• ফুটবল

বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!

পোস্টটি ১০৯৭ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

কোপা আমেরিকা ২০১৯ এর সময় ইএসপিএন এফসির একটা টকশোতে তিনজন সাংবাদিক মেসিকে নিয়ে আলোচনা করছিলেন। প্রথমজন বললেন, “সবাই ভাবছে মেসি হয়তো কিছু একটা করবে? নাহ, এটা কক্ষনও হবেনা”। প্রথমজনের কথায় সমর্থন যোগালেন দ্বিতীয়জন, “সবাই যেটা ভাবছে সেটা হবেনা, মেসি এমন খেলোয়াড় নন যিনি আর্জেন্টিনার একটা দলকে একটা উইনিং টিমে পাল্টে ফেলতে পারবে”। এই দুইজনের কথা শুনে তৃতীয়জন যে মন্তব্যটা করলেন সেটা ছিল আরো ভয়াবহ। তৃতীয়জন বললেন, “মেসি দলের জন্যে ক্ষতিকর। তিনি থাকায় ড্রেসিং রুম, কোচ, মাঠের খেলোয়াড় এমনকি ফুটবল ফেডারেশনও ডি-মোরালাইজড হচ্ছে। এটা আর্জেন্টিনার জন্যে কখনই সুখকর হবেনা” 

 

আর্জেন্টাইন ফুটবলের সবচেয়ে বড় কিংবদন্তী দিয়েগো মারাদোনা তো মেসির মধ্যে নেতৃত্বের কোন ছাপই দেখতেন না, সোজাসাপ্টাভাবেই তিনি বলেছিলেন,   “লিওনেল মেসি কখনই একজন নেতা নন” 

 

টানা তিনটে ফাইনাল, তিনটেতেই মাথা নিচু করে ফিরে আসার পর এভাবেই লিওনেল মেসির উদ্দেশ্যে সমালোচনার বাণ ছোড়া হয়েছিল। সবাই তো ধরেই নিয়েছিল, লিওনেল মেসি যতটা বার্সেলোনার ততটা আর্জেন্টিনার নয়। আর্জেন্টাইন কোচ লুইস সিজার মেনোত্তি বলেছিলেন, “লিও বার্সায় যতটা খুশি থাকেন, আর্জেন্টিনায় ততটা থাকেন না” । যে মানুষটা একটা দলকে নিয়ে টানা তিন ফাইনাল খেলেছিলেন, সেই মানুষটাকে মিডিয়া বলেছিল অভিশাপ। সরাসরি সম্বোধনে উক্তিটা ছিল,

“লিওনেল মেসি ইজ ডেফিনিটলি আ কার্স ফর আর্জেন্টিনা” 

 

রোজারিওতে মেসির মূর্তি ভাঙা হয়েছিল, আর্জেন্টিনার রাস্তায় লিওর জার্সি পোড়ানো হয়েছিল। রোজারিও ছাড়িয়ে সেই আগুনের আঁচ লেগেছিল লিওর পরিবারেও।  ফক্স স্পোর্টসের দেয়া সাক্ষাৎকারে বড় আক্ষেপ করে লিও বলেছিলেন, “আমার ছয় বছরের ছেলে আমাকে জিজ্ঞেস করে, ওরা এমন করছে কেন? আমি ওকে বলেছিলাম, ওরা আমার বিরুদ্ধে। এরপর আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করেছিল, তুমি তো ভাল খেল। তাও কেন ওরা তোমাকে চায়না? আর না চাইলে তুমি আবার ওদের হয়ে খেলবে কেন? আমার কাছে এর উত্তর ছিল না”

 

তবে লিও কেন এরপরও আর্জেন্টিনার হয়ে খেলবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি ছোট একটা জবাব দিয়েছিলেন, ইংরেজিতে যেটার মানে হয়, “আই ডোন্ট কেয়ার, বিকজ আই ওয়ান্ট টু বি দেয়ার” 

 

দেশপ্রেমের মাপকাঠি মাপার জন্যে এখন অব্দি কোন প্যারামিটার সেট করা হয়নি, হলে হয়তো আমরা জানতে পারতাম রোজারিওতে জন্ম নেওয়া এই মানুষটা নিজের দেশকে কতটা ভালোবাসতেন, কতটা প্রাণভরে নিজের দেশের জন্যে একটা আন্তর্জাতিক শিরোপা চাইতেন, কতটা আত্মত্যাগ নিয়ে খেলতে চাইতেন দেশের হয়ে! 

