বাংলার ফুটবল মুক্তির ৬-দফা (প্রথম পর্ব); ফুটবল ঈশ্বর থাকেন বৈদেশে, এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।
পোস্টটি ১৬৬৭ বার পঠিত হয়েছেবিশ্বমহামারীর তান্ডব লীলার মধ্যেই দীর্ঘ এক মাস যুদ্ধ শেষে এক পরশ বিনোদিনী উত্তেজনা ছড়িয়ে দুই দুইটি মহাদেশীয় প্রতিযোগীতার ফলাফলে ফিফা র্যাংকিং এর শীর্ষ চল্লিশে ব্যপক রদবদল যখন নিশ্চিত, বাংলাদেশ থাকবে আপন অবস্থানেই। প্রায় সব নেতিবাচক ইস্যুতেই বৈশ্বিক রাস্ট্র তালিকার শিরোপা দৌড়ে বরাবরই অন্যতম হট ফেভারেট থাকা বাংলাদেশের জন্য ১৮৪ ফিফা র্যাংকিং এমন কি আর মন্দ অবস্থান? আমাদের পরে যে আরো ২৬ টি দেশ রয়েছে এটাই বা কম কি! ভ্রান্ত বিস্ময় কাটাতে বলতে হয়, বাংলাদেশ পরবর্তী নামগুলো থেকে পাকিস্তান আর শ্রীলংকাকে এক পাশে সরিয়ে রাখলে বাকি ২৪ টি দেশই নামসর্বস্য। ভূগোলের উপর পিএইচডি না করে থাকলে আপনি এসব দেশের বেশিরভাগের নাম কম্মিনকালেও শোনেননি। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এসব দ্বীপরাস্ট্রগুলোর বেশিরভাগ জনসংখ্যায় পুরান ঢাকার মাত্র গুটিকয়েক গলির সাথে পেরে উঠবেনা। স্বাভাবিক আয়তন আর জনসংখ্যার দেশ বিবেচনায় বাংলাদেশ ফিফার সবচেয়ে দুর্বলতম দেশের একটি। সামাজিক ও জীবনঘনিষ্ট সব বৈশ্বিক ইস্যুতে নিয়মিত লাড্ডা গোড্ডা হওয়া বাংলাদেশ ফুটবলে পতনের শীর্ষে পৌছালেও আমরা নতুন করে হতাশ হইনা। ফুটবলের প্রতি হ্রদয় নিংরানো ভালোবাসা রেখেও আমরা সত্যের মত বিশ্বাস করেছি, আমরাতো বটেই, আমাদের পরবর্তী কয়েক প্রজন্মও তাদের জীবদ্দশায় স্বদেশকে কখনো বিশ্বকাপে খেলতে দেখবেনা। প্রেমিকাকে অন্যের ঘরনী হতে দেখার পর গড়পরতা বাঙ্গালি প্রেমিকপুরুষ যেমন সামান্য কিছু সময় দুঃখবিলাস শেষে গামছা বেঁধে বিয়ের জন্য হন্যে হয়ে পাত্রী খুঁজে, তারপর বাসর ঘরে স্ত্রীর হাতটি ধরে বাল্যপ্রেমিকার অস্তিত্ব ভুলে যায়, আমরাও তেমনি ইউরোপ বা ল্যাটিন পরাশক্তিদের কাউকে হৃদ মণিকোঠায় স্থান দিয়ে বিশ্বকাপ রোমাঞ্চের স্বাদ নেই। বহু বছর পর সহস্রের ভীড়ে হারানো বাল্য প্রেমিকার সাথে চোখাচোখি হলে কিছুক্ষণের জন্য হ্রদয় ঘড়ি থমকে যায়, স্মৃতির জানালা খুলে অনিন্দ্যসুন্দর সব স্মৃতি সাময়িক মুক্তি পেয়ে সময়কে যেমন অসাড় করে দেয়, তেমনি হঠাৎ হঠাৎ এএফসির বিশ্বকাপ আর মহাদেশীয় প্রতিযোগীতার বাছাই পর্বে স্বদেশ খেলার সুযোগ পেলে উত্তেজনায় ফুটবলপ্রেমী বুদ্ধিমান বাঙালি মুখে স্বীকার না করলেও নড়ে চড়ে বসে। আর বোকা বাঙালি? শুধু আবেগকে পুঁজি করে ঝাপিয়ে পড়ে অসম্ভব ফল প্রত্যাশায়। হোম ম্যাচগুলোতে শ্যাওলাধরা বঙ্গবন্ধুর গ্যালারী প্রাণ ফিরে পেয়ে বাল্য প্রেমিকার স্মৃতি রোমন্থনের মত হারিয়ে খুঁজে আশি নব্বইয়ের আবাহনী মোহামেডানের দ্বৈরথ ঘিরে তার উচ্ছাসকে। আর পশ্চিম এশিয়ার আরব সাগরের পাড় ঘেঁষা দেশগুলোর সাথে এওয়ে ম্যাচ হলেতো কথাই নেই, হাজার প্রবাসীর গর্জনে স্টেডিয়াম পরিণত হয় এক টুকরো বাংলাদেশে। তবে এ উচ্ছাস জাতীয় সংগীত পর্যন্তই। রেফারির খেলা শুরুর বাশীতো নয়, এ যেন ইসরাফিলের কেয়ামতের বাঁশী। লন্ড ভন্ড করে দেয় সব