সামির নাসরি : হারিয়ে যাওয়া ক্ষুদে রাজপুত্র
পোস্টটি ৯০৩ বার পঠিত হয়েছে১৫ মে, ২০০৪। ফ্রান্সের শ্যাতেরো শহরের স্টেডিয়ামে ভীড় করেছে বেশ কয়েক হাজার দর্শক। চলছে ফাইনাল ম্যাচ। স্বাগতিক ফ্রান্সের সাথে লড়ছে স্পেন। ম্যাচের প্রথম মিনিটেই এগিয়ে গিয়েছিলো স্বাগতিকরা। কিন্তু লিড ধরে রাখতে পারেনি। দ্বিতীয়ার্ধের ৬৩ মিনিটে গোল করে ম্যাচে সমতা ফিরিয়েছে স্প্যানিশরা। তবে হাল ছাড়ার পাত্র নয় ফরাসিরা। গোল হজম করে ফের আক্রমণ শুরু করে তারা।
তখন ৭৯ মিনিট চলছে। হঠাৎ বামপাশ থেকে এক সতীর্থ পাস দিলো মাঝমাঠে থাকা ফ্রান্সের ১০ নাম্বার জার্সি পরিহিত ছোটখাটো এক ছেলেকে। ছেলেটি বল নিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। তবে ডিবক্সের আশে পাশেও গেলোনা। ডিবক্সের বেশ দূর থেকে সামনের সবকটি ডিফেন্ডারকে বোকা বানিয়ে দারুণ এক শট নিলো। আর গোলপোস্টের বামদিক দিয়ে দারুণ ভাবে বল জড়িয়ে গেলো জালে।
বলছিলাম এক সোনালি প্রজন্মের সূচনার গল্প। যে প্রজন্ম বিশ্ব ফুটবলে যাত্রা শুরু করেছিলো উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের মতো। যে প্রজন্মের হাতে বিশ্ব ফুটবলের ভবিষ্যৎ দেখে ফেলেছিলো সবাই। ২০০৪ সালের ১৫ মে ইউয়েফা অনূর্ধ্ব-১৭ ইউরো জয়ের মাধ্যমে তারা সেদিন যেন রাজকীয় ভাবেই ফুটবলে যাত্রা শুরু করে।
রাজকীয় সে দলে উঠতি তারকার কমতি ছিলোনা। পুরো দল ছিলো ট্যালেন্টে ভরপুর। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিলো সে দলটির আক্রমণভাগ। দলের চারজন ফরওয়ার্ডের সবাইকে ধরা হচ্ছিলো ভবিষ্যতের মহাতারকা হিসেবে। ১৯৮৭ সালে জন্ম নেওয়া সে চারজনের গ্রুপকে বলা হতো "জেনারেশন ৮৭"। তবে পুরো দলে সবচেয়ে বড় তারকা ছিলেন ফাইনাল ম্যাচে জয়সূচক গোল করা ১০ নাম্বার জার্সি পরিহিত ছোটখাটো নিষ্পাপ একহারা চেহারার সেই বালকটি। নাম তার সামির নাসরি।
১৯৮৭ সালের ২৬ জুন ফ্রান্সের বন্দরনগরী মার্সেই এর উত্তরে সেপ্তেমে লে ভ্যালো নামক উপশহরে সামির নাসরির জন্ম। তার পরিবার ছিলো আলজেরীয় বংশদ্ভূত ফরাসি। তার পিতামহ ভাগ্যান্বেষনে আলজেরিয়া থেকে ফ্রান্সে আসেন এবং মার্সেই শহরে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। তার পিতার জন্ম ও বেড়ে ওঠা মার্সেই শহরেই। তার পিতা আবদেলহাফিদ নাসরি পেশায় ছিলেন বাস ড্রাইভার, আর মা উয়াসিলা বেন সাইদ ছিলেন গৃহিণী। সামির নাসরিরা ছিলেন মোট চার ভাই বোন, এদের মধ্যে সামির ছিলেন জ্যেষ্ঠ। খুব একটা স্বচ্ছল ছিলোনা তাদের পরিবার। বাস চালিয়ে সামিরের বাবা যা পেতেন, তা দিয়ে কোনোরকমে কেটে যেত দিন।
