মার্সেলো ভিয়েরাঃ ঝাকড়া চুলের এক উন্মাদ মাদ্রিদিস্তা
পোস্টটি ৪০৩ বার পঠিত হয়েছেবোটাফোগো বীচে ফুটসাল খেলা শুরু হবে একটু পরেই। একজন বলে উঠলেন, “আমি পেলে”, আরেকজন তার দেখাদেখি বললেন “আমি রিভালদো”, একে একে সবাই বলার পরে এবার পালা এলো দলের সবচেয়ে কনিষ্ঠ খেলোয়াড়টি বললো “আমি রবার্তো কার্লোস”! বীচ ফুটবল খেলতে আসা বাকিরা তার কথা শুনে অবাক! কে ভেবেছিলো সেদিন রবার্তো কার্লোস পদরেখা ছুতে পারবে সেই ছোট্ট ছেলেটি। যার কথা বলছিলাম তার নাম মার্সেলো ভিয়েরা ডা সিলভা, ঝাকড়া ঝাকড়া চুলের এক পাগলাটে ছেলে!
মার্সেলো- নামটি শুনলে আপনার চোখে প্রথমে কি ভেসে উঠে? লা ডেসিমা ফাইনালে গোল করে জার্সি উচু করে সবাইকে নিজের নাম দেখানো,মাদ্রিদের ব্যাজে চুমু দেয়ার ছবি নাকি সতীর্থদের গোলে উল্লাসে ফেটে পড়া এক পাগলা মাদ্রিদ সমর্থককে? যে ছবিটিই ভেসে উঠুক না কেন, সে ছবিটিকেই মাদ্রিদিজমের প্রতিচ্ছবি হিসেবেই তুলনা করতেই পারেন।
রিও ডি জেনিরোর পাশেই এক গ্রাম, ক্যাতেতে- প্রাচীন ঐতিহাসিক উপনেবেশিক স্থাপত্যকলার জন্য বিখ্যাত এই গ্রামেই জন্মেছিলেন মার্সেলো ভিয়েরা সিলভা দা জুনিয়র। আর আট-দশটা সাধারণ ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারদের পরিবারের মতো তার পরিবারেরও সঙ্গী ছিলো দারিদ্র্যতা।
শৈশবে খেলার সাথীরা আদর করে ডাকতো মার্সেলিনো বলে। ছোটবেলা থেকেই দাদার সাথে ছিলো সবচেয়ে বেশি সখ্যতা, যাকে হারিয়েছিলেন ২০১৪ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের মাত্র দুদিন আগে। দাদার অনুপ্রেরণায় ফুটবলকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, উত্থান-পতনে দাদাই ছিলেন সবচেয়ে কাছের সঙ্গী। দাদাকে হারানোর পরে স্কোলারির অনুমতি পেলেও যোগ দেননি দাদার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে। পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি আমার দাদাকে সবার থেকে ভালোভাবে জানি, আমি সেখানে উপস্থিত থাকি নি কারণ সে যদি বেচে থাকতো তাহলে আমাকে সেখানে যেতে দিতো না”।
রিও ডি জেনিরোর পাশেই একটি ছোট বীচ বোটাফোগো, ছোট্ট মার্সেলোর বেশিরভাগ সময়ই কাটতো সেখানেই,ফুটবল পায়ে সাগরের পাড়ে ছুটে চলাই যেন তার জীবন। ফুটসাল নিয়ে পড়ে থাকতেন সারাদিন। ফুটবল নিয়ে অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস খুব অপছন্দ ছিলো তার মায়ের।মায়ের সমর্থন না পেলেও একজন মানুষের সমর্থন পেয়েছিলেন সবসময়, উৎসাহে, অনুপ্রেরণায় তাকে সাহস জুগিয়েছিলেন তার দাদা। মাত্র ৪ বছর বয়স থেকে ফুটসাল খেললেও বীচ ফুটবল খেলা শুরু করেন ৮ বছর বয়স থেকে। বালুর মাঝে ডাইভ দিলে ব্যাথা পাওয়া যায় না, তাই বোটাফোগো বীচে যখন খেলতেন তখন বেশিরভাগ সময়ই খেলতেন গোলকিপার হয়ে।
