• ফুটবল

সিজার লুইস মেনোত্তি: সিগারেটের ধোঁয়ায় আর্জেন্টাইন ফুটবলের এক অদ্ভুত পুনরুত্থান ঘটিয়েছিলেন যে ভদ্রলোক

পোস্টটি ১৪৮০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

২৭ শে জুন, ১৯৭৮। আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলের রুগ্ন দশাটা আরেকবার ফুটে উঠল গোটা বিশ্ববাসীর সামনে। তৎকালীন সময়ের উদীয়মান ফুটবল ধারণা টোটাল ফুটবলের কাছে পরাজিত হয়ে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত হওয়া সেবারের বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গিয়েছিল আলবিসেলেস্তেরা।

 

গেলসেনকির্শেনে ভ্লাদিস্লাও ক্যাপের দল ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত হয়েছিল রাইনাস মিশেলসের এই ডাচ দলের বিপক্ষে। ইয়োহান ক্রুইফ এবং তার সতীর্থদের আশ্চর্যজনক নৈপুণ্যের বদৌলতে পুরো বিশ্ববাসীর থেকে বেশ প্রশংসা কুড়োয় এই দক্ষ ডাচ দল। সেদিন মাঠে উপস্থিত থাকা সর্মথকেরা তাদের এই অসাধারণ ফুটবল প্রদর্শনে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়েছিল। আপনি যদি সেই সময় আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের সমর্থক হতেন, তাহলে আপনার তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

 

সে সময় আর্জেন্টিনা নান্দনিকতার দিক থেকে খুব একটা শক্তিশালী দল ছিল না। তারা কঠোর, শারীরিক এবং গেমসম্যানশিপে পারদর্শী ছিল, শোম্যানশিপে নয়। ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে অসভালদো জুবিয়েলদা এস্তুদিয়ান্তেসের কোচ হিসেবে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখার পরেও আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের মধ্যে তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। বরং নেদারল্যান্ডসের মতো অ্যাটাকিং মেশিনের সামনে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হয় আলবিসেলেস্তেদের।

 

সোজা কথায়, আর্জেন্টিনা জাতীয় দলে এক বিশাল পরিবর্তন দরকার ছিল এবং সেই পরিবর্তনটা এসেছিল সিজার লুইস মেনোত্তির হাত ধরে, যিনি আর্জেন্টিনার ফুটবলে এক অদ্ভুত পুনরুত্থান ঘটিয়েছিলেন। এল ফ্লাকো (দ্য স্লিম ওয়ান) নামে পরিচিত এই ভদ্রলোক বেশ সাহসী ছিলেন। তিনি যদি ট্রেনে আপনার বিপরীতে বসে থাকত তবে আপনি সম্ভবত ভাবতেন যে মেনোত্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষকদের সেই বিরল প্রজাতি; বুদ্ধিজীবী কিন্তু আড়ম্বরপূর্ণ নয়, নির্লিপ্ত কিন্তু পুরোপুরি অজ্ঞ নয়।

 

তিনি হয়ত স্বভাবতই কুড়ি মিনিট দেরি করতেন কিন্তু কোটের পকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করার সময় তার মুখের ভাব স্পষ্ট হয়ে উঠত। যদিও তার ঢেউ খেলানো কালো চুল, সাইডবার্ন এবং আকর্ষণীয় নীল চোখ বেশিরভাগের কাছে বিভ্রান্তিকর ছিল না। ফুটবলের অভ্যন্তরে তাকে আধ্যাত্মিক হিসেবে বিবেচনা করলেও তিনি কিন্তু শারীরিকভাবেও বিশালদেহী ছিলেন না। তবে তিনি যুক্তিযুক্ত চিন্তাভাবনার মাধ্যমে খেলোয়াড়দের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখতেন। একজন চিন্তাবিদ, একজন আংশিক-রোমান্টিক এবং একজন কৌশলী পণ্ডিত হিসেবে তিনি স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বাস করতেন আক্রমণাত্মক মনোভাবকে জোর দিয়েই ফুটবলটা খেলতে হয়।

