গারিঞ্চা: বাঁকানো পায়ের ঈশ্বর
পোস্টটি ২১৫০ বার পঠিত হয়েছেজীবন মানেই সকল বাঁধা বিপত্তি কে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাবার লড়াই।জীবন মানে হার না মেনে নিজেকে ছড়িয়ে যাবার এক অন্যতম যুদ্ধক্ষেত্র।কিন্তু এই যুদ্ধক্ষেত্রে কতজনই বা নিজের সাফল্যের পতাকা উড়তে পেরেছে? কতজনই বা এই সংগ্রামে নিজের সকল বাঁধাকে ডিঙিয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে অসাধারণ হতে পেরেছে? কিংবা কতোজনই বা সাধারণ থেকে নিজেকে মহারথীর কাতারে নিতে পেরেছে? ফুটবল মাঠের এমনই অনেক সংগ্রামী যোদ্ধা, মহারথীর নাম আসলে সবার সামনের কাতারে একটি নাম থাকবে - ' মানুয়েল ফ্রান্সিসকো দস সান্তোস'। যাকে আমরা সকলে গারিঞ্চা নামে চিনি!
গারিঞ্চার জন্ম ১৯৩৩ সালের ২৮ অক্টোবর ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোর পাও গ্রান্দে তে। শরীরে ছিল তার ক্রীতদাসের রক্ত।জন্মের কয়েকবছর পরেই শরীরে হানা দেয় পোলিও যার জন্যে মেরুদন্ডটা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে গরিঞ্চার পায়ে।অবাক হলেও সত্যি যে গারিঞ্চার ডান পা টা ভেতরের দিকে একটু বাঁকানো এবং ডান পায়ের চেয়ে বাম পা ৬ সেন্টিমিটার ছোটো এবং বাহিরের দিকে বাঁকানো! যে কেউ প্রথম দেখায় তাকে দেখলে ভেবে নিত লোকটা বোধহয় হাঁটতে পারেনা।থাকতেন বস্তি তে এবং তার ছোটবেলা কেটেছে চরম দরিদ্রতায়।
ম্যানুয়েল থেকে গারিঞ্চা হবার পিছনেও আছে একগুচ্ছ অবহেলা,কটাক্ষ এবং উপহাসের গল্প। ছোটবেলায় একবার একটি ছোটো পাখি কোথা থেকে যেনো ধরে নিয়ে আসে ম্যানুয়েল। পাখিটি যখন তার নিজের বড় বোন কে দেখায় তখন তার বোন তাকে বলে, ' দেখো ম্যানুয়েল,পাখিটা ঠিক তোমার মতোই।উড়তে জানে কিন্তু কোনো কাজের নয়। আরে এই পাখির নাম তো গারিঞ্চা!' গারিঞ্চা শব্দের অর্থ হচ্ছে ছোটো ডানাওয়ালা পাখি,যে সুন্দর করে গান গাইতে পারে।কিন্তু এই গারিঞ্চা তো সেই অর্থে কোনো গায়ক নয়।বাস্তবিক অর্থে গায়ক না হলেও ঠিকই তার চেয়ে বড় সুর তুলতেন তার অমূল্য দুটি পা দিয়ে কেননা এই শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কে কাজে লাগিয়ে সেই কটাক্ষ-উপহাসের স্বীকার ছেলেটি পরবর্তীতে বিশ্বের অন্যতম সেরা আবার করো কাছে সেরা ড্রিবলার হিসেবে পরিচয় লাভ করে! গারিঞ্চার মতো এতো স্বচ্ছন্দ ড্রিবলার বোধহয় আর কাউকে পাওয়া যায়নি।উরুগুয়ের বিখ্যাত লেখক এদুয়ার্দ গ্যালিয়ানি একবার বলেছিলেন, 'ফুটবলের ইতিহাসে আর কেউই গারিঞ্চার মতো এতটা আনন্দ দিতে পারেনি'। দুই পা দিয়ে যখন অসাধারণ সব ড্রিবলিং, দক্ষতা দেখাতেন তখন মনে পড়ে জন কিটসের বিখ্যাত সেই উক্তিটি - ' A thing of beauty is joy forever '
গারিঞ্চার পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু হয় ব্রাজিলিয়ান ক্লাব সেরানো'র মাধ্যমে ১৯৫১ সালে। পরবর্তীতে ১৯৫৩ সালে নাম লেখান বোটাফোগো'র হয়ে। বোটাফোগো তে যোগ দেওয়া নিয়ে রয়েছে একটি মজার ঘটনা। ব্রাজিলের সর্বকালের সেরা লেফট ব্যাক বলে বিবেচিত নিল্টন সান্তোসের কাছে ট্রায়াল দিতে গিয়েছিলেন ২০ বছর বয়সী গারিঞ্চা। প্রথম টাচেই সান্তোসের দুই পায়ের মাঝখান দিয়ে বলকে চালান করে বোকা বানালেন । সবাই ভেবেছিলেন পুঁচকে কুখ্যাত ছেলেটির কাছে হাস্যরসের পাত্র হয়ে তার ডেপোমি সহ্য করবেন না সান্তোস।কিন্তু ট্রায়ালের পর ক্লাব কর্মকর্তাদের ডেকে নিয়ে সান্তোস বলেছিলেন, ' ছেলেটি সাধারণ নয়। ওকে নিয়ে নাও। ওর বিপক্ষে খেলার চেয়ে একসাথে খেলাই বোধহয় ভালো হবে'। পরবর্তীতে তাকে দলে ভেরায় বোটাফোগো এবং তিন মাসের মধ্যে মূল দলে জায়গা করে নেন এবং অভিষেক ম্যাচেই করেন হ্যাটট্রি্ক!! তার সাথে হয়ে যান বোটাফোগো দলের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯৫৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত বোটাফোগোর হয়ে ২৩৮ ম্যাচে ৮৪ গোল করেন গারিঞ্চা।
