শরণার্থী-বালিকা যখন আর্ন্তজাতিক ফুটবল সুপারস্টার
পোস্টটি ১৫০৬ বার পঠিত হয়েছেআফগানিস্থান মধ্য ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার একটি পার্বত্য-দেশ। আজ থেকে ৬০-৭০ বছর আগেও এদেশের মানুষের দেশপ্রেম, মন-মানসিকতা, ধর্ম ভীরুতা ও অতিথি পরায়ণতা ছিল পৃথিবী খ্যাত। কিন্তু বিশ্বের পরাশক্তিদের কুটচালের প্ররোচনায় ও ওপিয়াম চাষের লোভে ১৯৭৮ ইং পর থেকে অদ্যাবধি দিনের পর দিন সেখানে চলছে মধ্যযুগীয় কায়দায় দাঙ্গা, হাঙ্গামা, ধ্বংস-লীলা, হত্যা, নারী-নির্যাতন, নারীর সর্ব প্রকার অধিকার হরন ও হনন ইত্যাদি। তবে সবই ঘটছে বর্তমান পৃথিবীর অত্যাধুনিক মারোনাআস্ত্রের সাহায্যে। আফগানিস্থানের নাম শুনলেই মনে হয় তালেবানের হাতে একে-৪৭ রাইফেল বা আল-কায়দার হাতে কালাশনিকভ রাইফেল। অথবা বদ্ধঘরে অবরুদ্ধ কোন এক নারী যেন মানসিক বা শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ বিধস্ত, যার আপাদমস্তক বোরখায় ঢাকা, শুধু কান্না ভেজা চোখ দুটো জানালার পানে তাকিয়ে-কিন্তু সরবে কান্নারও অনুমতি নেই তার।
সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় আফগানিস্তানের তৃতীয় বৃহত্তম শহর হেরাতে জন্ম গ্রহন করেছিলো জানুয়ারি ০২, ১৯৮৮ ইংতে নাদিয়া নাদিম নামে এক বালিকা, তারা ছিল মোট ৫ বোন, মার নাম হামিদা নাদিম আর বাবা রাবানি নাদিম। রাবানি নাদিম আফগান ন্যাশনাল আর্মির জেনেরেল ছিলেন, আফগান ন্যাশনাল হকি টিমের প্রাত্তন খেলোয়াড়ও ছিলেন এবং নাদিয়া নাদিম বাবার সাথেই প্রথম বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডে ফুটবল খেলেন শৈশবে। রাবানি নাদিমকে ২০০০-ইংতে তালিবানরা হত্যা করে। ৫ মেয়েকে নিয়ে তার মা দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন। হামিদা নাদিম তার পাঁচ মেয়েকে নিয়ে শুভাকাক্ষিদের সহায়তায় মাইলের পর মাইল পায়ে হেটে বা কখনও গাধার পিঠে চড়ে আবার কখনও মালবাহী ট্র্যাকে চড়ে পালিয়ে আসেন পাকিস্তানে। কিন্তু মৃত আফগান জেনেরেলের পরিবারের নিরাপত্তা কোথাও মিলেনি। কেটেছিল সময় শুধু আতঙ্কে আর অনিশ্চয়তায়। শুভাকাক্ষিদের সহায়তায় পরিকল্পনা তৈরি করেন হামিদা নাদিম, ৫ মেয়েকে নিয়ে ছদ্বনামে পাসপোর্টের আর টিকেটের সাহায্যে ইটালি হয়ে ইংল্যান্ডে যাওয়ার, যেখানে তাদের কিছু আত্মীয় স্বজন ছিল। অতি গোপনে তারা ৬ জন পরমকরুনাময়ের অশেষ কৃপায় নরপশুদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পাকিস্তানের আকাশ সীমা অতিক্রম করে দ্বিতীয় বার জীবন পেলেন ইটালির পথে পাড়ি দিয়ে, কিন্তু সামনে অপেক্ষা করছিলো দ্বিতীয় দফার জীবন যুদ্ধ।
