• ফুটবল

অস্ত্রের ঝনঝনানির বিপরীতে শৃঙ্খলিত এক জীবন : এক কিশোরের থিয়াগো সিলভা হয়ে উঠা!

পোস্টটি ১২২০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

রিও! ব্রাজিলের তৃতীয় বৃহত্তম ছবির মতো সুন্দর এই শহর'টি সর্বদা কর্মব্যস্ত। সরু উঁচুনিচু রাস্তাঘাট, ইলেক্ট্রিক তারের ছড়াছড়ি; এই রোদ এই গোলাগুলির ঝুম বৃষ্টি! পাড়ায় পাড়ায় দিবারাত্রি চলে মাদক সম্রাট বাহিনীর স্বসস্ত্র মিছিল। আজন্ম কর্মচঞ্চল এই নগরীকে অশান্ত করে তারা তাদের অস্তিত্ব জানান দিতে চায়। 

 

অস্থির সে সময়। মাদক, দারিদ্র, গ্যাং, খুব সাধারণ জীবনযাপন- এইতো এখানকার বেশিরভাগ মানুষের জীব। অস্থির সময়ে স্বস্তি কেবল এখানকার ফুটবলে! ব্রাজিল ততোদিনে ৩ বার বিশ্বচ্যাম্পিয়নস হয়ে গিয়েছে। এই অঞ্চল থেকে ফুটবলাররা মেধার সাক্ষর রাখছেন জাতীয় দলে। তাইতো মোটামুটি বড় অঙ্কের মানুষেরা চান তাদের সন্তানেরা ফুটবলার হোক- জাতীয় দলে খেলুক। দেশের প্রতিনিধিত্ব করার পাশাপাশি তাদের দারিদ্রও ঘুচাক। 

 

আমি সে অঞ্চলের এক কিশোরের বেড়ে উঠা নিয়ে গল্পের আসর সাজাতে চাই। সে কিশোর আমার ফুটবল আইডলদের একজন। কিভাবে খুব সাধারণ এক ফুটবলার থেকে তার শ্রেষ্ট সময় পার করেছেন, কিভাবে সব বাঁধা পেরিয়ে নিজেকে শ্রেষ্টদের মঞ্চে দাঁড় করিয়েছেন- তা হয়তো কেউ ফলাও করে প্রচার করে না। 

 

ব্রাজিলের যেসব ফুটবলাদের নামের পাশে বিশ্বকাপ না থাকা বেমানান, তিনি তাদের একজন। যদিও এই ক'দিন আগে ক্লাবের হয়ে জিতেছেন ইউরোপের সবচেয়ে মর্যাদার শিরোপা। মিলানের আলোয় ম্লান হয়েও যারা সুনামের সাথে 

ফুটবলে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তিনি তাদের একজন- থিয়াগো এমিলিয়ানো ডা সিলভা। 

 

গ্যাংস্টার আর মাদক সাম্রাজ্যে লিপ্ত তৎকালিক রিওতে দিনদুপুরে গুলির বৃষ্টি রীতিমতো সাধারণ ব্যাপার ছিলো। সিলভা যেখানে বেড়ে উঠেছেন সেখান থেকে ৫০ গজ দূরে গুলাগুলি হতো, মনে হতো এই যেন যুদ্ধ বেঁধে গেলো। ইতিমধ্যেই ৩ বিশ্বকাপ জেতা এই জাতীর গৌরবের জায়গা ফুটবল- সিলভাও স্বভাবতই খুব ছোটবেলা থেকেই ফুটবলপ্রীতিতে আসক্ত! 

 

তবে সময়টা দারুণ বাজে ছিল ছোট্ট সিলভার জন্য। পরিবারের আর্থিক অস্বচ্ছতা, মা বাবার আলাদা হয়ে যাওয়া, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ- এইসব সমীকরণ সিলভাকে খুব ছোটবেলাতেই মেলাতে হয়েছে। দারিদ্র্যতার পাশাপাশি প্রায় সারাবছরই অসুস্থ থাকতো ছোট সিলভা আর তার দুই ভাইবোন। ঠিক যে সময়ে বাবাকে পাশে পাওয়া সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল, তখন তাকে না পাওয়ার পীড়া খুব ভুগিয়েছে সিলভাকে। 

 