বয়স যখন ১০, তখন থাকা শুরু করলেন দাদা-দাদীর কাছে। দাদা স্যান পেদ্রো ফুটবলে সমর্থন দিলেও দাদী মায়ের মতোই নিরুৎসাহই করতেন। দাদা ছিলেন গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল, বিপদে-আপদে মার্সেলোকে সবসময় আগলে রাখতেন তিনি।দাদা নিজেও ছিলেন ফুটবলার। শুরুর দিকের দীক্ষা দাদার কাছেই পেয়েছেন মার্সেলো। মার্সেলোর দাদা ছিলেন ড্রাইভার, পরবর্তীতে তিনি সেই চাকরি ছেড়ে দেন, এবং মার্সেলোকে নিয়ে প্রতিনিয়ত ট্রেনিংয়ে নিয়ে যেতেন। তার দাদার একটি গাড়ি ছিলো কিন্তু সেই গাড়িতে গ্যাস ঢুকানোর মতো টাকা তাদের ছিলো না, বাসের টিকেট কিনারও টাকা ছিলো না তাদের। বাসের টিকেট কিনার টাকা ব্যবস্থা করার জন্য দাদা তার গাড়িটি বিক্রি করে দেন এবং সেই টাকা দিয়েই মার্সেলোর যাতায়াতের ব্যবস্থা হয়। এখানেই থেমে যাননি মার্সেলোর দাদা। দিনের পর দিন তার নাতিকে সমর্থন দিয়ে গেছেন। মার্সেলোর যখন ট্রেনিং এর জন্য জেরেমে যাওয়া লাগতো, যেটা তার বাড়ি থেকে ৫০ কিমি দূরে ছিলো। তার দাদা তখন একটি কমলা রঙের কার কিনে, সেই কারের টাকা তিনি পান একটি লটারি জিতে। ক্রোয়েশিয়ার পতাকার উপর বেট ধরে সেই লটারি জিতে নেন তার দাদা, এইজন্যই মার্সেলো বলেন, লুকা মদ্রিচকে দেখলে তার দাদার কথা মনে পড়ে। “সেই একমাত্র আমাকে বুঝতো এবং আমাকে সমর্থন দিতো”- দাদাকে নিয়ে মার্সেলোর বক্তব্য ছিলো এটি।
মার্সেলো তার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন লোকাল ফুটসাল ক্লাব হেলেনিকোতে। হেলেনিকোর উদ্দেশ্য ছিলো ছোট বাচ্চাদের রিক্রেয়শনের জন্য কিছু একটা করা, এবং তাদেরকে ড্রাগ ট্রাফিকিং থেকে দূরে রাখা। মার্সেলোর প্রতিভা বুঝতে বড় ক্লাবগুলোর একটুও দেরি করে নি, তাদের মধ্যে প্রথমে ছিলো ফ্লুমিনেন্স।কিন্তু ফ্লুমিনেন্স ট্রায়ালে তার খেলা দেখে সন্তুষ্ট হয় নি। ফ্লুমিনেন্সের রিজেকশনের কিছুদিন পরে দরজায় কড়া নাড়ে ভাস্কো দা গামা। আগের বারের কাহিনীর পুনরাবৃত্তি আর ঘটে নি, ভাস্কো দা গামা তাকে সাইন করিয়ে নেয়। কিন্তু এক বছরের মাথায় তারাও তাকে ছেড়ে দেয় তার কারণ হিসেবে দেখায় তার ছেয়েও ভালো প্লেয়ার তাদের রয়েছে। মন খারাপ করে মার্সেলো বাড়ি ফিরে যান এবং অপেক্ষা করতে থাকেন।
