• ফুটবল

নেইমারের কাছে রোমারিওর খোলা চিঠি

পোস্টটি ১১৮৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

নেইমার,

 

সেই মুহুর্ত চলে এসেছে, তুমি জানো? সেই মুহুর্ত, ফুটবলীয় ভাষায় যা কিনা বালক আর পুরুষের পার্থক্য তৈরি করে। আমি জানি, তুমি ইতোমধ্যে অনেক বুলশি* কথাবার্তা শুনে এসেছো, অনেক অনেক সমালোচনা, আ লট অফ পিসিং এন্ড মোনিং, সেইসব মানুষের কাছে থেকে, যাদের কাজই হলো অন্যের ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে মাথাব্যথা দেখানো।

 

সুতরাং, প্রথম কথা বলি তোমায়: আমি এখানে স্মার্ট সাজতে আসিনি, তোমার জীবনের নিয়ম ঠিক করে দিতে আসিনি, তোমার কি করা উচিত, কি অনুচিত, তা নির্ধারণ করার আমি কেউ নই। 



আমি রোমারিও, খুব ভালোভাবেই জানি তুমি এখন কেমন অনুভব করছো! তবে এটাও সত্য যে এখন সবাই এই কথাটাই বলবে, তোমার অনুভূতি সবাই অনুভব করতে পারতেছে। কিন্তু বাস্তবতা আসলে ভিন্ন। ১৯৯৩'র কথাই বলি, মানুষ আমাকে নিয়ে যা তা বলতো, বিশ্বাস করো, সত্যিই বলতো! তারা মাঠে আমার আচরণ নিয়ে কথা বলতো, তারা সাংবাদিকদের দেওয়া আমার স্টেটমেন্ট নিয়ে সমালোচনা করতো, তাদের মতে আমি নাকি ছিলাম উশৃংখল! আমাকে সত্যি করে বলতে পারবা, ওরা আসলে কি চাইতো? এমন একজন খেলোয়াড় যে কিনা ওদের অনুমতি নিয়ে আমার জীবন চালাতে হতো!? অহ প্লীজ! 

 

যদি আমি সেই সেইন্ট হতাম, যা তাদের কাছে হয়তো আদর্শ, কিন্তু তবে আমি কখনোই রোমারিও হতে পারতাম না, আমি যা অর্জন করেছি তা পারতাম না৷ কিছুই সম্ভব হতোনা, দা ক্র‍্যাক প্লেয়ার, জেনুইন ইন দা বক্স, টপ স্কোরার, কিছুইনা! 

 

না, নেইমার, এইটা কিন্তু দাম্ভিকতা নয়, এইটাকে বলে আত্মবিশ্বাস!  

 

তোমার মতোই আমি অনেকদুর থেকে এসেছি, আমাকেও অনেক লড়াই সংগ্রাম করতে হয়েছে, সেইখান থেকেই আমি ফুটবলার হয়েছি, যা কিছু পাওয়ার সবকিছু অর্জন করেছি! 

 

ভিলা দা পেনহা'র দিনগুলোতে ফিরে তাকালে কেবল এটিই আমার চোখে ভাসে, আমি যদি সাহস আর মননশীলতা আঁকড়ে না থাকতাম তবে, কিছুই অর্জন করা হতোনা আমার! 

 

তাহলে প্রিয়, তোমাকে যা করতে হবে - জাস্ট বি ইওরসেল্ফ! মানুষ সমালোচনা করবেই, কিন্তু সেই মানুষই, সেই মিডিয়াই তোমার প্রশংসা করবে যখন তারা তোমার মনোভাবে সত্য খুঁজে পাবে!  এবং তুমি তা ভালো করেই জানো একজন খেলোয়ার কিভাবে তা অর্জন করতে পারে  ঠিক?? মাঠে??

 

ঠিক তোমার মতই নেইমার, আমিও ইউরোপে খেলেছি। সময়ের সাথে একটা জিনিস খুবই কমন হয়ে গিয়েছিল, তা হলো তারা সবাই আমাকে সম্মান করত।

 

আমার সময়ে আমার মতো খেলোয়াড়দের কে বলা হত - ব্যাড বয়েজ! 

