• ফুটবল

মারাকানাজো ও একজন বারবোসা

পোস্টটি ৯৩০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

 

১৯৫০। ফাইনাল। মারাকানা। ব্রাজিল।

চারটা পৃথক শব্দকে জোড়া লাগালে একটা শব্দই দাঁড়ায়, ‘মারাকানাজো’। বাংলায় বলা যেতে পারে, ‘মারাকানার দুঃখ’। যেমন তেমন দুঃখ নয়, প্রায় দুই লক্ষ মানুষের মাঝে এক পলকে শ্মশানের নিস্তব্ধতা নেমে আসার দুঃখ, সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের হৃদয় ভাঙার দুঃখ। যে দুঃখের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে গেছেন মোয়াসির বারবোসা নামের এক হতভাগ্য যুবক।

They shied away from him as if he were a leper. And on the streets they pointed and insulted. The Brazilian goalkeeper who was cursed by the whole country. river-plate, botafogo, flamengo, vasco-da-gama, team-brasil, team-uruguay

১৬ জুলাই, ১৯৫০।

বিশ্বকাপের ফাইনাল দেখতে সেদিন মারাকানা স্টেডিয়ামে উপস্থিত হয়েছিলেন দুই লক্ষ মানুষ। ভুল বললাম, বিশ্বকাপের ‘ফাইনাল’ ছিল না ওটা। ফাইনালে তো বিজয়ী নির্ধারিত হয় জয়-পরাজয়ে, কিন্তু টুর্নামেন্টের নিয়মানুসারে ঐ ম্যাচের ফলাফল ড্র হলেও বিজয়ী ঘোষিত হওয়ার কথা ছিল পুরো টুর্নামেন্টে অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখানো স্বাগতিক ব্রাজিলের। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ‘ফাইনাল’-এ ওঠা উরুগুয়েকে উড়িয়ে দিয়ে শিরোপা নিয়ে উল্লাস করবে সেলেসাওরা, এই প্রত্যাশায়ই সেদিন দলে দলে মাঠে এসেছিলেন ব্রাজিলীয়রা। ব্রাজিলের গণমাধ্যমও প্রস্তুত ছিল উদযাপন করার জন্য, ম্যাচের আগেই ব্রাজিলকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়েছিল স্থানীয় সংবাদপত্রে। বাইশটা স্বর্ণপদকে খোদাই করা হয়েছিল বাইশ ব্রাজিলীয়ের নাম, ম্যাচের আগে দেওয়া বক্তব্যেও রিও ডি জেনেরোর মেয়র ব্রাজিল দলকে সম্বোধন করেছিলেন ‘চ্যাম্পিয়ন’ বলে। প্রতিপক্ষ উরুগুয়ে তখন সব দেখেশুনে ভেতরে ভেতরে শুধুই ফুঁসছে।

 

ম্যাচের শুরুটাও হলো অনুমিতভাবে। প্রথমার্ধে ব্রাজিলের আক্রমণের তোড়ে ভেসে গেল উরুগুয়ে, তবে আশ্চর্যের বিষয়, সতেরোটা শট নিয়েও কোন গোল হলো না। কিন্তু সেই গোলখরাও কেটে গেল দ্বিতীয়ার্ধের দ্বিতীয় মিনিটেই। ফ্রিয়াকার গোলে এগিয়ে গেল ব্রাজিল। মারাকানা তখন যেন গনগনে আগ্নেয়গিরি, তুমুল শব্দ আর উদযাপনে কান পাতা দায়। এরপরই যেন ঘুম ভাঙে উরুগুয়ের, পাল্টা আক্রমণ শুরু করে তারা। ৬৬ মিনিটে মাঠের ডান প্রান্ত ধরে বল নিয়ে ছুটলেন আলসিদেস ঘিগিয়া, এক ছুটে ব্রাজিলের বক্সের প্রান্তে গিয়ে ক্রস করেন। সেই ক্রস খুঁজে নেয় জুয়ান আলবার্তো শিফিয়ানোর মাথা, অতঃপর গোল। ব্রাজিল তখনও নির্ভার, ড্র হলেও তো চলবে তাদের। অপরদিকে উরুগুয়ের চাই জয়, আক্রমণের জোয়ার তাই কমলো না। ৭৯ মিনিটে আবারও ডান প্রান্তে বল পেলেন ঘিগিয়া, আবারও ছুটলেন বক্সের দিকে। ব্রাজিলের গোলরক্ষক মোয়াসির বারবোসা তখন সতর্ক, আগের গোল থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার তিনি প্রস্তুত হলেন ক্রসের জন্য, একটু ডানে চেপে গেলেন। বারবোসার এই নড়াচড়া ঘিগিয়ার চোখ এড়ালো না। মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত বদলালেন তিনি। ক্রস না করে নিজেই নিলেন জোরালো শট। হকচকিত বারবোসাকের সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে বল জড়ালো জালে। বাকিটা ঘিগিয়ার মুখ থেকেই শুনে  আসা যাক, “এক লহমায় মারাকানাকে একদম চুপ করিয়ে দিতে পারে এই পৃথিবীর মাত্র তিনজন, ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা, পোপ জন পল, আর আমি”।

 World Cup stunning moments: Uruguay's 1950 triumph in Brazil | World Cup |  The Guardian

ম্যাচের বাকি অংশে আর কোন গোল হয়নি। আর তাতে নিশ্চিত হয়ে গেল, বিশ্বকাপটা অধরাই থাকছে ব্রাজিলের। পুরো ব্যাপারটাই আঘাত হয়ে এলো ব্রাজিলের জনগণের কাছে, সেই আঘাত এতটাই গুরুতর, এরপরে তা রূপ নিলো তীব্র গণক্ষোভে। আর সেই ক্ষোভের আগুনে পুড়ে গেলেন পরাজিত গোলরক্ষক মোয়াসির বারবোসা, পরের বিশ বছরে জেতা তিনটা বিশ্বকাপও ঐ আগুনকে নেভালো না এতটুকুও।

 

এরপরে জাতীয় দলে আর একটা মাত্র ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন বারবোসা। কিন্তু অকালে জাতীয় দলের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়াটাই তাঁর একমাত্র ‘শাস্তি’ ছিল না। কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ায় প্রতিনিয়ত শুনতে হয়েছে বর্ণবাদী মন্তব্য, এমনকি তাঁকে রাস্তায় দেখিয়ে মায়েরা শিশুসন্তানদের বলতেন, “এই লোকটার জন্য সারা ব্রাজিল কেঁদেছিল”। ঐ ম্যাচের ৪৩ বছর পর, ১৯৯৩ সালে ‘অপয়া’ বলে চিহ্নিত করে তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি ব্রাজিল দলের ট্রেনিংয়ে। ২০০০ সালের এপ্রিলে, প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় মৃত্যুর সময়ে তীব্র আক্ষেপ নিয়ে বারবোসা বলেছিলেন, “ব্রাজিলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হচ্ছে ত্রিশ বছর, কিন্তু আমাকে এই দণ্ডটা পেয়ে যেতে হলো পঞ্চাশ বছর।”

 They shied away from him as if he were a leper. And on the streets they pointed and insulted. The Brazilian goalkeeper who was cursed by the whole country. river-plate, botafogo, flamengo, vasco-da-gama, team-brasil, team-uruguay

বলা হয়, ব্রাজিলীয়দের রক্তেই বইছে ফুটবল। কিন্তু সেই আবেগের ভয়ঙ্করতম দিকটা বোধ হয় বারবোসার চেয়ে ভালোভাবে কেউ অনুধাবন করেননি।