ছোটবেলা থেকেই ফুটবলে দারুণ আগ্রহী ছিলেন সামির নাসরি। বয়স যখন খুবই অল্প, তখন থেকেই সময় পেলেই বল নিয়ে ছুটতেন, বন্ধুদের সাথে এলাকার রাস্তায় মেতে উঠতেন ফুটবিলে। তার আগ্রহ দেখে তাঁর বাবা তাকে স্থানীয় ফুটবল ক্লাবে ভর্তি করিয়ে দেন। সেখানে একবছর খেলার পর পাশের এলাকার ক্লাব পেন মিরাবুতে নাম লেখান সামির৷ মিরাবুতে খেলার সময়ই তিনি নজরে আসেন ফ্রান্সের সেরা ক্লাব অলিম্পিক ডি মার্সেই এর স্কাউট ফ্রেডি আসোলেন এর। স্থানীয় লোকদের কাছে নাসরির ব্যাপারে জানতে পারেন আসোলেন।
এরপর আসোলেনের হাত ধরে মিলান ও জুভেন্টাসের একাডেমির বিপক্ষে টুর্নামেন্ট খেলতে আরও কিছু বালকদের সাথে ইতালি যান সামির। সেখানে দারুণ পারফর্মেন্স দিয়ে নজর কাড়েন সবার। তার পারফর্মেন্সে মুগ্ধ হয়ে মিলানের এক স্কাউট আসোলেনকে মজা করে বলেই বসেন যে, "ও এখানেই থাকবে, তুমি চলে যাও।" আসোলেন বুঝিতে পেরেছিলেন একে কোনোভাবেই হাতছাড়া করা যাবেনা। তাই ইতালি থেকে ফিরেই সামির নাসরির পরিবারের সাথে কথা বলে পাকাপাকিভাবে তাকে একাডেমিতে সাইন করিয়ে নেয় অলিম্পিক ডি মার্সেই।
মার্সেই তে দ্রতই সবাইকে মুগ্ধ করেন নাসরি। বয়সভিত্তিক সবগুলো দলে তিনি শিরোপা জয় করেন। ২০০৩-০৪ সিজন অনূর্ধ্ব-১৮ দলে খেলার পর মাত্র ১৬ বছর বয়সেই মার্সেই রিজার্ভ দলে জায়গা পান। পরের সিজনের শুরুতে বেশ কিছু স্বনামধন্য ক্লাব নাসরিকে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করে৷ কিন্তু নাসরিকে ধরে রাখতে মার্সেই ম্যানেজমেন্ট ছিলো বদ্ধপরিকর। তাই তাঁর সাথে নতুন করে তিন বছরের চুক্তি করেন ক্লাব প্রেসিডেন্ট পাপে দিউফ ও ম্যানেজার হোসে আনিগো।
২০১৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সোশোর বিপক্ষে বদলি হিসেবে সিনিয়র টিমে অভিষিক্ত হন নাসরি। অতঃপর ১৭ অক্টোবর সেইন্ট এতিয়েনের বিপক্ষে তাঁর পূর্ণ অভিষেক ঘটে। উইন্টার ব্রেকের পর প্রথম ম্যাচে লিলের বিপক্ষে প্রথম গোল পেয়ে যান নাসরি। অতঃপর ২৫ ম্যাচে ১ গোল ও ২ এসিস্ট নিয়ে অলিম্পিয়ানদের হয়ে প্রথম সিজন শেষ করেন তিনি।
পরের সিজনে মার্সেই শিবিরে যোগ দেন ফ্রাঙ্ক রিবেরি ও জিব্রিল সিসে। এ দুজনের সাথে দারুণ পার্টনারশিপ গড়ে তোলেন নাসরি। সেইসাথে সেন্টার ফরওয়ার্ডে ছিলেন মামাদু নিয়াং। চারজনে তৈরি করেন লিগের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আক্রমণভাগ।
২০০৫ সালের ১৬ জুলাই ইউয়েফা ইন্টারটোটো কাপে সুইস ক্লাব ইয়ং বয়েসের বিপক্ষে ইউরোপীয় মঞ্চে নাসরির অভিষেক ঘটে। তাদের বিপক্ষেই পরের লেগে নিজের প্রথম ইউরোপিয়ান গোলও পেয়ে যান। সেবার ইন্টারটোটো কাপ জয়লাভ করে মার্সেই।
