দিদি; এক টাইটানের গল্প
পোস্টটি ৩৫৭ বার পঠিত হয়েছেগল্প, উপন্যাস কিংবা সিনেমায় আমরা সবসময় নায়কদেরই মনে রাখি, হয়তো উপভোগ করি কোন পার্শ্ব চরিত্রকে কিন্তু মনের গহীন কোণে তাদের ঠাই দিয়ে বারবার রোমন্থন করি নায়ক কিংবা নায়িকাদের। ইতিহাসের পাতা উল্টালেও আমরা দেখি ইতিহাস শুধু গ্রীক গড দেরকেই মনে রেখেছে, কোন টাইটানকে কখনো মনে রাখে নি। ফুটবল রুপকথার গল্প বলতে গেলেও আমরা নায়কদের গল্প করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি, আমাদের মননে থাকে শুধু গ্রীকগডরাই। তেমনি পেলে, ম্যারাডোনারা যদি গ্রীক গড হয়, তাহলে এমনি একজন টাইটান ছিলেন দিদি। আজকের গল্পটা একজন টাইটানের যিনি ফুটবল মাঠে একজন শিল্পীর ন্যায় ভাবতেন, চিন্তা করতেন সবচেয়ে সুন্দর চিত্রকল্প তৈরি করবেন কি করে।
দিদিকে নিয়ে কিছু বলতে শুরু করলে সবার আগে মনে পড়ে ১৯৫৮ বিশ্বকাপে তাকে দেখে এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানোর মন্তব্যটি। তার মন্তব্যটি ছিলো এমনঃ
“Didi looked like an African icon, standing at the centre of the field, where he ruled. From there he would shoot his poison arrows.”
ব্রাজিল ফুটবল মানেই জোগো বনিতা। তারা সুন্দর ফুটবল খেলবে এটাই স্বাভাবিক। এই জোগো বনিতা যদি আপনি খেলতে চান তাহলে আপনার শুধু শারীরিক সক্ষমতা থাকলেই হবে না বরং হতে হবে সৃজনশীল এক চিত্রশিল্পী। দলে থাকতে হবে এমন একজনকে যিনি শুধু ফুটবলটা খেলেনই না, তিনি ফুটবলকে নিয়ে ভাবেন, চিন্তা করেন।
"বল দৌড়াবে, খেলোয়াড় কেন দৌড়াবে?" দিদির এই কথা শুনে আপনার চোখ কপালে উঠতেই পারে, কিন্তু তিনি ফুটবলটাকে এভাবেই দেখেন। এর পিছনে অবশ্য কারণ আছে, তিনি চাইলেও বাকি সবার মত দৌড়াতে পারতেন না। ছোটবেলায় যিনি হুইলচেয়ারে বসে ছিলেন, তিনি কিভাবে বাকি সকলের সাথে তাল মিলিয়ে দৌড়াবেন?
দিদির মতো স্মার্ট ফুটবলার এর জন্য এটি কোন ব্যাপারই ছিলো না। ফুটবল মাঠে তিনি দু কদম আগে চিন্তা করতেন, বল কোথায় যাবে তার গতিবিধি বুঝে ফেলতেন খুব সহজেই। প্রতিপক্ষের পাস কোথায় যাবে সেটা যদি আপনি দু কদম আগেই ধরে ফেলতে পারেন তখন আর আপনাকে বাকিদের মতো পরিশ্রম করতে হবে না। দিদির কাছে ব্যাপারটা ছিল এমন আপনি কেন বলের পিছনে দৌড়াবেন যখন আপনি চাইলেই বল আপনার কাছে নিয়ে আসতে পারবেন।
সম্ভবত দিদির সবচেয়ে বড় প্রশংসাকারী ছিলেন পেলে। পেলে যখন দিদিকে বর্ণনা করেছিলেন তখন তার ভাষ্য ছিলো এমনঃ
“He was too smart at times. He would pretend that he was going to cross the ball to one side of the pitch, and then cross it to the other. It sometimes confused us instead. He would shout, ‘No, you idiots, I’m trying to confuse the other team!”