বোটাফোগো তে নাম লেখানোর পর ১৯৫৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিল দলে ডাক পান গারিঞ্চা এবং অভিষেক হয় ২ ম্যাচ সাসপেন্সনের পর! বিশ্বকাপের মাত্র একমাস আগে বোটাফোগোর হয়ে ইতালিতে খেলতে গিয়েছিলেন গারিঞ্চা।সেখানে ফিওরেন্তিনা বিপক্ষে এক ম্যাচে ৪ জন ডিফেন্ডারকে করা গোলটি তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা বলে বিবেচিত। এরপর করেছিলেন আরো একটি গোল এবং সেটি নিয়েই বাঁধে বিপত্তি। ৩ জন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে গারিঞ্চা বল নিয়ে দাড়িয়েছিলেন ফিওরেন্তিনার গোলবারের সামনে যেখানে একটি টোকা দিলেই গোল হবার উপক্রম। কিন্তু সেটা না করে অপেক্ষা করতে থাকেন বিপক্ষ ডিফেন্ডার রোবোত্তির জন্যে। রোবোত্তি এলেন, গারিঞ্চা তাকে বোকা বানালেন এবং গোল দিলেন! গারিঞ্চার এই আচরণকে ভালোভাবে মেনে নেয় নি তৎকালিন ব্রাজিল কোচ ভিসেন্তে ফেওলা। শাস্তি হিসবে বিশ্বকাপের ২ ম্যাচ সাইডবেঞ্চে বসে কাটাতে হয় গারিঞ্চা কে। ৩য় ম্যাচে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে সুযোগ পান তিনি। সেদিন একসাথে অভিষেক ঘটেছিল ব্রাজিলের দুই সূর্য সন্তান পেলে এবং গারিঞ্চার । ম্যাচ শুরুর প্রথম মিনিটেই সোভিয়েত ইউনিয়নের ৩ জন প্লেয়ারকে কাটিয়ে শট নেন গারিঞ্চা যা পোস্টে লেগে ফিরে আসে। তার মিনিট দুয়েক পর গারিঞ্চার বাড়ানো বলে পেলের নেওয়া শটও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ক্রসবারে লাগে।সেই তিন মিনিট এরা দুজন সোভিয়েত ডিফেন্স কে এতোটাই ব্যস্ত রেখেছিলেন যে ফুটবল ইতিহাসে সেই ৩ মিনিটকে ' দা গ্রেটেস্ট থ্রি মিনিটস অফ ফুটবল হিস্ট্রি ' বলে আখ্যায়িত করা হয়। কোয়ার্টার ফাইনালে হারের পর ওয়েলসের ফুলব্যাক মেল হপকিন্স গারিঞ্চা কে উপাধি দিয়েছিলেন ' দা এঞ্জেল উইথ বেন্ট লেগ' অর্থাৎ 'বাঁকানো পায়ের ঈশ্বর'। সেবার সুইডেন কে ৪-২ গোলে হারিয়ে প্রথবারের মতো বিশ্বকাপ জিতে ব্রাজিল। তখন পেলে গারিঞ্চা, ভাভা দের নিয়ে গড়া ব্রাজিলকে দেখে মারাকানা ট্রাজেডির শোক ভুলতে থাকে ব্রাজিলিয়ানরা।
গারিঞ্চা তার সেরাটা জমিয়ে রেখেছিলেন ১৯৬২ সালের চিলি বিশ্বকাপের জন্য।সেবার চোট পাবার দুই ম্যাচ পর টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে যান পেলে। পরবর্তীতে দলের সব দায়িত্ব বর্তায় গারিঞ্চার কাঁধে। প্রায় একক নৈপুণ্যে দলকে জিতান টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। অধুনা প্রজন্ম মনে করে, দলকে একা বিশ্বকাপ জেতানোর কৃতিত্বটা শুধু ডিয়েগো ম্যারাডোনার। ফুটবলের সাথে বেমানান দেখালেও গারিঞ্চাই প্রথম এটি করে দেখান যা আমাদের অনেকের কাছেই অজানা। সেমিাইনালে চিলির বিপক্ষে ২০ গজ দূর থেকে ভলিতে গারিঞ্চার গোলটির পর চিলির দৈনিক তার পর দিন এটি নিয়ে শিরোনাম করেছিল এভাবে - ' সে কোন গ্রহের ফুটবলার?'। পেলে এবং গারিঞ্চার একসাথে অভিষেক হবার পর প্রায় ১২ বছর একসাথে জাতীয় দলে খেলেন। মজার বিষয় হচ্ছে, এই সময়ে একটা ম্যাচও হারেনি ব্রাজিল!
