• ফুটবল

সুয়ারেজঃ পা যার আগ্নেয়াস্ত্র

পোস্টটি ২০১৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

২৮ অক্টোবর, ২০১৮। সেসময় “এল ক্লাসিকো” মানেই ছিল উত্তাপ ছড়ানো, শ্বাসরুদ্ধকর এক মহারণ। লা-লিগার ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ দুই ক্লাব মুখোমুখি হচ্ছে-এ কথা জানামাত্রই উত্তেজনায় ফুটবলপ্রেমীদের রাতের ঘুম নিমিষেই উধাও হয়ে যেত, কাজকর্ম সব ফেলে তারা বসে পড়ত টিভির পর্দার সামনে। ঐতিহ্যবাহী এই ম্যাচকে আরো উদ্দীপনা, আরো রোমাঞ্চ এবং আরো উপভোগ্যতায় পরিপূর্ণ করে তুলেছিল ফুটবল ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ দুই খেলোয়াড় লিওনেল মেসি এবং ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর যুগ-যুগান্তর ধরে চলে আসা দ্বৈরথ।

কিন্তু ক্যাম্প ন্যুতে অনুষ্ঠিত হওয়া যে ম্যাচের কথা বলছি, অন্যান্য এল-ক্লাসিকোগুলোর তুলনায় হয়তো সেটা মনে হবে একটু ম্যাড়মেড়ে, একটু একঘেয়ে। কারণ? ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো যে এখন আর রিয়াল মাদ্রিদে নেই, মৌসুমের শুরুতেই চলে গিয়েছেন নতুন ঠিকানা জুভেন্টাসে। ওদিকে বার্সেলোনার প্রাণভোমরা লিওনেল মেসিও সেভিয়ার বিপক্ষে ডান হাতে চোট পেয়ে ছিটকে গিয়েছেন প্রায় তিন সপ্তাহের জন্য। মনে বুঝি একটু হতাশাই ছিল দর্শকদের। এল-ক্লাসিকোর মূল আকর্ষণ যে  দু’জন কিংবদন্তি, তাঁরাই অনুপস্থিত। এগারো বছর ধরে যে এমনটা হয়নি! কেমন হবে এই ম্যাচ?

ঐ রে দিক্-চক্রে কার

বক্রপথ, ঘুর্-চাকার!

ছুটছে রথ, চক্র ঘায়!

দিগ্বিদিক, মূর্ছা যায়!

কোটি রবি শশী ঘুর্-পাকায়

প্রবর্তকের ঘুর্-চাকায়

প্রবর্তকের ঘুর্-চাকায়!

 যতটা একঘেয়ে হবে বলে দর্শকরা ভেবেছিলেন, ততটা নিষ্প্রাণ, ততটা ঘুমপাড়ানি কি ম্যাচটা ছিল? সেদিন কার দুই পা আগ্নেয়াস্ত্র হয়ে দর্শকদের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল আর সেই স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছিল ক্যাম্প ন্যুর সবুজ ঘাসে? বার্সেলোনার হয়ে কোন খেলোয়াড় ৩০ মিনিটের মাথাতেই পেনাল্টিতে গোল ব্যবধান ১-০ থেকে ২-০ করে তোলেন? ৭৫ আর ৮৩তম মিনিটে যার নৈপুণ্যে সেই ব্যবধান হয়ে ওঠে যথাক্রমে ৩-১ এবং ৪-১, কে তিনি? কার দুর্দান্ত এক হ্যাটট্রিকে বার্সেলোনা চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে ৫-১ গোলের জয় তুলে নেয় ঘরের মাঠে, আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষস্থান?

Barcelona vs Real Madrid [5-1], El Clasico 2018 - SUAREZ HAT-TRICK - MATCH  REVIEW - YouTube

ইনিই ‘এল পিস্তলেরো’, আসল নাম যাঁর লুইস সুয়ারেজ। ১৯৮৭ সালের ২৪ জানুয়ারি, উরুগুয়ের সালতো অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করা এই ফুটবলারের ক্যারিয়ার অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়, চড়াই-উতরাই, আলোচনা-সমালোচনায় পরিপূর্ণ। ১২ বছর বয়সে পেটের দায়ে মন্টেভিডিওর রাস্তা ঝাড়ু দিতে দিতে কিশোর সুয়ারেজ কি ভেবেছিলেন যে একদিন তিনি ফুটবল-আকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রে রূপ নেবেন? ২০০৭ সালের আগস্টে নেদারল্যান্ডের ক্লাব আয়াক্সের সাথে পাঁচ বছরের চুক্তি করার সময় কি তার মাথায় এসেছিল যে পরের দশকেই ফুটবল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ দুই খেলোয়াড়ের একচেটিয়া রাজত্ব ভেঙে দিয়ে জয় করে নেবেন ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুট? কিংবা ২০১১ সালেই যখন তিনি লিভারপুলে পাড়ি জমান, চ্যাম্পিয়নস লীগ জয়ের স্বপ্নে কি তন্ময় হয়েছিল তার দু’চোখ?

