• ফুটবল

ইউরো বনাম কোপাঃ লাতিন ফুটবলের দিন শেষ?

পোস্টটি ৩৩৬৭ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ফিসফাসটা শোনা যাচ্ছিলো অনেক দিন ধরেই। সেই ফিসফাসটা গুঞ্জনে পরিণত হলো যখন বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ঘরের মাঠে ব্রাজিল ৭-১ গোলে নাস্তানাবুদ হলো জার্মানির কাছে। আর এখন গুঞ্জন ছাপিয়ে সবাই জোরেশোরেই বলতে শুরু করেছে। লাতিন ফুটবলের দিন শেষ, বিশ্বকাপটা আজীবনের জন্যেই হয়তো ইউরোপের দলগুলোর সম্পত্তি হয়ে গেলো।

এই প্রশ্নটা এবার আরো জোরেশোরে ওঠার কারণ একই সাথে ইউরো আর কোপার আয়োজন। সন্ধ্যা থেকে যেখানে ইউরোর গতিময়, আক্রমণ-পাল্টা আক্রমনে ভরপুর ফুটবলে নজর ফেরানোই দায়, সেখানে ভোরবেলা গা জোয়ারি, ধীরগতির, ফাউল সর্বস্ব কোপা দেখতে গিয়ে চোখ খোলা রাখাই তো কষ্টকর। সে আপনি যত বড় ফুটবল ফ্যানই হোন না কেন। কিন্তু লাতিন ফুটবলের এই অবস্থার পিছনে কারণটা কি?

লাতিন বোর্ডগুলোর স্বেচ্ছাচারিতা আর দুর্বল ক্লাব স্ট্রাকচার এর পিছনে একটা বড় কারণ। দক্ষিণ আমেরিকার দলগুলো যেখানে কাঁচা প্রতিভার উপরেই ভরসা করে আসছে, সেখানে ইউরোপের ক্লাবগুলো তাদের প্রতিভাগুলো আরো ঘষেমেজে চকচকে করার দিকেই মনোযোগ দিয়েছে। শক্তিশালী স্কাউটিং সিস্টেম দাড়া করিয়েছে। আর একদম রুট লেভেল থেকেই প্রতিভা তুলে এনেই ক্ষান্ত থাকে নি। তাদেরকে একটা সিস্টেমের মধ্যে এনে সেই প্রতিভা বিকশিত করার সুযোগ করে দিয়েছে। লাতিন ক্লাবগুলোর সেই স্ট্রাকচারও নেই, সেই পরিমাণ টাকাও নেই এর পেছনে এত সময় দেবে। কাজেই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার অলিতে গলিতে যতই প্রতিভাবান ফুটবল জন্ম নিক না কেনো, সঠিক পরিচর্যার অভাবে মার খেয়ে যাচ্ছে। এটা ঠিক, বেশীরভাগ খেলোয়াড়ই যখন একটু প্রতিভার ঝলক দেখাচ্ছেন, ইউরোপের ক্লাবগুলোই তাদের নিয়ে আসছে। কিন্তু এতে খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত উন্নতি হচ্ছে, দেশের ফুটবল স্ট্রাকচারটা পড়ে রয়েছে ত্রিশ বছর আগের যুগেই।

তাছাড়া কেবল খেলোয়াড় নয়, কোচদের ডেভেলপমেন্ট এর ব্যাপারেও ইউরোপে আলাদা করে কাজ হচ্ছে। ২০০৪ এর পর থেকে জার্মানি শুধু খেলোয়াড় নয়, ভালো কোচদের তুলে আনার জন্যে আলাদা পদক্ষেপ নিয়েছে। ক্লপ, তুখেল, নাগেলসমান কিংবা ফ্লিকরা কিন্তু এমনি এমনি উঠে আসেননি। আপনি এখন ফুটবল বিশ্বে ভালো লাতিন ফুটবল কোচ কয়জন দেখবেন? সিমিওনে বা পচেত্তিনো রা সেই ইউরোপের স্ট্রাকচারাল সিস্টেমেরই ফসল। বিয়েলসা, পেকারম্যান, জাগালোর মত কেবল লাতিন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে উঠে এসে ফুটবলে দুর্দান্ত কোনো ট্যাকটিকেল চেঞ্জ এনে দেওয়া কোচ আপনি সর্বশেষ কবে দেখেছেন? ফুটবল ট্যাকটিকসে যা কিছু আধুনিকায়ন হচ্ছে, ইউরোপ ঘরানার কোচদের হাতে ধরেই হচ্ছে এখন। তার ওপর ক্লাবগুলো চায় ইন্সট্যান্ট রেজাল্ট। কোনো কোচ লাতিন ক্লাবগুলোতে টানা দুই-তিন সিজন থেকে যেতে পারে, ব্যাপারটা মোটামুটি অবিশ্বাস্যই বলা চলে এখন। বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা, ২০২১ সালে ব্রাজিলিয়ান লিগ এর মাত্র ১১ রাউন্ড হয়েছে। এর মধ্যে ব্রাজিলিয়ান সিরি এ এর টপ টায়ারের ২০টা দলের সব মিলিয়ে ২১ জন কোচ পরিবর্তন হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। শুধুমাত্র প্রি সিজন কিংবা স্টেট লিগের ম্যাচে হারের কারণেও স্যাক হওয়াটা নিতান্তই মামুলী ব্যাপার। কোচরা যে নিজেদের কোনো ট্যাকটিকস বিল্ড আপ করবে সেই সময়টাও দেয় না ক্লাবগুলো।

