• ফুটবল

মিরাকল অফ ইস্তানবুল: দ্যা গ্রেটেস্ট কামব্যাক অফ ফুটবল হিস্ট্রি

পোস্টটি ৯৮০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

দৈনন্দিন জীবন বলতে আমরা কি শুধু গতানুগতিক সাধারণ জীবনধারা কে বুঝাই? কিংবা এই ধারা কি শুধুমাত্র স্বাভাবিকতার চাদরে মোড়ানো? সবার জীবনের অংক নিয়ে হিসাব কষতে বসলে হয়তো উত্তরটি 'না'ই হবে! আমাদের প্রতিটি মানুষের জীবনের সাধারণ ধারাকে যদি সমুদ্র হিসেবে বিবেচনা করি তাহলে আকস্মিকতাকে হয়তো সেই সমুদ্রের উত্তাল সৃষ্টিকারী ধেউই বলতে হবে যা নিয়ে বেঁচে থাকি আমরা সবাই। আচ্ছা, আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় মিরাকল বলতে কি বুঝেন তাহলে আপনার মাথায় কোন জিনিসটা সবার আগে আসবে? আরো বিশদভাবে যদি বলি, ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা মিরাকল কোনটি তাহলে আপনার কোন মুহুর্তটির কথা সবার আগে মনে পড়বে?

হলফ করে বলতে পারবো আমরা  অধিকাংশ সবাই বলবো ২০০৫ সালের ২৫ শে জুনে ঘটে যাওয়া 'দ্যা মিরাকল অফ ইস্তানবুল' এর কথা। সেদিন ইস্তানবুলের আতার্তুক স্টেডিয়ামে যা ঘটেছিলো খোদ নিজ চোখে দেখা ৬৯ হাজার দর্শক পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারেনি। খাদের কিনার থেকে তুলনামূলক ভঙ্গুর দল নিয়ে ২১ বছর পর ইতিহাস রচনা করে নিজেদের ৫ম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা ঘরে তুলে লিভারপুল।

 

পৃথিবীর প্রতিটি দেশ,প্রতিটি শহরের একটি নিজস্ব স্বত্বা, ইতিহাস,সংস্কৃতি বা রং রয়েছে।উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মিউনিখে লাল, মাদ্রিদে সাদা ইত্যাদি।  ঠিক তেমনি ইস্তাম্বুল শহরের প্রতীকী রং লাল। যে লাল রঙের আভা রয়েছে ইস্তাম্বুলের ৩ ক্লাবেও। সেই লাল আভার শহরে ২০০৫ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল দুই ক্লাব এসি মিলান এবং লিভারপুল যাদের ক্লাবেও রয়েছে লাল রঙের ছোঁয়া! দুদলের লড়াইয়ে যোজন যোজনে এগিয়ে ছিলো এসি মিলান। সেটি ছিলো তিন বছরের মাথায় মিলানের দ্বিতীয় ফাইনাল। বছর দুয়েক আগেও ওল্ড ট্রাফোর্ডে জুভেন্টাসকে হারিয়ে ষষ্ঠ ইউরোপীয়ান শিরোপা ঘরে তুলে রোজেনারিরা। দিদা,নেস্তা,মালদিনি,কাকা,শেভচেঙ্কো,পিরলো,গাত্তুসো নিয়ে গড়া মিলান ছিলো সেই প্রজন্মের সবচেয়ে ভয়ংকর এবং অন্যতম সেরা দল।16-43-28-thumb_8835_default_news_size_5

অন্যদিকে মুদ্রার ঠিক উল্টো পিঠ যেন লিভারপুল শিবিরে। সেই সিজনে লিগে অলরেডদের অবস্থান ছিলো টেবিলের পাঁচ নম্বরে যেখানে লিগ জয়ী চেলসির সাথে ব্যবধান ৩৭ পয়েন্টের! এফ এ কাপে বার্নলির কাছে হার এবং লিগ কাপের ফাইনালে পরাজয় মোট কথা যাচ্ছে তাই অবস্থা ছিলো রাফা বেনিতেজের দলের।16-43-47-ce1e7f240dfaebd67f578cf45d51c4c2

