২২ থেকে ২৪ঃ আর কত নেক্সট বিশ্বকাপ এর পরিকল্পনা করবে বাংলাদেশ?
পোস্টটি ৬৮৩ বার পঠিত হয়েছেবাংলাদেশের টি২০ বিশ্বকাপ এর পরিকল্পনা শুরু হয় কবে থেকে? ২০২২ বিশ্বকাপের আগের হযবরল অবস্থায় বিসিবি প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপন ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে বলেছিলেন, "আমাদের টার্গেট এই বিশ্বকাপ না, পরবর্তী বিশ্বকাপ।"
পরবর্তী বিশ্বকাপ যে পরিকল্পনায় ছিল তার একটা প্রমাণ ছিল তৎকালীন ক্যাপ্টেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ কে বাদ দিয়ে এশিয়া কাপ দল ঘোষণা, সাকিব আল হাসান কে ক্যাপ্টেন ঘোষণা কিংবা এশিয়া কাপের ম্যাচের পর মুশফিকের অবসরের ঘটনায়। এরপর ২০২২ টি২০ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দুইটি ম্যাচ জিতেছে, ভারতের বিপক্ষের ম্যাচ টা বিতর্কিত আম্পায়ারিং এ না হারলে সেমিফাইনাল এ যাওয়ার সম্ভাবনাও ছিল! যাক গে, ২০২৪ বিশ্বকাপ পরিকল্পনা আশা করা যায় তারপর থেকেই বাস্তবায়ন শুরু করার কথা। আমার আলোচনার বিষয় আমাদের পরিকল্পনা কী ছিল আর তার ছন্দপতন ই বা হলো কেন ২০২৪ সালে।
২০২৩ সালে বাংলাদেশ এশিয়ান গেমস টি২০ বাদে মোট ম্যাচ খেলেছে ১১ টি, জিতেছে ৮ টি, হেরেছে ২ টি, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা ১ টি টি২০ তে ফল হয় নি। এর মধ্যে ২০২২ টি২০ বিশ্বকাপের সময়কালীন বোর্ড প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, "অন্যরা যাচ্ছে চ্যাম্পিয়ন হতে৷ আমরা যাচ্ছি দল গুছাতে।" এ দ্বারা বোঝা যায়, বাংলাদেশ যে ব্র্যান্ডের ক্রিকেট টা খেলতো, তা আধুনিক টি২০ ক্রিকেটের সাথে বেমানান। যার ফলস্বরূপ একটি দল গুছানোর কাজ ওনারা করছেন ২০২২ বিশ্বকাপ দিয়ে, যারা নেক্সট বিশ্বকাপ অর্থাৎ ২০২৪ বিশ্বকাপ এ বাংলাদেশ কে রিপ্রেজেন্ট করবে৷ এ পরিকল্পনার প্রমাণ অবশ্য পাওয়া যায় জাতীয় দলের ২০২৩ সালের পারফরম্যান্স এও।
যেহেতু আলোচনার বিষয়টা ২০২৪ এর ছন্দপতন নিয়ে, ২০২৪ এ এখন অবধি মিডল অর্ডার পারফরম্যান্স তুলনামূলক সন্তোষজনক হওয়ায় ১ থেকে ৪ নম্বর পজিশন নিয়ে চিন্তা করি। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের হয়ে টি২০ তে ১থেকে ৪ নম্বর পজিশনে ব্যাটিং করেছেন মূলত ঘুরে ফিরে ৫ জন। লিটন দাস, রনি তালুকদার, নাজমুল হোসেন শান্ত, সাকিব আল হাসান এবং তাওহিদ হৃদয়। যদিও এর মাঝে আফিফ হোসেন এবং শামীম পাটোয়ারী খেলেছেন একটি ম্যাচ ১ থেকে ৪ নম্বর পজিশনে, সৌম্য সরকার খেলেছেন ২ টি।
২০২৩ সালে তাদের স্ট্রাইক রেট এর দিকে তাকালে-
১) লিটন দাস - ১৩৭.২৭
২) রনি তালুকদার - ১৪১.৯৬
৩) নাজমুল শান্ত - ১১৯.৭৮
৪) সাকিব আল হাসান - ১৩৩.৬৫
৫) তাওহিদ হৃদয় - ১২৬.৪৯
হ্যাঁ, গত কয়েক সিরিজে প্রথম ৬ ওভারে রান ই না ওঠা বাংলাদেশ টিমের দুইজন ওপেনার গত বছর ও প্রায় ১৪০ স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং করেছেন। এবারে ২০২৪ সালে ১ থেকে ৪ নম্বর পজিশনে ব্যাটার দের স্ট্রাইক রেট দেখা যাক,
১) লিটন দাস - ৯৬.৮৮
২) সৌম্য - ১১৯.৩৯
৩) তানজিদ তামিম - ১২৩.৪৫
৪) নাজমুল শান্ত - ১০২.৬৫
৫)তাওহিদ হৃদয় - ১৩৫.৫৭
দুইটি পরিসংখ্যান থেকেই একটা জিনিস পরিষ্কার তাওহিদ হৃদয় ছাড়া বাকি সবার সট্রাইকরেট আশানুরূপ না লাগলেও, শান্ত এবং লিটন এর পারফরম্যান্স রীতিমতো দৃষ্টিকটু।
২০২৩ থেকে ২০২৪ এ হুট করেই ছন্দপতন হওয়া দলের মধ্যে আসলে কি পরিবর্তন আসছে, তা খোঁজ করলে প্রথম বিষয়টি আসে রনি তালুকদার এর তিরোভাব। রনি তালুকদার কে আমার নিজের ব্যক্তিগত পছন্দ না তার বলের মেরিট না বুঝে শুধু স্ম্যাশ করার প্রবণতার কারণে। কিন্তু বর্তমান টি২০ তে সবচেয়ে জোর দেওয়া হয় যে স্ট্রাইক রেটে, গত বছর বাংলাদেশের ক্রিকেটার দের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি স্ট্রাইক রেট ছিল রনি তালুকদার এর। তার বাদ পড়ার প্রধান বিষয় কি ছিল? অফ ফর্ম?