coach change

এর সাথে যোগ করুন স্পন্সর আর দর্শক চাহিদার ব্যাপার। ইউরোপের লিগগুলোর দর্শক পাবেন বিশ্বজুড়ে। ফলে স্পন্সরও বেশী, টিভিস্বত্বও বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। ফলে দলগুলোও আরো বিনিয়োগ করতে পারছে ফুটবলের পেছনে। শুধু এবারের ইউরো আর কোপার প্রাইজমানিই দেখুন না। ইউরো চ্যাম্পিয়ন যেখানে পাচ্ছে ১০ মিলিয়ন ইউরো, কোপা বিজয়ী পাবেন ৬.৫ মিলিয়ন ডলার। পার্থক্যটা সুস্পষ্ট।

euro priz

copa priz

ইউরো টুর্নামেন্ট হিসাবে এত উপভোগ্য হয়ে ওঠার আরেকটা কারণ হলো দলগুলোর প্রতিযোগিতা মূলক মনোভাব। ৫০টা দলের মধ্য থেকে ২৪টা দল কোয়ালিফাইং শেষে চূড়ান্ত পর্বে খেলতে পারছে। অন্যদিকে লাতিন আমেরিকায় আছেই দশটা দল, কাজেই কোপায় তাদের  জায়গা তো নিশ্চিতই। ফলে একই দলগুলোর মধ্যেই ক্রমাগত ম্যাচ দেখতে দেখতে দর্শকেরাও ঠিক প্রতিযোগিতার আমেজটা উপভোগ করতে পারেন না। তাছাড়া ইউরোপের টিমগুলো বল পেলেই যেরকম কাউন্টার অ্যাটাক আর বল হারালে হাই প্রেসিং করে থাকে, সেটা কোপার টিমগুলোয় আপনি পাবেন না। কোপার দলগুলো ইন্ডিভিজুয়াল স্কিলের উপর অনেক বেশী নির্ভর করে। ফলে ইউরোর ম্যাচগুলো যেখানে হয় প্রানবন্ত, কোপার ম্যাচগুলো হয়ে পড়ে অনেকটাই বোরিং।

এর মধ্যে আবার কোচদের উপর যোগ হয় দেশি ক্লাব কোটায় খেলোয়াড়দের নেওয়ার প্রেশার। আপনি এমন কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ দেখবেন না যেখানে ব্রাজিলিয়ান লিগে খেলা দুই-একজন খেলোয়াড় স্কোয়াডে নেই, কিংবা রিভারপ্লেট বা বোকা জুনিয়র্স এর কোনো খেলোয়াড় আর্জেন্টাইন দলে নেই। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য, গোলকিপার হিসাবে এমি মার্টিনেজকে খেলানোর জন্যে স্ক্যালোনিকে নাকি রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়েছে। কারণ, বোর্ড আর মিডিয়ার প্রেশার ছিলো রিভারপ্লেটের কিপার আরমানিকে খেলাতে হবে।

তবে এতসব ঝামেলার পরেও লাতিন দলগুলো  ইউরোপের দলগুলোর কাছে পাত্তাই পাবে না বলে যদি মনে করেন, তবে আপনি কিছুটা ভুল ধারণা নিয়েই আছেন মনে হয়। প্রথম কথা হলো যারা বলেন, লাতিন ফুটবলের সৌন্দর্য আগের মত নেই, তারা ছোটবেলায় পেপারে পড়া লাতিন মানেই ছন্দ আর ইউরোপের ফুটবল মানেই যন্ত্র এসব ভুলে যান। মোটা দাগে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা বাদে বাকি সব লাতিন দলগুলোই আজীবন গা জোয়ারি, ফাউল সর্বস্ব ফুটবলই খেলে এসেছে। মাঝে মাঝে হয়তো ফ্রান্সিস্কো মাতুরানার কলম্বিয়ার মত কিছু টিম এসেছে, বাদবাকি সবই মোটামুটি ছিলো এক ঘরানার। আর ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনাও শিরোপা জয়ের স্বার্থে আগের সেই শুধুমাত্র অ্যাটাকিং আর পাসিং ফুটবলের দর্শন থেকে সরে এসেছে অনেক দিন। এ কারণেই ২৪ বছর পর বিশ্বকাপ শিরোপা জিততে ব্রাজিলের দলগত ভূমিকাই বেশী ছিলো। আর্জেন্টিনারও ২৪ বছর পর বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা বা ২৮ বছর পর আন্তর্জাতিক শিরোপা জেতার পিছনে ডিফেন্সের ভূমিকাই বেশী। কাজেই জোগো বোনিতোর মিথ থেকে বেরিয়ে এসে মেনে নিন লাতিন দলগুলো এমন স্লো বিল্ড আপ, গা জোয়ারি ফুটবলই খেলবে।