পরের মৌসুমে দলের ক্রুসিয়াল মোমেন্ট গুলোয় বিরাট ভূমিকা রাখেন নাসরি। তাদের সবচেয়ে বড় রাইভাল পিএসজির বিপক্ষে ৩-১ এ জয়ের ম্যাচে সিজনের প্রথম গোল করেন তিনি। সেই সাথে সিজনের শেষ দিনে তাদের শেষ ম্যাচে সেদানের বিপক্ষে তাঁর একমাত্র গোলে ১-০ গোলে জয় পায় মার্সেই এবং এই জয়ে ১৯৯৮-৯৯ সিজনের পর প্রথমবারের মতো রানার্সআপ হয়ে সিজন শেষ করে তারা। এই সিজনে নিজের ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ ৫০ ম্যাচ খেলেন সামির নাসরি।
তার অনবদ্য পারফর্মেন্সে সে সিজনে লিগের ইয়ং প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত হন নাসরি, সেই সাথে জায়গা পান টিম অব দ্য সিজনে। সেই সাথে মার্সেইতেও রিবেরি ও নিয়াং কে পেছনে ফেলে নির্বাচিত হন প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার। তাঁর স্বল্প উচ্চতা, নিষ্পাপ মুখাবয়ব ও রাজকীয় খেলায় মুগ্ধ হয়ে মার্সেই ফ্যানরা ভালোবেসে তাঁর নাম দেন "পেতি প্রিন্স" বা "ক্ষুদে রাজপুত্র"।
পরের সিজনে বায়ার্ন মিউনিখে পাড়ি জমান রিবেরি। ফলে এবার দলের প্রাণভোমরা হয়ে ওঠেন নাসরি। সেই সাথে তিনিও কাটান ক্যারিয়ারের সেরা সিজন। সেবার ৪২ ম্যাচে ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ ছয়টি গোল করেন, সেই সাথে এসিস্ট করেন ১৫ টি ম্যাচে, এটিও ছিলো ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ। দলের তরুণ উইঙ্গার ম্যাথু ভালবুয়েনার সাথে গড়ে তোলেন দারুণ এক জুটি, সেই সাথে মিডফিল্ড থেকে সঙ্গ দেন লোরিক সানা ও বেনোয়া শেইরু। গড়ে তোলেন লিগের সেরা তিন আক্রমণভাগের একটি।
তবে সিজনের শুরুতে ইঞ্জুরি বেশ ভুগিয়েছিলো। ফলে দলের প্রথম আট ম্যাচে কোনো গোল বা এসিস্ট পাননি নাসরি। তবে ইঞ্জুরি থেকে ফিরেই দলের কি প্লেয়ার হয়ে ওঠেন। সে সিজনে ক্যারিয়ারে প্রথমবার চ্যাম্পিয়নস লিগে অংশ নেন নাসরি, তবে সে অভিজ্ঞতা খুব সুখকর ছিলোনা। গ্রুপে তৃতীয় হয়ে ইউয়েফা কাপে রাউন্ড অব ৩২ এ কোয়ালিফাই করে মার্সেই। সেখানে পরের রাউন্ডে প্রথম লেগে বড় ব্যবধানে পরাজিত হওয়ায় পরের লেগে ৩-১ গোলে জয় পেয়েও ছিটকে যায় মার্সেই। তবে ৩-১ গোলের জয়ে দুটি এসিস্ট করেন নাসরি।
পরের মৌসুমে ইউরোপের বড় বড় প্রায় সবকটি ক্লাব নাসরিকে পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করে। অবশেষে সে প্রতিযোগিতায় জয়ী হয় গানার্সরা। ফরাসি কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গারের আহবানে আস্বস্ত হয়ে মার্সেই ছেড়ে প্রায় ১২ মিলিয়ন পাউন্ড ট্রান্সফার ফির বিনিময়ে আর্সেনালে পাড়ি জমান নাসরি।
