• ক্রিকেট

স্ট্যাম্প হাতে সাকিবঃ স্বীকৃত নন, তবে নিন্দিতও নন!

পোস্টটি ১৩৯৪ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

সাকিব আল হাসান বিতর্কের পিছে লেগে থাকেন, নাকি বিতর্ক সাকিব আল হাসানের পিছে লেগে থাকে সেটা একটা পুরনো প্রশ্ন। তবে সাকিব বিতর্কের রথে শেষ সংযোজন, আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে সাকিবের অখেলোয়াড়সুলভ মতান্তরে 'প্রতিবাদী' আচরণ! পিচভিশন আর লাইভ খেলা দেখানোতে পুরো ঘটনা অবশ্য এখন সবার সামনে পরিষ্কারই। তবুও লেখার শুরুতেই দুটো ঘটনা আরেকবার বলে নেওয়া যক। 

ঘটনা একঃ মুশফিকুর রহিমের এলবিডব্লুর আবেদনে সাড়া না দেওয়ায় স্ট্যাম্পে লাথি মেরে বসেন সাকিব আল হাসান।

ঘটনা দুইঃ আম্পায়ার গ্রাউন্ডসম্যানদের পিচকভার আনতে বললে স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলেন সাকিব আল হাসান।

সাকিব আল হাসান যে অখেলোয়াড়সুলভ আচরণ করেছেন, সেটাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সবচাইতে বড় প্রশ্ন হয়ে যেটি দাঁড়াচ্ছে, সাকিব আল হাসান কেন এমনটা করেছেন? আবাহনীর মুশফিকুর রহিমের এলবিডব্লুর আবেদনে সাড়া না দিলে সাকিবই বা আম্পায়ারের উপরে এত ক্ষেপে গেলেন কেন?

এই 'কেন'র উত্তর জানত আমাদেরকে ফিরতে হবে আরেকটু পেছনে। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে আবাহনী ইতোমধ্যেই খেলে ফেলেছে গোটা সাতেক ম্যাচ। মজার ব্যাপার হল, এই সাত ম্যাচে আবাহনীর কেউ কখনও লেগ বিফোরের ফাঁদে আটকা পড়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে যাননি। এখন এমনটা হতেই পারে, সরল মনে আপনি ভাবতেই পারেন যে অতি সতর্ক আবাহনীর ব্যাটসম্যানদের কেউ লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলতে পারেনি। তা সেই সরল প্রশ্ন আবারও প্রশ্নবিদ্ধ হবে যদি আপনি একটু চোখ বুলিয়ে দেখেন এই সাত ম্যাচে আবাহনীর ম্যাচ পরিচালনায় কারা কারা ছিলেন? 

সাত ম্যাচে আবাহনীর ম্যাচগুলোতে দায়িত্ব পালন করেছেন মোট ছয়জন আম্পায়ার। কে কতটি ম্যাচ পরিচালনা করেছেন সেটার একটা তালিকা নিচে দেওয়া হল-

আম্পায়ার ম্যাচ
ইমরান পারভেজ ৪ টা
মাহফুজুর রহমান ৩ টা
সোহরাব হোসেন ৩ টা
মোজাহিদুজ্জামান ২ টা
হাবিবুর রহমান ১ টা
তানভীর আহমেদ ১ টা

উপরের তালিকাটাতে একবার চোখ বুলালেই দেখতে পাবেন, এই ছয় আম্পায়ারের মধ্যে একমাত্র তানভীর আহমেদ ছাড়া আর কারো আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনার অভিজ্ঞতাই নেই। যে তানভীর আহমেদের এই অভিজ্ঞতা আছে তাঁর গায়েও লেপ্টে আছে পুরনো বিতর্কের গন্ধ, তাও তিনি ছিলেন মোটে একটা ম্যাচে!

অথচ, এই ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের আম্পায়ার্স প্যানেলেই আছেন গাজী সোহেল আর শরফুদ্দৌলা সৈকতের মত আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনার অভিজ্ঞতা থাকা আম্পায়ারেরা। এখন এই দুইজন অবশ্যই আবাহনীর সব ম্যাচেই আম্পায়ারিং করবেন না। কিন্তু তাই  বলে আবাহনীর কোন ম্যাচেই এদের দুইজনকে/ আন্তর্জাতিক ম্যাচের অভিজ্ঞতা থাকা আম্পায়ারদের দায়িত্ব দেওয়া হবে না সেটাও তো একটা বড় প্রশ্নের জন্মই দেয়। 

এছাড়াও, ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে পক্ষপাতিত্বমূলক আম্পায়ারিংয়ের নমুনা চলে আসছে বহু আগে থেকেই। সে হিসেবের রেশ টানলেও সাকিব আল হাসানের রেগে যাওয়াটাও স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, রেগে গিয়ে তিনি করলেন টা কি? 

