• ফুটবল

পুনর্জন্মের পর বিজয়ী হয়ে দুর্গ ছাড়লেন যোদ্ধা বেনজেমা

পোস্টটি ৬৩০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

বিদায়ের সুর বেজে উঠেছে দুনিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধ ক্লাবটাতে। একের পর এক তারকা যেন খসে পড়ছে ক্লাবের বিশাল আকাশটা থেকে। তবে করিম বেনজেমার বিদায়ে যেন আকাশের সবচেয়ে বেশি মেধাবী নক্ষত্রটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল ক্লাবের আকাশ থেকে। সবচেয়ে ধারালো অস্ত্রটাকেই এখন হয়ত তুলে রাখতে হচ্ছে, আর কোনোদিন বার্নাব্যুর সবুজ গালিচাতে হাতে ব্যান্ডেজ জড়িয়ে খেলতে নেমে যাবেন না বেনজেমা, রিয়ালের সাদা জার্সিতে আর না।

 পুনর্জন্মের পর বিজয়ী হয়ে দুর্গ ছাড়লেন যোদ্ধা বেনজেমা 2                          বিদায়বেলায় করিম বেনজেমা। 

 

২০০৯ সালে যখন রিয়াল মাদ্রিদে এসেছিলেন বেনজেমা, নামডাক ছিল খুবই কম। অল্প কিছু মানুষ হয়ত চিনত, নাম জানত। ২০২৩ সালে এসে যখন বিদায় নিচ্ছেন পুরো দুনিয়া চিনে গেছে একজন করিম বেনজেমাকে। জেনেছে একজন বেনজেমার আত্মত্যাগ কিংবা ধারালো পারফরম্যান্স সম্পর্কে। মাঝের সময়টায় বহু চড়াই উতরাই পার করেছেন বেনজেমা। হয়েছেন ঘৃণিত, সমালোচিত। আবার সেই সমালোচনাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সমর্থকদের ভালোবাসায় সিক্তও হয়েছেন। মাঝের সেই পুনর্জন্ম কিংবা পালাবদলের সময়টাই মহিমান্বিত করেছে বেনজেমাকে। বিশেষ এই সময়টার জন্যই বিখ্যাত হয়ে থাকবেন বেনজেমা। এই সময়ের জন্যই আজীবন মনে রাখা যায় বেনজেমাকে।

 

সদ্য রিয়ালে পা দেওয়া ২২ বছরের বেনজেমার মধ্যে বিশেষ তেমন কিছু ছিল না। ধীরে ধীরে বার্নাব্যুর সবুজ গালিচা মাড়িয়েছেন বেনজেমা। ধীরে ধীরে ধারালো হয়েছে বেনজেমার পা। প্রথাগত স্ট্রাইকারদের মতই গোল করার দক্ষতাটা ভালো হতে থাকে বেনজেমার। একাদশেও নিয়মিত হতে শুরু করলেন আস্তে আস্তে।

 

২০১৪-১৫ মৌসুম পর্যন্ত সময়টা ভালোই কেটেছে বেনজেমার। বিশেষ করে ২০১৪-১৫ মৌসুমে তো ছিলেন ফর্মের তুঙ্গে। সেবার ট্রফিলেস মৌসুমেও রিয়ালের জার্সিতে আলো ছড়িয়েছিলেন তিনি। খরাটা শুরু হয় পরের মৌসুম থেকে। একসময় গোলের পর গোল করা বেনজেমা যেন খেই হারিয়ে ফেললেন। চোট তো ছিলই তার সাথে মারাত্মক অবনতি হয়েছিল বেনজেমার ফিনিশিংয়েরও। গোলপোস্টের একদম সামনে থেকেও বহুবার সহজ সুযোগকে গোলে পরিণত করতে ব্যর্থ হয়েছেন বেনজেমা। একের পর এক মিসে বেনজেমার সমর্থকদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়ে যাওয়া যেন শুরু হল।

 

তবে তখন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো নামের এক সুপারহিরো ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদে। যত মিসই বেনজেমা করুন না কেন তা পুষিয়ে দেওয়ার জন্য রোনালদো তো ছিলেনই। টুকটাক অ্যাসিস্ট করে রোনালদোকে সাহায্য করার কাজটা মাঝেমধ্যেই করতেন বেনজেমা। কিন্তু তাতে কী হবে? স্ট্রাইকারের আসল কাজই তো গোল করা। সেই আসল কাজটা করতেই বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলেন বেনজেমা। সমর্থকদের রাগ-ক্ষোভও বাড়ছিল বেনজেমাকে ঘিরে।