হেলেনিকোয় ফিরে আবার ফুটসালে মন দেন, এর কিছুদিন পরেই আবার ডাক পান ফ্লুমিনেন্স থেকে! ফ্লুমিনেন্সে দেখা মিলে বন্ধু আলভেজের সাথে। বন্ধু আলভেজের বোন ক্লেরিসকে দেখার পরেই তার প্রেমে পড়ে যান। যে করেই হোক জিততে হবে ক্লেরিসের মন, সেজন্য একবার চুল ব্লন্ডও করে ফেলেন। দুর্ভাগ্যবশত সে ম্যাচ দেখতে আসেন তার বাবা, বাবার ক্রোশানলেরও স্বীকার হন চুলের রঙের জন্য। পরবর্তীতে অবশ্য ক্লেরিসের সঙ্গেই ঘর বাঁধেন মার্সেলো।
১৫ বছর বয়স পর্যন্ত ফুটসাল নিয়েই পড়ে থাকেন। খেলার অভাবনীয় উন্নতি করেন সেই সময়, সেটা নজরে আসেন ফ্লুমিনেন্সের শীর্ষ কর্তাদেরও। উন্নতি পান ফ্লুমিনেন্সের ফার্স্ট টিমে। সব উন্নতি হয়তো সবার মনে টানে না, প্রথম টিমে যোগদান করার সুযোগ পেয়েও বিষণ্ন হয়ে পড়েন মার্সেলো। ফুটসালের সাথে অনেক দিনের সঙ্গীদেরকেও যে দূরে রেখে আসতে হয়েছে তখন। বন্ধুদের থেকে দূরে সরে আসা, পড়াশোনায় অনেক সময় কাটানো এভাবেই বিষণ্নতা গ্রাস করে ফেলে মার্সেলোকে। একদিন দাদাকে গিয়ে বলেও বসেন আর ফুটবলই খেলবেন না। এমন সিদ্ধান্ত শুনে দাদাও অবাক হয়ে যান। বলেছিলেন পরের ম্যাচে সুযোগ পেলে খেলা চালিয়ে যেতে আর না পেলে নিজের সিদ্ধান্তে এগিয়ে যেতে। বিধাতার আশীর্বাদে পরের ম্যাচে সুযোগ পান, আর আমরা আজকের মার্সেলোকে পাই।
ব্রাজিলে তখন বিশ্বসেরা খেলোয়াড়েরা মাঠ কাপাচ্ছিলেন, তারই একজন রবার্তো কার্লোস। নিজের পজিশনকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। সময় ফুরিয়ে আসার আগেই রবার্তোর রিপ্লেসমেন্ট চাই মাদ্রিদের, তারই পরিপ্রেক্ষিতে রবার্তোর রিপ্লেসমেন্ট খুঁজে পেতে আবারো ব্রাজিলেই চোখ দিলো মাদ্রিদ বোর্ডের কর্তারা। ফ্লুমিনেন্সে খেলা কোকড়া চুলো সেই তরুণকে তাদের চাই। মার্সেলোর কানেও সেই খবর গেলো, এই খবর শুনে নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না মার্সেলো। মাদ্রিদের আগে অবশ্য মার্সেলোকে চেয়েছিলো আরেক স্প্যানিশ জায়ান্ট সেভিয়া।ফ্লুমিনেন্সের সাথে তাদের চুক্তিপত্রও সই হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু এরপরেই মাদ্রিদের ইন্টারেস্টের কথা জানতে পারেন মার্সেলো। ফ্লুমিনেন্স বোর্ডকে জিজ্ঞেসও করেন মাদ্রিদের ইন্টারেস্টের সত্যতা কতটুকু। জানতে পেরে আর কোন দ্বিধা রাখেননি মনে, তল্পিতল্পা গুছিয়ে চলে আসেন মাদ্রিদে।