 

কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা দুষ্ট কিংবা খারাপ কিছু করেছি! 

সত্য হলো আমার মনোভাব আমারই ক্ষতি করেছে, হ্যাঁ আমারই। 

 

শুধু ভেবে দেখো, আমি একজন ফুটবলার যে কিনা নিজের শরীরের যত্ন ঠিকঠাক নিচ্ছিল, ঠিক তোমরা এখন যেমনটা নাও; আমি ধারণা করি, কেবলই ধারণা - হয়তো আমি আরো একটি বিশ্বকাপ জিতিয়ে আসতে পারতাম। 

 

তোমার যা দায়িত্ব মাঠে পালন করো বাকি সবকিছু ভুলে যাও! 

 

ব্রাজিল ফ্যানরা অনেক সময়ই ভুলে যায় যে বিশ্বকাপের মত আসরে পারফর্ম করা কতটা কঠিন, যেখানে "ভুল" করার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই! 

 

এবং সবাই খুব ভালোভাবেই জানে তুমি মাঠে কি করতে পারো, কি করতে চাও!  তুমি তো ইউনিক, আলাদা, কজনই বা এমন আছে যারা কিনা মাঠে ফ্যানদের বু শুনতে শুনতে মাঠে নেমে, পরে পারফর্ম করে হাততালি অর্জন করতে পারে! কিন্তু এটাও সত্যি, যা তুমি মাথায় রাখবে, যত কিছুই হোক না কেনো, কোন কিছুই একা অর্জন করা সম্ভব নয়! আমি জানি, তুমি হয়তো তা ভালোভাবেই জানো। এখন আমি তোমাকে বলি, আমি কিভাবে তা জানলাম! 

 

আমরা যখন ১৯৯৪ তে যুক্তরাষ্ট্রে গেলাম, আমি সবাইকে বললাম যে আমরা বিশ্বকাপ জিততে পারি, শুরুতে হয়তো কেউই বিশ্বাস করেনি, কিন্তু হুট করেই সংবাদের শিরোনাম পাল্টে গেল "রোমারিও একাই 1994 বিশ্বকাপ জিতিয়ে আনলো"! কিন্তু এসব বুলশিট কথাবার্তা, আমি একা কিছুই করিনি! আমরা হয়তো তাফারেলের দৃঢ়তা ছাড়া কিছুই অর্জন করতে পারতাম না, যিনি কিনা বিশ্বকাপের আগেই কঠোর সমালোচনা সহ্য করে এসেছেন, তিনিই ইতালির বিপক্ষে পেনাল্টি শ্যূট আউটে আমাদের প্রধান অস্ত্র হলেন! 

 

আমি তোমাকে একটি বিশেষ ম্যাচের কথা বলি৷ এটি ছিল ১৪ই জুলাই, যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস! আমরাও কিনা আবার সেই যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষেই মাঠে নেমেছি, ম্যাচটি কঠিন ছিল, আরো কঠিন হয়ে যায়, লিওনার্দো লাল কার্ড খেয়ে মাঠ ছাড়ায়। চিন্তা করতে পারো, কি পরিমান প্রেশার!? রাউন্ড অফ ১৬ তেই, যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে হেরে, টুর্ণামেন্ট থেকে বাদ যাওয়া!? আমি যেন মাঠেই সমালোচনার উত্তাপ অনুভব করতে লাগলাম, যা হয়তো আমাদের জন্য বাইরে অপেক্ষা করছিল! 

 

"ব্রাজিল আর ফুটবলের দেশ নয়"

 

"২৪ বছর কোন জয় নেই! কি লজ্জাকর!”