৩০ জুলাই ২০০৮ জার্মান ক্লাব স্টুটগার্টের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে আর্সেনাল জার্সিতে নাসরির অভিষেক ঘটে। অতঃপর ১৬ আগস্ট ওয়েস্টব্রোমের বিপক্ষে তার প্রিমিয়ার লিগে অভিষেক ঘটে। সে ম্যাচের চতুর্থ মিনিটেই প্রিমিয়ার লিগে নিজের প্রথম গোলও পেয়ে যান। তাঁর একমাত্র গোলে ১-০ তে জয় পায় আর্সেনাল। এর মাধ্যমে প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসে ৮৩ তম খেলোয়াড় হিসেবে অভিষেক ম্যাচে গোল করার কীর্তি গড়েন সামির নাসরি। ৪৪ ম্যাচ খেলে ৭ গোল ও ৫ এসিস্ট করে আর্সেনালে নিজের প্রথম সিজন শেষ করেন নাসরি।
পরের সিজন শুরুর আগেই প্রিসিজনে অনুশীলন ম্যাচ খেলতে গিয়ে পা ভাঙে তাঁর। ফলে প্রায় মাস তিনেকের জন্য মাঠের বাইরে চলে যান এবং মিস করেন ২০০৯-১০ সিজনের প্রথম পার্ট। অতঃপর ২৫ অক্টোবর লিভারপুলের বিরুদ্ধে ম্যাচে মাঠে ফেরেন নাসরি। ইঞ্জুরি থেকে ফিরে ফের ছন্দ ফিরে পান। ক্রুসিয়াল ম্যাচ গুলোয় গোল এসিস্ট আসতে থাকে।
সেবার ইউসিএল রাউন্ড অব সিক্সটিনে পোর্তোর বিপক্ষে চোখ ধাঁধানো এক গোল করেন নাসরি। এ গোলটি ছিলো নাসরির ড্রিবলিং ও স্পোর্টিং অ্যাবিলিটির এক আশ্চর্য সমাহার। রাইট উইং থেকে মিডফিল্ডার আবু দিয়াবির বাড়ানো বল নিয়ে ড্রিবলিং এর মাধ্যমে সামনে এগিয়ে যান নাসরি, এরপর সামনের তিন ডিফেন্ডার কে পাশ কাটিয়ে গোলমুখে চলে যান, সেখানে প্রতিপক্ষ উইংব্যাক আলভারো পেরেইরা কে পাশ কাটিয়ে বল পাঠিয়ে দেন জালে। "দ্য গার্ডিয়ান" পত্রিকার কলামিস্ট ডেভিড লেসি এ গোলের ব্যাপারে বলেন, "ব্রিটিশ ফুটবলের হারানো শিল্পের স্মৃতিচারণ"।
আর্সেনালে সময় ভালোই কাটছিলো তাঁর। ৩৪ ম্যাচে ৫ গোল ও ৫ এসিস্ট করে '০৯-১০ সিজন শেষ করেন। তবে ইঞ্জুরি পিছু ছাড়ছিলোনা। ২০১০ এর আগস্টে আবার ইঞ্জুরির কবলে পড়েন। তবে ইঞ্জুরি থেকে ফিরলেই আর্সেনালের ত্রাতা হয়ে উঠতেন। অক্টোবর, ডিসেম্বরে ও জানুয়ারিতে প্রিমিয়ার লিগের প্লেয়ার অব দ্য মান্থ নির্বাচিত হন। একইসাথে ফ্লোরেন্ত মালুদা ও হুগো লরিস কে পেছনে ফেলে ফ্রান্স ফুটবল ম্যাগাজিন কর্তৃক ফ্রেঞ্চ প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত হন সামির নাসরি। ২০১০-১১ সিজন শেষে প্রিমিয়ার প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার ও ইয়ং প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার উভয় পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হন। সেই সাথে জায়গা করে নেন টিম অব দ্য ইয়ারে। আর্সেনালের জার্সিতে নাসরি সর্বমোট ১২৪ ম্যাচে ২৭ গোল করেন।
২৪ আগস্ট ২০১১ আর্সেনাল ছেড়ে ২৫ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে চার বছরের চুক্তিতে ম্যানচেস্টার সিটিতে সাইন করেন নাসরি। চারদিন পরেই স্পার্সদের বিপক্ষে সিটিজেনদের জার্সিতে তাঁর ডেব্যু হয়। অভিষেক ম্যাচেই তিনটি গোলে এসিস্ট করেন নাসরি। সেই সিজনে ক্যারিয়ারে প্রথমবার প্রিমিয়ার লিগ ট্রফি জয় করেন সামির নাসরি। সেবার কিউপিআর কে সিজনের শেষদিনে ৩-২ গোলে হারিয়ে লিগ টাইটেল ঘরে তোলে ম্যানচেস্টার সিটি।