১৯৬৬ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে হাঙ্গেরির বিপক্ষে ৩-১ গোলে হারে ব্রাজিল।ওই ম্যাচে পেলে খেলেনি। গ্রুপ পর্বের তৃতীয় ম্যাচে না নামায় সেই ম্যাচই ছিলো গারিঞ্চার জীবনের শেষ আন্তর্জতিক ম্যাচ। ব্রাজিলের হয়ে মোট ৫০ ম্যাচ খেলেন তিনি যার মধ্যে পরাজয়ের স্বাদ পান সেই শেষ ম্যাচে। ক্যারিয়ারে বোটাফোগো ছাড়াও করিন্থিয়াস, অ্যাথলেটিকো জুনিয়র, ওলারিয়া এবং ফ্লামেঙ্গো তে খেলেন তিনি। কিন্তু ক্যারিয়ারের সিংহভাগ সময় কাটান প্রাণের বোটাফোগো ক্লাবে। ১৯৭২ সালে ওলারিয়ার হয়ে ফুটবলীয় জীবনের ইতি টানেন।
মাঠ এবং মাঠের বাইরে সব জায়গায় এক আলোচিত নাম ছিলেন গারিঞ্চা। গারিঞ্চাকে সম্মান জানিয়ে ব্রাসিলিয়া তে তার নামে তৈরি করা হয় একটি ফুটবল স্টেডিয়াম যার নাম-'Estádio Nacional de Brasília Mané Garrincha'
আর্সেন ওয়েঙ্গার একবার বলেছিলেন - 'A football team is a like a beautiful woman, when you do not tell her, she forgets she is beautiful'। অন্যান্য ফুটবলাররা যেখানে সবসময় ক্যারিয়ার কেন্দ্রিক থাকার চেষ্টা করেছে গারিঞ্চা ছিলেন সেই মুদ্রার ঠিক উল্টোপিঠ। নারী সঙ্গ ভীষণ পছন্দ ছিলো তার। জীবনে মোট ৫ বার বিয়ের পিড়িতে বসেন গারিঞ্চা এবং তার সন্তানের সংখ্যা একটি ফুটবল দলের খেলোয়ারের সংখ্যার চেয়ে বেশি! সংখ্যাটা মোট ১৪ তে গিয়ে ঠেকে। বাবার মতো মদ খেতে ভালোবাসতেন তিনি। কথিত আছে, খেলা শুরুর আগে সারদিন মদ খেয়ে খেলতে নামতেন তিনি।আবার ড্রেসিংরুমে ফিরে মদ খেতেন। বাবার পথ অনুসরণ করে ১৯৮৩ সালে লিভার পচিয়ে পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।
গারিঞ্চা ব্রাজিলিয়ানদের কাছে কি ছিলেন সেটা তার মৃত্যুর পরদিন দেশটির বিখ্যাত কবি ও লেখক কার্লোস ড্রুমান ডি আন্দ্রের একটি লেখনির মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায়। তিনি লিখেছিলেন- ' ঈশ্বর যদি ফুটবলকে লালন করে থাকেন তাহলে তিনি খুবই চতুর। গারিঞ্চা তারই পাঠানো প্রতিনিধি যিনি সবার মনে চিত্তবিনোদনের খোরাক যোগাতো।একটা মানুষ দেশের প্রায় সকল মানুষের দুঃখ ( মারাকানা ট্রাজেডি) কে ভুলিয়ে দিয়েছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই দুঃখ আবার ফিরে এসেছে। কারণ গারিঞ্চা কে আর খুঁজে পাওয়া যাবেনা। কখনোই না।' মৃত্যুর পর রিও ডি জেনিরো শহরে সমাধিস্থ করা হয় গারিঞ্চাকে। চিরো কালের জন্য হারিয়ে গেলেও তার সমাধিতে খোদাই করা আছে কয়েকটি কথা - 'here rests in peace the one, who was the joy of people - Mane garrincha' এবং ' thank you garrincha doa having lived'
- 0 মন্তব্য