• ফুটবল

হিলসবোরো ডিজাস্টার : এক কালো অধ্যায়ের ইতিবৃত্ত

পোস্টটি ৪৯৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

মাঝে মাঝে বিশ্বে এমন কিছু অঘটন বা দূর্ঘটনা ঘটে, যা মুহূর্তের মধ্যে শেষ করে দেয় অসংখ্য প্রাণ, সেই সাথে শেষ হয়ে যায় অসংখ্য স্বপ্ন, অসংখ্য ভালোবাসা, অসংখ্য গল্প। সময়ের সাথে সাথে একসময় সেই অঘটন গুলো হয়ে পড়ে নিতান্তই অন্ধকার অতীত, কিন্তু তার রেশ কখনো কাটেনা। সেই দুর্বিষহ স্মৃতিগুলো ইতিহাসের পাতায় অমলিন থেকে যায় চিরকাল, সেখান থেকে মনের মণিকোঠায় অভিশপ্ত অধ্যায় হয়ে ফিরে আসে বারংবার।

চার্লি মার্টিন ও তাঁর একমাত্র ছেলে অ্যান্ড্রু মার্টিন। দুজনেই মার্সিসাইডের ক্লাব লিভারপুলের পাঁড় ভক্ত। নিয়মিত মাঠে গিয়ে দলের খেলা দেখা তাদের বহুদিনের অভ্যাস। বরাবরের মতো সেদিনও বাবা ছেলে মিলে খেলা দেখতে গিয়েছিলেন। এফএ কাপের সেমিফাইনালে সেদিন নটিংহ্যাম ফরেস্টের মুখোমুখি হয়েছিলো লিভারপুল। মার্টিনদের মতোই সেদিন খেলা দেখতে গিয়েছিলেন আরও অসংখ্য সমর্থক। কিন্তু এতো লোকের চাপ সহ্য করার ক্ষমতা ছিলোনা সেই ছোট্ট স্টেডিয়ামটির। ফলে প্রচুর লোক কে বাইরে রেখেই বন্ধ করে দেওয়া হলো গেইট।

প্রচন্ড ভীড় ঠেলে কোনোরকমে গ্যালারিতে জায়গাও করে নিয়েছিলেন চার্লি ও অ্যান্ড্রু। কিন্তু হঠাৎ ঘটে গেল সেই চরম বিভীষিকাময় ঘটনা। মাত্রাতিরিক্ত অসংখ্য মানুষের চাপ সইতে না পেরে মূহুর্তেই ভেঙে পড়লো স্টেডিয়ামের এক পাশ। চার্লি ও অ্যান্ড্রু বাবা ছেলে দুজন ছিটকে পড়লো দুপাশে। মুহূর্তের মধ্যে শত শত লোক একে অন্যের ওপর চাপা পড়তে শুরু করলো। সেই চাপ সইতে না পেরে সেখানেই মারা গেল অ্যান্ড্রু মার্টিন। ওদিকে তার বাবা চার্লি প্রাণে বেঁচে গেলেন, তবে পঙ্গু হয়ে গেলেন আজীবনের জন্য। একটি ছোট্ট সুখী পরিবার মুহূর্তের মধ্যে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। মারা গেলেন তাদের মতো আরও অসংখ্য মানুষ, পাশাপাশি শত শত লোক হলেন আহত। নির্মম ভাবে শেষ হয়ে গেল ফুটবল পাগল শত শত পরিবার। ঘটে গেলো ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাগুলোর একটা।

