বাংলার ফুটবল মুক্তির ৬-দফা (৩য় পর্ব); থাকব নাকো দক্ষিণ এশিয়াতে, দেখবো এবার জগৎটাকে
পোস্টটি ১১৬৫ বার পঠিত হয়েছে
ফিরে যাই ১৯৮৪ সালে। বাংলাদেশ তখন এ অঞ্চলের ফুটবলের অন্যতম সেরা দল। ক্রিকেট আর হকিতে পাকিস্তানকে নিজেদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর আসনে বসানো ভারত ফুটবলে বাংলাদেশকেই তখন আঞ্চলিক শ্রেষ্ঠত্বের পথে মূল প্রতিদ্বন্দী হিসেবে ভাবত। শুধু জাতীয় দল বিবেচনাতেই নয়, অর্থনৈতিক শক্তিতে এশিয়ার অন্যসব অঞ্চলের চেয়ে পিছিয়ে থাকা দক্ষিণ এশিয়ার ঘরোয়া ফুটবল কাঠামো আর প্রতিযোগীতার মানেও বাংলাদেশ তখন না বুঝেই অনেক এগিয়ে। এশিয়ার ফুটবলে রাজত্ব করা পশ্চিম এশিয়ার খেলোয়াররা তখন দেশের বাইরে খেলার জন্য এশিয়ার অন্যান্য বড় লীগের মধ্যে বাংলাদেশের লীগটাকেও বিবেচনায় রাখেন।
চিত্রঃ ১৯৮২ ও ১৯৮৬ ফিফা বিশ্বকাপ মাতানো কয়েকজন ফুটবলার কেরিয়েরর মধ্যগগণে বেছে নিয়েছিলেন ঢাকা লিগকে। Image Source: Dhaka Tribune
ঠিক এমন একটা সময়ে নেপালের রাজধানী কাঠমুন্ডুতে প্রথমবারের মত বসল দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের ক্রীড়া আসর- সাফ গেমস। এশিয়ার ফুটবলে নিম্ন-মধ্যম শক্তির দেশ থেকে উচ্চ-মধ্যম শক্তির দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে লড়াই করা দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশ- ভারত ও বাংলাদেশের ফুটবল শাসকরা একটি ভুল করে বসলেন। এশিয়ার উচ্চ মধ্যম শক্তিতে রূপান্তরের চ্যালেঞ্জ ভুলে সাফ গেমসের ফুটবলের ইভেন্টটাকে পাখির চোখ করলেন। স্বপ্নের সীমানা হল ছোট। সাফ গেমসের প্রথম আসরে স্বাগতিক নেপালের কাছে ফুটবল ইভেন্টের সোনা হাতছাড়া হলেও সাফ গেমসের পরের কয়েকটি আসরে সব ইভেন্ট মিলিয়ে সোনা জয়ের একচেটিয়া রাজত্ব কায়েম করা ভারত দ্রুতই উপলব্ধি করে নিয়েছিল, অন্যান্য খেলার মত সাফ গেমস কখনও তাদের ফুটবল সামর্থ্য প্রমাণের মঞ্চ হতে পারেনা। এশিয়ার মানদণ্ডে কিছুটা পিছিয়ে পড়েই ভারত চোখ সরালো দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবল থেকে। প্রথম কয়েকটি আসরের পর থেকেই ভারত সাফ গেমসের ফুটবল ইভেন্টটাকে বিবেচনা করত তরুণ খেলোয়াড় অন্বেষণ আর পরীক্ষা নীরিক্ষা করে জাতীয় দলের বেঞ্চকে শক্তিশালী করার মঞ্চ হিসেবে। কিন্তু ভুল ভাঙ্গেনি বাংলাদেশের। ফুটবল মানদন্ডে পূর্ব ও পশ্চিম এশিয়ার জাদরেল প্রতিপক্ষদের সাথে ফুটবল মাঠে চোখে চোখ রেখে লড়াই করলেও তারা তখনও দক্ষিণ এশিয়ার মানদন্ডে নিজেদের এগিয়ে থাকা শক্তি হিসাবে বিশ্বাস রাখতে পারেনি।
চিত্রঃ তেহরানের কানায় কানায় পরিপূর্ণ স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের স্বাগতিক ইরানের সাথে লড়ছে বাংলাদেশ (১৯৮৯) । দ্বিতীয় অর্ধের শেষে দিকে একমাত্র গোলে তুমুল প্রতিদ্বন্দীতাপূর্ণ ম্যাচটিতে এশিয়ার পরাশক্তি ইরানের কাছে হেরে যায় বাংলাদেশ। Image Source: Youtube