তাই বলে একেবারে ঘুম পাড়ানিয়া ফুটবল হয় সবসময়, তা নয়। এবারের কোপার একই দিনে অনুষ্ঠিত কোয়ার্টার ফাইনালের দুটো ম্যাচের কথায় আসি। পেরু বনাম প্যারাগুয়ের ম্যাচটা ছিলো ৩-৩ গোলে ড্র, পরে গড়িয়েছে টাইব্রেকারে। আর ব্রাজিল-চিলির ম্যাচের স্কোরলাইন ১-০ হলেও ট্যাকটিকেলি অত্যন্ত ভালো মানের ম্যাচ ছিলো। ম্যাচগুলো দর্শকশূণ্য স্টেডিয়ামে না হলে আরো অনেক বেশী উপভোগ্য হতো সন্দেহ নেই।

বলতে পারেন, এরকম খেলা দিয়ে ইউরোপের টিমের সাথে জেতা কি সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব। আপনি গত বিশ্বকাপে ব্রাজিল- বেলজিয়ামের ম্যাচ দেখুন। প্রথম হাফে রবার্তো মার্তিনেজ এর ট্যাকটিকস এর কাছে মার খেয়ে গেলেও সেকেন্ড হাফে ব্রাজিল যেভাবে খেলেছে, কোর্তোয়ার অতিমানবিক পারফরম্যান্স আর কৌতিনহো আর রেনাটো অগাস্টোর দুটো নিশ্চিত গোলের সুযোগ মিস না হলে ফলাফল অন্যরকমই হতো। তাছাড়া বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট গুলোতে ন্যাশনাল টিমের কোচেরা অতটা নতুন ট্যাকটিকস নিয়ে আসার সময় ও সুযোগ কোনোটাই পান না। আবার টুর্নামেন্ট নক আউট পর্বে গেলে কোচেরা আরো কিছুটা সাবধানী হয়ে যান। তার উপর যেহেতু বেশীরভাগ লাতিন খেলোয়াড়ই ইউরোপ ঘরানায় অভ্যস্ত, ভালো ট্যাকটিকেল কোচ হলেই ইউরোপের টিমগুলোকে হারানো সম্ভব। আর আপনি হয়তো ভাবছেন ইউরোপের টিমগুলো যোজন যোজন ব্যবধানে এগিয়ে আছে। ভুল!! এবারের ইউরো আর কোপা শুরু হওয়ার আগের ফিফা র‍্যাংকিং অনুযায়ী শীর্ষ ২০ দলের ৫টিই লাতিন আমেরিকান, যেখানে লাতিন দল আছেই মোটে ১০ টি। ভেসিনা, বেন্টাংকুর ও ভালভার্দে নিয়ে উরুগুয়ের যে মিডফিল্ড, সেটা কি ইউরোপের যেকোনো দলের মিডের সাথে সেয়ানে সেয়ানে লড়বে না? কিংবা মিনা, সানচেজ, হামেস, জাপাতা, লুইস দিয়াজ দের নিয়ে গড়া কলম্বিয়া কি ইউরোপের কোনো টিমকে ছেড়ে কথা বলবে?

গত চার বিশ্বকাপের তিনটাতেই হয়েছে অল ইউরোপ ফাইনাল। দুটোতে আবার ছিলো অল ইউরোপ সেমিফাইনাল। মোটা দাগে আপনি আমি লাতিন ফুটবল বলতে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাই তো বুঝি। দুটো দলই প্রতিবার বাদ পড়েছে ইউরোপের টিমের কাছেই। তাই বলে আর কখনো জিতবে না বিশ্বকাপ, এটা মনে করাটা কিছুটা অতিকল্পনা। হ্যাঁ, আগের মত এক বিশ্বকাপ পর পরই হয়তো জিতবে না, কারণ ইউরোপে যেখানে ৫-৬ টা দল শিরোপা প্রত্যাশি থাকে, লাতিনে তো সেই ঘুরে ফিরে দুটো দল। হয়তো ৪-৫ টা বিশ্বকাপ পর পর লাতিন দলগুলোর হাতে শিরোপা দেখবো। টুর্নামেন্ট এর ম্যাচগুলোর কোয়ালিটির বিচারে ইউরো কোপার চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে, কিন্তু ইউরোপের টিমগুলোর সাথেও লাতিন টিমগুলোর এত ব্যবধান ভাবলে ভুলই করবেন। অন্তত যতদিন ইউরোপের টপ ক্লাবগুলোতে লাতিন ফুটবলার দেখবেন, ধরে নিতে পারেন, লাতিন কোনো দলের শিরোপা জেতার সম্ভাবনা থাকছেই।