 

এমনকি তিনি এটা করেও দেখিয়েছেন। মেনোত্তি প্রথম ম্যানেজার হিসেবে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ উপহার দেন। তিনি আলবিসেলেস্তেদের আকর্ষণীয় এবং আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলানোর মাধ্যমে এই শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট অর্জন করেছিলেন। ১৯৭৪ বিশ্বকাপে ডাচদের কাছে হেরে বিদায়ের পর যখন আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলের কালো অধ্যায়ে এক নতুন দৃশ্যপটের আবির্ভাব ঘটে, এর ঠিক ৪ বছর পরেই ঘরের মাঠ বুয়েন্স আইরেসের এল মনুমেন্টালে তাদেরকে পরাজিত করে বিশ্বের শ্রেষ্ট ফুটবল দলের আসনে বসে মেনোত্তির আর্জেন্টিনা। এই ৪ বছরে মেনোত্তি একটা দলকে শুধু খাদের কিনারা থেকেই টেনে তোলেননি বরং নান্দনিক ফুটবল উপহার দিয়ে সমর্থকদের মনও জয় করেছেন। সমর্থকরাও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে তারা সত্যিসত্যিই এস্তাদিও মনুমেন্টালের সবুজ গালিচায় বিশ্বকাপ ট্রফি উঁচিয়ে ধরবে, তাও আবার ইউরোপীয়ান ফুটবলের পাওয়ারহাউজ দুর্দান্ত ডাচদের বিপক্ষে।

 

কোচ হিসেবে মেনোত্তির আবির্ভাব হঠাৎ করে হয়নি। কেননা জাতীয় দলের চাকরি গ্রহণ করার আগে তিনি বেশ কয়েক বছর ধরে নিজ দেশে একজন শ্রদ্ধেয় এবং প্রভাবশালী কোচ ছিলেন। অবশ্য ১৯৬৯ সালে খেলোয়াড় হিসেবে অবসর গ্রহণের আগে তার পেশাদার ক্যারিয়ার খুববেশি আহামরিও ছিল না।

 

ঠিক এক বছর পর ১৯৭০ বিশ্বকাপের জন্য মেক্সিকোর উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান এই উদীয়মান ট্যাকটিশিয়ান। সেখানে দক্ষিণ আমেরিকার আরেকদেশ যাদের দৃষ্টিনন্দন ফুটবল দর্শনের প্রেমে পড়েছিলেন তিনি, সেই দলটি ছিল আর্জেন্টিনারই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিল। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন। সেই দুর্দান্ত সেলেসাও দল গভীর চিন্তাশীল মেনোত্তির কল্পনাকে আরও বেশিমাত্রায় বিস্তৃত করেছিল। তার আদর্শকে ভিন্নরূপ দিয়েছিল এবং ফলশ্রুতিতে কোচিংয়ের এমন একটি পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছিল যা তাকে পরবর্তীতে এক অনন্যমাত্রায় নিয়ে যায়।

 

মেনোত্তি যাকে সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচনা করতেন মেক্সিকো বিশ্বকাপে সেই পেলের নেতৃত্বে ফুটবল কীভাবে খেলা উচিত তার এক ঈর্ষান্বিত নীলনকশা প্রতিষ্ঠা করেছিল ব্রাজিল। ফাইনালে ইতালিকে ৪-১ গোলে পরাজিত করার পরে ব্রাজিল যখন বিশ্ব শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট অর্জন করে তখন সেটা মেনোত্তির মানসিকতায়ও বেশ ভালোভাবেই প্রভাব ফেলে। অনেকের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন এই বিশ্বমঞ্চের ফাইনালে তার দেশ আর্জেন্টিনারও তো থাকা উচিত।

 