 

মাঝের সময়ে এক জাদুকরের জাদুর কাঠির পরশ পেয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ। ২০১৬ সালের শুরুর দিকে রিয়ালের কোচের দায়িত্ব নেওয়া জিনেদিন জিদান খুব কাছে দেখেছেন বেনজেমার খারাপ সময়টা। ডাগআউটে বহুবার রাগান্বিত অবস্থাতেও দেখা গেছে জিদানকে। বেনজেমার এত এত মিস সহ্য করতে হয়ত জিদানেরও কষ্টই হচ্ছিল। কিন্তু এতকিছুর পরেও প্রিয় শিষ্য বেনজেমার ওপর থেকে আস্থা হারাননি জিদান। একের পর এক ম্যাচে বেনজেমাকে সুযোগ দিয়ে গেছেন তিনি। বহু সমালোচনা কিংবা কটাক্ষের পরেও রিয়ালের ৯ নম্বর জায়গাটায় অধীন ছিলেন বেনজেমা, জিদান আস্থা রেখেছিলেন বলেই।

 

২০১৭-১৮ মৌসুমের শেষে রিয়ালে শেষ হয় রোনালদো অধ্যায়। জিদানও ছাড়েন রিয়ালকে। তবে বেনজেমা ছাড়েননি। দুর্দিনে দলের ত্রাতা হয়ে ওঠেন বেনজেমা। কোটি ভক্তের সমালোচনায় বিদ্ধ বেনজেমা যেন পুনর্জন্ম পেলেন রোনালদোর বিদায়ের পরই। রোনালদো পরবর্তী যুগে রিয়ালে যখন কে দেবে আশা? কে দেবে ভরসা? রকম অবস্থা হওয়ার যোগাড় ঠিক তখনই দলকে উদ্ধার করার অভিযানে নেমে যান বেনজেমা। গোলের খাতাটা ভরিয়ে ফেলেন একের পর এক গোলে। অ্যাসিস্টের তালিকাটাও ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করে।   

 

যেই ফিনিশিং নিয়ে এত এত সমালোচনা হল সেই ফিনিশিংয়েই ব্যাপক উন্নতি আনলেন বেনজেমা। মাঝের সময়টায় একের পর এক মিস করা বেনজেমা পরিণত হয়ে গেলেন নিখুঁত এক স্ট্রাইকারে। সুযোগ পেয়ে তার সদ্ব্যবহার করে গোল করাই যার নিয়মিত কাজ। নিখুঁত ফিনিশিংয়ে গোলের পর গোল করা শুরু করলেন বেনজেমা। নিন্দুকদের সমালোচনায় ভাঁটা পড়লো হালকা।

 পুনর্জন্মের পর বিজয়ী হয়ে দুর্গ ছাড়লেন যোদ্ধা বেনজেমা 3

 

ধীরে ধীরে আরও বেশি ক্ষুরধার হতে শুরু করলেন তিনি। মাঝে এক মৌসুমের বিরতির পর আবারও রিয়ালে ফিরলেন জিনেদিন জিদান। আগের আমলে রোনালদোর রিয়াল মাদ্রিদকে টানা তিন তিনটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের গৌরব এনে দিয়েছিলেন জিজু। পুরনো দায়িত্ব নতুন করে গ্রহণ করে সেই ধারা কি অব্যাহত রাখতে পারবেন তিনি? এবারে তো রোনালদো নেই, ভুরু কুঁচকেছিলেন অনেকেই। রোনালদোবিহীন রিয়ালেও সাফল্য এসেছিল জিদানের হাত ধরে। টালমাটাল এক দলকে স্থিতিশীল করলেন জিদান। দ্বিতীয় মেয়াদে নিজের প্রথম পুরো মৌসুমেই জেতালেন লিগ। আর সেই লিগ জেতানোয় একদম সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিলেন করিম বেনজেমা। গোল-অ্যাসিস্ট, মাঠের চারদিকে আধিপত্য বিস্তার করে খেলা – এ যেন নতুন এক করিম বেনজেমা!