খেলাধুলা ছাড়াও অন্যান্য অনেক মানদন্ডে হীনমন্যতায় ভোগা বাংলাদেশ ফুটবল মাঠে মালদ্বীপ-ভুটানকে নিয়ে ছেলেখেলা করে কিছু হীনমন্যতা ফিরিয়ে দেয়ার সুযোগকে বিশেষ কিছু ভাবত। সাফের মঞ্চে ফুটবলে সোনার স্বপ্নটাকে হিমালয়ের চুড়া মনে করে বসে রইল বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক ফুটবলে নিজেদের পতনের বীজটা সেখানেই রোপন করেছিল বাংলাদেশ। ফিফার বিশ্ব র্যাংকিং পদ্ধতি চালু হয়নি তখনো। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে অনেকগুলো মানসম্পন্ন ফুটবল দেশের জন্ম হয়নি তখনো। অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ আফ্রিকা আর ফুটবল বিচ্ছিন্ন ওশেনিয়ার অধিকাংশ দেশকে পেছনে ফেলে এশিয়ার মধ্যম শক্তি বাংলাদেশ ফিফা র্যাংকিং চালু থাকলে ৮০-৮৫তম স্থানে থাকলেও বিস্ময়ের কিছু ছিলনা। তবে সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গীর অভাব ও সংকীর্ণ স্বার্থ চিন্তা পাশ কাটিয়ে সামনে এগোনোর চ্যালেঞ্জ নিতে চায়নি তৎকালীন বাফুফে নীতি নির্ধারকেরা। তারা হয়ত ভেবেছিলেন ভারত ছাড়া সেই অর্থে বড় প্রতিপক্ষ না থাকায় সাফের ফুটবলের সোনা জয় সাধ্যের ভিতরে থাকা এমন এক অর্জনের হাতছানি যা বাফুফের শাসক হিসেবে তাদের সাফল্য প্রদর্শনের সুযোগ করে দেবে। সেই সাথে বাফুফের ক্ষমতার গদি আরও পাকাপোক্ত হবে। যদিও ফুটবল বিধাতা তাদের সেই আশায় গুড়ে বালি ছিটিয়ে দীর্ঘদিন সেই সোনা অধরাই রেখেছেন। বাফুফের শয়নে স্বপনে তখন একটাই চাওয়া। জিততে হবে সাফের সোনা। সোনাতো নয়, এ নাকি গরীবের বিশ্বকাপ।
নেপাল তখনো বেশ পিছিয়ে। পাকিস্তান আর শ্রীলঙ্কাকে ফুটবলীয় আবগ কখনো স্পর্শ করেনি। ফুটবলে তারা কোনকালেই সিরিয়াস না। মালদ্বীপ, ভুটান তখন ফুটবল মাঠে হামাগুড়ি দিচ্ছে। ক্লাব ফুটবলে প্রতিপক্ষদের চেয়ে বেশ এগিয়ে থাকার কারণে সেই অধরা সাফের সোনা জয়ের লক্ষ্য পূরণে বাফুফে কর্তারা ফুটবল সম্প্রসারণ করে মেধাবী ফুটবল অন্বেষণ, ঘরোয়া ফুটবলের মানোন্নয়নের মত কাজে মনযোগ দেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। বরং জাতীয় দলকে চাঙ্গা রাখাই তাদের একমাত্র কর্তব্য মনে করতেন। এভাবেই কেটে গেল প্রায় দেড় যুগ। ফুটবল পতনের জন্য রোপিত বীজটি অনুকূল পরিবেশ আর জল হাওয়া পেয়ে ডাল পালা মেলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বেশ। নাম বদলে সাফ গেমস তখন এস এ গেমস। গঠিত হয়েছে দক্ষিণ এশিয় ফুটবল ফেডারেশন। এই আঞ্চলিক ফুটবল সংস্থাটির সদস্য দেশগুলোর অংশগ্রহণে সাফের পাশাপাশি চালু হয়েছে আঞ্চলিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের নতুন প্রতিযোগীতা। বাফুফে যথারীতি এই সাফ চ্যাম্পিয়নশীপকে দেখছে