রনি যদি তার অফ ফর্ম এর কারণে বাদ যান, সেক্ষেত্রে রনি তালুকদার এর খেলা শেষ ৬ ম্যাচে তার রান ১৪৯। গড় ২৪.৮৩। সেই ৬ ম্যাচে শান্তর রান সংখ্যা ৭০, গড় ১৪! অফ ফর্ম এর জন্য যদি রনি তালুকদার বাদ যেতে পারে, তাহলে কিভাবে ২০২৩ এর সর্বশেষ সিরিজে ক্যাপ্টেন হতে পারেন শান্ত? আমি রনি কে নেওয়াই হোক, এমন বলছি না, কিন্তু শান্ত কে ক্যাপ্টেন করার অর্থ আপনি রীতিমতো তিন ফরম্যাটে একজন ক্যাপ্টেন দেওয়ার দরকার ভেবেছেন, তাই তাকে ক্যাপ্টেন করেছেন।
হুট করে ছন্দপতন হওয়া বাংলাদেশ টিমের পরিবর্তন এর পরবর্তী জায়গা আসে লিটন আর শান্তর স্ট্রাইক রেটের অবনমন এবং এই পজিশনে তানজিদ কিংবা সৌম্য কারোই ঠিক শুরু থেকেই একদম ফ্লায়িং স্টার্ট এনে দিতে না পারা, যে কাজ টা ফুটওয়ার্ক ছাড়াই হোক আর যেভাবেই হোক রনি তালুকদার পেরেছেন।
সৌম্য কোন বিবেচনায় টি২০ টিমে আমার জানা নেই। ওয়ানডেতে নিউজিল্যান্ডের 'বি' গ্রেড বোলার দের সাথে ১৬৯ করার পুরস্কার কি তাকে টি২০ তে অন্তর্ভুক্ত করা? তানজিদ তামিম স্পিনের বিরুদ্ধে রান করতে বেশি সাবলীল নন, তিনি এই চিত্রনাট্যে এসেছেন ই অবশ্য কিছুদিন আগে শেষ হওয়া জিম্বাবুয়ে সিরিজে। হুট করেই এই দুইজন কে টি২০ টিমে নেওয়া এবং শান্তর চেয়ে বেটার পারফর্ম করা রনি কে বাদ দিয়ে শান্ত কে ক্যাপ্টেন করে বিশ্বকাপ এ নিয়ে যাওয়ার অর্থ আপনি ২০২২ এ যে পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন তা আপনি ভুলেই গেছেন! ভুলে যাওয়ার আরেকটা উদাহরণ হতে পারেন আফিফ হোসেন ও। লিটন এবং আফিফ ছিলেন রাজশাহী কে বিপিএল জেতানো টিমের অন্যতম প্রধান দুই পারফর্মার। আফগানিস্তানের সাথে রনির ইঞ্জুরিতে আফিফ সুযোগ পান এক ম্যাচ, করেন ২৪ রান। টিম ম্যানেজমেন্ট তার কথাও ভুলে গেছেন হয়তো। না হলে হুট করে সৌম্য - তানজিদ এলেও আফিফ এর কথা ভাবে নি কেউ। অথচ সৌম্য তার ফেরার ম্যাচে করেছিলেন ২২ রান।
লিটনের অবনমনের ব্যাপার টা একটু অন্যরকম। একটা পদ নিয়ে সমালোচনার শেষ নেই, এমন পদে আসীন হওয়ার পর যে কারো ইচ্ছা থাকে, পাবলিকের ভালোবাসা পাওয়ার। গাজী আশরাফ হোসেন লিপু হয়তো একই কাজ লিটন কে ওয়ানডে টিম থেকে বাদ দিয়ে করেছেন। দুই ম্যাচ ডাক মারার পরে একটা প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটার কে সর্বোত্তম যা করা যায় তা হলো বেঞ্চ করা। না, গাজী আশরাফ হোসেন লিপু রীতিমতো ভিডিও বানিয়ে লিটন কে বাদ দেওয়ার কথা দেশবাসীকে জানিয়েছেন। মিডিয়াও তাকে নিয়ে প্রচার করেছে কঠোর নির্বাচক, যার কাছে পারফরম্যান্স ই শেষ। অথচ একই সিরিজে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও শেষ দুই ইনিংস এ করেছেন ১ ও ০ রান। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ কে এই কারণে দল থেকেই বাদ দেওয়া যেমন অন্যায়, লিটনের ক্ষেত্রেও তাই। আশ্চর্যের বিষয় ঠিক তার পর তিনি লিটন কে পাঠিয়ে দিয়েছেন ডিপিএল খেলতে, অথচ ৩য় ওয়ানডের পর বাংলাদেশের ছিল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট!