মেনোত্তি প্রথম সকলের নজরে আসেন ১৯৭৩ সালে। হুরাকানের দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে সেবার আর্জেন্টিনায় মেট্রোপলিটানো চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছিল মেনোত্তি। জোনাথন উইলসন এল ফ্লাকোর কৌশলে এতটাই মুগ্ধ হয়েছেন যে  তার প্রতি চমৎকার এক শ্রদ্ধাঞ্জলিতে লিখেছেন, তারা এতটাই আনন্দদায়ক এবং দুর্দান্ত দল ছিল যে রোজারিও সেন্ট্রালকে যখন ৫-০ গোলে পরাজিত করেছিল হুরাকান, প্রতিপক্ষ সমর্থকরাও বেশ প্রশংসা করেছিল।

 

ফরোয়ার্ড কার্লোস ব্যাবিংটন বলেন,“আমাদের খেলার ধরণই ছিল মূলত গ্যাম্বেটাস, ওয়ান টাচ মুভ, নাটমেগ, সোমব্রেরোস, ওয়ান-টু, ওভারল্যাপ।” তার এই কথাগুলো শুনে মনে হতে পারে এটা হয়ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে। না, মেনোত্তির এই হুরাকান টিম আসলেই এক মহাকাব্যিক থেকে কোনো অংশে কম ছিল না। কেননা তারা ফুটবলের জাঁকজমককে এক ভিন্নরূপ দিয়েছিল। স্কিল, সুন্দর পাসিং আর ফরোয়ার্ড থিংকিং- এগুলোই ছিল ১৯৭৩ সালে আর্জেন্টিনার ফুটবলকে কাঁপিয়ে দেওয়া মেনোত্তির দলের বৈশিষ্ট্য।

 

মেনোত্তি 'রাইট-উইং ফুটবল' শব্দটি বেশ পছন্দ করতেন, যা তিনি সংগ্রাম এবং ত্যাগের সমতুল্য হিসেবে দেখতেন এবং বলতেন: "রাইট-উইং ফুটবল আমাদের বিশ্বাস করতে চায় যে জীবন একটি সংগ্রাম, ত্যাগের দাবি রাখে। আমাদের ইস্পাত হয়ে উঠতে হবে এবং যে কোনও উপায়ে জিততে হবে।”

 

মেনোত্তির ফুটবল ছিল লুই ফন গালের স্বপ্ন, দর্শন ও শৈল্পিকতার এক মাতাল ও মোহময় মিশ্রণ। তাঁর অপরিহার্য উক্তি অনুযায়ী ফুটবলের দেকার্ত যদি আপনি চান, "সবার উপরে একটি দল একটি ধারণা"। সেই কৌতূহলের চেতনা নিয়ে, মেনোত্তি তার অনুগামীদের থেকে মেনোটিস্টাস নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

 

মেনোত্তি ফুটবলকে স্বপ্নের সম্প্রসারণ হিসেবে বিশ্বাস করতেন। মেনোত্তির কাছে একজন ফুটবলার ছিলেন সুবিধাজনক অবস্থানে। তিনি বিশ্বাস করতেন একজন ফুটবলার কেবল তার বুটের ঝাঁকুনি দিয়ে হাজার হাজার দর্শককে আনন্দিত ও চমকে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। অনুভূতি ও স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে পারার ক্ষেত্রেও তার এক অনন্য গুণ ছিল। আর্জেন্টাইন সমর্থকরা গৌরবের স্বপ্ন দেখেছেন, আর খেলোয়াড়রা সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন।

 

তার সেই অদম্য দর্শন নিয়ে মেনোত্তি ১৯৭৪ সালে খাদের কিনারায় থাকা দক্ষিণ আমেরিকার এক দৈত্যকে পুনরুজ্জীবিত করার দায়িত্ব নেন। মেনোত্তি জয়ের চেয়েও আর্জেন্টিনার ফুটবলের উত্থান কার্যকর করতে একটুবেশিই ব্যস্ত ছিলেন। ফুটবলকে দর্শক হিসেবে গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন তিনি। আর তা নিয়েই ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প লিখতে শুরু করেন এল ফ্লাকো।