তখনকার ক্রিমিন্যাল গ্যাংগুলোতে বাচ্চাদের হাতেও থাকতো সুসজ্জিত অস্ত্রসস্ত্র! সেইসব কোনো ক্রিমিন্যাল গ্যাংয়ে যোগ না দিয়ে সিলভা বরং বেছে নিলেন ফুটবল। আর তাকে সাহায্যে এগিয়ে আসলেন তার সৎ পিতা; যার প্রতি সিলভার কৃতজ্ঞতা আজীবনের। সিলভা বলেন, 'আমার সৎ পিতা সবসময় আমার পাশে ছিলেন। তিনি কোনো স্বার্থ ছাড়াই আমাকে সমস্তভাবে সাহায্য করে গেছেন।'  

 

একসময় ফুটবলের চেয়ে ঘুড়ি উড়ানো'টাই বেশি ভালোবাসতেন থিয়াগো সিলভা, এই তথ্য জানতেন? বারুদ মাখা কিংবা সতেজ, পরিষ্কার নীল আকাশে বিকেল হলেই রঙ্গ বেরঙ্গের ঘুড়ি উঠাতে সিলভার আনন্দের শেষ ছিল না। সিলভার মতে ঘুড়ি সুঁতো দিয়ে যখন আরেক ঘুড়ির সুঁতো কাটা হয়- এই মূহুর্তটা ফুটবলে গোল দেয়ার চেয়ে বেশি উত্তেজনাকর! 

 

ফুটবলে হাতেখড়ি স্থানীয় ফুটবল মাঠে, তবে ট্রেনিং করতে যেতে হতো বহুদূর! ভাড়া দেয়ার সামর্থ্য ছিলোনা বলে স্কুল ড্রেস পড়ে উঠে পড়ছেন বাসে। ড্রাইভার'রা একটুখানি হেসে বলতেন, 'দুঃখিত বাচ্চা, আমরা তোমার স্কুলের দিকে যাচ্ছি না।' তাতে খুব একটা বিচলিত দেখাতো না সিলভাকে, কারণ সে স্কুলে যাচ্ছেও না! ড্রাইভারদের তাই অকপটে বলে ফেলতো তার আসল কথা- 'দেখুন আমি স্কুলে যাচ্ছি না। আমি যাবো ফুটবল খেলতে, ট্রেনিং নিতে। আপনারা যদি আমাকে সাহায্য করেন, আমি আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো আজীবন।' 

 

সাফল্য পেতে হলে আপনাকে অসাধ্য সাধন কর‍তে হয়; সিলভা ঠিক সেটাই করছিলেন। তবে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাচ্ছিলেন না। বারবার বিভিন্ন ক্লাবে অডিশন দিচ্ছিলেন, বারবার রিজেক্ট করে দেয়া হচ্ছিলো তাকে। তবে তাকে মনে ধরলো স্থানীয় এক স্কাউট পাওলো সিজারের। সিজার তাকে আমন্ত্রন জানালেন দক্ষিন ব্রাজিলের আরএস ফুটবল ক্লাবে যোগ দিতে; সিলভা রাজিও হয়ে গেলেন। ২০০১ সাল। সেটাই ছিল থিয়াগো সিলভার ক্যারিয়ারের প্রথম প্রফেশনাল চুক্তি! 

 

তারপরের গল্পটা আমাদের অনেকের জানা। সিলভা দিনদিন প্রতিভার সাক্ষর দিতে থাকলেন। প্রতিভা, শৃঙ্খলা ও হার্ডওয়ার্ক এবার তাকে সাফল্যের মুখ দেখালো। ২০০৪ সালে সিলভা পাড়ি জমালেন পর্তুগালে, পোর্তো বি দলের হয়ে চুক্তি হলো ২.৪ মিলিয়ন ইউরোর! মাস ছয়েক পরেই ক্লাব পাল্টিয়ে নাম লেখালেন রাশিয়ান ক্লাব ডায়নামো মস্কো'তে। যেখানের বরফ শীতল ঠান্ডা আবহাওয়ায় প্রচন্ড অসুখ বাঁধালেন। হাসপাতালে জীবন মৃত্যু নিয়ে শঙ্কা দেখা দিলো সিলভার। ছয় মাস পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে জানালেন তিনি নরকে ছিলেন!