অর্জনের কথা যে তার বলে শেষ করার নয়! পাঁচটি লা-লিগা, চারটি কোপা ডেল রে, দুটি স্প্যানিশ সুপার কাপ, একটি উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ, একটি উয়েফা সুপার কাপ এবং একটি ক্লাব বিশ্বকাপসহ তাঁর ঝুড়িতে আছে মোট ১৯টি ট্রফি। জাতীয় দল উরুগুয়ের হয়েও বর্ণিল তিনি, হয়েছেন উরুগুয়ের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা, ২০১১ সালে দলকে জিতিয়েছেন কোপা আমেরিকার ট্রফি। ২০১৪ থেকে ২০২০ পর্যন্ত বার্সেলোনায় খেলেছেন ছয়টি মৌসুম ও ২৮৩টি ম্যাচ, এরই মধ্যে ১৯৮টি গোল করে বনে গিয়েছেন ক্লাবটির ইতিহাসের তৃতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা, প্রথম মৌসুমেই ক্লাবের হয়ে জিতে নিয়েছেন ট্রেবল। হালের অন্যতম সেরা দুই ফুটবলার লিওনেল মেসি ও নেইমারের সাথে গড়ে তোলা বার্সেলোনার বিখ্যাত “এমএসএন” ত্রয়ীর কারুকার্যময় অথচ দুর্দান্ত, শৈল্পিক অথচ চাতুর্যপূর্ণ ফুটবলশৈলী তো আজীবন ফুটবলানুরাগীদের দু’চোখে লেগে থাকবে!

Suárez: 'I'm proud to have been part of the history of the club'

Messi, Neymar Jr and Suárez, candidates for UEFA Best Player in Europe Award

নন্দিত সুয়ারেজ, নিন্দিত সুয়ারেজ। মুদ্রার ওপিঠটা দেখলেই জানা যাবে তাঁর দ্বারা ঘটানো ফুটবল ময়দানের যত বিতর্কিত কীর্তি। ২০১৪ সালের ফিফা বিশ্বকাপে ইতালির বিপক্ষে খেলার সময় জর্জ কিয়েলিনির কাঁধে কামড় দিয়ে চার মাসের জন্য নিষিদ্ধ হবার ঘটনাটা তো অভুলন! অবশ্য এ কাণ্ড নতুন নয়, এর আগেও আয়াক্সে আর লিভারপুলের হয়ে খেলার সময় এ ঘটনা ঘটিয়েছিলেন তিনি। ২০১০ সালে বাক্কালকে কামড়ে দেবার পর তো তাঁর নামই হয়ে যায় “আয়াক্সের নরখাদক”! শুধু কি দংশনেই ক্ষান্ত তিনি? ২০১০ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ঘানার বিপক্ষে গোলকিপারের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে হ্যান্ডবল করেও কম বিতর্কের জন্ম দেন নি তিনি। প্যাট্রিস এভরাকে বর্ণবিদ্বেষমূলক কটাক্ষ করা, বেশ কয়েকবার ইচ্ছা করে পড়ে গিয়ে ডাইভারের তকমা পাওয়া-সবই তার খেলোয়াড়জীবনের অভিন্ন অংশ।

Remembering when Liverpool forward Luis Suarez caused outrage by biting  Branislav Ivanovic | The Independent | The Independent

World Cup stunning moments: Luis Suárez bites Giorgio Chiellini in 2014 |  Soccer | The Guardian

ক্যারিয়ারে যত সাফল্য, তত বিতর্ক। সুয়ারেজের জীবন যেন “দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি” চলচ্চিত্রেরই আরেক রূপ। তা পৃথিবীতে কবে, কোথায়, কোন গোলাপের গাছ কাঁটা ছাড়া জন্মেছে? সূর্য যেমন আলো ছড়ায়, তেমন প্রকৃতিকে তপ্তও তো করে তোলে! সুয়ারেজই বা ব্যতিক্রম কিসে?

বহুল আলোচিত-সমালোচিত এই ফুটবলারের জন্মদিন আজ। আশা করা যায়, গোটা বিশ্ব প্রতিপক্ষকে করা তার দাঁতের আঘাতের চেয়ে আগ্নেয়াস্ত্ররূপী ওই দুই পা দিয়ে ফুটবলকে করা আঘাত এবং গোলরূপী আঘাতের ঐ দাগগুলোকে বেশি স্মরণ করবে, যে দংশনে বারবার নীল হয়েছে প্রতিপক্ষ দলগুলো।

জন্মদিবসের শুভেচ্ছা, লুইস।