• ক্রিকেট

গল্পটা আর্জেন্টাইন রূপকথার, তবে ক্রিকেটে!

পোস্টটি ১৬৩৭ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ফুটবলের দেশ, মেসির দেশ, ম্যারাডোনা-রিকুয়েলমে-ওর্তেগার দেশ আর্জেন্টিনাতে ক্রিকেটের পরিচিতি ঘটে ১৮০৬-১৮০৭ সালের দিকে। শুরুর দিকে অবশ্য শুধু পরিচিতিতেই ক্রিকেটের এই উত্থান থেমে থাকেনি, বরং উনিশ শতকের শুরুর দিকে আর্জেন্টিনাতে ক্রিকেট ছিল রীতিমত জনপ্রিয় একটি খেলা। ক্রিকেট খেলার এই জোয়ারে আর্জেন্টিনাতে তাই ১৮৬৪ সাল নাগাদ একটা ক্রিকেট ক্লাবও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। ঐতিহ্যের সাক্ষী সেই ক্লাবের নাম-  বুয়েন্স এইরেস ক্রিকেট ক্লাব! 

আপনি যদি ভেবে থাকেন একটা ক্রিকেট ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেই ফুটবলের দেশে ব্যাট-বলের রাজত্ব ক্ষান্ত হয়েছে তাহলে ভুল করবেন। উনিশ শতকের শেষ দিকে, ১৮৯৭-৯৮ নাগাদ ক্রিকেটের বার্ষিক টুর্নামেন্ট প্রিমিয়ার ডিভিশনও চালু করে ফেলে আর্জেন্টিনা। গল্পের এতটুকু শুনে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আজকের গল্পটা আর্জেন্টিনার- তবে ফুটবলের নয়। আর্জেন্টিনা ক্রিকেটের সবচাইতে ঐতিহ্যের গল্প, তর্কসাপেক্ষে ক্রিকেটের সবচাইতে বড় 'আপসেট' গুলোর একটার গল্প আজকে নাহয় জেনে ফেলা যাক! 

মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব, এমসিসি। ১৯২৬-২৭ সাল নাগাদ এমসিসির একটা দল দক্ষিণ আমেরিকা সফরে বের হয়। সেই সফরে দলটি খেলে গোটা দশেক ম্যাচ। মজার ব্যাপার হল, ফিক্সচার অনুযায়ী সেই ১০ ম্যাচের সাতটির ভেন্যুই ছিল আর্জেন্টিনা, আর বাকি তিনটি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল যথাক্রমে উরুগুয়ে, চিলি আর পেরুতে। বাকি তিন ম্যাচ নিয়ে অবশ্য আজকে আমার কোন মাথাব্যাথা নেই। কিন্তু ঐ সাত ম্যাচের একটাতেই যে ইতিহাস রচিত হয়ে গেছে, সেটা না জানা বড্ড পাপ বৈকি! 

ম্যাচটা ছিল বুয়েন্স এইরেস ক্রিকেট ক্লাবের মাঠেই, যেখানে আর্জেন্টিনা একটা ক্রিকেট ম্যাচে হারিয়ে দেয় এমসিসি ক্রিকেট ক্লাবকে...... আদতে তো ইংল্যান্ড দলকেই! 

প্রথম দিনঃ ইতিহাস শুরুর দিন?

ম্যাচের প্রথম ব্যাটন তুলে নেয় টিম আর্জেন্টিনা। শুরুতে ব্যাট করতে নামা আর্জেন্টিনার হয়ে ব্যাট করতে নামেন হেনরি মার্শাল আর জন নক্স। এমসিসির পেলহাম ওয়ার্নারের বলে পার্টনারশিপ ভেঙে যাওয়ার আগে এই জুটি স্কোরবোর্ডে তুলতে পারে মোটে ৩১ রান। আর্জেন্টিনার জন্যে অবশ্য সেটাই যথেষ্ট ভাল ছিল বলা যায়। তবে আর্জেন্টিনার সুখ কিন্তু খুব বেশিক্ষণ কপালে সইল না। সমারসেটের স্পিনার জ্যাক হোয়াইটের বাঁহাতি স্পিনের ভেলকিতে আর গাবি অ্যালেনের পেস তান্ডবে আর্জেন্টিনা অল-আউট হয়ে যায় মাত্র ৬৫ ওভার ২ বলে, স্কোরবোর্ডে ১৩৪ রান তুলেই! তবে বোলিং ভেলকিতে টম হেন্ডারসনের লেগব্রেকের কথা না বললে অবশ্য হেন্ডারসনের প্রতি অন্যায় হয়ে যায়। 