সর্বোচ্চ অর্জনের নতুন হাতছানি হিসেবে। নেপাল, মালদ্বীপ ততদিনে এগিয়েছে বেশ। ভারতের পর তারাও ততদিনে বুঝে গেছে ফুটবলের সত্যিকার উন্নয়নের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার বৃত্তের বাইরে তাকাতে হবে। তাই বাংলাদেশের আপত্তির মুখেও অন্যান্য সহযোগী দেশের উৎসাহে অলিম্পিক ফুটবলের ফরম্যাট মেনে এস এ গেমস এর ফুটবল ইভেন্ট পরিণত হল বয়স ভিত্তিক প্রতিযোগিতায়। তাতেও থামেনি বাংলাদেশ। বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতায় আমাদের আত্মবিশ্বাস ও পারফরমেন্স অনেকখানি বেড়ে যায়। কারণটা আমরা জানি। তবে অনুর্ধ্ব ২৩ এর সাথে ৩ জন বেশি বয়সী খেলোয়াড় নেয়ার অলিম্পিক নিয়ম মেনে জাতীয় দলের সবাইকে নিয়ে (!) সোনার পদক জয়ের অভিযান অব্যাহত থাকল। এদিকে যুদ্ধ বিদ্ধস্ত আফগানিস্তান বাড়তি কিছু আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার লোভে পড়ে যুক্ত হয়েছে দক্ষিণ এশিয় ফুটবল ফেডারেশনে। বাংলাদেশকে দুধ ভাত বানিয়ে মালদ্বীপ আর নতুন সদস্য আফগানিস্তান ততদিনে দক্ষিণ এশিয়ার শিরোপা লড়াইয়ে ভারতের দ্বিতীয় সারির দলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। খুব অল্পদিনের মধ্যেই আফগানিস্তান উপলব্ধি করলো এই অঞ্চলের চ্যাম্পিয়ন হলেও অর্জনের পাল্লা তাতে কিছু মাত্র হের ফের হয়না। তাই সত্যিকারের উন্নতির পথ ধরতে দক্ষিণ এশীয় ফেডারেশন থেকে নাম কেটে আফগানিস্তান যুক্ত হল মধ্য এশীয় ফুটবল সংস্থার ছায়াতলে। যদিও মধ্য এশিয়ার শক্তিশালী দেশের ভীড়ে শক্তির মানদন্ডে আফগানিস্তান আজও নিচের সারির দেশ হিসেবে বিবেচিত। তবে দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান শক্তি হিসেবে থাকার চেয়ে মধ্য এশিয়ার নিচের সারিতে থাকাও যে উন্নতিতে বেশি কার্যকর তা প্রমাণ করে আফগানিস্তান মাত্র ৭ বছর আগেও বর্তমান বাংলাদেশের মত ১৮৫তম র্যাংকিং থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে ১৫০ এ উঠে এসেছে। এশিয়ার মহাদেশীয় আসরের চূড়ান্ত পর্যায়ে খেলাতেই তাদের চোখ। মালদ্বীপ আর নেপালের কাছেও দক্ষিণ এশিয় প্রতিযোগিতার খুব কম গুরুত্বই অবশিষ্ট আছে। তারাও এ প্রতিযোগিতায় তারুণ্য নির্ভর দল নিয়ে পরীক্ষা নীরিক্ষা চালিয়ে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের জন্য প্রস্তুত হতে আগ্রহী। আর মালদ্বীপ-নেপালের তারুণ্য নির্ভর দলের সাথে পেরে না উঠতে পেরে দক্ষিণ এশিয়ার সেমিফাইনাল খেলাই বেশ কঠিন হয়ে পরেছে বাংলাদেশের জাতীয় দলের। আমরা এখনো পড়ে আছি সেই দক্ষিণ এশিয়ার লেজ ধরেই। অন্যান্য সদস্য রাস্ট্রগুলোর ফুটবলীয় পরিকল্পনাগুলো যখন আবর্তিত হয় বিশ্বকাপ আর এশিয়ার বাছাই পর্বের প্রতিযোগিতা ঘিরে, তাদের লক্ষ্য থাকে এশিয়ার চুড়ান্ত পর্বের দিকে, বাংলাদেশ তখনো পরিকল্পনা সাজায় সেই দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিযোগীতা ঘিরে। এতদিনেও বাংলাদেশ উপলব্ধি করতে পারেনি যে ছোট থেকে মধ্যম শক্তির দলে পরিণত হতে ছোট অর্জনের হাতছানি পরিত্যাগ করে ছুটতে হয় বড় লক্ষ্যের দিকে। বড় লক্ষ্যে ছুটলে আপনাতেই ধরা দেয় ছোট লক্ষ্য। তাই ছোট অর্জনের যে স্বীকৃতি, বড় অর্জনের লক্ষ্য স্থির করা সাহসী পদক্ষেপের সম্মান তার চেয়েও বেশি।
চিত্রঃ ২০০৩ সাফ চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দল; সেই প্রথম, সেই শেষ বারের মত দক্ষিণ এশিয়ার শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশ। Image Source: Youtube
তাই এখন পর্যন্ত কোন বৈশ্বিক বা মহাদেশীয় শিরোপা না জিতেও বেলজিয়াম ফিফা র্যাংকিং এর শীর্ষ দেশের মর্যাদায় আসীন। ভৌগলিক অবস্থানকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে অস্ট্রেলিয়া ওশেনিয়া ছেড়ে যুক্ত হয়েছে এএফসি (এশিয়া)’র সাথে। ওশেনিয়ার মহাদেশীয় প্রতিযোগীতার নিরঙ্কুশ আধিপত্যের ইতিহাসকে উপেক্ষা করে এশিয়ার পরাশক্তিদের সাথে শিরোপার দৌড়ে থাকার চ্যালেঞ্জ নেয়াটাকেই তারা শ্রেয় মনে করেছে। ফলাফলটাও চোখে পড়ার মতই। মাত্র ৭ বছরের মধ্যেই পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ অফুটবলীয় দেশের তকমা ঝেড়ে র্যাংকিং এ ১০০ থেকে শীর্ষ ৪০ এ উঠে এসেছে অস্ট্রেলিয়া।
নেপাল মালদ্বীপ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অঞ্চল নিয়ে আবর্তিত হলে ভুটানই হবে আমাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দী। আর ফুটবলে মুক্তি চাইলে তাকাতে হবে দক্ষিণের বাইরে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিযোগীতাকে ব্যবহার করতে হবে প্রতিভা অন্বেষণ, তারুণ্যকে বিকশিত করার, দল নিয়ে পরীক্ষা আর সেরা ফর্মেশন খোজার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে। একে ঘিরে আবর্তিত হওয়া যাবেনা। বিশ্বকাপ আর এশিয়ার মহাদেশীয় প্রতিযোগিতার বাছাই আর মধ্য ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে নিয়মিত আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচের চ্যালেঞ্জ নেয়ার সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হবেই।
হকির পরাশক্তি ভারত-পাকিস্তান কখনই সাফের হকি সোনাকে গুরুত্ব দেয়নি। তাদের চোখ ছিল এশিয়াডে। এশিয়াডে ক্রিকেট অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরও সোনার সংখ্যা বাড়াতে ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলংকা মূল দল পাঠিয়ে তাতে ঝাপিয়ে পড়েনি। অনেক দেরি হয়ে গেছে ভুল থেকে শিক্ষা নেবার। বাফুফের সময় হয়েছে কি?
Special thanks to Freeflagicons.com for allowing me to use the wonderful thumbnail in this blog article
- 0 মন্তব্য