• ক্রিকেট

ক্রিকেট, নগর, সমাজ – ১খঃ আধুনিক স্পোর্টসের ঊষালগ্নঃ শেষ অংশ

পোস্টটি ৫১১ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

পর্ব ১-খ

(১ম অংশঃ পর্ব ১-ক পড়ুন এখানেঃ https://pavilion.com.bd/user/feeds/6670/details)

৪।

এই ‘সাদামাটা’ ঘটনাটিরই বেশকিছু তাৎপর্য আছে।

আপনার মনে কি প্রশ্ন এসেছে, আচ্ছা পুরস্কারটি দিচ্ছে কে? বা, এসকল ‘প্রতিযোগিতার’ আয়োজকই বা কে? কেনই বা এই আয়োজন?

কেনই বা নতুন করে লোকজন এক সাদামাটা হাটা নিয়ে এতো উৎসাহ দেখাচ্ছে? কারই বা লাভ হচ্ছে ষোলআনা?

এখানেই লুকিয়ে আছে আধুনিক স্পোর্টসের ইকোসিস্টেম।

প্রথম সূত্র হচ্ছে সময়টা উনিশ শতকের শুরু। এখনকার দুনিয়ার মতই আরেকটা বড়সড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল সমাজ।

শ দুয়েক বছর হল ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব শুরু হয়ে পুরো ইউরোপ, উত্তর আমেরিকাতে ছড়িয়ে গিয়েছে। আর কিছুদিন পরই (১৮৫০) শিল্পবিপ্লবের দ্বিতীয় ধাপে পা রাখবে পশ্চিমের বিশ্ব। ইংল্যান্ডের অবস্থা বেশ রমরমা, বিশ্বের সবচেয়ে বড় উপনিবেশ শক্তি হিসেবে দখল করে রেখেছে নানা অঞ্চল। সেখান থেকে টাকা, কাঁচামাল আসছে শিল্পবিপ্লবের ইংল্যান্ডে। ব্রিটিশ দ্বীপের গ্রামেগঞ্জেও ফ্যাক্টরি গড়ে উঠছে। একদিকে নতুন সব ভোগ্যপণ্য আসছে, দামে সহজলভ্য হচ্ছে; ফলে ভোগবিলাস আর নানাবিধ নতুন চাহিদা তৈরি হচ্ছে সমাজে, অন্যদিকে কাস্টোমার হিসেবে সমাজে মধ্যবিত্ত নামে নতুন এক শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে, যাদের হাতে কিছু টাকা পয়সা আর মনে নতুন শখ আছে। এদিকে ওয়ার্কিং ক্লাসে যোগ হয়েছে নতুন কারখানা শ্রমিক। কলকারখানা আর কৃষিকাজের এই শ্রমজীবীদের জীবনযাত্রার মান তেমন উন্নত না হলেও কিছু কাঁচা টাকা হাতে আসছে, আর সপ্তাহে একদিন ছুটি পাওয়া যায়। এসব মানুষের জন্য হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর বাস্তবতা থেকে পালাতে সহজলভ্য বিনোদন হয়ে দাঁড়ালো একটা বড় চাহিদা!

 

তখন আরও কিছু আয়োজনের সাথে সাথে ঘোড়ার রেস, প্রফেশনাল বক্সিং আর এই হাটার ম্যাচ, এই তিনের রমরমা শুরু হল এসব জনসাধারণের বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে। সেই বিয়ার-স্পিরিটের দোকান বা পাবগুলোতে গড়ে উঠলো এই নতুন ব্যবসা! তারা সেসব হাটার প্রতিযোগিতার পুরস্কারদাতা, আয়োজক, প্রচারক। একই সাথে এসব ম্যাচের জন্য এদের জুয়ার আয়োজন, জুয়ার আলাপের জন্য পাবের ভীড়, এবং ম্যাচের দিনগুলোতে ময়দানে পানীয়ের বেচা; ম্যাচগুলো তাদের বহুমুখী ব্যবসার মচ্ছব এনে দিলো।

Photo source: Culture24

 

দ্বিতীয়ত: দর্শকনির্ভর খেলার বিস্তার। সেই সময়ে পাবলিকের খেলাধুলা বা এধরনের শারীরিক কসরত দেখার ব্যাপারগুলোতে আগ্রহ বেড়েই যাচ্ছিলো। সম্ভবত কৃষিজীবন থেকে সদ্য নগরজীবনে পা দেয়া মানুষগুলো নিজের অংশগ্রহণটা মিস করছিলো বেশ। এছাড়া কাউকে আপাতঃ অসাধ্য কিছু করতে দেখায় বা দর্শক সাজাতে মানুষের আমোদ চিরকাল। এখনো যেমন ইউটিউবে কাউকে কিছু করতে দেখার ভিউ অনেক বেশি, আবার ফর্মুলা ওয়ান বা চরম প্রফেশনাল স্পোর্টসগুলোতে অসাধারণ স্কিলের প্রদর্শনীতে মানুষের আগ্রহ। তো সেই রাজা জর্জের আমলে ইংল্যান্ডে বেড়ে চলা খেলাধুলার জনপ্রিয়তা, সাথে ব্রিটনদের রক্তে জুয়ার নেশা আর সবকিছুর পরিবেশক হিসেবে হাতের কাছেই পাবের উপস্থিতি – এই তিনকে এই খেলাধুলার প্রফেশনাল রূপধারণের পেছনে তিন কারণ বলে ধারণা করা হয় । কিছুকাল পরে এটাকেই মডেল ধরে আধুনিক স্পোর্টসের উঠে আসাঃ পাবলিকের বিনোদনের চাহিদা, কাঁচা পয়সা, আর কৃত্রিম সেন্স অব প্রাইড এর মোড়কে প্রফেশনালদের পারফর্মার ও সাধারণের মানি-মেকিং দর্শক হিসেবে অংশগ্রহণ।

