• ফুটবল

মাঝমাঠের এক জাদুকরের গল্প

পোস্টটি ১৫৩৫ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
একটু ছোটখাটো গড়নের মানুষ, মাথায় ঝাঁকড়া চুল আছে। মাঝমাঠের শৈল্পিক ফুটবলে বুঁদ করে রাখেন দর্শকদের। বুড়ো হয়েও পুরো মাঠ দাপিয়ে বেড়াতে জানেন, যতক্ষণ মাঠে থাকেন মুগ্ধতা ছড়াতেই থাকেন। মেসি-রোনালদোর যুগে জিতেছেন ব্যালন ডি অরও। বয়সের ছাপ মাঠের পারফরম্যান্সে বিন্দুমাত্র পড়েনি।  বয়সের সাথে সাথে যেন স্বাদ বেড়েই চলেছে, একদম পুরোনো মদের মত। ইউরোপিয়ান ফুটবলের খোঁজখবর রাখা ব্যাক্তি হলে এতক্ষণে হয়ত বুঝে গেছেন কার কথা বলা হচ্ছে। হ্যাঁ, বলছিলাম লুকা মডরিচের কথা। 
 
 
 
 
 
১৯৮৫ সালের কথা। ক্রোয়েশিয়ার জাদারে সেপ্টেম্বর মাসের ৯ তারিখ পৃথিবীর আলো দেখেন লুকা মডরিচ। এক অভিবাসী পরিবারেই জন্ম মডরিচের। মডরিচ তার জীবনে ভয়াবহতার সম্মুখীন হয়েছেন একদম ছোট বয়সেই। সার্বিয়ান গৃহযুদ্ধ চলাকালীন মডরিচের পুরো পরিবার ছিল ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতার পক্ষেই। তবে ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা লাভ করা ক্রোটদের স্বাধীনতার জন্য মডরিচের পরিবারকেও মূল্য দিতে হয়েছে। মডরিচের দাদাকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে সার্বিয়ান সেনাবাহিনী। শুধু তাই নয়, মডরিচদের বাড়িটিকেও পুড়িয়ে দেয় সার্বিয়ান সেনাবাহিনী। বাধ্য হয়ে উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নেয় তাদের পরিবার। তবে মডরিচকে ফুটবল খেলা থেকে দূরে রাখা যায়নি। হোটেলের গাড়ি পার্কিংয়েই ফুটবল খেলতেন মডরিচ, সেখান থেকে রাস্তা, স্কুলের মাঠ। খেলার ছলেই ফুটবলের সাথে বন্ধন দৃঢ় হতে থাকে তার। 
 
 
 
মডরিচের জীবনে কষ্টের গল্প আরো আছে। নিজের ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করার উদ্দেশ্যে স্থানীয় ক্লাব হাজদুকের ট্রায়ালে যান মডরিচ। কিন্তু দুর্বল, লিকলিকে গড়নের এই লুকা মডরিচ হবেন ফুটবলার? ধুর, হতেই পারেনা। ক্লাবটা মডরিচের শারীরিক গড়নের কারণেই বাদ দিয়ে দেয় তাকে। তবে মডরিচ থেমে যাননি। কিছুটা দুর্বল আর ছোটখাটো গড়নের হলেও সেই প্রতিবন্ধকতাকে মডরিচ জয় করলেন নিজের পরিশ্রম দিয়ে। আর লোকেদের কথাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ডিনামো জাগরেবে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করে দেম মডরিচ। তখন মডরিচের বয়স কত? মাত্র ১৫। ছোট্ট মডরিচের জন্য অবশ্যই দারুণ কিছু।
 
 
 
 
 
 
ক্লাবে যোগ দেওয়ার পর থেকেই নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে শুরু করে দিলেন তিনি। ক্লাবও চিনতে পারে প্রকৃত প্রতিভাকে। চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে নেয় দশ বছর। কিছু পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর পর উচ্চতা আর শারীরিক গঠন কিছুটা হলেও উন্নত হয় মডরিচের। এরপর জাগরেব থেকে দুই দফায় ধারে খেলেছেন ভিন্ন দুইটা ক্লাবে, সেখানেই নিজের জাত চিনিয়েছেন। জাগরেবের সিনিয়র দলে অভিষিক্তও হয়ে যান ২০০৫ সালে। টানা তিন মৌসুম লিগ জেতেন তাদের হয়ে, পাশাপাশি ছিল ঘরোয়া কাপের শিরোপাও। ২০০৮ সালে পাড়ি জমান প্রিমিয়ার লিগের দল টটেনহাম হটস্পারে।
 