 

বেনজেমার পারফরম্যান্স দিনদিন হতে থাকল ক্ষুরধার। ফিনিশিংয়ে অভূতপূর্ব উন্নতি এনে একের পর এক গোল করতে থাকলেন তিনি। নিন্দুকদের সমালোচনার সেই মুখটাও বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করল। রোনালদো পরবর্তী যুগে এডেন হ্যাজার্ডকে নিয়ে আশায় বুক বেঁধেছিলেন সমর্থকেরা, লস প্রজেক্ট হ্যাজার্ড কাজে না আসলেও দলের দায়িত্বটা দারুণভাবে নিজের কাঁধে নিয়ে নেন বেঞ্জু। হাতের ভাঙ্গা আঙুলে ব্যান্ডেজ বেঁধে মাঠের এই প্রান্ত থেকে অই প্রান্ত দাপিয়ে বেড়াতে থাকেন। দলের মূল কান্ডারিই যেন হয়ে উঠলেন। দলের প্রতি তার এমন অসামান্য নিবেদনে একসময়ে বেনজেমার ঘোরতর নিন্দুকরাও যেন ধীরে ধীরে হয়ে উঠতে শুরু করলেন তার সমর্থক।

 

জিদানের বিদায়ের পর লা ডেসিমা জেতানো কোচ কার্লো আনচেলত্তির উপর আস্থা রাখল রিয়াল। তার প্রথম মৌসুমেই যেন অগ্নিমূর্তি ধারণ করলেন বেনজেমা। লা লিগার সাথে চ্যাম্পিয়ন লিগের ইউরোপিয়ান ডাবল জিতল রিয়াল, মূল নায়ক কে ছিলেন? অবশ্যই করিম বেনজেমা। একটা সময় দলের বোঝা হয়ে যাওয়া বেনজেমাই এবার দলের উদ্ধারকর্তা, দলের জয়ের নায়ক। জিতলেন ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার ব্যালন ডি অরও। নিন্দুকরা দল বেঁধে হয়ে গেল বেনজেমার বড় সমর্থক।

 

পরের মৌসুমটা আহামরি ভালো কাটেনি রিয়ালের, ভালো কাটেনি বেনজেমারও। রিয়াল থেকে অবসরে যেতে চাইলেও সেই ইচ্ছা পূরণ করতে পারেননি তিনি। বিদায় বলে দিয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদকে। রিয়ালের সাদা জার্সিতে শেষ ম্যাচটায় দারুণ এক গোলও করেছেন।

 পুনর্জন্মের পর বিজয়ী হয়ে দুর্গ ছাড়লেন যোদ্ধা বেনজেমা 5

 

একসময় বেনজেমাকে বেচে দেওয়ার জন্য প্রার্থনায় নিমজ্জিত ছিল বিশাল এক জনগোষ্ঠী, তারাই এখন অশ্রুজলে ভাসছেন তার বিদায়ে। লর্ড বেনজেমা, কদু বেনজেমা, মিস্টার অফসাইড কিংবা আরও কত তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের নামই ছিল বেনজেমার। সবকিছু ছাপিয়ে ক্যারিয়ারের শেষ ভাগে এসে এই বেনজেমার ওপরই শরীরের প্রতিটা কোষ দিয়ে ভরসা করেছিলেন একেকজন মাদ্রিদ সমর্থক। এমন বিশাল এক নিন্দুকগোষ্ঠীকে সমর্থকগোষ্ঠীতে পরিণত করা- ফুটবলে কে দেখেছে কবে? অন্য কোনো খেলাতেও কি দেখা গেছে? জানা নেই। থাকার কথা নয়। থাকলেও এতটা তীব্রভাবে থাকার কথা নয়। এসব জায়গাতেই অনন্য হয়েছেন বেনজেমা। মাহাত্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে বেনজেমার গল্প।

 

Karim The Dream!

King Karim!

Guru Benzema!

Guruji!

Kingzema!

GOATZEMA!

 

আরও কত আদুরে নামই না পেয়েছেন বেনজেমা। সমালোচনাটা যতটা তীব্র ছিল প্রশংসাটাও যেন ততটাই তীব্র হল। ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করে নিন্দুকগোষ্ঠীকে সমর্থকগোষ্ঠীতে পরিণত করাই যেন বেনজেমাকে মহিমান্বিত করেছে, অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। দুনিয়াকে বড় একটি শিক্ষাও দিয়েছে। হাল ছেড়ে না দিয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছে। আসলেই তো, আমরা চাইলে কী না করতে পারি!

 

এভাবেও ফিরে আসা যায়!

এভাবেও দেখিয়ে দেওয়া যায়!

এভাবেও যুদ্ধ জয় করা যায়!

এভাবেও বিজয়ী হওয়া যায়!

এভাবেও করিম বেনজেমা হওয়া যায়!

রিয়ালের সাদা দুর্গের সবচেয়ে চৌকস যোদ্ধাটাই যেন বিদায় নিলেন এবার। পুনর্জন্মের পর বিজয়ী বেশেই নিলেন।