সাকিব আল হাসান প্রতিবাদী, এটা আমরা সবাই জানি। দেশ ছাড়িয়ে বিশ্ব মিডিয়াও জেনে গেছে সাকিবের ঘাড়ত্যাড়ামি। এইতো এপ্রিলের ছয় তারিখে ভারতীয় ক্রিকেটবিষয়ক ওয়েবসাইট ক্রিকট্রাকার  সাকিব আল হাসানকে নিয়ে একটি ফিচার প্রকাশ করেছিল এই শিরোনামে,

Shakib Al Hasan is bold, the world knows it, so does Bangladesh Cricket

কিন্তু সাকিব আল হাসান যেটাই করেন, সেটাই কি বোল্ডনেসের কাতারে পড়ে? এই যেমন কাল তিনি যেভাবে স্ট্যাম্প উপরে ফেলে দিলেন, এমন প্রতিবাদে সাকিব  আল হাসান হয়তো খবরের শিরোনাম হয়েছেন, কিন্তু কিছুই কি তিনি পরিবর্তন করতে পেরেছেন? এটা সত্যি যে সাকিব একা হাতে কিছুই পরিবর্তন করতে পারবেন না, কিন্তু আদর্শিক প্রতিবাদ যে নিজের বোল্ডনেস টিকিয়ে রেখেও করা যায় এমন উদাহরণ তো সাকিব নিদাহাস ট্রফিতেই আমাদেরকে দেখিয়েছেন।

আবার, ম্যাচের দ্বিতীয় যে ঘটনাটি যেখানে সাকিব আল হাসান তিনটে স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলে দিয়েছেন ওখানে ম্যাচ কাভারে ঢেকে গেলে আর বল মাঠে না গড়ালে কিন্তু ডাকওয়ার্থ লুইস মেথডে ম্যাচটা জিতে যায় সাকিবের মোহামেডানই। সে হিসেবে তাই আমরা ধরে নিতে পারি, সাকিব আল হাসান শুধুই দলীয় স্বার্থ বিবেচনা করেই কাজটা করেননি। সাকিবের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে কাজ করেছে অন্যকিছু। সেই অন্যকিছুটা কি? ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বিতর্কের জাল খবরের শিরোনামে তুলে ধরা? নাকি ম্যাচের রেশ ধরে থাকা শুধুই একটা ঘটনা প্রবাহ?

তা যেটাই হোক, সাকিব আল হাসান ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের বিতর্ককে শিরোনামে তুলে ধরতে পেরেছেন সেটা কিন্তু নির্দ্বিধায় বলা যায়। দেশের সব মিডিয়াই এখন সাকিব আল হাসানের এমন ঘটনাতে নড়েচড়ে বসেছে, ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের পুরনো বিতর্কগুলি নিয়েও কথা হচ্ছে কোথাও কোথাও।

এখানেই আবার একটা প্রশ্ন সামনে চলে আসছে, এমন কাজের পর সাকিব কি তাহলে সুপারহিরো হয়ে গেলেন? কিংবা সাকিবকে শাস্তি দেওয়া হলে সাকিবের সবচাইতে কাছের মানুষের মতে সাকিবকে নিয়ে নাকি ষড়যন্ত্র হয় সেটাই সত্যি হবে?

আসলে সেটাও না। আগেই বলেছি, প্রতিবাদের আদর্শ নমুনা আমাদেরকে সাকিব আল হাসানই দেখিয়েছেন। সে হিসেবে সাকিব যেটা করেছেন একটা অন্যায়কে তুলে ধরতে তিনি আরেকটা অন্যায়ের আশ্রয় নিয়েছেন। সাকিবকে তুলনা দেওয়া হয় যে রথী মহারথীদের সাথে, সেই রথী মহারথীরাও কিন্তু পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং এর প্রতিবাদ করেছেন। সুনীল গাভাস্কার তো মাঠ ছেড়ে বেরিয়েই গেছিলেন। সেই প্রতিবাদ, নিদাহাস ট্রফির সাকিবের নিজের প্রতিবাদের সাথে মোহামেডান ম্যাচের সাকিবের 'প্রতিবাদ' এর মধ্যে কিঞ্চিৎ পার্থক্য আছে। সেই পার্থক্য সাকিব নিজেই খুব সম্ভবত ভালভাবে বলতে পারবেন।

সে হিসেবে সাকিব আল হাসান তাই 'সুপারহিরো' হয়ে যাননি, কিন্তু তাই বলে সাকিব নিন্দিতও হয়ে যাননি। দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের দুর্নীতির শেকলে তিনিই প্রথম আঁচড় কাটলেন, সেটা পরিণতিবোধ ব্যতিরেকে হলেও। আমরা তাই যারা আবাহনী ছায়া জাতীয় দল নিয়ে খেলতে নামলে কথা বলিনা, ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে আম্পায়ারিংয়ে নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব দেখলে আওয়াজ তুলিনা তাঁরা তাই সাকিব আল হাসানকে বলিকাঠের সামনেও তুলতে পারিনা। এটা আমাদের শোভা পায়না। 

তবে, সাকিব আল হাসানের এমন কাজকে সুপারহিরোইক প্রতিবাদের সাথে তুলনা করারও কোন অবকাশ নেই। এটাকে স্বীকৃতি দেওয়ারও কোন সুযোগ নেই। একটা অন্যায়কে রুখতে আরেকটা অন্যায়কে মহৎ করার অর্থ অন্যায় জিনিসটাকেই একটা ফ্লোর করে দেওয়া! স্ট্যাম্প হাতে সাকিব আল হাসান তাই সুপারহিরো নন,স্বীকৃত নন, তবে নিন্দিতও নন!