শেষ মহারনে মিলান দল সাজায় ৪-৪-২ ডায়মন্ড শেপে। যেখানে ব্যাকলাইনে যথারীতি মালদিনি - নেস্তা - স্ট্যাম-কাফু। ডিপ মিডে পিরলোর ক্যারিশমার সাথে ছিলেন গাত্তুসো,সিডোর্ফ এবং ক্রিয়েটিং রোলে ছিলেন ব্রাজিলিয়ান পোস্টার বয় কাকা।দুইজন ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলেন ক্রেসপো এবং শেভচেঙ্কো।

পক্ষান্তরে লিভারপুল দল সাজায় ৪-৪-১-১ এ। ব্যাকলাইনের ৪জন হলেন: ট্ররোরে,হাইপিয়া,ক্যারিগার এবং ফিনান।ডিপ মিডে ছিলেন লং পাস স্পেশালিস্ট জাভি আলোন্সো। বাকি ৩জনের মধ্যে ছিলেন স্কিপার জেরার্ড, লুইস গার্সিয়া এবং নরওয়েজিয়ান রিসসে। ফরোয়ার্ডে বারোস তার পেছনে স্পেস ক্রিয়েট করে সাহায্যের জন্য ছিলেন কেউয়েল। কাগজে কলমে সব দিক থেকেই এগিয়ে ছিলো মিলান এবং যথারীতি তাদের শকুনের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিলো শিরোপার দিকে।16-41-22-300px-Milan_vs_Liverpool_2005-05-25.svg

 

কিক অফ লিভারপুল! খেলার প্রথম মিনিট থেকেই আগ্রাসী ভাবে খেলতে থাকে রোজেনারিরা যেখানে প্রথম মিনিটের মাথায় কাকাকে ফাউল করে বসে ট্রারোরে। ফ্রি কিক পায় মিলান। পিরলোর ডি বক্সের ভেতর বাড়ানো বলে ফার্স্ট টাচেই বল জালে পাঠালেন মালদিনি।এর সাথে এসি মিলানের হয়ে ইউসিএলে সবচেয়ে বেশি বয়সে গোলের রেকর্ডটি করে নেন নিজের দখলে। ম্যাচ শুরু এক মিনিটের মাথায় ১-০ তে এগিয়ে গেলো এসি মিলান!ac-milan-s-brazilian-forward-kaka-l-hu-5bc34e42126aa1231d000001.jpg&filters[crop][w]=1.0&filters[crop][h]=0.9425051334702259&filters[crop][o_x]=0.0&filters[crop][o_y]=0.002857142857142857&filters[quality][target]=80&type=16-46-40- 

গোল করার পরেও আরো এটাকিং খেলতে থাকে কার্লোর শিষ্যরা। ১৩ মিনিটের মাথায় কাকার বাড়ানো বলে বল আবার জালে পাঠান শেভচেঙ্কো কিন্তু তা অফসাইডের কারনে বাতিল হয়ে যায়। প্রথম হাফে লিভারপুল একমাত্র যে উল্লেখযোগ্য আক্রমন করে সেখানে লুইস গার্সিয়ার বাড়ানো বলে হ্যান্ড বল দাবি করেন অলরেডরা।কিন্তু রেফারি সেই আবেদন নাকচ করে দেয়। এক মুহুর্ত না যেতেই আবার আক্রমনে উঠে মিলান। সেখানে কাকার বাড়ানো থ্রু বলে ডিবক্সের ভেতর বল ক্রস করে ডুডেককে বোকা বানান শেভচেঙ্কো যেখানে এসিস্টে অনায়াসে গোল করেন ক্রেসপো! ৩৯ মিনিট, মিলান ২-০ লিভারপুল।

মিলানের মিডের ক্রিয়েটিভিটির কাছে বারবার পরাস্ত হচ্ছিল লিভারপুল।পুলের মিডফিল্ড আর ফুলব্যাক মিলানের মিডকে প্রেসিং করায় মিলান তাদের দুই উইংয়ে অনেক স্পেস পাচ্ছিল এবং অনেক চান্স ক্রিয়েট হচ্ছিল।ঠিক এই অবস্থাতে আবার কাউন্টারে কাকার বাড়ানো বলে এক দারুণ চিপ শটে গোল করেন ক্রেসপো। তার নিখুঁত ফিনিশিংয়ে ৪৪ মিনিটের মাথায় ৩-০ তে এগিয়ে মিলান যেখানে ২ গোল এই আর্জেন্টিনাইনের।16-47-28-11-Crespo-getty_trans_NvBQzQNjv4Bqu2JAIAJjqha88sTfNbWLJxIv77NmvoUo5gHD4ci8YJI

