বেন লেডারম্যানঃ হারিয়ে ফেরা এক মার্কিন বিস্ময়বালক
পোস্টটি ৩৬৬১ বার পঠিত হয়েছে
১২০ গজের ফুটবল মাঠে দাঁড়িয়ে কে না স্বপ্ন দেখে ব্লাউগ্রানা জার্সি গায়ে জড়ানোর? অনেকেই চোখ গরম করে বলবে, 'সবাই না'। অবশ্যই সবাই না, তবে বেন লেডারম্যান স্বপ্ন দেখেছিলেন ব্লাউগ্রানা রঙেই। লস এঞ্জেলেসে জন্মগ্রহণ করা মার্কিন এই ফুটবলারকে ইশ্বর প্রতিভা দিয়েছেন দুহাত ঢেলে। এমন প্রতিভা চিনতে ভুল করেনি বার্সেলোনা। বার্সা যুবদলের বিপক্ষে ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট অনূর্ধ্ব-১০ দলের এক ম্যাচে বার্সেলোনা স্কাউটদের নজর কাড়েন লেডারম্যান, লা মাসিয়ায় ডাক পান ২০১১ সালে।
এফসি বার্সেলোনার ১১২ বছরের ইতিহাসে বেন লেডারম্যান ছিলেন প্রথম মার্কিন ফুটবলার। তাই ফুটবলমহলে তাকে নিয়ে আলোচনাও ছিল বেশি। পরিবারসমেত স্পেনে পাড়ি জমানো লেডারম্যানের লা মাসিয়া অধ্যায়ের শুরুটা হয়েছিল স্বপ্নের মতোই। ২০১৩ সালে নিউইয়র্ক টাইমসের হেডলাইনে এসেছিলেন 'American Boy Wonder' হিসেবে। তবে ওই যে কথায় বলে 'Man thinks, God laughs'. কে কল্পনা করেছিলো লেডারম্যানের স্বপ্নযাত্রায় বাধ সাধবে স্বয়ং ফিফা?
২০১৪ সালের ফিফা আর্টিকেল ১৯ অনুযায়ী লেডারম্যানসহ ১০ লা মাসিয়ানকে প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ করে ফিফা। ফিফা আইন অনুসারে ১৮ বছরের কমবয়সী কোনো ফুটবলারের জন্য বিদেশী ক্লাবের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়া আইনবিরুদ্ধ। তবে এই আইনের কিছু ব্যাতিক্রম আছে।
১. যদি কোনো ফুটবলার নিজ দেশের সীমান্তের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বিদেশী ক্লাবের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়, এবং ৫০ কিলোমিটারের মধ্যেই বসবাস করে।
২. যদি কোনো ফুটবলার ইউরোপের এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তরিত হয়, বা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত কোনো দেশের পাসপোর্টের মালিক হয়। তবে এক্ষেত্রে ফুটবলারের বয়স অবশ্যই ১৬ বা তার ঊর্ধ্বে হতে হবে।
৩. যদি কোনো ফুটবলারের পরিবার ফুটবল সংক্রান্ত কারণ ছাড়া অন্য কোনো দেশে স্থানান্তরিত হয়।
ফিফার দেওয়া তিন শর্তের কোনোটাই পূরণ করতে পারেননি লেডারম্যান। ফলাফলস্বরূপ ১২০ গজের ফুটবল মাঠ থেকে জায়গা হয় দর্শকসারিতে। শুধু লেডারম্যান নন, দক্ষিন কোরিয়ান বিস্ময়বালক লি সিউং-উও ছিলেন দুর্ভাগাদের দলে। প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ হলেও শুরুতে বার্সেলোনা যুবদেলের সাথে ট্রেনিং এর অনুমতি পেয়েছিলেন নিষিদ্ধ ১০ লা মাসিয়ান । কিন্তু বিধি বাম। সেটুকু স্বস্তিও খুব বেশিদিন ছিল না লেডারম্যানের কপালে। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ফিফার নতুন নির্দেশে লা মাসিয়া ছাড়তে এক প্রকার বাধ্য হতে হয় ১৫ বছর বয়সী মার্কিন মিডফিল্ডারকে। লেডারম্যানের তখন একটাই লক্ষ্য, অনুর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ। তাই যত দ্রুত সম্ভব যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যোগ দেন ব্রেডেনটনের IMG একাডেমিতে। সেখানেও ঘটে বিপত্তি। এক বছর প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল থেকে দূরে থাকায় কোনোভাবেই যেন জাতীয় দলের সাথে তাল মিলাতে পারছিলেন না লেডারম্যান। প্রথমবারের মতো বিশ্বমঞ্চে নিজ দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার স্বপ্নের তাই সেখানেই সমাধি।
তবে বেন লেডারম্যান হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। ২০১৪ থেকে ২০১৬- দুই বছরে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে যোগাড় করেছিলেন পোলিস পাসপোর্ট। এরপর আর বার্সেলোনায় ফিরতে কোনো বাধা ছিল না। নতুন করে নীল-মেরুন স্বপ্নও দেখা শুরু করেছিলেন হয়তো। কিন্তু কোথায় যেন ছন্দটা হারিয়ে যাচ্ছিলো বারবার। বার্সায় প্রথম সিজনে্র শুরুটা বেশ ভালো হলেও দ্বিতীয় সিজনের বেশিরভাগটা বেঞ্চেই কাটাতে হয়েছিলো লেডারম্যানকে। কোচ ডেনিস সিলভার সুনজরও পাচ্ছিলেন না কোনোভাবেই। ২০১৮ সালে তাই শেষমেশ সিদ্ধান্ত নেন স্বপ্নের বার্সেলোনা অধ্যায়ের ইতি টানার।পাড়ি জমান বেলজিয়ান ক্লাব জেনকে।
২০১৪-১৫ সিজনে বেলজিয়ান লীগ জেতা জেনক ততোদিনে তৈরি করেছে কেভিন ডি ব্রুইনার মতো বিশ্বমানের ফুটবলার। শুরুটা মনমতো না হলেও পরের দুই বছরে জেনক যুবদলে নিজেকে নতুনভাবে তৈরি করার কোনো সুযোগই হাতছাড়া করেননি লেডারম্যান। এরপর বয়সভিত্তিক ফুটবল পেরিয়ে ২০২০ সালে যোগ দেন ইসরায়েলের তৃতীয় সারির এক ফুটবল ক্লাবে। তবে তার উথাল-পাথাল ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় মোড় ছিল পোলিস ক্লাব Rakow Czestochowa -এ ছয় মাসের চুক্তি স্বাক্ষর। বেন লেডারম্যানের পরের গল্পটুকু আবার সেই শুরুর মতো রঙিন। ২০২০-২১ সিজনে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পোলিস কাপ জিতে Rakow, ২০২১-২২ সিজনে জিতে দ্বিতীয়বারের মতো। এর মাঝে ছন্দ ফিরে পাওয়া লেডারম্যানের ছয় মাসের চুক্তির মেয়াদ বেড়ে এখন চার বছরের।
তবে সবকিছুর পর একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। ছয় বছর আগের সেই অপূর্ণ স্বপ্নপূরণ করতে যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় ফুটবল দলের জার্সিতে কি মাঠে ফিরবেন মার্কিন বিস্ময়বালক? উত্তরটা বেশ স্পষ্ট, 'না'। ২০২১ সালের মে মাসে অনূর্ধ্ব-২১ ইউরোতে পোল্যান্ডের জার্সিতে অভিষেক হয় লেডারম্যানের। কেন? লেডারম্যানের উত্তর,
"I like to focus on things and places where I am wanted. Poland wanted me more."
২২ বছর বয়সী লেডারম্যানের চোখ এখন ২০২৬ বিশ্বকাপে। নিজেদের মাঠে 'American Boy Wonder' কে দেখতে হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলপ্রেমীদের অপেক্ষা করতে হবে আর মাত্র কয়েক বছর। তবে ভাগ্যের পরিহাসে তা অন্য দেশের জার্সিতে, হয়তো হাফওয়ে লাইনের বিপরীতপাশে।
- 0 মন্তব্য