প্রতিপক্ষকে তিনি তার কৌশল দিয়ে এতোটাই নাস্তানাবুদ করতেন যে মাঝে মাঝে সে কৌশলের ফাদে পড়তো তার সতীর্থরাই। ১৯৫০ এর বিশ্বকাপ জিততে না পারার দুঃখ তখনো ভুলতে পারছিলো না ব্রাজিলিয়ানরা। ৫০ এর ব্যর্থতাকে অনুসরণ করে ৫৪ বিশ্বকাপও জিততে পারে নি।পরের বিশ্বকাপ, ১৯৫৮ সালে হবে সুইডেনে। ব্রাজিলিয়ানরা তখন স্বপ্ন দেখতে ভয় পাচ্ছিলো, এবারো কি হাত ফসকে বের হয়ে যাবে বিশ্বকাপ? না, আর স্বপ্নভঙ্গ হয় নি। ব্রাজিল সেবার পেরেছিলো এটা পেরেছিলো প্রথমবারের মতো জুলেরিমে ট্রফি (বিশ্বকাপ) ঘরে তুলতে।
ব্রাজিল পেরেছিলো সেবার প্রথমবারের মতো নিজেদের ঘরে বিশ্বকাপের সোনালী ট্রফি আনতে। তবে সেবারও শঙ্কা জেগেছিলো। ফাইনালে স্বাগতিক সুইডেন মাত্র চার মিনিটেই লিড নিয়েছিলো ১-০ গোলে। ১-০ গোলে দল পিছিয়ে যাওয়ার পরে সবাই তখন ভেবেছিলো এবারও বুঝি গেলো!! শুধু বলকে বাহুর নিচে রেখে সেন্ট্রাল স্পটের দিকে এগিয়ে গেলেন একজন, তিনি একদম ঠান্ডা। ফাইনালের প্রেশার, প্রতিপক্ষের লিড নিয়ে নিছে, তবুও চাপ তাকে কাবু করতে পারছে না। মারিও জাগালো, পেলেরা তখন খুব রাগ হয়ে আছেন তার উপর। দল গোল খেয়ে পিছিয়ে আছে আর তিনি কিনা এমন নিষ্প্রাণ ঠান্ডা হয়ে মাঠে দাঁড়িয়ে আছেন। সবাই রেগে গিয়ে তাকে বকা শুরু করলো। জাগালো তো তাকে বলেই বসলেন, “দিদি, আমরা হারছি, তুমি এমন কিভাবে আছো?” জাগালোর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “ফাইনাল আমরাই জিতবো, আমরা এখনো তাদের চেয়ে ভালো দল।” দিদির উত্তর শুনে অবশ্য কিছুটা আত্ববিশ্বাস পেয়েছিলেন মারিও জাগালো। তিনি কেন এতো চুপচাপ ছিলেন তার প্রমাণ মেলে মিনিট চারেক পরেই , তার পাস থেকেই ব্রাজিলের প্রথম গোলের সূচনা। এরপর অবশ্য স্বাগতিকদের জালে গুণে গুণে ৫ গোল দিয়েছিলো ব্রাজিল, ৮০ মিনিটে সুইডেন আরেক গোল দিয়ে অবশ্য ব্যবধান কমাতে পেরেছিলো।শেষ বাশি বাজার আগেই বিশ্ব জেনে গেছে কারা চ্যাম্পিয়ন। ততক্ষণে বিশ্ব ফুটবল জেনে গিয়েছে, নতুন পরাশক্তি এসে গেছে। সে গল্পে তার অবদান অবশ্য ইতিহাস খুব একটা মনে রাখে নি। পত্র-পত্রিকার পাতায় শিরোনাম হয়েছিলো কৃষ্ণবর্ণের ছেলেটিকে নিয়ে। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই বিশ্বকাপ জয় করে ফেললো সে ছেলে, তাও আবার ফাইনালে দু গোল করেছে সে।
ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলে তখন রিয়াল মাদ্রিদের দাপট। তারা দলে ভেড়াতে চায় পেরেইরাকে , আমরা যাকে ডাকি দিদি বলে। প্রথম কোন ব্রাজিলিয়ান হিসেবে রিয়াল মাদ্রিদের দলে খেলবেন তিনি। তিনি যখন দলে আসলেন, তার খেলার আভিজাত্য দেখে মিডিয়া নাম দিয়েছিলো ইথিওপিয়ান রাজপুত্র।
শুরুতেই বলেছিলাম দিদি দৌড়াতে পছন্দ করতেন না। ছোটবেলার সেই অপারেশন এর পরে তার তো আর ফুটবল এই খেলার কথা না। তবুও তিনি খেলেছেন। ফুটবলকে এতোটাই ভালোবাসতেন যে ঘুমানোর সময় কিংবা হুইলচেয়ারে বসে থাকা সেই দিন গুলোতে তার পাশে একটা বল থাকতোই।