 

আমার মতে সিলভার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ফ্লুমিনেন্সে যোগ দেয়া। এখানে তাকে ডাকা হতো 'দ্যা মনস্টার'। এই নামের পিছনে কারণ বহু আছে। ২০০৬ সালে সিলভাকে সাইন করানোর পর প্রথমবারের মতো কোপা ডু ব্রাজিল শিরোপা ঘরে তুলে ক্লাবটি। কোয়ার্টার ফাইনালের শুরুর গোল, আর সেমিফাইনালে সমতাসূচক গোলটি করে সিলভা রীতিমতো হিরো বনে যান। ব্রাজিল জাতীয় দলেও ডাক মেলে তার। 

 

২০০৮ সালের কথা। সিলভাকে নিয়ে গুঞ্জন ছিল তিনি হয়তো চেলসি বা ভিয়ারিয়ালে যোগ দিবেন। তবে সে গুঞ্জন গুড়ে বালি, সিলভা জানালেন তিনি যোগ দিতে যাচ্ছেন এসি মিলানে। কার্লো আনচেলত্তির এসি মিলান দল তখন তারকায় ঠাসা। সিলভা সতীর্থ হিসেবে খুব কাছে পেলেন ডিফেন্স সম্রাট পাওলো মালদিনিকে। 

 

মিলানে ৪ বছরের চুক্তি শেষে ২০১১/১২ মৌসুমে সিলভা পাড়ি জমালেন প্যারিস সেইন্ট জার্মেইনে। তৎকালীন সময়ে ৪২ মিলিয়ন ইউরোর ডিফেন্ডার সিলভা- সবচেয়ে দামি ডিফেন্ডারের তকমাটাই পেয়েছিলেন। রোনাল্ডো ফেনোমেনন তো অকপটে স্বীকার করেন, 'সিলভা নিঃসিন্দেহে সেসময়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা সেন্ট্রোল ডিফেন্ডার।' 

 

গুনে গুনে এখানে কাটালেন ৮ মৌসুম! লীগ জিতলেন ৭ বার, ফ্রেঞ্চ সুপার কাপ ৭ বার। ফ্রেঞ্চ কাপ জিতলেন ৫ বার, ফ্রেঞ্চ লীগ কাপ ৬ বার! এতসব অর্জনের মধ্যে ছিলোনা কোনো ইউরোপীয়ান শিরোপা- আক্ষেপটা এখানেই। 

 

তবে এবার 'মানুষের অসাধ্য কিছু যে নেই' তা-ই যেন প্রমাণ করলেন থিয়াগো সিলভা। সাইত্রিশ ছুঁইছুই এক পরিণত ফুটবলারকে ডিফেন্স দুর্গে ডেকে পাঠাবার দুঃসাহস ইতালিয়ান কোন ক্লাব করতে পারে, ইংলিশ ক্লাবের বেলায় তা খুবই অবিশ্বাস্য। তবে তাই করে দেখালো চেলসি। পিএসজি থেকে সিলভাকে উড়িয়ে আনলো রোমান আব্রামোভীচের দল, যেখানে বর্তমানের প্রায় সব প্লেয়ারই তরুণ! 

 

বলছিলাম ইউরোপিয়ান শিরোপা ইউসিএল জয়ের আক্ষেপ'টা এতোদিন রয়েই গিয়েছিলো থিয়াগো সিলভার। চেলসি ক্যারিয়ারের প্রথম মৌসুমেই জিতে নিলেন ইউরোর মর্যাদাপূর্ণ এই শিরোপা। ধন্যবাদটা চেলসি'র প্রাপ্য, থিয়াগো সিলভায় বিশ্বাস রাখায়। 

 

সিলভা খুব সাধারণ একজন ফুটবলার, যিনি তার সমস্তটা দিয়ে খেলেন। যেখানেই খেলেছেন উজাড় করে দিয়েছেন সমস্তটুক। শুরুতে মিডফিল্ড পজিশনে খেলা শুরু করলেও নিজের রক সলিড ডিফেন্স প্রতিভায় দিন দিন সেরা ডিফেন্ডারদের একজন হয়ে উঠতে পেরেছেন। 

 

আমি সিলভার মধ্যে একজন যোগ্য নেতা দেখি। যে নেতা দলকে সবসময় আগলে রাখেন। দলের খারাপ সময়ে কান্ডারি হয়ে দেখা দেন, এক মিশেল জাদু দেখিয়ে মাতিয়ে রাখেন পুরো গ্যালারি। তার মধ্যে আমি অহংকারবোধ দেখি না, দেখিনা ক্রোধের বশবর্তী হয়ে কাউকে রাগে আঘাত করতে। বরং তাকে দেখি প্রতিপক্ষের আক্রমণভাগ ধ্বংস করে দিয়েও স্মিত হাসি হেসে কিংবা গম্ভীর চাহনি দিয়ে ডিফেন্স লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে। 

 

আজ ২২ এ সেপ্টেমব্র, এই অত্যান্ত গুণী ডিফেন্ডারের জন্মদিন। জন্মদিনের শুভেচ্ছা রইলো তার প্রতি আর বলতে ইচ্ছে করছে- আমার চোখে আপনি সবসময়-ই সেরা, থিয়াগো সিলভা। 

 

- আহমদ আতিকুজ্জামান।