শুরু থেকে ৪-৪-১-১ এ খেলা লিভারপুল তখন মিলনের ডেডলি মিডের সাথে পাল্লা দিতে পারছিলো না।যার ফলপ্রসূ টাক্টিসে পরিবর্তন এনে লিভারপুল শিফট করে ৪-২-৩-১ এ। যেখানে উপরের তিনজন মিডের সাথে প্রেসিংয়ের উঠত পিভট রোলে থাকা দুইজন। অন্যদিকে মিলানও পরিবর্তন আনে নিজেদের খেলার ধরনে।দল এবার খেলে ৪-৩-১-২ এ যেখানে তিনজন মিডফিল্ডার পিরলো,গাত্তুসো এবং সিডোর্ফ ডিফেন্সিভলি খেলতে থেকে এবং লং বল প্রোভাইড করতে থাকে। ট্রারোরে,হাইপা রা পিরলো মার্কিং করলেও কাজ হচ্ছিল না কারণ বাকি দুইজন ঠিকই পিরলোর ভূমিকা পুষিয়ে দিচ্ছিলো।এই স্কোর যেন অনুমেয় ছিলো তখন। হাফটাইম; লিভারপুল ০-৩ এসি মিলান।

 

ফুটবল এমন একটি খেলা যেখানে শেষ বাঁশি বাজা না পর্যন্ত কেউ অনুমান করতে পারবে না সামনে কি ঘটতে চলছে। সেদিন আতার্তুক স্টেডিয়ামে তেমন কিছুই হয়তো ঘটতে যাচ্ছিল। ইউরোপের সবচেয়ে ক্লাসি ফ্যানবেজের একটি লিভারপুলের সমর্থকরা।সেদিনও নিরলসভাবে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছিল তারা। সেকেন্ডে হাফে লিভারপুল ৩-৫-২ ছকে মাঠে নামে যেখানে অফেন্সিভ রোল প্লে করেন স্কিপার জেরার্ড।মূলত ডিফেন্স ঠিক রেখে খেলার জন্য এই ফরমেশনে নামে বেনিতেজের দল।ব্যাকলাইনে ৩জন থাকার কারনে এটাকের সময়ে বেশি সুবিধা করতে পারেনি কাকা আর মিলানের ২জন ফ্রন্ট লাইনার। এর সাথে ডিফেন্স থেকে ক্যারিগার মাঝে মাঝে উপরে উঠে বল মেকিংয়ের ভূমিকা পালন করছিলেন। সেকেন্ড হাফে বেশ গুছিয়ে খেলা শুরু করে পুল।অবশেষে ৫৩ মিনিটের মাথায় বাম প্রান্ত থেকে রিসসের ক্রসে হেডে গোল করেন ক্যাপটেন জেরার্ড। সাথে সাথে ফেটে পড়ে গ্যালারির দর্শকেরা।চিতকার করে কমেন্টেটর বলে উঠেন -

 

"Hello Hello! Here we go! Steven Gerrard puts a grain of doubt in the back Milan's mind and gives all the many thousands of All Red fans inside the Stadium.It's captain's goal!"16-42-21-Liverpool-vs-AC-Milan-2005-final-1316004

 

৫৩ মিনিটে শুরু হওয়ার সেই ঝড় শেষ হয় ৫৯ মিনিটে।  ৫৬ মিনিটে কেউয়েলের বদলি নামা ভ্লাদিমির স্মিকারের লং-রেঞ্জ শটে ব্যবধান ৩-২ করে লিভারপুল।16-48-03-Champions-League-Final-AC-Milan-v-Liverpool সব শেষে ৫৯ মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল করতে না পেরে ফিরতি শটে আর কোন ভুল করেননি আলোন্সো।সেই ৬ মিনিট মোড় ঘুরিয়ে দেয় পুরো ফাইনালের। ততকালীন মিলান কোচ কার্লো আঞ্চেলত্তির মতে ফাইনালে সেরা দল ছিলো এসি মিলান তবে সেটা 'প্রথম হাফে'! 