রিও ডি জেনিরোর একটা মফস্বল শহর ক্যাম্পোস, সেখানের বস্তিতেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। ব্রাজিলের মানুষদের কাছে ফুটবল ধর্মের শামিল, ছোট্ট দিদির কাছেও ছিলো এমন। প্লাস্টিকের ব্যাগ দিয়ে বানানো বল দিয়ে খেলতেন পিক আপ গেম। এই পিক আপ গেম খেলতে গিয়েই ব্যাথা পেয়েছিলেন পায়ে। সেটাই তাকে নিয়ে গেলো হুইলচেয়ারে। এরপর থেকে তিনি আর দৌড়াতে পারতেন না বাকিদের মতো। সেখান থেকেই তিনি তার সৃজনশীলতাকে প্রয়োগ শুরু করেন মাঠে। ফিরে যাই মাদ্রিদ অধ্যায়ে।
মাদ্রিদের সমর্থকদের কাছে তখন ফুটবল খেলা মানেই ট্যাকল করা, গায়ে কাদা মাখা থাকতে হবে, কিন্তু দিদি এতে রাজি না। তিনি তার সাদা জার্সিতে একটুও কাদা লাগাতেন না। পরিছন্ন ফুটবল খেলাই তার চিত্ত মননের আজন্ম সাধ। মাঝে মাঝে অবশ্য দর্শকদের খুশি করার জন্য নিজের হাতে গায়ে কাদা মেখে নিতেন।
লোকমুখে একটা মুখরোচক গল্প রটিত আছে। দিদিকে দলে আনার পক্ষে ছিলেন না ডি স্টেফানো। ততদিনে মাদ্রিদের একচ্ছত্র অধিপতি তিনি, তার প্রভাবে কেউ হানা দিবে এটা তিনি মেনে নিতে পারছেন না। দিদির ন্যাচারাল লিডারশিপ তাকে সকলের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলবে এই ভয় ডি স্টেফানোর। দিদির প্রেজেন্টেশনের পরে নাকি ডি স্টেফানো হ্যান্ডশেক ও করতে নারাজ ছিলেন, পরে অবশ্য তাকে অনেক বলে কয়ে প্রেজেন্টেশনে রাখা হয়েছিলো। দিদিও বুঝেছিলেন এই ব্যাপার, তিনিও মাদ্রিদে আর থাকলেন না। এক বছর পরেই ফিরে গেলেন তার পুরোনো ক্লাব বোটাফোগো তে।
১৯৬২ বিশ্বকাপ, সংবাদ মাধ্যমের টিপ্পনী কাঁটা শুরু তার বয়স নিয়ে। বয়স তখন ৩৩, এমনিতেই তিনি দৌড়ান না খুব একটা। এরউপর তিনি নাকি যথেষ্ঠ ফিট নয়। সংবাদমাধ্যমের একের পর এক খোচার প্রত্যুত্তরে বলেই বসলেন, “আমি বলের কাছে যাওয়া লাগবে না, বলই আমার কাছে আসবে”। যেন কোন এক চিত্রশিল্পী তার চিত্রকর্মকে বর্ণন করে যাচ্ছে। কোন এক চিত্রশিল্পী তার রংতুলি নিয়ে ক্যানভাসে একের পর এক ঢেউ তুলে যাচ্ছেন, তিনি যা চান তাই ফুটিয়ে তুলবেন। দিদিও পেরেছিলেন তেমন, তাকে বলের পিছনে ছুটে ছুটে হয়রান হতে হয় নি, বরং বলের আচরণবিধি তিনি এতোটাই নিখুঁতভাবে বুঝতে পারতেন যে তাকে আর কোন কষ্টই করতে হতো না।
১৯৬২ বিশ্বকাপ জয়ী তখন ব্রাজিল, তবুও দিদির আফসোস। সবার মনেই প্রশ্ন আফসোস কেন? দলের সেরা তারকা পেলে ইনজুরিতে পড়ার পরেও দল শিরোপা জিতেছে। দিদির আফসোস অবশ্য অন্যজায়গায় ছিলো, ব্রাজিল বনাম স্পেন ম্যাচে যে খেলেন নি ডি স্টেফানো। তিনি চেয়েছিলেন চোখে আঙুল দিয়ে একবার দেখিয়ে দিতে তিনি কেমন ফুটবল খেলতে পারেন।
ক্যাম্পোস এর বস্তির সেই দিনগুলো থেকে ফুটবল ছিলো তার প্রথম ভালোবাসা। কখনো তাকে ছেড়ে কোথাও যেতেন না। ভালোবাসাকে বেশি দূরে রেখে নাকি থাকা যায় না, দিদি এই ভালোবাসার জন্য অবশ্য নিজের স্ত্রীকেও ছেড়ে দিতে রাজি ছিলেন। ফুটবলার দিদি যেমন আভিজাত্য এর এক জীবন্ত ক্যানভাস, ব্যাক্তি দিদিও তেমনই ছিলেন। দারিদ্র্যকে জয় করে হয়েছিলেন বিশ্বকাপ জয়ী এক ফুটবলার, জিতেছিলেন ফিফা গোল্ডেন বলও। ফুটবলই ছিলো তার প্রথম ও শেষ ভালোবাসা। এই সবকিছুই তিনি করেছিলেন দারিদ্র্যতা নামক এক বিভীষিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, জীবনভর তাই লড়েও গেছেন এর বিরুদ্ধে। তার বলা এক বিখ্যাত উক্তি দিয়েই শেষ করছিঃ
“A man can speak lightly of poverty, only if he has never experienced its terrors.”
- 0 মন্তব্য