রবার্ট লেওয়ানডস্কি, বার্সেলোনার আক্রমণভাগ এবং কিছু কথা
পোস্টটি ৯৭০ বার পঠিত হয়েছেগত অক্টোবরের চার তারিখে পোর্তোর বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ম্যাচে ইনজুরিতে পড়ার পর থেকে সাম্প্রতিক এল ক্লাসিকো-নিজের স্বরূপ পুনরুদ্ধার করতে প্রাণপণ সংগ্রাম করে যাচ্ছেন রবার্ট লেওয়ানডস্কি। বিভিন্ন সূত্রমতে জানা যায়, ৩৫ বছর বয়সী এই পোলিশ স্ট্রাইকারের কাছে নাকি ব্যথানাশক ইনজেকশন নিয়ে মাঠে নামার পথ থাকলেও সেই পথ অনুসরণ করতে চাননি -তা এল ক্লাসিকোতে সম্পূর্ণরূপে ফিট অবস্থায় নামতে যতই উদগ্রীব থাকুন না কেন তিনি!
লেওয়ানডস্কিকে নিয়ে জাভির পরিকল্পনায় তেমন একটা বৈচিত্র্য কখনোই ছিলো না। এল ক্লাসিকোতে ফেরান তোরেসের পরিবর্তে তিনি মাঠে নামেন ৬১তম মিনিটের মাথায়। জুড বেলিংহামের জোড়া গোলে এগিয়ে থাকা ম্যাচটায় যেমন বার্সা শেষ পর্যন্ত লিগে খুইয়েছে তিন পয়েন্ট, তেমনি নামার পর থেকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিষ্প্রভ ছিলেন লেওয়া নিজেও। গোটা ম্যাচে ২০ বার বল টাচ করেছিলেন তিনি-তার মধ্যে মাদ্রিদের বক্সে মাত্র একবার। এ তালিকায় বার্সার সকল খেলোয়াড়ের মধ্যে একমাত্র লামিন ইয়ামালই তার পেছনে আছেন, তাও মাত্র ১৫ মিনিট খেলার কারণে।
১৪টির মধ্যে ১০টি সফল পাস, আটবার বলের দখল হারানো, বক্সের কিনার থেকে একটিমাত্র শট নেওয়া-তাও আবার অফ টার্গেটে। একজন স্ট্রাইকারের এহেন পরিসংখ্যান দেখেই অনুমান করা যায় যে গোটা ম্যাচে তার টিম কন্ট্রিবিউশনের অবস্থা ঠিক কেমন ছিলো!
অবশ্য লেওয়ানডস্কি উনুনে চাপানো কোনো ভাতের হাঁড়ি নন, যে একটিমাত্র দানা দেখেই রান্নার হালচাল বোঝা যাবে! প্রায় একমাস পর সাইডলাইন থেকে ফিরেছেন ১২০ গজের ভেতর, ফিটনেসও ছিলো না তেমন সন্তোষজনক। যদিও এ কথা একেবারে ফেলে দেওয়া যায় না যে আক্রমণভাগে বার্সেলোনা আর লেওয়ানডস্কির যুগপৎ মুখ থুবড়ে পড়ার ব্যাপারটাও নতুন কিছু নয়!
“বিশ্বকাপের পর থেকেই আমাদের আক্রমণভাগকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে। শুধু ম্যাচ জেতার কথা বলছি না, বরং বেশি বেশি সুযোগ তৈরী করা এবং তার সদ্ব্যবহার করা-অর্থাৎ, বেশি বেশি গোল করার কথাও বলছি। সাম্প্রতিক কালে এই দিকটায় উন্নতি করা বেশ বড়সড় একটা চ্যালেঞ্জই হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের জন্য। আমাদের সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে এবং টিম স্ট্রাকচারের এই দুর্বলতাটার একটা যথাযথ সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। ধরে নিন, এটাই আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যের পরবর্তী ধাপ।“