উচ্ছাস। বাস্তবে নেমে দেখতে হয় একজন গোলরক্ষককে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা দশ ডিফেন্ডারের গোল না খাওয়ার প্রাণান্তকর অপচেস্টা। খেলা শুরুর আগে বোকা সমর্থকের আবেগে ভেসে ফেইসবুকে অসমযুদ্ধের প্রতিশ্রুতি দেয়া শুভবার্তাগুলো ম্যাচ শেষে উপহাস করে হাসে। প্রেম উল্টে গেলেই যে ঘৃণা হয়ে যায়। সেই ঘৃণা সামলাতে ফুটবল উন্নতির রূপরেখা নিয়ে কয়েকজন বিশ্লেষক হাজির হন টিভির টকশোতে। স্পোর্টস এডিটরের আদেশে অনিচ্ছা স্বত্তেও তরুণ ক্রীড়া সাংবাদিক ফুটবলের উন্নতিতে করনীয় সংক্রান্ত দায়সারা রিপোর্ট লিখতে বসেন পুরানো আর্টিকেলের সফটকপি ঘেঁটে। ফুটবলপ্রেমী দর্শক বা বাফুফে কর্তাব্যক্তিরা, কেউই ভুলেও দেখেননা সেই বিশেষজ্ঞদের ক্লিশে উপদেশমালা। টিআরপি স্কোরে মুখ থুবড়ে পড়া সেইসব টক শো আর সোস্যাল মিডিয়া ইম্প্রেশন সংখ্যায় সুপার ফ্লপ নিউজ রিপোর্ট থেকে শিক্ষা নিয়ে টকশো সঞ্চালক বা ক্রীড়ালেখক প্রতিজ্ঞা করেন, বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে আর চর্চা নয়।
তবে ফুটবল বিমুখ থাকা বাঙালির পক্ষে অসম্ভব। বছর জুড়ে আমরা দেখতে থাকি প্রশান্ত আর অতলান্তই পাড়ের মনোমুগ্ধকর ফুটবল। আড্ডার চায়ের কাপ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, সোস্যাল মিডিয়া থেকে অফিসের কাজের ফাঁকে, কোথায় থাকেনা বিশ্বমাতানো সেই ফুটবলের গল্প? আর চার বছরের চক্র পূরণ করে যখন বিশ্বকাপটা এগিয়ে আসতে থাকে তখন ফুটবল উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে পুরা দেশ। বিশ্বকাপের পর্দা উঠলে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পাগল হয়ে যায় ফুটবল জ্বরের মহামারিতে। বর্নিল পতাকার অপূর্ব সব রঙে বাংলাদেশ তখন পৃথিবীর সবচেয়ে কসমোপলিটান দেশের নাম। সেই কসমোপলিটান দেশে অসংখ্য সব রং এর ভীড়ে কোথাও থাকেনা লাল সবুজের কম্বিনেশন। এ জাতি নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছে ফুটবল বিশ্বকাপে নিজের অস্বিস্তহীনতাকে।
চিত্রঃ বিশ্বকাপের দিনগুলোতে রঙ্গিন পতাকায় বর্ণিল ঢাকা; Photo Source: Dhaka Tribune
শত শত পরিকল্পনা হয়েছে। ফুটবলে উন্নতির নীল নকসা এঁকে প্রতিশ্রুতি পর প্রতিশ্রুতি দিয়ে আর প্রত্যয়ের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে কর্তাব্যক্তিরা বাফুফের গদিতে বসছেন। দীর্ঘদিন গদিতে বসলে যা করতে হয় ঠিক তাই করতে মুখ ভর্তি করে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ফিরিস্তি দিচ্ছেন। বছরব্যাপী ফুটবল, ফুটবলারদের কাড়ি কাড়ি টাকা কামানোর সুযোগ করে দেয়া পেশাদার লীগ, রেকর্ড সংখ্যক স্কুলের অংশগ্রহণে জাতীয় স্কুল ফুটবল, জাতির জনকের নামে আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্ণামেন্ট, জাতীয় দলের জন্য বারোমেসে পূর্ণাংগ বিদেশি কোচিং স্টাফ- সবই নাকি করেছেন তারা। সবই যদি করেন, তাহলে র্যাংকিং এ কেন এই ক্রমাবনতি? এই বাফুফের কর্তারা নীরব কবি হয়ে যান। তাঁরা জানেন, সব প্রশ্নের উত্তর দিতে নেই। কিছু এড়িয়ে যাওয়াই উত্তম। পেশাদার লীগের ম্যাচ লাইভ সম্প্রচারের জন্য এসেছে ডেডিকেটেড স্পোর্টস চ্যানেল। আকাশ চুম্বী বিনিয়োগ ক্ষমতাসম্পন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের ফুটবল ক্লাব করছে। এতকিছুর পরও ফুটবল বিধাতা র্যাংকিং নামক রিপোর্ট কার্ডে শুধু অবনমনের সিড়ি এঁকে দিচ্ছেন।