 
 
 
২০১০-১১ মৌসুমে প্রায় ৫০ বছর পর চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলে টটেনহাম, সেই আসরে কোয়ার্টার ফাইনালেও খেলে মডরিচের তখনকার ক্লাবটা। এরপর ২০১১-১২ মৌসুম টটেনহামে কাটানোর পর তিনি নাম লেখান স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদে। এরপরের গল্পটা ইতিহাস। 
 
 
 
 
রিয়ালের হয়ে প্রথম মৌসুমটা একেবারেই ভালো কাটেনি মডরিচের। বছরের জঘন্যতম সাইনিং হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন মডরিচ। এরপর সেই মডরিচই এখন বিশ্বের সেরা মিডফিল্ডারদের কাতারে। দলের নির্ভরযোগ্য একজন ফুটবলার। 
 
 
 
 
রিয়াল মাদ্রিদে প্রত্যেকটা মৌসুমে যেন নিজেকে ছাড়িয়েই যাচ্ছেন মডরিচ। কাসেমিরো আর টনি ক্রুসের সাথে মিলে এমন এক মিডফিল্ড তৈরি করেছেন রিয়ালে, যেটা তর্কসাপেক্ষে বর্তমান দুনিয়ার সেরা মিডফিল্ড বলেই বিবেচিত হয়। মাঝমাঠ থেকে ফুটবলে শিল্পের ছোঁয়া দিয়ে গোল, এসিস্ট করে যাচ্ছেন ক্রমাগত, এই বয়সে এসেও এতটুকু কমেনি ধার। হিটম্যাপ দেখলে কেউ বলবেই না মডরিচ ৩৫ বছর পার করে ফেলেছেন। টানা ম্যাচ খেলে যাচ্ছেন, একটুও ক্লান্ত মনে হয় না। যেন মাঝমাঠের এক জাদুকরের নাম লুকা মডরিচ।  
 
 
 
 
 
 
 
রিয়ালের হয়ে জিতেছেন টানা তিনটি চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা, জিতেছেন লা ডেসিমাও। দুই লালিগার পাশাপাশি জিতেছেন তিনটি ক্লাব বিশ্বকাপ। জায়গা পেয়েছেন ২০১৩-১৪ এবং ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮ এবং ২০২০-২১ মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেরা একাদশে। হয়েছেন ২০১৩-১৪ মৌসুমে লা-লিগার সেরা মিডফিল্ডার,  ২০১৫ সালে ফিফার বর্ষসেরা একাদশের সদস্যও ছিলেন, লালিগার ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭ মৌসুমের সেরা একাদশেও জায়গা পেয়েছিলেন। ধারাবাহিকভাবে ২ বার হয়েছেন উয়েফার বর্ষসেরা মিডফিল্ডার। জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জিতেছেন ২০১৮ সালের গোল্ডেন বল, খেলেছেন বিশ্বকাপের ফাইনাল এবং জায়গা করে নিয়েছিয়েন বিশ্বকাপের সেরা একাদশেও। মেসি রোনালদোর যুগে তাদের হারিয়ে জিতে নিয়েছেন উয়েফার সেরা প্লেয়ার, জিতেছেন ব্যালন ডি'ওরও। 
 
 
 
 
 
কষ্টের জীবনের দুঃখ-দুর্দশাকে পাশ কাটিয়েছেন নিজের মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে। নিজের স্বপ্ন পূরণ করেই থেমে থাকেননি, নিজেকে নিয়ে গেছেন এক্কেবারে উঁচুতে, সময়ের সেরাদের কাতারে। মুগ্ধতা ছড়িয়ে যাচ্ছেন এখনো। মেসি-রোনালদোর যুগে জিতেছেন ব্যালন ডি'অরও। নিজের দেশকে নিয়ে গেছেন ফুটবলের বিশ্বমঞ্চের ফাইনালেও। কোটি ভক্তের মুখে মুখে লুকা মডরিচের নাম তো আর এমনি এমনি শোনা যায় না।
 
 
 
 
৩৬ এ পা দেওয়া এই জাদুকরের বাক্সে আরো কী কী জাদুর কাঠি লুকানো আছে কে জানে? ভক্ত-দর্শকরা তো এরকম জাদুকর মডরিচকেই উপভোগ করেন।