হিলসবোরো ডিজাস্টার। ইংলিশ ফুটবলে এ ঘটনা টা এমন এক দাগ রেখে গেছে, যে মুছে ফেলা অসম্ভব। সুন্দর ফুটবলেরও যে কিছু কিছু অংশ নির্মম, কুৎসিত, দুর্বিষহ হতে পারে, এটি তার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

image_search_1684013266466
১৯৮৯ সাল। নটিংহ্যাম ফরেস্টের ইউরোপসেরা জেনারেশন ততদিনে প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে। তারপর কোনোরকমে চূড়ান্ত অধঃপতন এড়াতে লড়াই করে যাচ্ছে। তো সেবার এফএ কাপে বেশ ভালোই করছিলো তারা। পৌঁছে যায় টুর্নামেন্টের সেমি ফাইনালে। সেমি ফাইনালে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো বেশ কঠিন প্রতিযোগিতা। প্রতিপক্ষ যে আর কেউ নয়, ইউরোপের অন্যতম পাওয়ার হাউজ লিভারপুল।

অবশেষে ঘনিয়ে আসে ম্যাচের নির্ধারিত দিন। ১৯৮৯ সালের ১৫ এপ্রিল। ম্যাচের জন্য নিরপেক্ষ ভেন্যু হিসেবে বেছে নেওয়া হয় দক্ষিণ ইয়র্কশায়ারের ক্লাব শেফিল্ড ইউনাইটেডের হোম গ্রাউন্ড হিলসবোরো স্টেডিয়াম।

খেলা শুরু হতে তখনও ঢের দেরি। দু দলের ফ্যানরা এসে জমায়েত হতে শুরু করেছে মাঠের আশেপাশে। জনপ্রিয় দুই দলের লড়াইয়ে দুদিক থেকেই এসেছে প্রচুর সমর্থক, বিশেষভাবে লিভারপুল থেকে। ইংল্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্লাব তখন লিভারপুল। তাই জনতার ঢল আসছিলো পশ্চিম ইংল্যান্ডের শহরটি থেকে। পাশাপাশি শেফিল্ডের আশেপাশেও লিভারপুলের সমর্থক কম ছিলোনা। প্রিয় দলের খেলা দেখার লোভ সংবরণ করতে না পেরে হাজির হয়ে গিয়েছিলেন তাদের অনেকেই।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বোঝা গেলো দর্শকসংখ্যা প্রত্যাশার তুলনায় অনেক বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ঝামেলা এড়াতে দু দলের সমর্থকদের জন্য স্টেডিয়ামে প্রবেশের দুটি আলাদা গেট খুলে দেওয়া হলো। টিকিটধারী লিভারপুল সমর্থকদের পাঠানো হলো লেপিং লেনের দিকে। লিপিং লেন দিয়ে ঢুকে ছিলো সাতটি টার্নস্টাইল, অতঃপর দুইটা টানেলের মধ্য দিয়ে  ঢুকে সরু একটা গেট তাদের নিয়ে যাবে গ্যালারিতে।

শুরুটা স্বাভাবিক ভাবে হলেও গোল বাধলো একটু পরেই। আগেই বলেছি, লিভারপুল সমর্থক ছিলো অত্যধিক। মাত্র সাতটা টার্নস্টাইল তাদের জন্য যথেষ্ট ছিলোনা। আর সমর্থকরাও বুঝতে পেরেছিলো দেরি করলে খেলা দেখার সুযোগ আর পাবেনা। তাই দশ হাজারের অধিক লোক একসঙ্গে সেদিক দিয়ে ঠেলে ঠুলে জবরদস্তি করে প্রবেশ করার চেষ্টা করতে থাকে।

image_search_1684013326251
খেলা শুরু হতে তখন মাত্র আধাঘন্টা বাকি। তখনও  প্রবেশের অপেক্ষায় স্টেডিয়ামের বাইরে দাঁড়িয়ে অর্ধেকের বেশি লোক। বাধ্য হয়ে দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা ডেভিড ডাকেনফিল্ড ম্যাচ শুরুর মাত্র আট মিনিট পূর্বে দর্শকদের প্রবেশের জন্য প্রস্থান গেট খুলে দেওয়ার নির্দেশ দেন। সঙ্গে প্রায় দু হাজার লোক একসাথে সেদিক দিয়ে প্রবেশ করে। ভেতরে পাশের টানেলগুলো তুলনামূলক ফাঁকাই ছিলো। কিন্তু দর্শকরা সেদিকে না গিয়ে সবাই একসাথে মেইন টানেলের দিকে যায়। সেদিক দিয়ে সবাই পৌঁছে যায় ৩ ও ৪ নাম্বার স্ট্যান্ডে। এদিকে আগে থেকেই এ দুটি স্ট্যান্ড ছিলো সবচেয়ে বেশি জনবহুল। তার সাথে এবার একসঙ্গে যোগ হয় এতগুলো মানুষ। আর ঠিক তখনই ঘটে যায় ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম স্মরণীয় ও ভয়াবহ সে ঘটনা।

মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে পড়ে সে দুটি স্ট্যান্ড। হাজার হাজার মানুষ একে অন্যের ওপর চাপা পড়তে শুরু করে। মুহূর্তের মধ্যে স্টেডিয়ামের সে পাশ টা পরিণত হয় এক ধ্বংস স্তুপে। ঘটনাস্থলেই পিষ্ট হয়ে তৎক্ষনাৎ মারা যায় অসংখ্য মানুষ। অনেকে মারা না গেলেও পঙ্গু হয়ে যায় চিরতরে। ছোট বড় ইঞ্জুরি মিলিয়ে আহত হয় শত শত লোক।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এত বড় দুর্ঘটনা যে ঘটে গেলো, তৎক্ষনাৎ সেখানে উপস্থিত অনেকে সেটা খেয়ালও করেনি। এমনকি বুঝতে পারেনি মাঠের স্টাফ, রেফারি, খেলোয়াড়রাও। এর মধ্যেই চলছিলো খেলা। সময়মতো উদ্ধার কাজ শুরু করতেও সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় দায়িত্বরত পুলিশ বাহিনী। ফলাফল দুর্ঘটনা রূপ নেয় আরও বিভীষিকায়।

সে দুর্ঘটনায় সর্বমোট ৯৭ জন লোক প্রাণ হারায়। বহুদিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর ১৯৯৩ সালে মারা যান তাদের একজন। আর মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে যাওয়ার পর আরও এক ভিক্টিম মারা যান গত ২০২১ সালে। পাশাপাশি বাজেভাবে আহত হন ৭৬৬ জন লোক।

পরবর্তীতে এ ঘটনার জন্য পুলিশ দায়ী করে লিভারপুল সমর্থকদের। তাদের বক্তব্য ছিলো, নেশা করে মাতাল অবস্থায় লিভারপুল ফ্যানদের উন্মত্ত কর্মকাণ্ডই এ ঘটনার জন্য দায়ী। দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা ডাকেনফিল্ড বলেন, প্রস্থান গেট খুলে দেওয়ার জন্য তাকে লিভারপুল ফ্যান রা চাপ প্রয়োগ করে। পাশাপাশি ৩ ও ৪ নাম্বার স্ট্যান্ড ভর্তি হয়ে যাওয়ার পরও বন্ধ না করায় স্টেডিয়ামের নিরাপত্তাকর্মীদের ওপরও দোষ চাপানো হয়। তবে পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে কেসের আর তেমন অগ্রগতি হয়নি। শেষে ১৯৯১ সালে এ পুরো ঘটনাটিকে দুর্ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে সবাইকে খালাস করে দেওয়া করে দেওয়া হয়।

image_search_1684013277119
এর বহুবছর পর ২০০৯ সালে পুরো ঘটনা অনুসন্ধানের জন্য নতুন করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তিন বছর তদন্ত শেষে এ কমিটি তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করে, যেখানে বলা হয় এ ঘটনার দায়ভার চাপা দিতে পুলিশ অনেক সত্য গোপন করে ও অনেক মিথ্যা রিপোর্ট দেয়। সমর্থকদের মাতাল হওয়া বা উন্মত্ত আচরণের সকল অভিযোগ বাতিল করে দেয় তারা। পাশাপাশি পুরো ঘটনার জন্যই পুলিশের দায়িত্ব অবহেলা কেই দায়ী করা হয়। সেই সঙ্গে এটাও বলা হয় যে পুলিশ যথাসময়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে আরও প্রায় ৪১ জন লোক কে বাঁচানো যেত। অবশেষে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে পূর্বপ্রকাশিত দুর্ঘটনা হিসেবে উল্লেখিত রিপোর্ট বাতিল করে দেওয়া হয়।