 

সিজার লুইস মেনোত্তি একবার বলেছিলেন, "আমি মনে করি যে একটি দল একটি ধারণার ঊর্ধ্বে এবং একটি ধারণার চেয়ে এটি বড় ধরনের প্রতিশ্রুতি এবং প্রতিশ্রুতির চেয়েও বেশি স্পষ্ট যে একজন কোচকে অবশ্যই সেই ধারণাটি রক্ষা করার জন্য তার খেলোয়াড়দের কাছে প্রেরণ করতে হবে। সুতরাং আমার উদ্বেগ হলো আমরা কোচরা প্রদর্শনী থেকে উৎসবের সমার্থক শব্দটি মুছে ফেলার অধিকার নিয়ে নিজেদের কাছে অহংকার করি না, এমন একটি দার্শনিক পাঠের পক্ষে যা টিকিয়ে রাখা যায় না, যা ঝুঁকি নেওয়া এড়াতে বাধ্য করে। আর ফুটবলে ঝুঁকি আছে, কারণ যে কোনো ম্যাচে ঝুঁকি নেওয়া এড়ানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে না খেলা।” 

 

মেনোত্তি সাধারণত আর্জেন্টিনাকে ৪-৩-৩ অ্যাটাকিং ফর্মেশনে খেলাতে পছন্দ করতেন। মারিও কেম্পেস, লিওপোলদো লুক ও অস্কার অর্টিজের মতো তারকাদের বদৌলতে আক্রমণভাগে আর্জেন্টিনার দুর্বলতা ছিল না। ওসি আর্দিলেসের মতো মিডফিল্ড মেশিন এবং রেনে হাউসম্যানের গতির সাথে মিলিত হয়ে মেনোত্তির আর্জেন্টিনা এক রোমাঞ্চকর সৃষ্টি ছিল। খেলোয়াড়দের প্রতি মেনোত্তির বার্তা ছিল ম্যাচ জিততে হবে না, শুধু ভালো ফুটবল খেলার চেষ্টা করো।

 

১৯৭৮ বিশ্বকাপে তারা অবশ্যই সেই লক্ষ্য পূরণ করেছিল। তবে ১৭ বছর বয়সী উদীয়মান সুপারস্টারকে ছাড়াই ওই টুর্নামেন্টে খেলেছিল তারা। সেই খেলোয়াড় আর কেউ নন, দিয়েগো ম্যারাডোনা। আর্জেন্টিনার পরবর্তী সুপারস্টার হিসাবে অভিষিক্ত এই কিশোরকে মেনোত্তি তার দলে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রচণ্ড চাপের মধ্যে পড়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, মেনোত্তির অধীনেই আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে অভিষেক হয় ম্যারাডোনার। তবে এল ফ্লাকো মনে করেছিলেন যে তার স্কোয়াড ইতিমধ্যে সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। সে হিসেবে ম্যারাডোনাকে না নিলেও শেষ পর্যন্ত তাতে বিন্দুমাত্র যায় আসে নি।

 

১৯৭৮ বিশ্বকাপে ঝলমলে ফুটবল খেলে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। তারা তাদের প্রথম গ্রুপপর্ব শীর্ষে থেকে শেষ করার পরে দ্বিতীয় গ্রুপপর্বে শক্তিশালী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, যার মধ্যে তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের মুখোমুখি হতে হয়। পোল্যান্ডের বিপক্ষে ২-০ গোলে জয় এবং ব্রাজিলের বিপক্ষে ০-০ গোলে ড্র হওয়ার পর পেরুর বিপক্ষে জয় দরকার ছিল মেনোত্তির শিষ্যদের। শুধু তাই নয়, চার গোলের ব্যবধানে জয় দরকার ছিল আলবিসেলেস্তেদের।