প্রাক-মৌসুম চলাকালীন সময়ে লেওয়ানডস্কি দ্য অ্যাথলেটিক কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমনটাই বলেছিলেন। অবাক করার মত তথ্য হলো, লেওয়ানডস্কি নিজেই এই সমস্যার উৎস হিসেবে দায়ী করেছেন গত সিজনে জাভির পরিবর্তিত ট্যাকটিক্যাল অ্যাপ্রোচকে, যেখানে তিনি দুই ট্র্যাডিশনাল উইঙ্গারের বদলে বেছে নিয়েছিলেন চার মিডফিল্ডারের ফর্মেশনকে এবং গাভিকে খেলিয়েছিলেন ফলস লেফট-উইঙ্গার হিসেবে। যদিও এই ট্যাকটিক্স কাজে এসেছিলো গতবছর স্প্যানিশ সুপার কাপের ফাইনালে লস ব্ল্যাঙ্কোসদের ধরাশায়ী করতে, তবুও ক্লাবের অনেকেরই বদ্ধমূল ধারণা যে এর বিনিময়ে তাদের আক্রমণভাগের তীক্ষ্ণতার একটা অংশকেও চড়াতে হয়েছে হাঁড়িকাঠে। ২০২২-২৩ মৌসুমে লা লিগায় বার্সেলোনার ১১টি ম্যাচে ১-০ স্কোরলাইনের তথা “টেনেটুনে” জয়ের পরিসংখ্যানও বেশ জোরেসোরেই একই ইঙ্গিত দিচ্ছে। ২৩টি গোল করে পিচিচি ট্রফি জেতা লেওয়ানডস্কির কণ্ঠেও হতাশার সুর।
“যখনই আমার মনে হচ্ছে যে ম্যাচপ্রতি একটির বেশি গোল আমাদের পক্ষে করা সম্ভব হচ্ছে না, আমি হতাশ হয়ে পড়ছি,” গত জুলাইয়ে আক্ষেপ করে বলেছিলেন লেওয়ানডস্কি, “হ্যাঁ, সব দিন সবার সমান যায় না। কিন্তু বার্সেলোনার মত দল যদি একের পর এক ম্যাচে এমনটাই করে, তাহলে তা নিশ্চয়ই মেনে নেওয়ার মত নয়।“
গত চার সিজনে প্রতি ৯০ মিনিটে লেওয়ানডস্কির গড় গোল এবং গড় এক্সজি (Image Reference: The Athletic)
শুধু বার্সা কেন? লেওয়ানডস্কি নিজেকেই যে হারিয়ে বসেছেন, সেটাই বা মেনে নেওয়ার মত ব্যাপার কি? উপরের গ্রাফে তার গত চার মৌসুমের গোল এবং প্রত্যাশিত গোলসংখ্যা (এক্সজির) তুলনা দেখেই তা উপলব্ধি করা যায়। ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ মৌসুমে বায়ার্ন মিউনিখে অবস্থানকালীন যে দুর্দান্ত রেকর্ড তিনি গড়েছিলেন, তা ২০২২-২৩ মৌসুমে বার্সেলোনায় আসার পর শুরুর দিকে অব্যাহত থাকলেও আকস্মিক ধ্বস নামে মাঝপথে। তাও আবার সেই সময়টাতেই, যে সময়ে জাভি তার চার মিডফিল্ডারের ট্যাকটিক্সের প্রবর্তন ঘটিয়েছিলেন।
সাম্প্রতিক ক্যাম্পেইনে দশ ম্যাচ যাবার পর লেওয়ার গোলসংখ্যা এখনো তার এক্সজির খানিক নিচেই। FBRef.com এর ভাষ্যমতে, বর্তমান সিজনে লেওয়ানডস্কির গোলসংখ্যা এবং এক্সজির পার্থক্য -১.২ (৬.২ এক্সজি, গোলসংখ্যা ৫), যা কিনা বার্সেলোনার স্কোয়াডে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। এই লিস্টে কেবল জোয়াও ফেলিক্সই আছেন তার পিছনে (পার্থক্য -২.১, ৩.১ এক্সজি, গোলসংখ্যা ১)।
অথচ বার্সেলোনার হয়ে তার শুরুটা একবার দেখুন, কী চমৎকারই না ছিলো! ২০২১-২২ মৌসুমে ডাঙায় খাবি খেতে থাকা কইমাছের মত বার্সেলোনার কাছে টলটলে জলাশয় হয়েই আবির্ভাব ঘটেছিলো এই গোলন্দাজের। ডেব্যু সিজনে লা লিগার প্রথম ১৫ ম্যাচে ১৩ গোল, ৪ অ্যাসিস্ট। ম্যাচপ্রতি ১.১৩টি গোলে অবদান তার-একজন পাকা গোলশিকারীর থেকে এর চেয়ে বেশি আর কী-ই বা আশা করা যায়? কোনো সংশয় নেই, লেওয়ানডস্কির গোলভাণ্ডারে খানিক ভাটাই যেন পড়ে গেছে।
নিজের কাজটা ঠিকমতো কেন করতে পারছেন না-এই প্রশ্নের পাশাপাশি আরো একটা প্রশ্ন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে এই স্ট্রাইকারের সামনেঃ গেম বিল্ডআপে তার ইনভলভমেন্ট এত কম কেন? গত আগস্টে কাদিজের বিপক্ষে বার্সার ম্যাচটাকে সেই প্রশ্নের একটা জলজ্যান্ত প্রেক্ষাপট হিসেবে টেনে আনাই যায়।
কাদিজের বিপক্ষে বার্সার খেলোয়াড়দের পাসিং ইলাস্ট্রেশন (Image Reference: The Athletic)