 

"এই ব্রাজিল দলের সেরা কোন খেলোয়াড় নেই"

 

"আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হতে যাচ্ছে"

 

মাঠে তখন হুট করি আমি মিডফিল্ডার বনে গেলাম, এবং বল চাইতে লাগলাম, যেন আমি সামনে ইচ্ছামত মুভ করতে পারি। যুক্তরাষ্ট্রের খেলোয়াড়রা আমাকে ঘিড়ে ধরেছিল। একটা পর্যায়ে আমার একটি শট নেওয়ার সুযোগ এসেছিল, হয়তোবা আমি গোল পেতে পারতাম, কিন্তু আমি আরো সঠিক সিদ্ধান্ত নিলাম, দেখলাম বেবেতো আরো ভালো পজিশনে দাঁড়িয়ে, আমি তাকে বলটি পাস করলাম, টনি মিওয়ালা'কে পাশ কাটিয়ে জালের ডান কর্নারে পাঠিয়ে দিলো বেবেতো! বেবেতো আমাকে এসে বললো - আই লাভ ইউ! আমি যেন পুরো ব্রাজিলের সকল মানুষের ঠোঁটের ভাষা পড়ে ফেললাম, "উই লাভ ইউ"! অথচ ভেবে দেখো এরা কিনা একটা সময় আমাকে লোভী ডাকতো! এবং এর পরে আমাদের কাছ থেকে বিশ্বকাপ ছিনিয়ে নেওয়ার মতো আর কেউ ছিলনা! আমি তোমাকে এই গল্পটা এ কারণেই বললাম, তুমি যেন বুঝতে পারো যে একা কিছুই করা সম্ভব নয়, অন্তত বিশ্বকাপ জিততে হলে! 

images_voltaxMediaLibrary_mmsport_theplayertribune_01gj5y5fsevcfd4vc2n8

নেইমার, আমি অনেক বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পায়নি! ঈশ্বর জানেন, ১৯৯৮ কিংবা ২০০২ সালে খেলার সুযোগ পেলে, আমি কতটা উপভোগ করতাম! দুর্ভাগ্যবশত আমি পারিনি! এবং সেই একটিমাত্র বিশ্বকাপ যেখানে আমি শুরুর একাদশে ছিলাম, সেখানে আমি আমার টিমমেটদের কে নিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি, যেন আমি তা জিততে পারি!



মাথায় রাখবা, সবাই কেবলমাত্র আনন্দ, উৎসব এবং বিজেতাদেরকেই কথায় স্মরণ রাখে! কিন্তু অধিকাংশই মনে রাখবেনা, বিশ্বকাপের মতো আসরে ব্রাজিলের জার্সি পড়ে মাঠে নামা ঠিক কতটা চাপের, তাও আবার অনেক অনেক বছর বিশ্বকাপের শিরোপাহীন থাকা! 

 

অযাচিত তুলনায, মর্যাদাহানিকর কথাবার্তা, অন্তঃসারশূন্য সমালোচনা একজন খেলোয়াড়'কে ভিতর থেকে ভেঙেদেয়! কিন্তু তোমার ভিতরে সেই সক্ষমতা আছে যে কিনা আনন্দ নিয়ে ফুটবল খেলতে পারো, যে কিনা মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারো! ইউ আর ফাকিং গ্রেট ব্রো! 

images_voltaxMediaLibrary_mmsport_theplayertribune_01gj5zt1c61yqrnas99x

আমি তোমাকে একটা কথা বলি?? আমি যদি আবারো সেই ১৯৯৪ এর সময় ফিরে যেতে পারি, তবে আমি আলাদা কিছুই করতাম না, ঠিক আবার সময়ে যা করেছিলাম একইভাবে সেসবই করব, আমার গল্প লেখব! এবং আমি বিশ্বাস করি তুমিও সক্ষম হবে! ব্রাজিলিয়ানরা কমিটমেন্ট, ডেডিকেশন ভালোবাসে! 



আমি যখন দেখি তুমি মাঠে আছো, আমার মন ভরে যায়, কেনোনা আমি জানি তোমায়, আমি চিনি তোমায়, তোমার সেই উদ্দীপনা, যা কিনা ব্রাজিলিয়ানরা তোমার মাঝে দেখতে চায়! লড়ো, টিমমেদের সাথে নিয়ে লড়, যদি তা পারো তবে তোমার হাতেই ৬ষ্ঠ বিশ্বকাপ আসা সম্ভব!

 

এখন তোমার পালা, নেইমার! আই ট্রাস্ট ইউ! ব্রাজিল ট্রাস্ট ইউ! সৃষ্টিকর্তা তোমার মঙ্গল করুক! 



রোমারিও!

(প্লেয়ার্স ট্রিবিউন থেকে অনুদিত)