• ফুটবল

দ্য গ্রেটেস্ট অফ অল টাইমস

পোস্টটি ৯২০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

 

লেখাটি শুরু করার আগে একটি বিষয়ের উপর কিছুটা আলোকপাত করা যাক। কেউ একবার বলেছিলেন, ফ্রেড অ্যাস্টায়ার ছিলেন বিশ্বের সেরা নৃত্যশিল্পী তবে তার সঙ্গী জিঞ্জার রজার্সও তার চেয়ে কোন অংশে কম ছিলেন না। রজার্স ফ্রেডের মতোই সবকিছুই করতে পারতেন এবং সেটাও হাই-হিল জুতো পরা অবস্থায়। পরবর্তীতে জিঞ্জার রজার্সের সম্মানার্থে “Dancing Backward in High Heels” নামে স্টুডিও অ্যালবাম প্রকাশ করে নিউইয়র্ক ডলস।

এখন মূল আলোচনায় আসি। পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসে এটা অনেকটাই দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর চেয়ে লিওনেল মেসি নিশ্চিতভাবেই কিছুটা এগিয়ে থাকবেন। দীর্ঘ ৩৬ বছর পর আর্জেন্টিনার তৃতীয় বিশ্বকাপ জয় এর পিছনে মুখ্য ভূমিকা হিসেবে পালন করে। কিছু কিছু ফুটবল পন্ডিতদের চোখে মেসি অনেক আগে থেকেই বিশ্বসেরা হয়ে উঠেছিলেন। আরেকটু স্পষ্ট করে বলতে গেলে আজ থেকে ঠিক ১৫ বছর আগে যখন তিনি প্রথমবারের মতো ব্যালন ডি’ওর জিতেছিলেন।

এই বিশ্বকাপ জয় তাকে সর্বকালের সেরা করে তুলেছে, তাই না? হয়তো। তার মানে ম্যারাডোনার চেয়েও কি ভালো খেলোয়াড় বনে গেলেন মেসি? বিভিন্ন যুগের খেলোয়াড়দের সাথে তুলনা করাটা কি আসলেই যৌক্তিক? সম্ভবত নয়। কিন্তু আমরা যেভাবেই হোক এটা করি। 

তাহলে কিভাবেই বা ডিয়েগো ম্যারাডোনার সাথে লিওনেল মেসির তুলনা দেওয়া হয়?

মেসি অবশ্যই একজন ভালো খেলোয়াড় কিন্তু ম্যারাডোনা ছিলেন মহান। অনেক ভক্ত-সমর্থক থেকে শুরু করে বেশকিছু ফুটবল পন্ডিতরাও এটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন। অথবা মেসি সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় কিন্তু ম্যারাডোনাও তার চেয়ে কোন অংশে কম ছিলেন না। ঐযে লেখার শুরুতেই বলেছিলাম জিঞ্জার রজার্সের কথা। এই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রজার্সের ভূমিকায় নিশ্চিতভাবেই থাকবেন ম্যারাডোনা।

সম্প্রতি মারাডোনার আত্মজীবনী “এল ডিয়েগো” শেষ করলাম। সব মিলিয়ে খেলাধুলা বিষয়ক আমি যে দশটি বই পড়েছি তার মধ্য থেকে আমার ভাষ্যমতে সেরা বই ছিল এটি।

বইটি সম্পূর্ণ নিখুঁত না হওয়ায় আমি ব্যাক্তিগতভাবে কিছুটা অবাক হয়েছি। বইটি মূলত স্প্যানিশ ভাষা থেকে অনুবাদ করা হয়েছে এবং এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যা আমার কাছে বেশ অদ্ভুত লেগেছে। বইয়ের অনুবাদ যিনিই করুন না কেন, তিনি পাঠকদের মাঝে দিয়েগোকে জিম রয়েলের মতো উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। বলা যায় এটি মোটামুটি অনুবাদকের অদ্ভুত সাহিত্যিক পছন্দ।

