• ফুটবল

Sir Alex Ferguson- The magician god of Manchester

পোস্টটি ২৩৭৫ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।


আমরা ছোটবড়, মাঝ বয়সী প্রায় সবাই জাদু দেখতে খুব ভালোবাসি, উপভোগ করি। সাধারণ অর্থে জাদু বলতে এমন কিছু চমকপ্রদ, বিস্ময় উদ্রেককারী বিষয়কে বোঝায় যা আমাদের মনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে।জাদু বলতে প্রকৃত অর্থে কোনো কিছু নেই। এটি একটি শিল্প যার শিল্পী হচ্ছেন খোদ জাদুকরই। তার সুনিপুণ দক্ষতার মাধ্যমে এই শিল্পকে সকলের নিকট আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেন । অর্থাৎ যিনি শৈল্পিক দক্ষতাকে বাস্তবতার সাথে মিল রেখে এই শিল্পের পূজা করতে পারবেন তিনি ততো বেশি গ্রহণযোগ্য হতে পারবেন।

এবার একটা ছোট গল্প শোনা যাক।
১৯৭৮ সাল। স্কটিশ ক্লাব সেইন্ট মিয়েরেনের চেয়ারম্যান Willie Todd তৎকালীন কোচকে "immature" "particularly petty" এমনকি তাঁর কোনো ম্যানেজারিয়াল অ্যাবিলিটি নেই বলে আখ্যা দিয়ে ক্লাব থেকে বরখাস্ত করে দেন।
২০১৩ সাল। সেদিনের সেই রক্তিম আভার শুভ্র মুখো মানুষটি নিজের ম্যানেজেরিয়াল ক্যারিয়ারে সর্বমোট ৪৯টি শিরোপা জিতে অবসরে যান।

বাস্তব জীবনে খুব নগণ্য মানুষই আছেন যারা নিজের কাজের মাধ্যমে সবাইকে মন্ত্র মুগ্ধ/জাদু করতে পারে। বিষয়টি যদি হয় ফুটবলের কর্তা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে, তাহলে এই সংখ্যা হবে হাতে গোনা কয়েকজন যারা অসম্ভবকে সম্ভব করতে পেরেছিলেন। নিজেকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। ফুটবল ইতিহাসে এদের নাম লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। এমনই একটি জাদুকরের নাম "স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন" যিনি অসম্ভব কল্পকাহিনী কে রূপ দিয়েছিলেন বাস্তবে। যাকে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং তর্কসাপেক্ষে শ্রেষ্ঠতম ম্যানেজার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের জন্ম ১৯৪১ সালের ৩১ ডিসেম্বর স্কটল্যান্ডের সর্ববৃহৎ শহর গ্লাসগোর Govan নামক স্থানে। ছোটবেলা থেকেই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠেছেন দুই ভাই অ্যালেক্স এবং ছোট ভাই মার্টিন ফার্গুসন।lyzQXXw

তাদের বাবা একটি শিপইয়ার্ডে কাজ করতেন যেটি তাদের বাড়ির পাশেই ছিল। ফুটবলের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ছিলো দুই ফার্গুসন ব্রাদারের। নিজের ইয়ুথ ক্যারিয়ারে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন Harmony Row Boys Club এবং Drumchapel Amateur Football Club ক্লাবের হয়ে খেলেছিলেন।Alex-Ferguson (1)

সিনিয়র ক্যারিয়ারে পদার্পণ ঘটে মাত্র ১৬ বছর বয়সে স্কটল্যান্ডের অন্যতম প্রাচীন ক্লাব কুইন্স পার্কের মাধ্যম।স্ট্রাইকার পজিশনে খেলা ফার্গি সেখানে ৩ মৌসুমে ৩১ ম্যাচে গোল করেন ১৫টি। এরপর তিনি পাড়ি জমান সেইন্ট জনস্টন ক্লাবে। সেখানে ৪ মৌসুমে ৩৭ ম্যাচে গোল করেন ১৯ টি। মজার বিষয় হচ্ছে- এই দুই ক্লাবে তিনি পার্ট টাইম ফুটবলার হিসেবে খেলতেন। কারণ তাঁকে গোটা দিনের এক ভাগে শিক্ষানবিশ বা apprenticeship হিসেবে কাজ করতে হতো।
ফার্গুসনের বাবা ছেলেকে ফুটবল খেলার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করলেও সবার আগে সেই শিক্ষানবিশ প্রশিক্ষণের বিষয়টিকে গুরত্ব দিতেন। দুই দিকে ঠিক মতো তাল মেলাতে না পারায় বেশ ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে যান তিনি।

