দ্য হিস্টোরিক্যাল জার্নি অব দ্য হ্যাটার্স
পোস্টটি ৯৩৬ বার পঠিত হয়েছেমাত্র ৯ বছরের ব্যবধানে শেকড় থেকে শিখরে, একটা জার্নি কতটা রোমাঞ্চকর হতে পারে?
লন্ডন থেকে ৩০ মাইল উত্তরে ছোট্ট এক শহরতলী। নাম তার লুটন। সে শহরেই ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় লুটন টাউন ফুটবল ক্লাব। ঐতিহাসিকভাবে এলিটদের কাতারে কখনো নাম লেখাতে না পারলেও উত্থান পতন দেখেছে অসংখ্যবার। তবে সবচেয়ে বড় অধঃপতনের সূচনা হয় গত শতকের শেষদিকে। ১৯৯২ সালে, যখন ইংলিশ ফার্স্ট ডিভিশনের বিলুপ্তি ঘটে, প্রতিষ্ঠিত হয় প্রিমিয়ার লিগ, ঠিক সেবারই রেলিগেশনের শিকার হয় হয় লুটন টাউন। নব্য প্রতিষ্ঠিত প্রিমিয়ার লীগে আর খেলা হয়নি। এরপর ধারাবাহিকভাবে শুধু অধঃপতনই দেখে গিয়েছে এ ক্লাব টি। পয়েন্ট কর্তন, আর্থিক অনিয়ম, ম্যানেজমেন্টে অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি সব মিলিয়ে প্রায় দেউলিয়া হওয়ার অবস্থা হয় তাদের। অবশেষে একদম অপেশাদার লিগে গিয়ে শেষ হয় তাদের এ পশ্চাৎযাত্রা।
২০০৮-০৯ সিজনে ইংলিশ ফুটবলের পেশাদার লিগগুলোর সবচেয়ে নিচের ডিভিশন ফুটবল লিগ টু তে থাকা অবস্থায় নানারকম আর্থিক অসংগতির জের ধরে ৩০ পয়েন্ট কর্তনের শিকার হয় লুটন টাউন। আর এতে করে অবনমন হয়ে পড়ে অবশ্যম্ভাবী। অবশেষে ২০০৯-১০ সিজনে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অপেশাদার কনফারেন্স লিগে পা রাখে লুটন।
নামে ভারে অপেশাদার লিগের অন্য দলগুলোর তুলনায় অনেক এগিয়ে থাকা লুটন শুরু থেকেই ছিলো প্রমোশনের জন্য সবচেয়ে ফেভারিট। কিন্তু বাস্তবে যাত্রাটা সহজ হয়নি একদমই। প্রতি মৌসুমেই মনে হচ্ছিলো এবারই হয়তো হয়ে যাবে, ফিরে যাবে পেশাদার লিগে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হচ্ছিলোনা। প্রথমবার প্রোমোশন প্লে অফের সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নেওয়ার পর টানা দুইবার বিদায় নেয় ফাইনালে হেরে।
এমনিভাবে ক্লাবের যখন চরম দূরাবস্থা চলমান, ঠিক তখন নিরুপায় হয়ে ম্যানেজমেন্ট লুটনেরই সাবেক খেলোয়াড় জন স্টিল কে নিয়োগ দেয় কোচ হিসেবে। কোচ হয়ে এসে অনেক প্রচেষ্টায় বেশ কিছু খেলোয়াড় কে দলে ভেড়ান স্টিল। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পেলি রুডক এমপাঞ্জু, যিনি পরবর্তীতে ক্লাবের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হন এবং এখনো লুটনের জার্সি গায়েই মাঠ মাতিয়ে চলেছেন।