চিত্রঃ ফিফার র্যাংকিং এ বাংলাদেশের অবস্থানের লেখচিত্র (১৯৯২-২০২১); Source: FIFA.com
নব্বইয়ের দশকে তৃতীয় বিশ্বের রাস্ট্রীয় কালিমা আর খেলাধুলায় বিনিয়োগ সক্ষমতায় আক্ষরিক অর্থে বিশ্বের তলানীতে পড়ে থাকা বাংলাদেশ র্যাংকিং এ স্থান করে নিয়েছিল প্রায় মধ্যভাগে। সেই সময়ে বাংলাদেশের র্যাংকিং এর আশেপাশে থাকা এশিয়ার দেশগুলো এখন রীতিমতো বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন দেখছে। আর অর্থনৈতিক উন্নতির সিড়ি বেয়ে গত দুই দশকে তর তর করে উপরে উঠে মধ্যম আয়ের দেশের তকমা জোটানো বাংলাদেশ উল্টো পথে হেঁটে র্যাংকিং তলানীতে নেমে এল। এমন তো হওয়ার কথা ছিলনা। আশির দশকে বিখ্যাত জাতীয় দলের খেলোয়াড়েরা পায়ে হেঁটে বা রিকসায় চড়ে অনুশীলন মাঠে আসতেন। এখন তো প্রিমিয়ার থেকে রেলিগেশনের ঝুঁকিতে থাকা দুর্বল ক্লাবদলের খেলোয়াররাও প্র্যাকটিসে আসেন ব্যক্তিগত দামী গাড়িতে চড়ে। প্রতিবেশি নেপাল-মালদ্বীপ র্যাংকিং এ আমাদের বেশ পেছনে ফেললেও বাংলার খেলোয়াররা আয় দিয়ে তাদের খেলোয়াড়দের কয়েকবার কিনতে পারবেন। তারপরও কেন অদ্ভুত উটের উল্টো পিঠে চড়েছে আমাদের ফুটবল?
পথ খোঁজাও তো কম হলনা। তারপরও পথ খুঁজে যেতেই হবে। কারণ ফুটবল আমাদের মুক্তি দেবেনা। ল্যাটিন ইউরোপের অনিন্দ্য সুন্দর ফুটবলের মোহতে পড়েই হোক, কিংবা বাঙ্গালী জাতিস্বত্তায় মিশে থাকা প্রেমের কারণেই হোক, ফুটবল আমাদের কাঁধে সিন্দাবাদের ভুতের মতই চেপে আছে, থাকবে। এ থেকে আমাদের পরিত্রান নেই। তাই পথ খুঁজে যেতেই হবে ফুটবলের মুক্তির জন্য। নতুন কিছু খোঁজা যাক এবার। অবকাঠামো উন্নয়ন, দেশব্যপি খেলা ছড়িয়ে প্রতিভা খোঁজা, নিয়মিত ফুটবল মাঠে রাখা, পেশাদারীত্ব- ইত্যাদি হাজার বছর ধরে চলতে থাকা ক্লিশে পরিকল্পনা নিয়ে চতুস্পদ প্রাণীর জাবর না কেটে খোঁজা যাক নতুন কিছু মুক্তির পথ। এমন নয় যে পুরানো পথগুলো ভুল ছিল। তবে বাস্তবায়নের লম্বা ফিরিস্তি দিলেও ফুটবলের দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই উন্নয়নের জন্য যে পেশাদারিত্ব, মেধা, আন্তরিকতা প্রয়োজন তার কোনটাই বাফুফের নেই। কোনদিনই ছিলনা। তাই মুক্তির জন্য ভিন্ন পথ খুজতে হবে। সীমাবদ্ধ সুযোগ আর হাজারো সমস্যাকে পাশে নিয়েও যে পথে মুক্তি পাওয়া যায়। আফ্রিকান কাপ অফ নেশন্স (আফ্রিকার মহাদেশীয় প্রতিযোগীতা) শিরোপা জয়ে অন্যতম শীর্ষ দুই দেশ, বিশ্বকাপে চমকে দেয়া ক্যামেরুন আর ঘানার ফুটবল যেভাবে হাজারো জাতীয় সমস্যা পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেছে। ৭ পর্বের ধারাবাহিকের বাকি ৬টিতে সেরকম কিছু সমাধান খোঁজার চেষ্টা চলবে।
Special thanks to Freeflagicons.com for allowing me to use the wonderful thumbnail in this blog article
- 0 মন্তব্য