• ক্রিকেট

ক্রিকেট, নগর ও সমাজ-২কঃ একটি স্কুল-উপন্যাস ও ক্রিকেটের আদিসুর (১ম অংশ)

পোস্টটি ৮৮৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

১।

হ্যারি পটার পছন্দ করেন? বা নিদেনপক্ষে দিপু নাম্বার টু?

সাথের ছবিতে বইয়ের তিনটি প্রচ্ছদ দেয়া আছে। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, একই বইয়ের - ‘টম ব্রাউন’স স্কুলডেজ’। তিনটি কভারে লুকিয়ে আছে খেলা আর সমাজের কিছু মজার গল্প, সাথে হ্যারি পটারের সংযোগ।

টম ব্রাউন’স স্কুলডেজ - বিরল মাত্রার বই পোকা না হয়ে থাকলে এ বইটির নাম না শোনা খুবই স্বাভাবিক। ১৮৫৭ সালে প্রকাশিত বইয়ের নাম না জানারই কথা। এরপরেও বইটির সাথে আপনাকে যোগ করিয়ে দেয়া যায়, যদি বলা হয় ‘দিপু নাম্বার টু’, বা হালজামানার হ্যারি পটার সিরিজ এসব স্কুল স্টোরি জনরার জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে মডেল ছিল এ বইটি। জে কে রাওলিং তো হগওয়ার্ট স্কুলকে বানিয়েছেনই এ গল্পের বোর্ডিং স্কুলটির আদলে। আজ চেনা না গেলেও, রাওলিংয়ের হ্যারি পটারের মতই টম ব্রাউনও একসময় ছিল খুব জনপ্রিয় এক চরিত্র। বইয়ের তাকে, স্কুলের পাঠ্যে ছিল তার সগৌরব উপস্থিতি। একে নিয়ে মুভি হয়েছে, টিভি সিরিজও হয়েছিল এক সময়। বলা চলে এই বইয়ের মাহাত্ম্য এতোই ছিল যে ব্রিটেন ছাড়িয়ে সুদূর মেইজি-আমলের জাপানের পাঠ্যসূচীতে জায়গা করে নিয়েছিলো এই স্কুল নভেল। কি ছিল সে বইতে?

বইটির গল্প আদর্শ স্কুল-নভেলের ফ্রেমেই এগিয়েছে; ব্রিটিশ জামানায় সুবিখ্যাত হওয়া বোর্ডিং স্কুল আর ‘আদর্শ ব্যক্তি গড়া হোলিস্টিক এডুকেশন’ এর প্রেক্ষাপটে। গল্পের নায়ক টম ব্রাউন একটু ছন্নছাড়া কিশোর, যে ঘটনাক্রমে এ গল্পের বোর্ডিং স্কুলটিতে ভর্তি হয়। ভর্তির পর থেকেই তাকে ‘বদমাশ’ কিছু কিশোরের উৎপাতের শিকার হতে হচ্ছিল। এপর্যায়ে টমের পরিচয় হয় সুহৃদ কিছু সঙ্গীর, যারা তার সাথে মিলে দুষ্ট কিশোরদের প্রতিরোধ করতে এগোয়। সে প্রতিরোধ হয়ে ওঠে সংঘাতময়। ক্লাসরুম, করিডোর ছাড়িয়ে খেলার মাঠ, সুউচু ক্লক টাওয়ারে কখনো সখনো মারামারি পর্যন্ত গড়ায়। গল্পে অন্যতম আরেক চরিত্র হিসেবে আমরা দেখতে পাই টমাস আর্নল্ড নামে সে স্কুলের হেডস্যারকে, যার ব্যতিক্রমী কিন্তু প্রজ্ঞাময় কাজকর্ম আর গল্পের নায়কের প্রতি সস্নেহ নজরের মধ্যে গল্পের মূল শিক্ষাগুলো একে একে প্রকাশ পায়। এ পর্যন্ত পড়ে আপনারা হ্যারি পটারের হ্যারি, রন, হারমিওনি, ড্রাকো আর ডাম্বল্ডরকে দেখতে পেলেও পেতে পারেন। যেমনটি বলেছিলাম, হ্যারি পটারের আসল মডেল এ স্কুল নভেলটি।

সেটা বোঝা গেল, কিন্তু এর সাথে খেলাধুলার সম্পর্ক কোথায়? চলুন ঘুরে আসা যাক এর প্রচ্ছদগুলোতে।

