• ফুটবল

ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ ট্রফি,এর জন্মকথা এবং ইতিহাস

পোস্টটি ৬৭৮৭ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ফুটবল,এটি কী শুধু মাত্র একটি খেলার নাম? কেবল তিনটি মাত্র পয়েন্টের জন্যে মাঠের সবুজ গালিচায় দুদলের নব্বই মিনিটের দ্বৈরথ দিয়ে এই খেলাকে বিশ্লেষণ করা যাবে? উত্তর টা বোধহয় ' না ' ই হবে সবার কাছে।বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই খেলাটি প্রায় 4 বিলিয়ন মানুষ উপভোগ করে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা " ক্রিকেট " কে অনুসরণ করে প্রায় ২.৫ বিলিয়ন মানুষ। আরেকটি জরিপে দেখা যায়, বিশ্বের প্রায় ৪৩ শতাংশ মানুষের পছন্দের খেলা হলো ' ফুটবল'। সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে হয়তো ফুটবলের প্রতি কোটি মানুষের আবেগ,ভালোবাসা , বেঁচে থাকার উৎসকে বুঝানো যাবেনা। কেউ হয়তো বুঝতেও চাইবেনা। 

 

ফুটবলের কথা আসলে সবার আগে যে বিষয়টি আমাদের সামনে চলে আসে সেটা হচ্ছে ' বিশ্বকাপ ফুটবল '। আরো বিশদ ভাবে বললে ফুটবলপ্রেমীদের কাছে এক আকর্ষণীয় কেন্দ্রবিন্দু হলো 'বিশ্বকাপ ট্রফি'। হোক না কোনো কিছুর মূল্য হাজার মিলিয়ন ডলার,ইউরো।হোক না করো জগত জুড়ে খ্যাতি, ঘরের ট্রফি কেসে শোভা পাক অগণিত খেতাব সব কিছুই যেনো ম্লান এই ৬.১৭৫ কেজি ওজন আর ৩৬.৮ সেন্টিমিটার এর উচু এই ট্রফিটির সামনে। এটি করো কাছে এক আক্ষেপের নাম তো করো কাছে পরিপূর্ণতার এক জ্বলজ্যান্ত নিদর্শন।যে ট্রফিটি ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়নি অনেক মহারথীদের। একজন ফুটবলারের কাছে যেন এক চূড়ান্ত অভিলাষের নাম এই বিশ্বকাপ ট্রফি যেটি উচিয়ে জানান দেওয়া যাবে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের।

 

বিশ্বকাপ ফুটবলের যাত্রা শুরু হয় ১৯৩০ সালে উরুগুয়েতে। কিন্তু আজকের এই আমাদের অতি পরিচিত ট্রফিটি বিজয়ী দলকে দেওয়া শুরু হয় ১৯৭৪ সালে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ থেকে।এর আগে অর্থাৎ ১৯৭৪ সালের আগে যে কাপটি বিজয়ীদের দেয়া হতো তার প্রথমে পরিচিত ছিলো ' ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ ট্রফি' নামে যার নাম পরিবর্তন করে ১৯৪৬ সালে রাখা হয় ' জুরেলিমে ট্রফি '। ফিফার তৃতীয় প্রেসিডেন্ট ফরাসি নাগরিক স্যার জুরেলিমের নামেই নামকরণ করা হয় এই বিখ্যাত ট্রফিটির। এটি মূলত রূপার উপর স্বর্ণের আবরণ দিয়ে তৈরি গ্রীক দেবী ' নাইকের ' একটি প্রতিমূর্তি যার নিচের অংশটি নীলকান্ত মণি দিয়ে খচিত। প্রায় ১ কেজি ৮০০ গরম নিখাদ স্বর্ণের পাশাপাশি ট্রফিটিতে ব্যাবহার করা হয়েছিল অনেক মূল্যবান পাথর। ঐতিহাসিক এই ট্রফিটি নকশা করেছিলেন ফরাসি ডিজাইনার আবেল লাফলিউর। এই কাপ টি নিয়ে রয়েছে নানান ধরনের বিচিত্র এবং অদ্ভূত ঘটনা।17-56-41-l-r-fifa-president-jules-rimet-presents-the-world-cup-to-dr-paul-jude-GBBWG4

 