তবে আপনি কখনোই এই সত্যটি অস্বীকার করতে পারবেন না যে ফুটবলের দিয়েগো কেবল এক আশ্চর্যজনক চরিত্র। মাঝারি মানের কল্পকাহিনি কি আদৌ তার মতো বিষ্ময়কর চরিত্রকে বর্ণনা করতে পারবে?? উত্তর যদি হ্যাঁ হয় তবে ডিয়েগোর এই আত্মজীবনী উপন্যাসের সমতুল্য। এটা অনেকটা টোয়াইলাইট সিরিজে অ্যাটিকাস ফিঞ্চকে খুঁজে পাওয়ার মতো।

এটাই ম্যারাডোনার সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার যে তিনি কেবল তর্কসাপেক্ষে ফুটবলের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়ই নন, তিনি সর্বকালের সেরা চরিত্রও হতে পারতেন। এরিক ক্যান্টোনা, ব্রায়ান ক্লফ, সক্রেটিস, ফাউস্টিনো অ্যাসপ্রিলা এরা সবাই লার্জার-দ্যান-লাইফ ক্যারেক্টার। মাঠের খেলায় দিয়েগোর ধারেকাছেও যেতে পারেনি তারা। কিন্তু তাতেও তারা কখনো হাল ছাড়েননি।

ম্যারাডোনার পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ার নিয়ে সকলেই একমত পোষণ করবেন যে তিনি আসলেই সেরা। এতে অবশ্য আমি বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকার কারণ দেখি না। তারপরও বার্সেলোনায় দুটি বাজে মৌসুম ছাড়া তিনি তার ক্যারিয়ারে এমন দলে কাটিয়েছেন যেগুলো মোটেও সেরা ছিল না। বলতে পারেন তারা সবচেয়ে বড় ক্লাবের কাতারে পরে না।

বার্সেলোনায় তার সেই দুই বছরের সম্পর্কের ইতি ঘটে খুব বাজেভাবে। ১৯৮৪ সালের কোপা ডেল রের ফাইনালে অ্যাথলেটিকো বিলবাওয়ের বিপক্ষে ১-০ গোলে হারের পর বিলবাওয়ের খেলোয়াড়দের সাথে মারামারিতে লিপ্ত হন ম্যারাডোনা। এক পর্যায়ে তিনি বিলবাওয়ের এক খেলোয়াড়কে লাথি মেরে বসেন। এই ঘটনাটি আপনি যদি এখনো না দেখে থাকেন তাহলে ইউটিউবে সার্চ করলেই আপনি সেই ভিডিওটি অনায়াসে পেয়ে যাবেন। সেদিন স্পেনের রাজা হুয়ান কার্লোস হাজার সমর্থকদের ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন।

কাতালুনিয়ার ক্লাবটি যখন ডিয়েগোকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তখন কোনও ক্লাব তাকে দলে ভেড়াতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। তবে সিরি-এ'তে প্রতিনিধিত্বকারী খর্বশক্তির ক্লাব নাপোলি তাকে দলে নিতে বেশ আগ্রহী ছিল।

বিশ্বজুড়ে ক্লাব এক্সিকিউটিভরা নিশ্চয়ই ম্যারাডোনাকে পছন্দ করেননি কিন্তু ভক্তরা তা করেছেন। নাপোলি ও বার্সেলোনার মধ্যকার আলোচনা যখন ভেস্তে যায়, তখন নাপোলির কিছু সমর্থক নেপলসের সান পাওলো স্টেডিয়ামের গেট শিকল দিয়ে বেঁধে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। তারই দরুন অবশেষে এই দলবদলটি সফলতার মুখ দেখে।

খোদ ম্যারাডোনা নেপলসের মানুষের কাছে স্বর্গের ঈশ্বরের সমতুল্য ছিলেন কিনা তা আসলে বলা মুশকিল। নাপোলির সমর্থকরা সর্বদা ম্যারাডোনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকতেন। তিনি যেন সমহিমায় সকল সমর্থকদের নেশায় বুদ করে রাখতেন। নিঃসন্দেহে ডিয়েগো প্রতিভাবান ছিলেন তবে তিনি নিজেকে সর্বদা একজন বহিরাগত হিসেবেই দেখতেন। ম্যারাডোনার কল্যাণেই অবিশ্বাস্য সাফল্যের দেখা পেতে শুরু করে নেপলসের ক্লাবটি। ১৯৮৭ সালে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইতালিয়ান লীগ জিতেছিল নাপোলি এবং তার পরেরটা জেতে আবার ১৯৯০ সালে।