চারিদিক থেকে যখন সবকিছু মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলো তখন ভাগ্য বিধাতা আবার ফিরে তাকালেন তাঁর দিকে।  সারা বছর রিজার্ভ টিমে খেলা ফার্গি লিগ ম্যাচের  রেঞ্জার্সের বিপক্ষে হঠাৎ ডাক পেলেন সেইন্ট জনস্টনের মূল দলে । বলা বাহুল্য, ছোটবেলা থেকে তিনি ছিলেন রেঞ্জার্সের ডাই হার্ড ফ্যান। সেই ম্যাচে হ্যাটট্রিক করে নজরে আসেন বেশ কয়েকটি স্কটিশ ক্লাবের।skynews-sir-alex-ferguson-never-give-in_5275777
সেইন্ট জনস্টন থেকে পরবর্তীতে যোগ দেন ডানফার্মলাইন অ্যাথলেটিক ক্লাবে। এখানে যোগ দেবার মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ পেশাদার ফুটবলার হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে ফার্গুসনের! সেখানে ছিলো তাঁর নজরকাড়া পার্ফরমেন্স! সেবার ডানফার্মলাইনের হয়ে ৩১ গোল করে হয়ে যান লিগের টপ স্কোরার। তাঁর কল্যাণে সেই মৌসুমে বেশ ভালো পজিশনে ছিলো ডানফার্মলাইন অ্যাথলেটিক। সেল্টিক এর চেয়ে ১ পয়েন্ট কম পেয়ে হয়েছিল লিগ রানার্সআপ। তিন মৌসুম এখানে কাটানোর পর তৎকালীন স্কটিশ রেকর্ড ৬৫ হাজার পাউন্ডের বিনিময়ে যোগ দেন নিজের স্বপ্নের ক্লাব রেঞ্জার্সে!Sir Alex Ferguson

রেঞ্জার্সের হয়ে খেলেছেন মোট দুই মৌসুম । সেখানে ৪১ ম্যাচে গোল করেন ২৫ টি। এই যাত্রার শুরু স্বপ্নের মতো হলেও হলেও পরিণয় ঘটে এক দুঃস্বপ্নের মত।
১৯৬৯ সালের স্কটিশ কাপ ফাইনালে মুখোমুখি হয় রেঞ্জার্স ও সেল্টিক। সেখানে সেল্টিকের কাছে ৪-০ হলে লজ্জাজনক হারের মুখ দেখে রেঞ্জার্স। সেল্টিক এর করা প্রথম গোল এক প্রকার দৃষ্টিকটু ভুল করে বসেন ফার্গুসন। যার জন্যে বলির পাঠা হতে হয়েছে ফার্গুসনকে।
প্রিয় দলের সমর্থকদের কাছ থেকে সেই যন্ত্রণা তিনি কোনোভাবে সহ্য করতে পারেননি। ঐ ফাইনাল ম্যাচটি ছিল রেঞ্জার্সের হয়ে তাঁর খেলা শেষ ম্যাচ! রেঞ্জার্স থেকে ১৯৬৯ সালে যোগ ফালকার্কে। সেখানে চার বছর কাটানোর পর এয়ার ইউনাইটেডে কাটান আরো এক বছর। সেখানে প্লেয়ার - ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭৪ সালে এখানেই আনুষ্ঠানিকভাবে খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি টানেন।