পরবর্তীতে ২০১৪ সালে আরেক দফা তদন্তে জানা যায়, প্রস্থান গেট খুলে দিতে চাপ প্রয়োগ করার জন্য লিভারপুল সমর্থকদের প্রতি ডাকেনফিল্ডের অভিযোগটিও ছিলো সম্পূর্ণ ভুয়া। পাশাপাশি ডাকেনফিল্ড এটাও স্বীকার করেন যে মেইন টানেল বন্ধ করতে তার ব্যর্থতাই দুর্ঘটনার পেছনে দায়ী। ২০১৬ সালে জুরি কর্তৃক ৯৬ জনের মৃত্যু কে "বেআইনীভাবে হত্যা" হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

পরের বছর ঘটনার সাথে জড়িত ছয়জনের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল চার্জ ফাইল করা হয় ও নতুন করে শুনানি শুরু হয়। ডাকেনফিল্ডের বিরুদ্ধে হত্যার ৯৫ টি অভিযোগ দাখিল করা হয়, কিন্তু আইনী জটিলতায় ১৯৯৩ সালের মৃত্যুর জন্য তার বিচার করা সম্ভব হয়নি। ডাকেনফিল্ডের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ট্রায়াল শেষ হয় অমীমাংসিত ভাবেই। পরে সে বছরই আবার দ্বিতীয় ট্রায়ালে তাকে নির্দোষ সাব্যস্ত করা হয়। এর মাঝে অভিযুক্ত অন্যান্য ব্যক্তিদেরও খালাস করা হয় বা চার্জশীট থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। সবশেষে একমাত্র দোষী হিসেবে সাব্যস্ত হন স্টেডিয়ামের নিরাপত্তা কর্মকর্তা গ্রাহাম ম্যাকরেল। ২০১৯ সালে "পর্যাপ্ত পরিমাণ টার্নস্টাইল সরবরাহে ব্যর্থতা"র দায়ে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে জরিমানা করা হয়।

এভাবেই শেষ পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হিলসবোরো ডিজাস্টার অধ্যায়। অনেক তদন্ত ও রহস্য উদঘাটনের পরও শেষ পর্যন্ত সুষ্ঠু বিচার সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ক্ষমতার জের, রাজনৈতিক টানাপোড়েন সহ নানা রকম ইস্যু কে কেন্দ্র করে শেষ পর্যন্ত মিমাংসা হয়েও যেন হয়নি এই ভয়াবহ ঘটনার। আর এখন আর সেটা সম্ভবও না, ভবিষ্যতেও আর হবেনা। সুতরাং বলা যায় এভাবে "শেষ হয়েও হইলোনা শেষ" হয়েই সমাপ্তি ঘটলো সে অধ্যায়ের।

image_search_1684013985781
এরপরও হিলসবোরো স্টেডিয়ামে শত শত ম্যাচের আসর বসেছে, লিভারপুল আর ফরেস্টও মুখোমুখি হয়েছে অসংখ্যবার। সেসব ম্যাচে বরাবরের মতোই ভীড় জমিয়েছে হাজার হাজার জনতা। সব চলেছে স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু মার্টিন পরিবারের মতো যেসব পরিবার বিধ্বস্ত হয়েছিলো চিরতরে, তারা কখনো ভুলতে পারেনি সে ঘটনা, ভুলতে পারবেও না। এখন সময়ের ফেরে নানান প্রেক্ষিতে ফিরে ফিরে আসে সেই হিলসবোরো ট্রাজেডি, যে অন্ধকার অধ্যায় ইতিহাসের পাতায় রয়েছে অম্লান হয়ে, থাকবে চিরকাল ধরে।