 

অন্যান্য দেশের মানুষদের চাইতে নিজের দেশের ফুটবলারদের নিয়ে আর্জেন্টিনার মানুষদের চিন্তাভাবনা একটু অন্যরকম। অন্যরা চায় নিজের দেশের প্লেয়াররা গ্রেট হোক, তাঁরা বিশ্বসেরার মুকুট পুরে উড়ে বেড়াক ঐ উঁচু আকাশে। কিন্তু আর্জেন্টিনার মানুষদের হৃদয় জয় করতে চাইলে আপনাকে আগে সেখানকার একটা লিগে খেলতে হবে, এরপর ইউরোপ মাতালে তাতে কোন আপত্তি নেই। আর্জেন্টাইন সমর্থকদের এই নীতি লিও তো ভেঙেছেন সেই ছোট্টবেলায়, আর তাই কার্লোস তেভেজকেই হামেশাই লিওর চাইতে কাছের মানুষ ভেবে এসেছে আর্জেন্টিনার অধিবাসীরা। তবে লিওর সামনেও ছিল মন গলানোর সুযোগ, তার জন্যে আর্জেন্টিনাকে মনে করিয়ে দিতে হত এমন এক স্মৃতি, যেটা সবশেষ সে দেশের মানুষ পেয়েছিল ২৮ বছর আগে! 

 

আর লিও যে বারবার সেটাই পারছিলেন না! 

 

লিওনেল মেসি নিজের দেশকে ভালোবাসেন না, বার্সাকেই তার মনে হয় সবচেয়ে আপন- এই অভিযোগের তীরে বিদ্ধ হতে হতে একসময় তিনি কোপা আমেরিকা জিতেছেন। আর কাল তো দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ড ভেঙে পেরিয়ে গেলেন পেলেকেও! 

 

আমি জানিনা, একটা মানুষ আর ঠিক কতটা করলে নিজের দেশের জন্যে করা হয়। আর কতটা আত্মত্যাগ করলে প্রমাণিত হয়  মানুষটা দেশের জন্যেই খেলতে চেয়েছিল। এই তো গত রাতে, রেকর্ড ভাঙার পর ম্যাচ শেষে লিও যখন অশ্রুসিক্ত চোখে নিজের দেশের আকাশের দিকে চেয়েছিলেন, ঐ চোখ ঠিকরেই বেরিয়ে আসছিল, “আমি তো তোমারই নাম গাই” 

 

যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, সেখানেই ফিরে যাই। লিওনেল মেসি শিরোপাখরার জন্যে, আর্জেন্টিনার হয়ে ফাইনাল হারার জন্যে কম যন্ত্রণায় বিদ্ধ হননি। তবুও বারবার লিওনেল মেসি এগিয়ে গেছেন, উঠে দাঁড়িয়েছেন। আর কাল যখন লিও হ্যাট-ট্রিক করে দক্ষিণ আমেরিকার রেকর্ড ভেঙে দিয়ে নিজেকে আরেকটু উপরে নিয়ে গেলেন, ধারাভাষ্য কক্ষে থাকা ধারাভষ্যকার চিৎকার করে যাচ্ছিলেন, “ইটস লিওনেল মেসি শো ওয়ান্স এগেইন” , আমার বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল- 

 

“দিস ইজ লিও’স ওয়ার্ল্ড। উই আর জাস্ট লিভিং ইন ইট”