 

কাকতালীয়ভাবে সেই বিশ্বকাপ হয়েছিল আর্জেন্টিনার ডানপন্থী সামরিক একনায়কতন্ত্রের পটভূমিতে, যার নেতৃত্বে ছিলেন হোর্হে ভিদেলা। গল্পটি হলো পেরু ইচ্ছাকৃতভাবে স্বাগতিক দেশ আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে পৌঁছানোর জন্য ম্যাচ পাতাবে। ভিদেলার বিরুদ্ধে পেরুর স্বৈরশাসনের সাথে একটি চুক্তির অভিযোগ আনা হয়েছিল, যেখানে ১৩ জন পেরুর নাগরিককে কন্ডোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আর্জেন্টিনায় স্থানান্তর করা হয়েছিল, যা ছিল রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন করার জন্য নীলনকশা। ধারণা করা হচ্ছিল, পেরু ম্যাচ হারতে রাজি হলেই ভিদেলা বন্দিদের ছেড়ে দিতে রাজি হবেন।

 

এটি সত্য হোক বা মিথ্যা, আর্জেন্টিনা ম্যাচটি ৬-০ ব্যবধানে জিতেছিল এবং ফাইনালে আগের বিশ্বকাপের রানার্সআপ নেদারল্যান্ডসের মুখোমুখি হওয়ার পথ প্রশস্ত করেছিল। তবে ভিদেলার সেই 'চুক্তি'র সম্ভাবনাকে পুঁজি করে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়কে বরাবরই সন্দেহের চোখে দেখেছেন অনেকে, তবে মেনোত্তির কোনো দোষ দেয়া যায় না এক্ষেত্রে। জোনাথন উইলসন পরবর্তীতে অবশ্য বলেছিলেন, “আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে আনা এই অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং এর যথাযথ কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ম্যাচে আলবিসেলেস্তেদের খেলা এতটাই নিখুঁত ছিল যে পেরুভিয়ানদের আসলে জবাব দেওয়ার মতো কিছুই ছিল না।”

 

মেনোত্তির দিক থেকে যেটা বলা যায় তা হলো তিনি তার দলে গেমসম্যানশিপ তৈরি করেছিলেন। ফাইনালের আগে নেদারল্যান্ডসের টিম বাসের 'মনোরম' রুট ধরে মনুমেন্টালে যাওয়ার সাথে কোনও ধরনের সম্পর্ক না থাকলেও তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে তার খেলোয়াড়দের মাঠে আসতে বিলম্ব করেছিলেন। ডাচ খেলোয়াড়দের মনের অবস্থা যাই হোক না কেন, মেনোত্তি জোর দিয়েছিলেন যে তিনি তার প্লেয়িং স্টাইলে চেঞ্জ আনবেন না। আলবিসেলেস্তেরা পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে যে একই স্টাইল এবং আক্রমণাত্মক খেলার পসরা সাজিয়ে বসেছিল তারই ধারাবহিকতা বজায় রেখেছিল ফাইনালের মঞ্চে।

 

৯০ মিনিটের খেলা ১-১ গোলের সমতায় থেকে শেষ হয়। অতিরিক্ত সময়ে মারিও কেম্পেস এবং ড্যানিয়েল বার্তোনি গোল করলে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পায় আর্জেন্টিনা। প্রকৃতপক্ষে, এই বিজয় সবসময় সামরিক জান্তার কথিত কার্যক্রমের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হতে পারে, তবে মেনোত্তির আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের এই সাফল্যকে কোনোঅংশে ছোট করে দেখার বিন্দুমাত্র কারণ নেই।

 