এরপর আস্তে আস্তে কনসিস্টেন্সি হারাতে শুরু করেন সামির নাসরি। ২০১২-১৩ সিজন থেকেই মূলত পারফর্মেন্স ওঠানামা করতে শুরু করে। কিছু ম্যাচে অসাধারণ পারফর্ম করতেন, আবার কিছু ম্যাচে থাকতেন একদমই বিবর্ণ। পরের সিজন গুলোতে এটা আরও জেঁকে বসে। সেই সাথে হানা দিতে থাকে একের পর এক ইঞ্জুরি৷ ২০১৫-১৬ সিজনে মারাত্মক ইঞ্জুরির কবলে পড়েন, যার ফলে পাঁচ মাসের জন্য ছিটকে যান নাসরি। এরপর ইঞ্জুরি থেকে ফিরে আসেন, কিন্তু পারফর্মেন্সে ভাটা পড়ে গিয়েছিলো। সিটি টিমে নিজের জায়গা হারিয়ে ফেলেছিলেন ততদিনে।
সুদিনের আশায় ২০১৬-১৭ সিজনে লোনে যান স্প্যানিশ ক্লাব সেভিয়ায়, তবে সুদিন ফেরেনি। সেভিয়ার সাইডলাইনেই কাটান প্রায় পুরো সিজন। নিজেকে যেন ততদিনে হারিয়ে ফেলেছেন। ২০০৭ সালের সামারে অফিসিয়ালি সিটি ছাড়েন নাসরি, যোগ দেন তুর্কি ক্লাব আন্তালিয়াস্পোরে। সেখানে গিয়েও ছিলেন বিবর্ণ। নাসরি নিজেই বুঝে গিয়েছিলেন তার ক্যারিয়ার প্রায় শেষ। দুবছরের চুক্তি থাকলেও মাত্র ছয় মাস পরেই জানুয়ারিতে কন্ট্র্যাক্ট টার্মিনেট করে ফেলেন।
এর মধ্যে মরার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে আসে আরেক ইস্যু। ডোপিং রুলস ভঙ্গ করায় ছয় মাসের জন্য ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ হন সামির নাসরি, যেটা পরে বেড়ে দাঁড়ায় ১২ মাসে। নিষেধাজ্ঞা শেষে ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেডে ট্রেইনিং শুরু করেন নাসরি। ২০১৮-১৯ সিজনে হ্যামার্সদের সাথে স্বল্পদৈর্ঘ্য একটি চুক্তি সাইন করেন। অতঃপর সে সিজন শেষে তাঁকে রিলিজ করে দেয় ওয়েস্ট হ্যাম।
ওয়েস্ট হ্যাম ছাড়ার পর ২০১৯ সালের ৫ জুলাই যোগ দেন যোগ দেন বেলজিয়ান ক্লাব আন্ডারলেখটে। অতঃপর ২০২০ সালে সেখান থেকেও চলে আসেন। এরপর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে এক সাক্ষাৎকারে নাসরি বলেন যে আন্ডারলেখট থেকে বিদায়ের মাধ্যমেই ফুটবল ক্যারিয়ার কে ইতি বলে দিয়েছেন তিনি।
ফ্রান্স জাতীয় দলের ক্যারিয়ারেও ছিলো একই চিত্র৷ ফুটবলে এসেছিলেন আলো ছড়িয়ে, কিন্তু সেটা ধরে রাখতে পারেননি। ফ্রান্সের বয়সভিত্তিক সবকটি দলেই খেলেন নাসরি, পারফর্মেন্সও ছিলো টপ ক্লাস। আগেই বলেছি, "জেনারেশন ৮৭" এর চারজনের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল ছিলেন নাসরি। তিনি বয়সভিত্তিক দলগুলোয় সুযোগও পাচ্ছিলেন অন্যদের চেয়ে দ্রুত। পারফর্মেন্স ছিলো এককথায় অনবদ্য। গোল এসিস্ট রেগুলার আসতো তাঁর পা থেকে।