বুট জোড়া তুলে রাখলেও ফুটবল থেকে দূরে সরে যাননি তিনি। সে বছরই ইস্ট স্টার্লিংশায়ার নামক স্কটিশ ক্লাবের পার্ট টাইম কোচ হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। এর মাধ্যমে ফুটবল কোচিং জগতে পদার্পণ করেন ফার্গুসন। সেবছর অক্টোবরেই স্কটল্যান্ড জাতীয় দলের কোচ জক স্টেইনের পরামর্শ মতে যোগ দেন আরেক স্কটিশ ক্লাব সেইন্ট মিরেনে। সেখানে তিনি দলকে দ্বিতীয় বিভাগ থেকে প্রথম বিভাগে উন্নীত করে ১৯৭৭ সালে প্রথম বিভাগ ফুটবলে মিরেনকে  শিরোপা জেতান।
সেইন্ট মিরেনে সাড়ে তিন বছর থাকবার পর ক্লাবের মালিক পক্ষ এবংএক নারী কর্মকর্তার সাথে ঝামেলায় জড়ানোর বরখাস্ত করা হয় । কোচ হিসেবে সেই একবারই বরখাস্ত হয়েছিলেন তিনি।

এরপর ১৯৭৮ সালে  স্কটিশ টপ টায়ারের ক্লাব এবার্ডিনের ফুলটাইম ম্যানেজার হবার অফার পান।shutterstock_editorial_3065060a-e1622038285264-1-940x564
তখন এবার্ডিন ক্লাবের ফুটবল ফ্যাসিলিটিজ ছিলো খুবই সীমিত।তারা সাধারণত স্থানীয় একটি পার্কে ট্রেনিং করতো।কখনো কখনো গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গাতে এমনকি বিকেল বেলায় সবাই সমুদ্রের পাড়েও ট্রেনিং করতে যেতো।

তিনি যখন দলের হাল ধরেন তখন দলের সমর্থকদের এমনকি প্লেয়ারদের প্রত্যাশা ছিলো একদম কম। তারা কেউই বড় কোনো স্বপ্ন দেখতো না। ফার্গুসন এসে সেই ধারণা বদলানোর জন্যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হোন। তাঁর প্রথম টার্গেট ছিল বড় দুই ক্লাব রেঞ্জার্স এবং সেল্টিক কে হারানো।কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, এই দুই দলকে না হারাতে পারলে লিগ জেতা সম্ভব নয়।38d5c44dd142e8470f9d8fd1d9ad73fe

ফার্গি সেই এবার্ডিনকে তিলে তিলে নিজের মতো করে গড়ে তুলেছিলেন। যার ফলাফল-  দায়িত্ব নেবার দুই বছরের মাথায় স্কটিশ লিগ চ্যাম্পিয়ন হয় এবার্ডিন !  সেবার লিগ জেতার নিশ্চিত হবার পর ধারাভাষ্যকার বলে উঠে - 'Alec Ferguson, can you blame the man for going out of his mind temporarily?' এরপর টানা দুই মৌসুম জেতেন স্কটিশ কাপ।ae52dfb7a4b8973c48e4de001c367435_XL
১৯৮২-৮৩ মৌসুম ছিলো এবার্ডিন এমনকি গোটা স্কটিশ ফুটবল ইতিহাসের জন্যে ছিলো অন্যতম সেরা মূহুর্ত।  সেবার সেমিফাইনালে শক্তিশালী বায়ার্ন মিউনিখ এবং ফাইনালে আরেক ফুটবল পরাশক্তি রিয়াল মাদ্রিদকে  হারিয়ে জয় করেন ইউরোপিয়ান কাপ!Alex-Ferguson (2)

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরের মৌসুমে সেই ছন্দের পতন ঘটে । এবার্ডিন লিগে চতুর্থ হয় এবং সেবছর দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। এবার্ডিনের হয়ে ইউরোপিয়ান কাপ ও ইউরোপিয়ান সুপার কাপ সহ মোট ১১ টি শিরোপা জেতেন তিনি।
১৯৮৫ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব চলাকালীন সময়ে আকস্মিক মৃত্যু হয় তৎকালীন স্কটিশ কোচ জ্যাক স্টেইনের। বিশ্বকাপ বাছাইয়ের বাকি ম্যাচ গুলোতে অন্তর্বর্তীকালীন কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ফার্গুসন।Cbvj5B1WIAElakc

