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তাকে সহযোগীতা করেছিলেন। ১৯৭৩ ইং সালে সে সাফল্য জনক ভাবে কোর্স শেষে দেশে ফিরে বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচ হিসাবে বাংলাদেশ ক্রীড়া নিয়ন্ত্রন সংস্থায় ৫৫০/- টাকা বেতনে চাকুরী শুরু করলেন, তখন তার আস্থানা ছিল দিনের বেলায় ঢাকা ওয়ার্ন্ডারাস ক্লাব ও পাশের বাস্কেটবল কোর্ট। তার ধ্যানজ্ঞান ছিল খেলাধুলাকে নিয়েই তাই তিনি কখনই সরাসরি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হননি। বিশিষ্ঠ ক্রীড়া সংগঠক শেখ কামাল তার প্রিয় বন্ধু ছিলেন। এমনকি ক্রীড়া সংগঠক হিসাবে ঢাকার প্রাক্তন মেয়র মরহুম সাদেক হোসেন খোকাও তার ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
কিন্তু হঠাৎ ১৯৭৫ ইং সালেন ১৫ইং আগষ্ঠ দেশের বেশ কিছু বিপথগামী সৈন্যকতৃক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কলংকহীন কাজী কামাল উদ্দীনের জীবনেও নেমে এলো কাল বৈশাখী ঝড়। বিপথগামী সৈন্যরা তাকে গ্রেফতার করে, পেছনে হাত বেধে রামপুরা বিটিভির পেছনে ঝিলের পাড়ে অনেকের সংঙ্গে সারিবদ্ধভাবে ফায়ারিং স্কোয়াতে দাঁড় করায়। কিন্তু কমান্ডো ট্রেনিং প্রাপ্ত সুপার এ্যাথেলেটের সামনে সেই আর্মিরা ছিল শিশু। চোখের পলকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ঝিলের জলে, মুর্হুতে হাঁতের বাধন খুলে ফেললেন, শুরু করলেন ডুব সাঁতার, মনে অদম্য সাহস আর শরীরে প্রচন্ড স্ট্যামিনা- এন্ডুরেন্স। আর্মিরা এলোপাথাড়ি পানিতে ব্রাশফায়ার চালাল কিন্তু ততক্ষনে কাজী কামালউদ্দীন র্যামবোর মত লাপাত্তা। ঘন্টাখানেক সাঁতার কাটার পর যখন অজানা পাড়ে উঠলেন সেখানে দেখা হলো তারই এক শিষ্য আর্মির ক্যাপ্টেনের সাথে সুতরাং গুরুদক্ষিণা বলুন আর যাই বলুন সে কাজী কামালউদ্দীনকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে দিলেন । এর পর পাড়ি জমালেন আবারও জার্মানীর উদ্দেশ্যে নির্বাসন জীবন যাপনের জন্য প্রায় একদশক নির্বাসনে থাকার পর তিনি ১৯৮৪ ইং সালে দেশে এসে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তার স্ত্রীর নাম খাদিজা কামাল। এবার তিনি জীবিকার তাগিদে মেসার্স স্ট্যার্ডাট ট্রেড ও ইকুইপমেন্ট স্পাপ্লাই নামে কোম্পানী খুলে ব্যবসা শুরু করলেন। ব্যবসায় তিনি কখনো নীতির সাথে আপোস করেননি, মাথা নোয়াননি বা তেল দেননি । সুতরাং তার ব্যবসা কখনোই বড় কোন লাভের মুখ দেখেনি। কিন্তু মাতৃ ও পিতৃক‚লের স্বচ্ছলতার জন্য কখনো তেমন কোন বিপাকে পড়েনি। তার একমাত্র ছোট বোন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম ফজলে এলাহী মোহনের সঙ্গে।আর তার চার ভাই- লেখাপড়া ও খেলাধুলায় মেধাবী ছিলেন । কিন্তু চারভাই সত্যিকারের দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা কাজী কামলউদ্দীনের ৭৫ ইং সাল পরবর্তী দুর্দশা দেখে এতই ব্যথিত হয়েছিলেন যে তারা সবাই বিদেশে পাড়ি জমান চিরস্থায়ী ভাবে।
২০০৮ ইং সালে তিনি প্রথমে কিডনীরোগে অক্রান্ত হন, চিকিৎসা শুরু করেন ঢাকা ও ইন্ডিয়াতে তাকে ডায়ালাইসিস করতে হোত চিকিৎসকের পরামর্শানুযায়ী । হঠাৎ বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কানে সম্ভবত তারই জ্বালানী উপদেষ্ঠা জনাব তৌফিক এলাহী চৌধুরীর মাধ্যমে সংবাদটি পৌঁছায় । মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তৎক্ষনাত তার সকল খবরাখবর নেন এবং ঢাকা সি.এম.এইচ এ তার ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ভ্যাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেই কিডনীতেই বাসা বাধেঁ মরণ ব্যাধি ক্যান্সার।তখন দলমত নির্বিশেষে তার মুক্তিযোদ্ধা সুহৃদরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বনানীর ১নং রাস্তাটিকে অথাৎ যে রাস্তায় তার পৈতৃক বাড়ী অবস্থিত সেটিকে বীর বিক্রম কাজী কামাল উদ্দীন সড়ক নামকরনের জন্য প্রস্থাব দেন- প্রধানমন্ত্রী মৌখিক সম্মতি দেন। কিন্তু প্রচার বিমুখ বীরবিক্রম সবিনয়ে এই উপহার ফিরিয়ে দেন । জীবণ সায়ান্নে তিনি নীরবেই কাটাতে চান, ২০১২ ইং সালে ১৫ই জানুয়ারীতে বীর বিক্রমের জীবন প্রদীপের আলোচ্ছটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেয়ে না ফেরার দেশে হারিয়ে যায়।
তার একমাত্র পুত্র বর্তমানে কাজী সিয়াম আহ্মদ ফিনল্যান্ড থেকে আর্ন্তজাতিক ব্যবসা ও মার্কেটিং এ গ্রাজুয়েশন করে ঢাকাতে গার্মেন্টস ব্যবসার সাথে জড়িত। আর একমাত্র মেয়ে কাজী মাশফিয়া ফারডিয়া (ইথা) বাংলাদেশ মেডিকেল, ঢাকা থেকে পাশ করে বর্তমানে ইংল্যান্ডে এম. আর. সি. পি-তে অধ্যায়নরত।
- 0 মন্তব্য