এতক্ষণ যা বললাম তা কেবল ম্যারাডোনা-নাপোলি গল্পের অংশ মাত্র। শুরু থেকেই গুজব ছিল নেপলসের ক্লাবটি তার জন্য যে ১০ মিলিয়ন ডলার প্রদান করেছিল তা ইতালির বিখ্যাত নেপোলিটান মাফিয়া সংগঠন ক্যামোরা থেকে এসেছিল। নিঃসন্দেহে বলা যায় ক্যামোরা মূলত তাদের নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ম্যারাডোনাকে ব্যবহার করেছিল। তাকে মাদকদ্রব্য সরবরাহ করত, শহরের বিভিন্ন জায়গায় তাকে নিয়ে যেত এবং বিভিন্ন ব্যবসায়িক উদ্যোগের প্রচারের জন্য তার জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করত।

শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা বেশ বাজেভাবে শেষ হয়। ১৯৯০ সালে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে একই সান পাওলো স্টেডিয়ামে ইতালিকে টাইব্রেকারে হারানোর পর ডিয়েগো সমর্থকদের কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। আজ্জুরিদের হার অবশ্য একটা কারণ কিন্তু তার থেকেও অন্যতম বড় কারণ ছিল কিছু নেপোলিটান গ্যালারিতে বসে আর্জেন্টিনাকে সমর্থন দিচ্ছিল। আর এটাই মূলত ইতালিয়ান সমর্থকেরা ভালোভাবে নেয় নি। যে মাফিয়াচক্র ডিয়েগোকে প্রতি সপ্তাহে পার্টি করতে উৎসাহ দিত এবং প্রতিনিয়ত ড্রাগ সরবরাহ করত তাদের মুখোশও ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করে। অবশেষে ডিয়েগোর ফোনালাপ ফাঁসের মাধ্যমে জানা যায় তিনি পতিতাদের সাথে মাদক দেওয়া নেওয়া করতেন। ফলস্বরূপ তাকে ১৫ মাসের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং এখানেই তার নাপোলি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে।

১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ জয়ের পাশাপাশি ম্যারাডোনার সেরা ফুটবল মুহূর্ত ছিল এই নেপলস শহরে। কিন্তু এই শহর হয়তো তাকেও ধ্বংস করে দিয়েছে। এর পরের বছরগুলোতে তিনি সেভিয়া, নিওয়েলস ওল্ড বয়েজ, বোকা জুনিয়র্স যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই ম্যানেজার ও চেয়ারম্যানদের সঙ্গে তার বনিবনা হতোনা। সত্যিই নেশার কবলে পড়ে তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়।

১৯৯৪ বিশ্বকাপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যাবর্তনের সময় আবারও ডোপটেস্টে ধরা পরেন ডিয়েগো এবং এর কিছুদিন পরেই তার পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটেছিল। ঠিক যেন গল্পের বইয়ের শেষটায় করুণ পরিণতি, রূপকথার চেয়ে বেশি সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার।

শেষটা দুঃখজনক, কিন্তু তার গল্পটা অসাধারণ। ভালো ফুটবল সিনেমা এখনো তৈরি হয়নি। ম্যারাডোনাকে নিয়ে সিনেমা অবশ্যম্ভাবী। দিয়েগোর জীবন থেকে যদি তারা ভালো কিছু তৈরি করতে না পারে, তাহলে তাদের চেষ্টা একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া উচিত।

তার জীবনধারা, তার ক্যারিশমা এবং যেভাবে তার ক্যারিয়ার চলছিল, সবকিছুই তাকে মেসির থেকে আলাদা করেছে। মেসি অবশ্যই ক্রিশ্চিয়ানোর থেকে যোজন যোজন এগিয়ে থাকবেন। পেশাদারি ফুটবল ক্যারিয়ারের ইতি টানলে বরং রোনালদোর চেয়ে ম্যারাডোনার নামটাই মেসির সাথে চিরকাল জড়িয়ে থাকবে। সে সম্ভবত ফুটবলের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়। তবে তিনি কখনোই ম্যারাডোনার সমতুল্য নন।