১৯৮৬ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সেবারই প্রথম লিগে সবচেয়ে বাজে শুরু করে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ১৩ ম্যাচ শেষে লিগ টেবিলে ১৯ তম অবস্থানে ছিলো রেড ডেভিলসরা। দলের এই বাজে অবস্থার জন্যে বরখাস্ত করা হয় তৎকালীন কোচ রন অ্যাটকিনসনকে। লিগের মাঝ পথে নিয়োগ দেওয়া হলো অ্যালেক্স ফার্গুসনকে - যেটি ছিলো তার জীবনের বহুল প্রতীক্ষিত মাহেন্দ্রক্ষণ।45544746_1988283451256786_3361661844493172736_n
কিন্তু সেসময় মাঠ এবং মাঠের বাহিরে - দুইজায়গাতেই সমস্যায় জর্জরিত ছিলো গোটা দল। প্রথমত, দল লিগের রেলিগেশন জোনে চলে গিয়েছিল।অপরদিকে দলের প্রধান কিছু ফুটবলার মাদকাসক্ত ও হতাশাগ্রস্থ ছিলো। এককথায় দলে শৃঙ্খলা নামক কোনো শব্দই ছিলো না। ফার্গি এসেই সর্বপ্রথম দলে শৃঙ্খলা ফেরানোর চেষ্টা করেন এবং প্লেয়ারদের ম্যাচ ফিটনেস ডিসেন্ট লেভেলে নিয়ে আসতে সহায়তা নক্রেন। সেবার ইউনিটেড লিগ শেষ করে ১১ নম্বরে থেকে।

ওল্ড ট্রাফোর্ডে নিজের দ্বিতীয় মৌসুমে বেশ কয়েকটি সাইনিং করেছিলেন ফার্গুসন। যাদের মধ্যে স্টিভ ব্রুস, জিম লেইটন, অ্যান্ডারসন ছিলেন অন্যতম। সেবার সবাইকে চমকে লিগ রানার্সআপ হয় রেড ডেভিলরা। কিন্তু পরের মৌসুমে আবার লিগ শেষ করে ১১ নম্বরে থেকে। একের পর এক সাইনিং করেও ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে বের হতে পারছিলো দল। ১৯৮৯-৯০ মৌসুমেও লিগে বাজে অবস্থা বজায় থাকলেও ইউনাইটেডের হয়ে নিজের প্রথম ট্রফির দেখা পান তিনি। ফাইনালে ক্রিস্টাল প্যালেস কে হারিয়ে  এফএ কাপ চ্যাম্পিয়ন হয় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। gettyimages-79022736-2048x2048

তিনি দলের দায়িত্ব নেবার পর লিজেন্ডারি কোচ স্যার ম্যাট বাসবির লিগেসি মতো আগানোর চেষ্টা করেন। বাসবির ইউনিটেডে সফলতার মূল কাঠি ছিল নতুন ইয়াং প্লেয়ার। ফার্গি সেই ধারণাকে সামনে নিয়ে এগোতে থাকে। এই কনসেপ্টের অন্যতম আউটপুট ছিলো সেই বিখ্যাত ' ক্লাস অফ ৯২ ' ব্যাচ, যেখান থেকে বের হয় রায়ান গিগস,পল স্কোলস, নিকি বাট ও নেভিল ব্রাদার্সদের একঝাঁক তরুণ তুর্কি যারা পরবর্তীতে মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছে।_methode_times_prodmigration_web_bin_ea1fbe8c-4c74-3e57-b0f9-e7d297f3bc1f

১৯৯২-৯৩ মৌসুমে লিডস ইউনাইটেডের ফ্রেঞ্চ ফরওয়ার্ড এরিক ক্যান্টোনা কে দলে ভেড়ায় ম্যান ইউনাইটেড। সেবার ২৬ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ইউনাইটেড দেখা পায় সেই কাঙ্ক্ষিত লিগ শিরোপার!NINTCHDBPICT000663330654 এরপর ফার্গুসনের হাত ধরে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে ৪ বার শিরোপা জয়ের কীর্তি গড়ে রেড ডেভিলরা!