ইটালিতে পৌঁচেছিলেন কিন্তু ইংল্যান্ডে যাওয়া নিয়ে নানা বিপত্তি উপস্থিত হোল। শেষ পর্যন্ত সেই ভুয়া পাসপোর্টের উপর ভর করে কার্ভাড ট্রাকে সাওয়ার হলেন তারা ইংল্যান্ডে যাওয়ার জন্য, কিন্তু বিধি বাম। ৫০ ঘণ্টার অভুক্ত অবস্থায় জার্নির পর ডেনমার্কের এক গহীন জঙ্গলের মাঝে অবস্থিত এক রিফুজি ক্যাম্পে তাদেরকে নামিয়ে দেওয়া হোল। চারিদিকে বিশাল কাঁটাতারের বেষ্টনী, সামনে খোলা মাঠ আর চারিদিকে হাঁটছে নিরাপত্তা রক্ষীরা। ক্ষুধার যন্ত্রণায় ইশারায় নিরাপত্তা রক্ষীদের কাছে অনেকটা ভিক্ষুকের মতই খাবার চাইলো তারা। নিরাপত্তা রক্ষীরা তাদের কলা, দুধ আর রুটি দিলো। তারপর দেখিয়ে দেওয়া হোলা তাদের তাঁবু।
ভোরে উঠে দেখলো বিশাল মাঠের ওপারে ফুটবল ট্র্রেনিং একাডেমীর বিশাল কাঁটাতারের বেষ্টনী। রিফুজি ক্যাম্পের সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষে ক্যাম্পের স্কুলে যাওয়া শুরু করলো মেয়েরা। নাদিয়া নাদিমের ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার। কিন্তু স্কুল থেকে ফেরার পথে জীবনে চাক্ষুষ প্রথমবার দেখল সেই একাডেমীতে মেয়েরা হাফ প্যান্ট পরে সকার বা ফুটবল খেলছে। নাদিয়ার কায়োমনে এক অজানা উল্লাস ও উৎসাহ শিহরিত হোল।
ক্যাম্পের অন্যান্য ছেলেমেয়েদের নিয়ে একাডেমীতে যেয়ে এবার হাত পাতলেন পুরাতন বলের জন্য। বাচ্ছাদের আগ্রহ দেখে একাডেমী কতৃপক্ষ তাদের ২৩ টি পুরাতন বল দিয়ে দিলেন। তার নেতৃতে সেগুলোকে পাম্প করে খেলার উপযোগী করে তোলা হোল। কিন্তু নাদিয়ার একাগ্রতা, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যাবসায়, টাইম-ম্যানেজমেন্ট, অনুকরণশৈলী ও আগ্রহ ছিল অতুলনীয়। স্কুলে ও স্কুল-হোম ওয়ার্কে সে ছিল পারফেক্ট। ঠিক তেমনিভাবে একাডেমীর মেয়েদের ফুটবলের শুটিং, পাসিং, ড্রিবলিং, ডজিং, ট্যাঁকলিং, কনট্রোলিং, ড্রাগ ফ্লিক, ইনসাইড ফ্লিক, ক্লাম্প স্পিন, আউট সাইড ফ্লিক, ক্লাম্প জাম্প, হিল টো ফ্লিক, ক্রস ওভার ফ্লিক, ক্লাম্প স্ম্যাশ, ব্রাজিলিয়ান ফ্লিক, রিভেরস ক্লাম্প, পোপ আপ ইত্যাদি চোখ দিয়ে দেখে আত্তীকরণে ছিল অসাধারণ মেধা ছিল নাদিয়ার ; যা সে প্র্যাকটিসের সময় বার বার অনুশীলনের মাধ্যমে রপ্ত করে ফেলেছিল। প্র্যাকটিসের সময় সে অনুধাবন করে ফেলে ফুটবলের বেসিক জিনিসগুলো, যথা-স্ট্রেন্থ,স্টামিনা, স্কিল, স্পীড, সেন্স, রিবনা, বাম্পি ফ্লিক, ফ্লিক এন্ড হিল, অফ ব্যাক লেগ, নো লুক পাস, টু ফুট্টে লিফ্ট ইত্যাদি। রিফুজি ক্যাম্পে থাকা কালীন সময়ে তার মা টেম্পোরারি ওয়ার্ক পারমিট পায় এবং তিনটি কাজ করতো, তাতে ছয়জনের সংসারে পেট ভরতো, কিন্তু মনের তেষ্টা মিটতো না। তাই নাদিয়া যোগাড় করলো একটি পুরাতন বাইসাইকেল, যোগাড় করলো ওয়ার্ক পারমিট আর শুরু করলো ভোররাতে উঠে নিউজ পেপার বিলি করা-কারণ তার চাই সংসারকে ও মাকে সাপোর্ট করা আর ফুটবল গির্য়াস কেনার অর্থ জমানো। পনেরো বছর বয়স থেকেই সে পড়াশুনা, খেলাধুলা ও অর্থ উপার্জন-এই তিন নিয়ে রীতিমত বিরতিহীন প্রফেশনাল জীবন শুরু করে দিল। এ যেন অনেকটা- “মন্ত্রের সাধন বা শরীরের পতন”।