২।

প্রথম প্রচ্ছদটির দিকে নজর দেয়া যাকঃ কিছু পরিপাটি স্কুলবয় রাগবি খেলছে। সেটাকে সার্থক করতেই যেন গল্পটির স্কুলের নামও রাগবি স্কুল। জ্বী, স্কুলের নাম রাগবি স্কুল। আমার মত আপনারও প্রশ্ন জাগতে পারে, নামকরণের সম্পর্কটা কি? স্কুলটা রাগবি শেখানোর জন্য নাকি? পড়ে জানা গেল মজার ব্যাপারঃ রাগবি খেলার নামে এই স্কুলের নামকরণ হয়নি, বরং এই স্কুল থেকেই এই খেলাটার নামকরণ।

এ পর্যন্ত ধাঁধার মতো লাগতেও পারে, একটা গল্পের স্কুলের নামে বাস্তবের বেশ বড়সড় একটা খেলার নামকরণ কিভাবে হয়! গোলকধাঁধাটা মিলে যাবে যদি জানেন রাগবি স্কুলটা বাস্তবিকেই আছে, এবং বেশ ভাল ভাবেই আছে। ইংল্যান্ডের অন্যতম পুরনো একটি গ্রামার স্কুল (পাবলিক স্কুলও বলতে পারেন) হিসেবে এটির শুরু, এবং এখন অবশ্য প্রাইভেট স্কুল, সদর্পে টিকে আছে ইংল্যান্ডের নয়টি ঐতিহ্যবাহী স্কুলগুলোর একটি হিসেবে। গল্পের লেখক টমাস হিউজ নিজে আর তার বড় ভাই এই স্কুলে পড়েছেন; ধারণা করা হয় টম ব্রাউন চরিত্রটি তার বড় ভাইয়ের ছায়া অবলম্বনেই করা। ইংল্যান্ডের রাগবি অঞ্চলের টিনএজারদের জন্য ফ্রি স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বলে এ স্কুলের নাম রাগবি স্কুল। এবং কথিত আছে এই স্কুলের ছেলেপিলেরা একদিন ফুটবল খেলার ফাঁকে বল হাতে দৌড়ানোর এই নতুন খেলার আইডিয়া পান, মজা পেয়ে নিজেদের জন্যই কিছু নিয়মকানুন করে ফেলেন। সেটাই রাগবির জন্ম। কিছুদিন পর এই স্কুলের রাস্তার পাশেরই এক মুচী নাকি চ্যাপ্টা বিশেষ বল তৈরি করে দেন এই ‘হাতের ফুটবলের’র জন্য। সেই খেলা থেকে দুধরনের রাগবির প্রচলন, সে আরেক বিস্তারিত গল্প।

রাগবির পাশাপাশি ফুটবল ইতিহাসেও এ স্কুলের অবদান আছে। রাগবি স্কুলের ছাত্রেরা নিজেদের সুবিধার্থে ফুটবলের লিখিত একটা নিয়মকানুন তৈরি করেছিল, সেটাই নাকি রেকর্ডে পাওয়া প্রথম প্রথাবদ্ধ ফুটবল রুলস।

টম ব্রাউন’স স্কুলডেজ এর গল্পের প্রেক্ষাপট অবশ্য আরো পরেরঃ ১৮৩০-৪০-এর দিকের (লেখকের নিজের স্কুলকাল এ বছরগুলোতেই)। এ সিরিজের প্রথম পর্বে (লিংক নীচে) আমরা জেনেছিলাম ঠিক এই মুহুর্তটিতে জর্জিয়ান যুগ থেকে ভিক্টোরিয়ান যুগে বদলে যাচ্ছে ইংল্যান্ড ও তার উপনিবেশ। সে পরিবর্তনগুলোর উল্লেখযোগ্য একটি ছিল দর্শকনির্ভর (স্পেকটেকুলার স্পোর্টস) খেলাধুলা(ঘোড়দৌড়, বক্সিং আর ক্রিকেট)-টার চেহারার পরিবর্তনঃ জর্জিয়ান যুগের ওয়ার্কিং ক্লাসের ‘সস্তা বিনোদন’ আর জুয়া, মারামারির হই হট্টগোলের চেহারা থেকে শিক্ষিত উচ্চ ও মধ্যবিত্তের ‘সুনীতি’ চর্চার হাতিয়ারে বদলে যাওয়া। বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ মধ্যবিত্তের ক্লাবের পাশাপাশি রাগবি স্কুলের মত সুবিখ্যাত পাবলিক স্কুলগুলোরও বেশ ভূমিকা ছিল এই রূপ বদলে। এতোদিন খেলাধুলা বা এমনকি শারীরিক কসরতকে বাঁকা চোখে দেখার পর স্কুলের প্রিন্সিপালেরা চরিত্রগঠন ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ক্রিকেট, ফুটবলের মত টিমগেম আর শরীর চর্চাকে গ্রহণ করছেন। স্কুলে এসবের বেশ চর্চা শুরু হয়েছে। যথারীতি টম ব্রাউনের গল্পেও ক্রিকেট ঠাই পেয়েছে শেষভাগের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে।

আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতা বলিঃ আমরা হাইস্কুল জীবনের শুরুর দিকে একজন প্রজ্ঞাবান হেডমাস্টার পেয়েছিলামঃ হাবিবুর রহমান স্যারকে দেখতাম ক্লাস শুরুর আগে, কিংবা টিফিন ব্রেকের সময়টাতে তার রুম থেকে ফুটবল ছুড়ে দিতেন ছাত্রদের উদ্দেশ্যে “যা এইডা ফাডায়ে নিয়া আয়!” ফুটবল বা শারীরিক কসরতে ব্যস্ত থাকার এই প্রচ্ছন্ন আহবানের মূল্য বুঝেছিলাম স্কুলে পরের বছরগুলোতে। স্যার চলে যাওয়ার পর স্কুলের উঠান, বাগান নস্ট হবে এই অজুহাতে যখন খেলা বন্ধ করা হল, তখন বেকার ছেলেপুলেগুলো সামনের রাস্তায়, মার্কেটে আড্ডা দেয়া শুরু করলো, অলস মস্তিষ্কে এলো নানান শয়তানি আইডিয়া। অনেকটা এরকমই শরীর আর মনের সংযোগ আর শরীরচর্চার গুরুত্ব দেখা শুরু হয়েছিল ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডে। সেখানে সব হেডমাস্টার মন থেকে ক্রিকেটকে মেনে না নিলেও ক্রিকেটের উঠতি জনপ্রিয়তা আর শরীরচর্চার প্রতি সমাজ ও চার্চের নতুন ম্যান্ডেটে ক্রিকেটকে স্কুলের কার্যক্রমের অংশ করে নিয়েছিলেন। শুনলে অবাক হবেন, প্রফেশনাল ক্রিকেটে কোচের আগমন অনেক পরে হলেও, সেইযুগে ইংল্যান্ডের স্কুলগুলোতে বেতনভূক্ত ক্রিকেট ট্রেনার রাখা হচ্ছিল। এটাই বলবে কি পরিমাণ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল ক্রিকেটের প্রতি। তবে এই গুরুত্ব যে শুধু শরীর মনের সুস্থতায় সীমাবদ্ধ ছিল না, একটু পরেই আমরা দেখবো।

টম ব্রাউনের গল্পের ডাম্বলডর টমাস আর্নল্ডও এই ম্যান্ডেট আর চিন্তাধারার একজন অগ্রপথিক ছিলেন, এর ভিত্তিতেই উনি রাগবি স্কুলে নতুন ধারা চালু করেন। বলে রাখা ভাল, গল্পের টমাস আর্নল্ড আসলেই ১৮২৮ থেকে বাস্তবের রাগবি স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। লেখক নিজের সময়ে দেখা হেডস্যারকে গল্পে অন্যতম নায়ক করেছেন, এর অন্যতম কারণ হচ্ছে টমাস আর্নল্ডের বেশ বড়সড় সংস্কার ঘটিয়েছিলেন রাগবি স্কুলের সিলেবাস আর নিয়মকানুনে। লেখক হিউজ তার হেডমাস্টারের বয়ে আনা চিন্তাধারা, দর্শনে বেশ প্রভাবিত হয়েছিলেন। টম ব্রাউন’স স্কুলডেজ ছিলো তারই চিত্রায়িত রূপ যেন। আর এই এজেন্ডাতে সে বইটির লেখার স্টাইল ভিক্টোরিয়ান ‘সুশিক্ষা’র নানান উপদেশনামাতে বেশ ভারী হয়ে উঠেছে; তাই স্রেফ সাহিত্যরস উপভোগের উদ্দেশ্যে পড়তে গেলে হোঁচট খেতেও পারেন। হিউজ এর পরের পর্ব হিসেবে ‘টম ব্রাউন এট অক্সফোর্ড’ লিখেছেন কিছুকাল পরে, সে বইটা আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠেছিল সেই ‘নতুন’ দর্শনের শ্বেতপত্র।

(পরের পর্বে সমাপ্যঃ পর্ব ২-খঃ https://pavilion.com.bd/user/feeds/6673/details)

পর্ব ১ঃ https://pavilion.com.bd/user/feeds/6670/details

 

#SamiHasan #CricketCitySociety #ক্রিকেটনগরওসমাজ