১৯৯৮-৯৯ মৌসুমটি ছিলো ফার্গুসনের কোচিং ক্যারিয়ার এবং যেকোনো ফুটবল ক্লাবের জন্যে এক স্বর্ণালী মুহুর্ত। সেই মৌসুমে প্রথম এবং একমাত্র ইংলিশ দল হিসেবে ট্রেবল জয়ের ( লিগ, এফ এ কাপ, চ্যাম্পিয়নস লিগ) কৃতিত্ব দেখায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।The victorious United squad of 1999

সেবছর তাঁর এই সাফল্যের জন্যে ব্রিটেনের রাণী এলিজাবেথ তাঁকে নাইটহুড উপাধিতে ভূষিত করে। তাঁর নামের সাথে যুক্ত হয় "স্যার" উপাধি। তখন থেকেই তাঁকে ডাকা হয় "স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন" নামে।

সেই ট্রেবল জয়ের মৌসুম থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত টানা লিগ জয়ের মাধ্যমে হ্যাটট্রিক শিরোপা জয়ের এক অনন্য রেকর্ড গড়ে ইউনাইটেড! কিন্তু পরবর্তীতে দলের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ন প্লেয়ার চলে যাওয়ায় সেই ধারাবাহিক জয়ের পালে বড় আঘাত লাগে। ফলে গোটা ইউনাইটেডকে আবার রিবিল্ড করার প্রসেস হাতে নেন স্যার অ্যালেক্স। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, ভ্যান নিস্টল রয়, রিও ফার্ডিনান্ড, ওয়েইন রুনি, নেমানিয়া ভিদিচ, এডউইন ফন ডার সার, মাইকেল ক্যারিক, প্যাট্রিস এভ্রাদের মতো প্রতিভাবানদের অন্তর্ভুক্ত করে পুনরায় দলকে ঢেলে সাজান।417309_10150547280662746_751789371_n অবশেষে ২০০৬-০৭ মৌসুমে লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে পুনরায় রাজার বেশে ফিরে রেড ডেভিলরা। ফার্গুসন জেতেন তার নবম লিগ শিরোপা।

২০০৭-০৮ মৌসুমে লিগ জয়ের পাশাপাশি দ্বিতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জয়ের স্বাদ পায় রেড ডেভিলসরা। 0_2019-Champions-League-Final-Preview-Package২০০৮-০৯ সালে লিগ জয়ের মাধ্যমে একমাত্র ম্যানেজার হিসেবে দুইবার টানা হ্যাটট্রিক শিরোপা জয়ের গৌরব অর্জন করেন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন, যে কৃতিত্ব করে দেখাতে পারেনি কোনো ম্যানেজার!  সেবার লিগ জয়ের মাধ্যমে লিভারপুলের তৎকালীন ১৮ টি লিগ শিরোপার রেকর্ডে ভাগ বসায় ইউনাইটেড। ঐ সিজন শেষে তিনি আরো একবার লীগ জেতার আশা ব্যক্ত করেন কারণ এর মাধ্যমেই লিভারপুলকে পেছনে ফেলে ইউনাইটেড হবে প্রিমিয়ার লিগের রেকর্ড সংখ্যক লিগ শিরোপার মালিক! এক মৌসুম বাদেই তাঁর সেই বহুল প্রতীক্ষিত ইচ্ছা পূরণ হয়।20211231_035356