২০০৪ সালের অনূর্ধ্ব-১৭ ইউরো ছিলো "জেনারেশন ৮৭" এর টার্নিং পয়েন্ট, যেটার কথা বলেছি শুরুতেই। সেবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে সারাবিশ্বের নজর কাড়ে তাঁরা। অতঃপর ২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো ফ্রান্স সিনিয়র দলে ডাক পান নাসরি। ২৮ মার্চ ২০০৭ অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে ইউরো কোয়ালিফাইয়ার ম্যাচে ব্লুজদের হয়ে অভিষেক ঘটে তাঁর। সে ম্যাচের একমাত্র গোলে করিম বেঞ্জেমাকে এসিস্ট করেন তিনি। অতঃপর ৬ জুন জর্জিয়ার বিপক্ষে করেন প্রথম আন্তর্জাতিক গোল।
জাতীয় দলে ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করছিলেন, তাই প্রত্যাশিত ভাবেই ডাক পান ২০০৮ ইউরোর ফ্রান্স স্কোয়াডে। গ্রুপ পর্বের তিনটি ম্যাচের দুটিতে বদলি হিসেবে নামেন নাসরি। এরপর ইউরোর সময় থিয়েরি অঁরির সিটে বসা কে কেন্দ্র করে সতীর্থ উইলিয়াম গালাসের সাথে ইন্টার্নাল কলহে জড়ান নাসরি। নানারকম ইস্যুর কারণে ২০১০ বিশ্বকাপ দলে জায়গা হয়নি তাঁর।
বিশ্বকাপ শেষে নতুন কোচ লরা ব্লাঁর অধীনে ফের ফ্রান্স দলে ফেরেন নাসরি। নীল জার্সিতে নিয়মিত হয়ে ওঠেন তিনি৷ ২০১২ ইউরোতে ফ্রান্সের কোয়ালিফাইং এ তাঁর বিরাট ভূমিকা ছিলো। অবশ্যম্ভাবী ভাবেই দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে ইউরো যাত্রা শুরু করেন।
ইউরোর প্রথম ম্যাচে তাঁর একমাত্র গোলে ইংল্যান্ডের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে ফ্রান্স। তবে সে যাত্রা শেষ পর্যন্ত মনে রাখার মতো হয়নি। কোয়ার্টার ফাইনালে স্পেনের কাছে হেরে তারা টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে পড়ে।
এরপর আবার পরিবর্তন হয় ম্যানেজারের সিটে, লরা ব্লাঁর জায়গায় আসেন দিদিয়ের দেশম। ওদিকে আস্তে আস্তে ফর্ম হারাতে থাকেন নাসরি৷ দেশমের দলে অনিয়মিত হয়ে পড়েন। ২০১৪ বিশ্বকাপে তাঁকে ছাড়াই ২৩ জনের দল ঘোষণা করেন দেশম। বিশ্বকাপ শেষে ২০১৪ সালের ৯ আগস্ট মাত্র ২৭ বছর বয়সে জাতীয় দলকে বিদায় বলে দেন সামির নাসরি।
শেষ হয় একটি অধ্যায়। যাকে ঘিরে সবার প্রত্যাশা ছিলো আকাশচুম্বী, ঝরে যান তিনি। বিশ্ব ফুটবলে সামির নাসরি একটি আক্ষেপের নাম। সামির নাসরি ছিলেন অনেকটা উল্কার মতো, যার আগমন ঘটেছিলো উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে, কিন্তু তারপরে আস্তে আস্তে হয়ে পড়ে নিস্প্রভ।
সামির নাসরির নাম শুনলেই ফুটবল ফ্যানদের বুকের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে চাপা হাহাকার। তিনি ছিলেন একটি পূর্ণাঙ্গ প্যাকেজ, কিন্তু হারিয়ে গেলেন কালের গর্ভে, সবাইকে হতাশ করে৷ তবে তাঁর গুণমুগ্ধ অসংখ্য ফ্যান এখনো স্মরণ করে তাঁকে, স্মরণ করে মার্সেই ফ্যানরা, তাদের একান্ত আপন ক্ষুদে রাজপুত্র কে।
- 0 মন্তব্য