প্রথম ইনিংস শেষে জ্যাক হোয়াইটের বোলিং ফিগার ছিল ঈর্ষণীয়, ৬৫ রানের বিনিময়ে ৫ উইকেট। অন্যদিকে আর্জেন্টিনার বেঁধে দেওয়া ১৩৪ রানও এমসিসির জন্যে একেবারেই কঠিন ছিল না। তবে আর্জেন্টাইন সেনসেশন ডর্নিং এর পরিকল্পনা কিছুটা অন্যরকমই ছিল। ইংলিশ এই ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের ব্যাটসম্যানদের জন্যে সেদিন যেন দক্ষিণ আমেরিকান ডর্নিং সাক্ষাৎ যমদূতের মতই আবির্ভূত হয়েছিলেন, স্কোরবোর্ডে মোটে ২৩ রান তুলতেই তাই এমসিসি হারিয়ে ফেলে ৩ উইকেট! 

দ্বিতীয় দিনঃ এমসিসির ডুব! 

'ইগো স্পোর্টস' হিসেবে এমনিতেই ক্রিকেটের বেশ নামডাক আছে, ইংলিশদের জন্যে তো সেটা রীতিমত মান-মর্যাদার ব্যাপার। আর তাই এমসিসি ক্রিকেট ক্লাব যখন আনকোরা আর্জেন্টাইনদের কাছে নাস্তানাবুদ হয়ে প্রথম দিন শেষ করেছে, দ্বিতীয় দিনের লক্ষ্যই ছিল তাই মান বাঁচানোর লড়াই...... আর যাই হোক আর্জেন্টিনার কাছে তো আর হারা যায়না! 

তা এমসিসির সে ভাবনা কিন্তু অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায় যখন ইশারউড দ্বিতীয় দিনের সকালের শুরুতেই এমসিসির বিপদকে আরো বাড়িয়ে দিয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে আসেন। ইশারউড ফিরে যাবার পর ক্রিজে থাকা ওয়ার্নার তখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। পারতপক্ষে ডর্নিং আর ওয়ার্নারের মধ্যে লড়াইটা তখন বেশ ভালভাবেই জমে ওঠে। তবে দলীয় সর্বোচ্চ ২৮ রান করে ওয়ার্নারও বিদায় নেওয়ার পর এমসিসির ইনিংস আর বেশিদূর এগোয়নি, গুটিয়ে যায় মাত্র ৮৯ রানেই! 

আর্জেন্টিনার সময় তখন স্বপ্নের মত। ইংলিশদের ঐতিহ্য এমসিসির চাইতে এগিয়ে রয়েছে আর্জেন্টিনা, এগিয়ে থেকেই নামছে ব্যাট হাতে। আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়েরা তখনও জয়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন কিনা এখন হলফ করে বলা যায়না। তবে যদি তা দেখেও থাকে, সেটাও একটা বড়সড় ধাক্কা খেতে সময় লাগেনি। আর্জেন্টিনার জন্যে আবারও আতঙ্ক হয়ে হাজির হন জ্যাক হোয়াইট, এবার তাকে সঙ্গ দেন অ্যালেন! দুজনেই চারটি করে উইকেট ভাগাভাগি করে নিলে দ্বিতীয় ইনিংসে আর্জেন্টিনার স্কোর থেমে যায় মাত্র ৬৩ রানে!

এমসিসির জয়ের জন্যে তখন চাই ১০৯ রান! 