photo source: Study.com

হাটার ম্যাচ, বা এধরনের চ্যালেঞ্জ-টাইপের উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার আকর্ষন এর পরের দশকে কমে যায়। মূলতঃ ভিক্টোরিয়ার ইংল্যান্ডে নতুন করে সমাজের উচ্চমার্গের রীতিবোধ জেন্টলম্যানশিপ গড়ে উঠছিলো। বাজির দুর্নাম ও মেঠো হৈ-হট্টগোল, মাতলামী এসবের সংস্রব এড়াতে খেলার এধারা ছেড়ে, ইংল্যান্ডের ভার্সিটি পড়ুয়া ও স্বচ্ছল সমাজ ক্লাব ভিত্তিক ক্রীড়াচর্চার দিকে মনোযোগ দিলো। এসব ক্লাব শ্রমজীবিদের জন্য উন্মুক্ত ছিলো না – তবে প্রফেশনাল এথলেট হিসেবে ‘জেন্টলম্যান’দের সাথে খেলার সুযোগ পেত। বাকীরা টিকেট কেটে দর্শক হতেন। এভাবেই ফুটবল ও ক্রিকেটসহ নিয়মতান্ত্রিক ও দলবদ্ধ খেলা বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয় ও সাংগঠনিক রূপ পেতে লাগলো। পরের পর্বে আমরা ক্রিকেটেরই এমন এক গল্প শুনবো।

৫।

জর্জিয়ান ইংল্যান্ডের সেই দিনগুলোর সাথে আইপিএল শুরুর দিনগুলো মেলাতে পারছেন কিনা দেখুন। না পারলে এর শুরুর হোতা লোলিত মোদীর সাক্ষাৎকার পড়ে নিতে পারেন, যে কি মডেলটি চালিকাশক্তি ছিল এর পেছনে। হাতে কাঁচা টাকাওয়ালা উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অল্প সময়ের বিনোদন দরকার- শুধু আইপিএল না, অধিকাংশ আধুনিক ক্রীড়া আয়োজনকেই মেলাতে পারবেন। ক্রিকেট একেবারেই শুরুর দিককার আধুনিক সাংগঠনিক স্পোর্টসের অন্যতম বলে, ক্রিকেটের গল্পেও এই কানেকশন আসবে।

স্যরি, আমি হয়তো আপনার ক্রিকেটের প্রতি প্যাশনে পানি ঢালছি। সেটা মনে হলে প্লীজ এই লেখা এবং এই সিরিজের আগামী লেখাগুলো এড়িয়ে যাবার অনুরোধ রইলো। তবে ক্রিকেটকে অন্য লেন্সে দেখতে চাইলে, ক্রিকেটের জন্যই ক্রিকেটের অন্য কানেকশনগুলো দেখা দরকার। ক্যারিবিয়ার সেই বিখ্যাত ক্রিকেটামোদী পণ্ডিত সি এল আর জেমস কথাতেই যেমন

‘যে (খেলার) ক্রিকেটটাই শুধু জানে, সে ক্রিকেটের কতটাই বা বোঝে?’ (What do they know of cricket that only cricket know?)।

জেমসের মতোই আমার আগ্রহ ক্রিকেটকে সমাজ ও নগরের প্রেক্ষিতে দেখা। ক্রিকেট ছাড়া আমার আরেক আগ্রহ নগর ও নগরজীবন। সামনের পর্বগুলোতে তাই ক্রিকেট মাঠ আর এর পেছনে নগর ও নগরজীবনের মজার কিছু গল্প বলার চেষ্টা। আপনি আগ্রহী হলে আমন্ত্রণ রইলো – #CricketCitySociety এই সিরিজে সামনের পর্বগুলোর জন্য। আজকে প্রথম পর্ব / ভূমিকা এখানেই।

#SamiHasan #CricketCitySociety #ক্রিকেটনগরওসমাজ

———————-

[লিন্ডা রড্রিগাজ ম্যাকরবি (LINDA RODRIGUEZ MCROBBIE)-র এটলাস অবসকিউরা ব্লগের আর্টিকেল থেকে ভাবানূদিত। মূল লেখাটিঃ How Competitive Walking Captivated Georgian Britain (JUNE 29, 2017)-র লিংক এখানে। ছবির উৎস/ Picture Credit: Cover photo: BBC, Photo-1,2: Welcome Images, Photo-3: Culture24, Photo-4: Study.com ]