২০০৯-১০ মৌসুমে স্যার ম্যাট বাসবি কে পেছনে ফেলে ইউনাইটেডের সবচেয়ে দীর্ঘদিন সার্ভিস দেওয়া ম্যানেজার হন ফার্গি। ২০১২ সালের ২রা সেপ্টেম্বর সাউদাম্পটনের বিপক্ষে নিজের ১০০০ তম লিগ ম্যাচে কোচিং করানোর মাইলফলক স্পর্শ করেন তিনি।
২০১৩ সালের ৮ মে ফার্গুসন কোচিং ক্যারিয়ার থেকে অবসরে যাবার ঘোষণা দেন। বিদায় বেলাতেও চিরচেনা সেই রঙিন রূপে ছিলেন তিনি। দলকে রেকর্ড ২০ তম এবং নিজের ১৩ তম লিগ শিরোপা জয় করে ইউনাইটেড এবং ফুটবলকে বিদায় জানান এই জীবন্ত কিংবদন্তি।Official Manchester United Website

ফুটবলের অনেক গুরুত্ত্বপূর্ন বিষয়ের সাথে মিশে আছে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের নাম। যাদের মধ্যে সুপার সাব, ফার্গি টাইম, হেয়ার ড্রায়ার ট্রিটমেন্ট অন্যতম। তার সবচেয়ে বড় গুণ ছিলো দূরদর্শিতা। যার ফলে সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন তিনি। নামি দামি প্লেয়ারদের পেছনে না ছুটে অখ্যাত প্রতিভাবানদের গড়ে তুলতেন হীরার মতো করে। এ যেন এক খাঁটি জহুরীর চোখ।
জীবনের ২৬ টি বসন্ত পার করেছেন ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে। প্রায় ১৪০০ বারের মতো দাঁড়িয়েছেন ইউনাইটেডের ডাগআউটে, মিস করেছেন ৩ ম্যাচ। চুইংগাম চাবানোকে পরিণত করেছিলেন এক অসামান্য ট্রেডমার্কে। প্রায় আড়াই দশকের এই ক্যারিয়ারে ইউনাইটেডকে পরিণত করেছেন একটি গ্লোবাল ব্র্যান্ডে। রেড ডেভিলদের হয়ে জিতেছেন মোট ৩৮ টি শিরোপা। ২৬ বছরের এই স্পেলে লিগে ১৩ বার হয়েছেন চ্যাম্পিয়ন, পাঁচবার রানার্সআপ, তিনবার তৃতীয়।ইংলিশ ফুটবলে তিনিই একমাত্র ম্যানেজার, যার দল টানা ২০ মৌসুম শীর্ষ তিনে থেকে লিগ শেষ করেছে। কোচ হিসেবে যে কয়বার প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জিতেছেন, ইতিহাসে অন্য কোন কোচ তার অর্ধেকও জিততে পারেনি। গোটা কোচিং ক্যারিয়ারে তিনি জিতেছেন সর্বমোট ৪৯ টি ট্রফি। তাঁর নামে ওল্ড ট্রাফোর্ডে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন স্ট্যান্ড নামে একটি স্ট্যান্ডের নামকরণ করা হয়েছে । তিনিই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের একমাত্র ম্যানেজার, যার জীবদ্দশাতেই নিজের নামে ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে।gettyimages-156863074-2048x2048

প্রায় ৪ দশকের এই কোচিং ক্যারিয়ার অথবা ইউনাইটেডে ২৬ বছর তিনি স্রোতের ধারায় তাল মিলিয়ে এভাবেই পার করে দেননি। ফুটবল জগতে নিজেকে অধিষ্ঠিত করেছেন শ্রেষ্ঠদের কাতারে। দীর্ঘ এই পথচলায় মানুষকে দেখিয়েছেন অসংখ্য স্বপ্ন, অসম্ভবকে করেছেন সম্ভব, করেছেন অগণিত রেকর্ড ও ইতিহাস যা বর্তমান ফুটবলের প্রেক্ষাপটে অর্জন/ভাঙ্গা একপ্রকার দুঃসাধ্য ব্যাপার। সবশেষে তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক এবং মানুষ যার নাম এবার্ডিন, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তথা পুরো ফুটবল ইতিহাসের পাতায় সোনালী হরফে লেখা থাকবে, যে নাম কখনো মলিন হবেনা!Fergie-trophy