এমনিতে কাগজে কলমে এই অল্প রানের টার্গেট এমসিসির জন্যে মাথাব্যাথার কারণ হবে , এমনটা ভাবা তখন ছিল বোকামি। কিন্তু খেলাটা যখন ক্রিকেটের তখন নিশ্চয়তা শব্দটা যেন বড্ড বেশি হাস্যকর শোনায়। আর সেটাকেই সত্যি প্রমাণ করতে যেন এমসিসি দিন শেষ করে ২৪ রানে ২ উইকেট হারিয়েই, আট উইকেট হাতে নিয়ে ইংল্যান্ডের তখনও দরকার ৮৫ রান!

আর্জেন্টিনা কি তবে ইতিহাসের কাছাকাছি?! 

তৃতীয় দিনঃ আর্জেন্টাইন ইতিহাসের দিন!

সত্যি বলতে এই ম্যাচটা আরো আগেই রঙহীনভাবে শেষ হতে পারত, বিশেষ করে স্কোরবোর্ডে ৫১ রান তুলতেই যখন তৃতীয় দিনে এমসিসি হারিয়ে ফেলেছে ৯ উইকেট। তবে ঐ যে ক্রিকেট, অমোঘ অনিশ্চয়তায় সে আপনাকে অবগাহন করিয়ে আনবে। ঠিক শেষ উইকেট জুটিতে এমসিসির হয়ে তাই দাঁড়িয়ে গেলেন জেরি ওয়েইগাল আর লর্ড ডাংল্যাস! 

আর্জেন্টিনার তখন মাথায় হাত। তীরে এসে কি তবে ডুবে যাবে তরী? নাহ, আর্জেন্টিনার সহায় তখন আবারও ডর্নিং। চমৎকার এক কটবিহাইন্ডে ডাংল্যাসকে পরাস্ত করে শেষ উইকেট জুটি তিনি ভেঙে দেন ২৮ রানেই! আর তখন ? আর্জেন্টিনা তখন ইতিহাসের সাক্ষী। ইংলিশ ঐতিহ্যের এমসিসিকে তাঁরা ক্রিকেটে হারিয়ে দিয়েছে। যে দেশটাতে ক্রিকেট বড় খেলা নয়, যে দেশটাতে গেল দশকের শেষদিকে সবেমাত্র চালু হয়েছে একটা বার্ষিক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, সেই দেশটাতে হারিয়ে দিয়েছে এমসিসিকে! 

আর্জেন্টিনা ক্রিকেটের এখন বেহাল দশা। লাতিন ফুটবলের জাদুতে আর ক্রিকেটবিমুখতায় সে দেশে এখন আর ক্রিকেটের প্রচার আর প্রসার নেই। আর্জেন্টিনার সবচাইতে আশাবাদী মানুষও আর এখন এমসিসি/ইংল্যান্ডকে ক্রিকেটে হারানোর স্বপ্ন দেখে না এ কথা নিশ্চিত, নিকট ভবিষ্যতে সে সম্ভাবনাও নেই। তবুও, অতল গহ্বরে চলে যাওয়া এই দেশের ক্রিকেটেই যে আছে এক রূপকথার গল্প সে কথা তো এখন আর না বলে দিলেও চলে! 

স্কোরকার্ড

আর্জেন্টিনাঃ ১৩৪ (কিনেথ হেন্ডারসন ৩২ ;  জ্যাক হোয়াইট ৫-৬৫, টম জেমসন ৩-২৪) এবং ৬৩ (জ্যাক হোয়াইট ৪-২১, গাবি অ্যালেন ৪-৩২)

এমসিসিঃ ৮৯ (হার্বার্ট ডর্নিং ৭-৩৮) এবং ৭৯ (ডিনেট অ্যাইলিং ৬-৩২, হার্বার্ট ডর্নিং ৩-২৯)

ফলাফলঃ আর্জেন্টিনা ২৯ রানে জয়ী! 

ম্যাচসেরাঃ নাহ, ক্রিকেটে সেসময় ম্যাচসেরার পুরষ্কার ছিল না। এই পুরষ্কারের প্রচলন শুরু হয়েছে সেই ম্যাচেরও অর্ধশতাব্দী পরে। তবে সেসময় ম্যাচসেরার কোন পুরষ্কার থাকলে সেটা কে হত?

হার্বার্ট ডর্নিং ছাড়া আবার কে?