নাদিয়া নাদিম ২০০৪ ইং তে ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করেন ক্লাব বি৫২ এলবর্গ দিয়ে তার পলিটিক্যাল এ্যসিলাম গ্রান্ট হওয়ার পর পরই। ৫ ফুট ৯ ইি উচ্চতার তার পজিসোন হলো ফরওয়ার্ডে। ২০০৫-২০০৬ ইংতে খেলেন ক্লাব ভির্বগের পক্ষে। তার হোম সিটি ছিল ডেনমার্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী আরহুস। ২০০৬-২০১২ ইংতে খেলেন ক্লাব আইকে স্কভবাকেনের পক্ষে। ২০১২-২০১৫ ইংতে খেলেন ক্লাব ফরচুনা হজ্রিংর পক্ষে। ২০১৫-২০১৬ ইংতে খেলেন ক্লাব স্কাই বুø এফসির পক্ষে (ইউএসএ)। আবার ২০১৫-২০১৬ ইংতে খেলেন ক্লাব ফরচুনা হজ্রিংর পক্ষে। ২০১৬-২০১৭ ইংতে খেলেন ক্লাব পোর্টল্যান্ড র্থন্সের পক্ষে (ইউএসএ)। ২০১৮ ইংতে খেলেন ক্লাব মানসীটির পক্ষে (ইংল্যান্ড)। ২০১৯-২০২১ ইংতে খেলেন ক্লাব প্যারিস সেন্ট জারমেইনের (পিএসজি-ফ্রান্স) পক্ষে ও চ্যাম্পিয়ান হন । ২০২১ ইংতেও খেলছেন ক্লাব প্যারিস সেন্ট জারমেইনের (পিএসজি-ফ্রান্স) পক্ষে।
৩৩ বছর বয়সী নাদিয়া নাদিম আফগানিস্থান ও ডেনমার্কের নাগরিক। সে বর্তমানে মেডিক্যাল স্কুল অব আরহুস ইউনিভার্সিটিতে গ্রাজুয়েশন শেষে রিমোটলি রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারিতে র্কাযরত। ২০১৬ ইং তে ড্যানিশ টিভি ডিয়ার ৪ টি এপিসোডের মাধ্যমে নাদিয়া নাদিমের ডকুমেনটরি তৈরি করেন যা ডেনমার্ক থেকে সুদূর ইউএস পর্যন্ত প্রচারিত হয়েছে। সে অনর্গলভাবে ১০-১১ ভাষায় কথা বলতে পারে। ২০১৭ইং তে সে ডেনমার্কে নাইকির ব্রান্ড-এ্যম্বাসেডর হন, এ ছাড়াও সে এয়ার জর্ডান, হুগো বস, ভিসা, র্মাটিনি রস ইত্যাদির সাথে কাজ করেন। ২০১৮ ইংতে র্ফোবস ম্যাগাজিন তাকে পৃথিবীর সকল নারী এথেলেটদের মাঝে ২০তম শক্তিশালী নারী হিসাবে ভূষিত করে। ২০১৯ ইংতে তাঁকে পৃথিবীতে নারী-শিক্ষার মানোন্নয়ন, স্পোর্টসে অবদান ও লিঙ্গ সমতা আনার অবদানের জন্য ইউনেস্কো চ্যাম্পিয়ন হিসাবে ভূষিত করেন। মে ২৬, ২০২১ ইংতে ড্যানিশ পাবলিশার তার আত্মজীবনী ভিত্তিক বই “মাই স্টোরি” প্রকাশ করেন, যা ফ্রেন্চ ও ইংরেজিতে অনুদিত হোয়েছে। সে ডেনমার্কের পক্ষে ৯৮ ম্যাচ খেলেছেন আর তার ব্যক্তিগত সর্বমোট গোল সংখ্যা ২০০-র উপর। সে ফুটবল থেকে অবসরে যাওয়ার পর ফুলটাইম ডাক্তারি বিদ্যাকে কাজে লাগাতে চান দুস্থ মানবতার জন্য, যারা সমাজে নানাভাবে অত্যাচারিত ও নিপীড়িত। ইতিমধ্যেই সে নানা দাতা সংস্থার সাথে কাজ করছেন। ডেনমার্কে না এসে ইংল্যান্ডে চলে গেলে তার জীবন কাহিনী হয়তোবা অন্য রকম হতো। তাই ডঃ রাই বাচ্চানের (অমিতাভ বাচ্চানের বাবা) কথাটি মনে হয়-“যা হয়েছে তা ভাল হয়েছে, আর যা হয়নি তা বোধ হয় আরো ভাল হয়েছে”।
- 0 মন্তব্য