এখানে দেখা যাচ্ছে, লেওয়ানডস্কি যে পাসগুলো পাচ্ছেন, সেগুলোর সিংহভাগ আসছে পেদ্রির কাছ থেকেই। এছাড়াও আশেপাশের বৃত্তগুলোর আকার দেখে সহজেই ধারণা করা যায় যে লেওয়ানডস্কি নিজেও বেশ কম সংখ্যক পাস দিয়েছেন অন্যদের তুলনায় এবং অ্যাটেম্পট বেশি করা সত্ত্বেও যে পাসগুলো দিয়েছেন, সেগুলো থেকে গোল বা প্রতিপক্ষের গোলপোস্টে নেওয়া শট তেমন একটা উৎপন্নই হয়নি।
মাঠে নিজের পজিশনের কারণেই স্বাভাবিকভাবে লেওয়ানডস্কি সে ম্যাচেও বলে খুব একটা স্পর্শ করেন নি। একের পর এক সুযোগ হারানোর পরও ফেরান তোরেসের গোলটা সাজিয়ে দেবার কারণেই হোক বা অন্য কারণেই হোক, জাভির কণ্ঠে বরাবরের মতই আস্থার সুর লেওয়ার সামর্থ্যের ওপর।
“আমাদের এটা নিশ্চিত করতে হবে যেন লেওয়ানডস্কি সঠিক জায়গায় সঠিক সময়ে বল রিসিভ করতে পারে, তাহলেই সে নিয়মিত স্কোর করতে পারবে। তার সামর্থ্য নিয়ে আমার কোনো সংশয় না থাকলেও এ কথা ধ্রুবসত্য যে, একজন স্ট্রাইকারের আত্মবিশ্বাস বজায় থাকার জন্য তার ধারাবাহিকভাবে গোল পাওয়ার কোনো বিকল্প নেই।“
বোঝাই যাচ্ছে, লেওয়ানডস্কির কাঁধে এখনো রয়েছে জাভির আশ্বাসের হাত। এ সিজনে পরিসংখ্যানও এখন পর্যন্ত তার পক্ষেই যে আছে- লা লিগার নয় ম্যাচে তার পাঁচ গোল, চার অ্যাসিস্ট সেটাই বলছে। এখনও সবধরণের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ছয়টি গোলসহ তিনিই বার্সেলোনার সর্বোচ্চ স্কোরার। আগস্টের শেষদিকে এবং সেপ্টেম্বরে দুটো ম্যাচে উইনিং গোলসহ টানা চার ম্যাচে তিনিই স্কোর করে পয়েন্ট এনে দিয়েছিলেন বার্সেলোনাকে-যা ভুলে যাওয়া রীতিমত অন্যায়।
ট্রান্সফারের শেষ দিন জোয়াও ক্যান্সেলো এবং জোয়াও ফেলিক্সকে দেখে লেওয়ানডস্কি নিশ্চয়ই বেশ খুশি হয়েছিলেন-বিশেষ করে ফেলিক্সকে নিয়ে, যিনি ওয়াইড লেফট উইংয়ে খেলার মাধ্যমে লেওয়ানডস্কিকে সহায়তা করতে পারবেন বলে আশা ছিলো সবার। এই আশাও বিফলে যায়নি। ইতোমধ্যে রয়্যাল অ্যান্টোয়ার্প এবং সেল্টা ভিগোর বিপক্ষে লেওয়ানডস্কিকে দু’বার অ্যাসিস্ট করেছেন ফেলিক্স-যেখানে গত সিজনে গোটা লা লিগা জুড়ে রাফিনহা এবং ডেম্বেলে মাত্র তিনবার অ্যাসিস্ট করেছিলেন পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকারকে। চ্যাম্পিয়ন্স লীগে রয়্যাল অ্যান্টোয়ার্পের বিরুদ্ধে ম্যাচশেষে তেইশ বছরের ফেলিক্সকে নিয়ে প্রশংসার তুবড়ি ছুটিয়েছিলেন পোড়খাওয়া এই গোলশিকারী।
“একজন আক্রমণভাগের খেলোয়াড়ের মনোভাব এমনই হওয়া উচিত। সে সবসময় ওপরের দিকে খেলতে এবং স্পেস তৈরী করতে বেশি আগ্রহী। বক্সের দিকেও তার নজর থাকে, যেন আমি তার তৈরী করে দেওয়া সুযোগগুলোর জন্য প্রস্তুত থাকি এবং তাদের সদ্ব্যবহার করতে পারি।“
এল ক্লাসিকোয় প্রত্যাবর্তনের পর আশা করাই যায়, লেওয়ানডস্কি নিজেকে পুনরুদ্ধার করবেন, ফিরে আসবে তার সেই ক্ষুরধার গোলস্কোরিং পারফরম্যান্স। তাছাড়া পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে থাকা জিরোনা এবং দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদকে টপকানোর জন্য যে লেওয়ানডস্কিকে জাভির এবং বার্সেলোনার অনেক বেশি প্রয়োজন-সে কথা আর নতুন করে না বললেও চলছে!
Reference: The Athletic
(ফিচারটির সকল তথ্য নভেম্বর ০৪, ২০২৩ ইং পর্যন্ত সময়কার)
- 0 মন্তব্য