স্টিলের ফুটবল স্ট্র্যাটেজি ছিলো প্রচন্ড আক্রমণাত্মক, যা লুটন কে এক প্রকার গোলস্কোরিং মেশিনে পরিণত করে। নিজের প্রথম সিজনেই দ্বিতীয় পজিশনে থাকা ক্যামব্রিজ ইউনাইটেডের চেয়ে ১৯ পয়েন্ট এগিয়ে থেকে ১০১ পয়েন্ট নিয়ে কনফারেন্স লিগ জিতে নেয় স্টিলের লুটন টাউন।
লিগ টু তে ফিরে আসার পর শুরুতেই আগের সিজনের দলের সেরা তারকা ও প্রোমোশনের সবচেয়ে বড় কারিগর ৩৮ গোল করা স্ট্রাইকার আন্দ্রে গ্রে কে হারায় লুটন। এর সাথে অল আউট এটাক ট্যাকটিক থেকেও বের হয়ে আসতে হয় তাদের। অনেক দেখে শুনে ভেবে চেন্তে ট্রান্সফার গুলো হ্যান্ডেল করতে হয়। এসময় তাদের মূল লক্ষ্য ছিলো যতটা সম্ভব ফ্রি তে প্লেয়ার সাইন করা ও স্কোয়াড ডেপথ ঠিক রাখা যেন খেলোয়াড়দের কম্পিটিটিভ মনোভাব বজায় থাকে।
তবে এরপরও পরবর্তী প্রোমোশনের জন্য আরও তিন সিজন অপেক্ষা করতে হয় তাদের। এর মাঝে লিগ টু তে দ্বিতীয় সিজনে ১৭ তে থেকে সিজন শেষ করে লুটন, কোনোরকমে এড়ায় অবনমন। এমন হতাশাজনক পারফর্মেন্স এর ফলস্বরূপ বরখাস্ত হন কোচ জন স্টিল। তার স্থলাভিষিক্ত হন অনভিজ্ঞ নাথান জোন্স, যার পূর্বের কোচিং এক্সপেরিয়েন্স ছিলো শূন্যের কাছাকাছি। ব্রাইটনে মাত্র একসপ্তাহ কেয়ারটেকার ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, এটাই ছিলো তার একমাত্র কোচিং এক্সপেরিয়েন্স।
এমন অনভিজ্ঞ এক লোক কে প্রধান কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়াটা শুরুতে বেশ সমালোচিত হয়েছিলো। তবে সেসব সমালোচনার জবাব জোন্স ভালোমতোই দেওয়া শুরু করলেন। লুটনের ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন এ ওয়েলশম্যান। নিজের প্রথম সিজন শেষ করলেন লিগ টেবিলের এগারো তে থেকে।
লুটন নিয়ে নাথান জোন্সের বেশ বড় পরিকল্পনা ছিলো, এবং তিনি সে মোতাবেকই এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর প্রথম লক্ষ্য ছিলো দলকে লিগ ওয়ানে প্রোমোট করা, আর এর জন্য তার পূর্বসূরি জন স্টিলের ট্রান্সফার স্ট্র্যাটেজি ফলো করতে শুরু করলেন। তার হাত ধরে লুটনে পা রাখে ইংলিশ স্ট্রাইকার ড্যানি হিলটন, যিনি লুটনের হয়ে অভিষেক মৌসুমেই ২৭ গোল করেন। লুটন সেবার চতুর্থ হয়ে লিগ শেষ করে। তবে প্রোমোশন প্লে অফে হেরে সেবারের মতো লিগ টু তেই ক্ষান্ত দিতে হয়।
পরের মৌসুমে অবশেষে লক্ষ্য পূরণ হয়। এবার আর প্লে অফ মাড়াতেই হয়নি। ২০১৭-১৮ মৌসুমে লিগে রানার্সআপ হয়ে সরাসরি লিগ ওয়ানে প্রোমোশন পেয়ে যায় লুটন টাউন।
তবে সুসংবাদ আর দুঃসংবাদ লুটনের জন্য বারবার একসাথেই আসছিলো। আগেরবার লিগ টু তে প্রোমোশনের পর হারাতে হয়েছিলো দলের সেরা তারকা আন্দ্রে গ্রে। আর এবার লিগ ওয়ানে প্রোমোশনের পর হারাতে হয় এ যাত্রার সবচেয়ে বড় কারিগর কোচ নাথান জোন্স কে। লুটন ছেড়ে স্টোক সিটি তে যোগ দেন জোন্স। তার স্থলে অস্থায়ী ভাবে কোচ নিযুক্ত হন মিক হারফোর্ড।