ফুটবল নিয়ে মেনোত্তির চিন্তাভাবনা নিমেষেই যেন পুরো আর্জেন্টাইন ফুটবলের চিত্রটাই বদলে দিয়েছিল। তিনি এমন একটি দলে তার এই নিজস্ব খেলার ধরণ প্রবর্তন করেছিলেন যারা ঠিক ৪ বছর আগে শোচনীয়ভাবে পরাজয় লাভ করত। এমনকি মেনোত্তির এই দৃষ্টিনন্দন ফুটবল কথিত সামরিক জান্তার বিষয়টিকে পুরোপুরি ভিত্তিহীন প্রমাণ করে।

 

মেনোত্তির খ্যাতি এবং গুরুত্ব তার ট্রফি ক্যাবিনেটের গভীরতার চেয়ে বেশি, অনেকটা আরিগো সাচ্চির মতো। এই দু'জনই আধুনিক খেলাটিকে ব্যাপকভাবে রূপ দিয়েছেন এবং এটি সমর্থকরা সবথেকে বেশি উপলব্ধি করে যখন তারা দুজনেই কোচিং ক্যারিয়ার থেকে অবসর নিয়েছিল। ক্যারিয়ারের পরবর্তী সময়ে, মেনোত্তি আর্জেন্টিনার টেলিভিশনের একজন সম্মানিত পন্ডিত এবং ধারাভাষ্যকার হয়েছিলেন, খেলাটি সম্পর্কে তার উন্নত জ্ঞানকে ভালভাবে ব্যবহার করেছিলেন এবং পরবর্তীতে জাতীয় দলের দুর্দশা সম্পর্কে বিচক্ষণ মতামত দিয়েছিলেন।

 

হ্যাঁ, ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপ জয়ের পর মেনোত্তির ক্যারিয়ার হয়তো তাকে অফুরন্ত সাফল্য উপহার দেয়নি, কিন্তু সেটা কখনোই তার অনুপ্রেরণা ছিল না। তার অনুপ্রেরণা ছিল আর্জেন্টিনাকে আরও একবার যেন তিনি বিশ্বকাপ জয় উপহার দিতে পারেন। সেটা সম্ভবও হয়েছে তবে এবার আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশনের ডিরেক্টর হিসেবে তিনি এটি করে দেখিয়েছেন। তিনি জাতীয় দলের কোচ হওয়ার আগে আর্জেন্টিনার একের পর এক লজ্জাজনক হার মেনে নিতে পারেননি এবং এটা তিনি পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। এমনকি তিনি সেটা করেও দেখিয়েছেন। তার অসাধারণ অনুপ্রেরণামূলক কৌশল এবং ছন্দবদ্ধ ও মনোরম ফুটবল সমর্থকদের বেশ আনন্দিত করেছিল।

 

আমরা এটিকে 'দ্য বিউটিফুল গেম' বলি এবং এই সুন্দর ফুটবলের প্রদর্শণীতে মেনোত্তি সর্বদা একটি জায়গা পাওয়ার যোগ্য দাবিদার। একজন কঠোর বাস্তববাদী হিসেবে তিনি মাঠে ঘাসের ফলক যাচাই না করে খেলার একটি উপায় কল্পনা করার সাহস রাখতেন।

 

হ্যাঁ, এখন অবশ্য ফুটবল মাঠে কোচদের ধূমপান করার অনুমতি দেওয়া হয় না কিংবা আধুনিক ফ্যাশনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে গলায় একটি মোটা সোনার চেইন পরার অনুমতি দেওয়া হয় না, তবে এটি জানা দরকার যে ফুটবলে সিজার লুইস মেনোত্তির মতো ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন। যাতে করে ফুটবলে প্রতিনিয়ত নতুন চিন্তাধারার সুযোগ থাকে।

 

এই আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি আজকেই পৃথিবীর মায়াত্যাগ করে ৮৫ বছর বয়সে পরলোকে পাড়ি জমান। একজন ক্ষুদে আর্জেন্টাইন সমর্থক হিসেবে সবসময় আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব। তাকে সর্বদা কুর্নিশ জানাই। আর হ্যাঁ আনকোরা স্কালোনির উপর আস্থা রাখার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।