১৯৩৪ এবং ১৯৩৮ সালে টানা দুবার বিশ্বকাপ জিতে নিজেদের দেশে ট্রফি নিয়ে যায় ইতালি।তারপর শুরু হয় বিশ্বযুদ্ধ। নাৎসি বাহিনী ইতালি দখলের পর নজর যায় সেই মূল্যবান জুরেলিমে ট্রফিটির উপর। একরকম হন্য হয়ে খুঁজতে থেকে এই ট্রফিটি কে। তখন সেটি তৎকালিন ফিফা সহ সভাপতি অত্তেরিনো বারোসির হেফাজতে ছিলো এটি। ট্রফি কে বাঁচানোর ক্ষুদ্র প্রয়াস হিসেবে সাধারণ একটি জুতার বাক্সে অবহেলিত ভাবে রেখে দেন তাঁর বাড়ির খাটের নিচে। আশ্চর্যজকভাবে তাতেই রক্ষা পেয়ে যায় নাৎসি বাহিনীর শকুনের চোখ থেকে। এরপর অঘটনহীনভাবে কেটে প্রায় ২০ বছরের অধিক সময়। জুরেলিমে ট্রফি নিয়ে সবচেয়ে বেশি তোলপাড় হয় ১৯৬৬ সালে অনুষ্ঠিত ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে। টুর্নামেন্ট শুরুর মাসখানেক আগে ওয়েস্ট মিনিস্টারে হলে একটি ডাকটিকিট প্রদর্শনীতে রাখা কাপটি কে। সেখান থেকেই বেমালুম হয়ে যায় মহামূল্যবান এই ট্রফিটি। সারা বিশ্বে হৈচৈ পড়ে যায় এই ঘটনা নিয়ে। লন্ডনের তৎকালিন সবচেয়ে প্রশিক্ষিত গোয়েন্দা বাহিনী সপ্তাহখানেক অনুসন্ধান করেও এর হদিস পায়নি।

 

তার সপ্তাহখানেক পর দক্ষিণ লন্ডনের একটি থানায় নিজের পোষা কুকুর নিয়ে হাজির ডেবিট করবেট নামে ২৬ বছর বয়সী এক যুবক। তার হাতে ছিল কাগজে মোড়ানো হারিয়ে যাওয়া সেই কাঙ্ক্ষিত ট্রফিটি। কারবেট এর ভাষ্যমতে সে তার পোষা কুকুর ' পিকলোস' কে নিয়ে সকালে হাঁটতে বের হয়। হঠাৎ রাস্তায় পাশে একটি গাছের আড়ালে দৌড়ে গিয়ে ঘেউ ঘেউ শুরু করে পিকলস। কারবেট সেখানে গিয়ে দেখে গাছের আড়ালে কাগজে মোড়ানো একটি বস্তু।সেটি খুলে দেখতেই তার চোখ মাথায় উঠার মতো অবস্থা!! এটা তো সেই হারিয়ে যাওয়া জুরেলিমে ট্রফিটি। ট্রফিটি উদ্ধার করতে সক্ষম হওয়ায় পিকলোস এবং কারবেট কে ৩ হাজার পাউন্ড পুরস্কার দেওয়া হয়। এবং এর সাথে এরা দুজন হয়ে যান বিশ্বকাপের ইতিহাসের অংশ।18-03-33-pickless_env

 

আলোচিত এই বিশ্বকাপ নিয়ে ঘটনার শেষ নেই। যার পরিণতি একটি ট্রাজিক উপাখ্যানের চেয়ে কম নয়। তৎকালীন নিয়ম অনুসারে ৩ বার যে দেশ বিশ্বকাপ জিতবে তারাই একেবারে ট্রফিটি নিজের করে নিবে। তারই অংশ হিসেবে ১৯৫৮,১৯৬২ এবং ১৯৭০ সালে বিশ্বকাপ জিতে বিশ্ব সেরা হওয়ার পাশাপাশি আজীবনের জন্যে জুরেলিমে ট্রফিটি নিজেদের করে নেয় ব্রাজিল। কিন্তু তাতেও শেষ রেহাইও হয় নি।১৯৮৩ সালে ব্রাজিল ফুটবল ফেডরেশন ভবন থেকে আজীবনের জন্যে চুরি হয়ে যায় ঐতিহাসিক এই ট্রফিটি। এই কাজের প্রধান হোতা ছিলেন সার্জিও পেরেইরা আইরেস নামে এক ভদ্রলোক যিনি পেশায় একজন ব্যাংকের এবং তার সাথে সম্পৃক্ত ছিল একজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তাও! গ্রেফতার হবার পর তাদের ভাষ্যমতে ট্রফি টি গলিয়ে স্বর্ণের বারে রূপান্তর করে।সামান্য কিছু অর্থের লোভে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় আলোচিত এই ট্রফিটি। যদিও এখনো ব্রাজিলে জুরেলিমে ট্রফিটি আছে তবে সেটা রেপ্লিকা।