মিলান ৩-৩ লিভারপুল!!

নির্ধারিত সময়ে আর গোল না হওয়ায় খেলা চলে যায় অতিরিক্ত সময়ে।  সেখানে শেভচেঙ্কোর এক নিশ্চিত গোল ঠেকিয়ে দেন পোলিশ কিপার ডুডেক। সেখানেও নিষ্পত্তি হয়নি ফলাফল।16-44-54-TELEMMGLPICT000003847002_trans_NvBQzQNjv4Bqu97izp7Iuxauf2FzlVPIdydA0QksjLezJI_lIui_6cQ 

খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। মজার বিষয় হচ্ছে, শেষবার ২১ বছর আগে লিভারপুল যখন ইউরোপিয়ান কাপ জিতে তখন টাইব্রেকারে রোমাকে ৪-২ গোলে হারিয়েছিল।অন্যদিকে ২০০৩ সালে ওল্ডট্রাফোর্ডে জুভেন্টাসকে টাইব্রেকারে ৩-২ গোলে হারায় এসি মিলান।

 

মিলানের পক্ষে প্রথম দুইটি পেনাল্টি মিস করেন সার্জিনহো এবং পিরলো।পক্ষান্তরে প্রথম দুইটি পেনাল্টিতে গোল করেন হামন ও সিসে।মিলানের হয়ে ৩য় ও ৪র্থ পেনাল্টিতে গোল করেন টমারসন এবং কাকা।লিভারপুলের ৩য় শট রিসসে মিস করলেও ৪র্থ পেনাল্টি আর ঠেকাতে পারেনি দিদা।গোল করেন স্মিকার। সমতা আনার জন্য শেষ পেনাল্টিতে স্কোর করা ছাড়া উপায় ছিলো না শেভচেঙ্কোর।কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ডুডেক তা ঠেকিয়ে দেন। 16-45-40-CjP_gopWgAEwbBm

অনেক নাটকিয়তার পর অবশেষে নিজেদের ইতিহাসে ৫ম বারের মতো ইউরোপ শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট ঘরে তুলে লিভারপুল! তার সাথে মিরাকলের পূর্ণতা দান করে অলরেডসরা। পেনাল্টি ঠেকিয়ে ফাইনাল জয়ের নায়ক হিসেবে সমর্থকদের মনে জায়গা করে নেন ডুডেক। আর ওভারঅল পার্ফম্যান্সের কারণে ফাইনাল সেরা হোন ক্যাপটেন জেরার্ড। এই কামব্যাক সম্পর্কে কিংবদন্তি ফুটবলার দিয়েগো ম্যারডোনা বলেছিলেন - 'সেদিন লিভারপুল যা করে দেখিয়েছিল তা ব্রাজিলের সেই ১৯৭০ সালের সোনালি প্রজন্ম হয়তো করে দেখাতে পারতো না'।16-44-04-3504

সেই ফাইনাল হারের পর পিরলো বলেছিলেন - ' এক মুহূর্তের মধ্যে ড্রেসিংরুমের পরিবেশটা অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল।আমরা কেউ বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সবাই সবার মতো চুপ করে মাথা নিচু করে বসেছিল।সত্যি ভয়াবহ রকমের অভিজ্ঞতা সেদিন হয়েছিল। 

২০১৯ সালে গোল ডট কমের এক জরিপে সাংবাদিক এবং ভক্তদের ভোটে সেরা ফাইনাল মাচের তালিকার শীর্ষে ছিলো এই ম্যাচটি।

সামনে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো অনেক শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচ এবং এক্সাইটিং সিচুয়েশন দেখা যাবে।কিন্তু এই ফাইনাল ম্যাচটি অনির্দিষ্ট কালের জন্যে ফুটবল ফ্যানদের মনে বিশেষভাবে দাগ কেটে রাখবে। সেদিন ইস্তানবুলে আতার্তুক স্টেডিয়াম মুখর ছিলো - You'll never walk alone চান্টে যা এখনো কানে বাজে সকল অলরেড ফ্যানদের!17-08-19-Liverpool-vs-A.C-Milan-2005