তবে হারফোর্ড হতাশ করেননি একদমই। সে সিজনে লুটনের গড়পড়তা দল নিয়েই চমকে দেন সবাইকে। প্রোমোশন পাওয়ার পর প্রথম সিজনেই লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন হয় লুটন টাউন। এবং সেই সাথে বহু বছর পর আবার পা রাখে চ্যাম্পিয়নশিপে।
তবে চ্যাম্পিয়নশিপে যাত্রাটা সহজ ছিলোনা একদমই। এখানে শক্ত প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হয় তাদের। নতুন কোচ গ্রায়েম জোন্সের আন্ডারে প্রথম সিজনের বেশিরভাগ সময়টাতেই রেলিগেশন জোনে কাটাতে হয় তাদের। অন্যদিকে স্টোক সিটির দায়িত্বে থাকা নাথান জোন্সও বেশ বাজে সময় কাটাচ্ছিলেন। লিগের অন্যতম শক্তিশালী স্কোয়াড নিয়েও আশানুরূপ পারফর্মেন্স আসছিলোনা।
সিজনের শেষদিকে এপ্রিল মাসে জোন্স কে বরখাস্ত করে স্টোক সিটি। এদিকে ধুঁকতে থাকা লুটন আবারও ভাগ্য ফেরানোর আশায় নিজেদের সাবেক গুরু কে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। অবশেষে আবারও হ্যাটার্সদের ডাগআউটে ফিরে আসেন নাথান জোন্স। প্রত্যাবর্তনের গল্প টা হয়েছিলো রূপকথার মতোই। তার হাত ধরে সিজনের শেষ পাঁচ ম্যাচ অপরাজিত থেকে সেবারের মিশন শেষ করে লুটন। সেই সাথে কোনোরকমে এড়ায় অবনমন।
পরের মৌসুমে চ্যাম্পিনশিপের কঠিন পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য বেশ ভালো মানের একটা দল গড়ে তোলে লুটন টাউন। ফ্রি তে দলে ভেড়ায় অভিজ্ঞ কাল নেইস্মিথ ও জর্ডান ক্লার্ক কে। সেই সাথে বেশ কিছু তরুন খেলোয়াড় কে লোনে নিয়ে আসে।
ফলাফল আসছিলো আস্তে আস্তেই। আগের মৌসুমে রেলিগেশন ব্যাটলে যুঝতে থাকা লুটন এবার ১২ তে থেকে লিগ শেষ করে। তবে সামারে ট্রান্সফার উইন্ডোতে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। কারণ ফিনান্সিয়ালি লিগের অন্য দলগুলোর তুলনায় সবসময়ই অনেক পিছিয়ে ছিলো লুটন। যেখানে প্রতিপক্ষ দল গুলো প্রচুর ব্যয় করে দল গুছিয়ে নিচ্ছিলো, সেখানে তাদের ফ্রি তে চারটা প্লেয়ার সাইন করেই ট্রান্সফার উইন্ডো তে ক্ষান্ত দিতে হয়।
তবে এ দল নিয়েই নাথান জোন্সের হাত ধরে লিগে ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করে যাচ্ছিলো হ্যাটার্সরা। পুরো সিজন ধরে তারা এ ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। অবশেষে ছয়ে থেকে ২০২১-২২ মৌসুম শেষ করে লুটন টাউন, সেই সাথে প্রথমবারের মতো প্রমোশন প্লে অফ খেলার সুযোগ হয়। তবে সে গল্পটা সুখকর ছিলোনা। হাডার্সফিল্ডের কাছে হেরে প্লে অফের সেমিফাইনাল থেকে ফিরে আসতে হয়। প্রিমিয়ার লিগে প্রত্যাবর্তনের গল্পটা আরও একবার থেকে যায় অসমাপ্ত।