 

১৯৭০ সালে ব্রাজিল জুরেলিমে ট্রফি একেবারে নিজেদের নামে করে নেবার পর তার বদলি হিসেবে নতুন মূল্যবান ট্রফি বানানোর পরিকল্পনা করে ফিফা।যার অংশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী সবার কাছে আহ্বান জানায় ট্রফির ডিজাইন পাঠানোর জন্যে।অনেক যাচাই বাছাই করে সাতটি দেশের সেরা ডিজাইনার এবং কয়েকটি নামি দামি সংস্থা থেকে পাঠানো ৫৩ টি নমুনা আলাদা করে রাখা হয়।সেখান থেকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বেছে নেওয়া হয় ইতালির ভাস্কর সিলভিও গাজ্জানিগার তৈরি ডিজাইনটি যার বাস্তব রূপ হচ্ছে আজকের এই বিশ্বকাপ ট্রফি। ইতালির বিখ্যাত ট্রফি তৈরির কারখানা ' বার্তোনী' তে বানানো হয় এটি। নতুন ট্রফিটিতে ১৮ ক্যারেটের প্রায় ৫ কেজি নিখাদ স্বর্ণ ব্যাবহৃত হয় যার ওজন ৬.১৭৫ কেজি এবং উচ্চতা ৩৬.৮ সেন্টিমিটার। গাজ্জানিগা তার ডিজাইনে যে বিশেষত্বটি ফুটিয়ে তুলে ধরেন সেটি হচ্ছে - দুজন ক্রীড়াবিদ পরস্পর পিছনে ফিরে হাত উচু করে দাঁড়ানো এবং তাদের দুইহাতের মাঝে রয়েছে ভূ - গোলক যার মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে - বিশ্ব এখন আমাদেরই। ট্রফিটির নিচের অংশে খোদাই করে লেখা হয় বিশ্বকাপজয়ী দেশের নাম।18-05-28-a3kqnizvsdlgyjltbc8v 

 

১৯৭৪ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত মোট ১২ টি আসরের বিজয়ী দেশের নাম খোদাই করা আছে। ট্রফিটির এই অংশে যে পরিমাণ জায়গা আছে তাতে ২০৩৮ সাল পর্যন্ত আর মাত্র ৫টি দেশের নাম খোদাই করা যাবে।তবে মজার বিষয় হচ্ছে এই ট্রফিটি কাউকে আজীবনের মতো দেওয়া হবেনা। তবে ২০৩৮ সালের পর এর কি হবে তা ভবিষ্যতেই জানা যাবে। অতীতের সব বাজে অভিজ্ঞতার জন্যে সর্বদা কড়া নজরদারিতে রাখা হয় বর্তমান এই ট্রফিটি কে।এমন নিরাপত্তা হয়তো কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধানও পান না। এর জন্যে আলাদা বিমাও করেছে ফিফা যার বিমাকৃত মূল্য প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার ডলার। বর্তমানে এটি ফিফার সদর দপ্তর জুরিখে সুরক্ষিত কাঁচে রাখা হয়েছে যাতে কেউ এটি ছুতে না পারে। প্রতিবার বিশ্বকাপ আসর শেষে জয়ী দলের খেলোয়াড়,কোচ,কোচিং স্টাফ, সকল রাষ্ট্র প্রধান,ফিফা প্রেসিডন্ট ছাড়া ক্ষেত্রবিশেষে অন্য কেউ এটি স্পর্শ পারেনা। মাঠে যখন ফুটবলাররা তাদের পায়ের জাদু,দক্ষতা দেখায় তাদের মোহে হয়তো সবাই ভুলতে থাকে এই ট্রফিটির মাহাত্ম্য। কিন্তু সবুজ গালিচায় নীরবে সকলের হাসি কান্না,সফলতা ব্যার্থতার এক নীরব সাক্ষী হয়ে থাকে বিশ্বকাপ ট্রফিটি। কারণ ফুটবলারদের ক্যারিয়ারের পূর্ণতার আরেক নাম যে এই সোনালী ধাতব বস্তুটি!18-06-37-1280px-France_champion_of_the_Football_World_Cup_Russia_2018