যেদিন মার্সেলোর প্রেজেন্টেশন সেদিন মাদ্রিদের বোর্ডকর্তারাসহ ৫৫ জন উপস্থিত ছিলেন সেখানে, এটা দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন মার্সেলো। মাদ্রিদে ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে আবার ফিরে এসেছিলো ফ্লুমিনেন্সের দিনগুলো। সুযোগ পাচ্ছিলেন না, বোর্ডকর্তাদের চাওয়া তিনি কাস্তিয়া খেলে নিজেকে প্রস্তুত করুক, কিন্তু কোচ ফ্যাবিও ক্যাপালোর আদেশে থেকে যান প্রথম টিমের সাথে। নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করে যান। শুরুর দিকে ট্যাকটিকালি অনেক সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতেন, তার উপর মড়ার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে কোচ ছিলেন ফ্যাবিও ক্যাপেলো। যিনি ডিফেন্সিভ কোচ না কিন্তু দলকে ডিফেন্সভলি সলিড দেখতে চান। শুরুর দিকে মানিয়ে নিতে সমস্যা হলেও রবার্তো কার্লোস তাকে সবসময়ই আগলে রেখেছিলেন, ব্যক্তিগতভাবেই পরিচর্যা করেছিলেন মার্সেলোকে। রবার্তো কার্লোস যখন মাদ্রিদের লেফটব্যাকের দায়িত্ব তাকে দিয়ে যান তখন হয়তো নির্ভার হয়েই অবসর নিয়েছিলেন।
শুরুর দিকের সব বাধা-ধকল পেরিয়ে হয়েছেন মাদ্রিদিস্তাদের আস্থার জায়গা, মাদ্রিদের হয়ে খেলেছেন সাড়ে পাঁচশোরও বেশি ম্যাচ। মাদ্রিদের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ট্রফি জয়ী প্লেয়ারের নামটিও তারই। ভীষণ আবেগী এই মানুষটা ফুটবলের কারুকার্য দিয়েই জায়গা করে নিয়েছেন মাদ্রিদিস্তাদের অন্তরে।
সফেদ সাদা জার্সিতে গোধুলী লগ্নের ছায়া পড়েছে, পড়ন্ত বিকেলে এক যোদ্ধা যুদ্ধ শেষে ক্লান্ত দেহ হেলিয়ে দিয়েছে। মৌসুম শেষেই বিদায় জানিয়েছেন আমাদের। ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলায় তার বাহুতে যোগ হয়েছে মাদ্রিদের ক্যাপ্টেনের আর্মব্যান্ডও। ৩৫তম লা লীগা ঘরে তুলেই বিদায় নিয়েছেন আমাদের পাগলাটে ব্রাজিলিয়ান।
ছোট ছোট চুলের গুচ্ছ আজ ঝাকড়া চুলে পরিণত হয়েছে,সঙ্গীসাথীরা একে একে সবাই দল ছেড়েছেন। এবার বিদায় নিলেন মার্সেলোরও। মার্সেলোও দল ছেড়েছেন, যোগ দিয়েছেন গ্রীস ক্লাব অলিম্পিয়াকোসে, সেখানেও তিনি হোন গ্রীক কোন দেবতা। সে আশা এবং প্রার্থনাই থাকবে চিরকাল। মার্সেলোকে চিরকাল স্মরণ করে রাখবো রবি ঠাকুরের কবিতার দুটো পঙক্তি দিয়েই;
"তোমারে যা দিয়েছিনু তা তোমারি দান,
গ্রহণ করেছ যতো ঋণী করেছি আমার।
হে বন্ধু, বিদায়"
মার্সেলো ভালোবেসেছিলেন মাদ্রিদকে, আর মার্সেলোকে? বুনো পাগলাটে এই লোককে বুঝি ভালো না বেসে থাকা যায়!
- 0 মন্তব্য