তবে হাল ছাড়ার পাত্র নয় হ্যাটার্সরা। ২০২২-২৩ মৌসুমের শুরুর দিকেই ম্যানেজারের আসনে আসে পরিবর্তন। বিদায় নেন নাথান জোন্স। তার স্থলাভিষিক্ত হন তরুণ রব এডওয়ার্ডস। সিজনের শুরুতে ওয়াটফোর্ডের হয়ে ১০ ম্যাচের মাত্র তিনটিতে জয় পেয়ে বরখাস্ত হওয়া এডওয়ার্ডসের জন্য লুটন ছিলো বেশ বড় ধরনের একটা চ্যালেঞ্জ।
তবে এ ইংলিশম্যান হতাশ করেননি একদমই, বরং তাঁর আন্ডারে দলের পারফর্মেন্স ছিলো প্রত্যাশার চেয়েও ওপরে। সিজনের প্রথমার্ধে একটু স্ট্রাগল করলেও দিনকে দিন লুটন আরও ধারাবাহিক হয়ে উঠছিলো। অবিশ্বাস্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ চ্যাম্পিয়নশিপে শেষ পর্যন্ত ধারাবাহিকতা বজায় রাখে লুটন। অবশেষে তৃতীয় হয়ে সিজন শেষ করে তারা। আবার সামনে এসে দাঁড়ায় সেই প্রোমোশন প্লে অফ।
তবে এবারের লুটন ছিলো আগেরবারের চেয়ে অনেক বেশি পরিপূর্ণ, অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। প্লে অফ সেমিফাইনালের প্রথম লেগে সান্ডারল্যান্ডের বিপক্ষে ২-১ গোলে হারলেও পরের লেগে ঘুরে দাঁড়ায়। সেকেন্ড লেগ ২-০ তে জিতে পৌঁছে যায় প্লে অফ ফাইনালে। কভেন্ট্রি সিটির বিপক্ষে শ্বাসরুদ্ধকর সে ম্যাচটি ১-১ সমতায় শেষ হওয়ার পর খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। অবশেষে পেনাল্টি শুট আউটে ৫-৬ ব্যবধানে ম্যাচ জিতে নেয় লুটন টাউন। সেই সাথে সম্পূর্ণ করে তাদের ঐতিহাসিক যাত্রা। নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পৌঁছে যায় স্বপ্নের প্রিমিয়ার লিগে!
নয় বছর! মাত্র নয় বছরের ব্যবধানে অপেশাদার লিগ থেকে ইংলিশ ফুটবলের সর্বোচ্চ চূড়া প্রিমিয়ার লিগ, ভাবতে পারেন? এ যেন রূপকথা কেও হার মানায়।
আগামী ১২ আগস্ট ব্রাইটনের বিপক্ষে ম্যাচের মধ্য দিয়ে প্রিমিয়ার লিগে যাত্রা শুরু করবে হ্যাটার্সরা। প্রিমিয়ার লিগের বাঘা বাঘা সব দলের বিপক্ষে ছোট্ট লুটনের এ যাত্রাটা কঠিন থেকে কঠিনতর হতে যাচ্ছে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এখানে টিকে থাকতে গেলেও যে তাদের অসম্ভব কে সম্ভব করতে হবে। তবে নাম টা তো লুটন টাউন। তারা গত ৯ বছরে যা করেছে, সেটার যে এখানেই পরিসমাপ্তি তাই বা কে বলতে পারে? হয়তো রূপকথার অনেক প্লটই এখনো বাকি। হয়তো সামনে অপেক্ষা করছে আরও কিছু চমক।
বাকি গল্পটা বলার দায়িত্ব আপাতত সময়ের ওপরেই থাক।
- 0 মন্তব্য