লিটন এর সমস্যাটা তাই মানসিক। একজন প্রফেশনাল ক্রিকেটার হিসাবে যদিও তার উচিত ছিল এক ফরম্যাট এর ফর্ম অন্য ফরম্যাটে না টানা, তবে তিনি তাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
২০২৪ এ এসে গত বছরের তুলনায় ব্যাটিং এ এই সুস্পষ্ট পার্থক্য গুলো বিদ্যমান। যা মূলত টিম ম্যানেজমেন্ট এর পরিকল্পনাহীনতার ফল। কারণ আপনার রাডারে প্লেয়ার ই ১৫ থেকে ১৭ জন। এইক্ষেত্রে আপনি স্ট্রাইক রেট এ সর্বোচ্চ থাকা প্লেয়ার কে বাদ দিয়ে এমন কাউকে ক্যাপ্টেন করেছেন যার টি২০ ব্যাটিং ই প্রশ্নবিদ্ধ। কোথায় গেল সেই ২০২২ এর নেক্সট বিশ্বকাপের পরিকল্পনা।
এই ছন্দপতনে অবশ্য আরো দুইটি ফ্যাক্টর লক্ষ করা যায়।
প্রথমত সাকিব আল হাসান, ২০২১ বিশ্বকাপের পর থেকে একের পর এক ব্যাটিং নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছেন, কোনো বিশ্ব আসরেই ফল পান নি। সবশেষ ২০২৩ বিশ্বকাপে চোখের সমস্যায় পড়েছেন, যেই চোখের সমস্যায় তার ব্যাটিং দেখাটাও দৃষ্টিকটু। মাঝে নির্বাচন করেছেন, সাকিব আসলে ক্রিকেট টা নিয়েই কতটুকু সিরিয়াস তা দেখার ব্যাপার। এদিকে ২২ বিশ্বকাপের আগে তার হাতে ক্যাপ্টেন্সি তুলে দেওয়ার পর যে এগ্রেসিভ মাইন্ডসেট দেখা গিয়েছিল পুরো টিমে, দুইজন ওপেনার খেলছিলেন ১৪০ স্ট্রাইক রেটে, সেই এগ্রেসিভ মাইন্ডসেট বিলুপ্ত টিম থেকেই। এখনকার ক্যাপ্টেন শান্তর নিজের স্ট্রাইক রেট ই এবছর ১০২, সে আর বাকিদের কি এগ্রেসিভ বলবেন। শান্ত উইকেটের দোহাই দিয়েছিলেন, অথচ এবছর ও মিরপুর এ হয়েছে দুইটি টি২০, গতবছর ও তাই। আর একই দলের তাওহিদ হৃদয় ১৩৭ স্ট্রাইক রেটে এবছর ব্যাট করতে পারলে সে তো আর ভিন্ন উইকেট এ খেলেন নি!
দ্বিতীয় ফ্যাক্টর টা হতে পারে জাকের আলী এবং রিশাদ। এই দুইজনের ব্যাটিং এর উপর যে ভরসা টিম করেছিল, তার কিছুই দিতে পারেন নি। জাকের আলী কিপার হিসাবে সুপার ফ্লপ, ব্যাটিং এ তিনি ওয়ান ম্যাচ ওয়ান্ডার হয়েই থাকবেন কি না দেখার ব্যাপার। অন্তত শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচের পর আমি কোনো ম্যাচেই জাকের কে আপ টু দ্য মার্ক দেখি নি। রিশাদ হোসেন ওয়ানডেতে শ্রীলঙ্কার হাসারাঙ্গাকে ছয়ের পর ছয় মারার পর টি২০ তে জিম্বাবুয়ে কিংবা ইউ এস এ, কোনো সিরিজেই ব্যাটিং এ সাবলীল ছিলেন না৷
সবমিলিয়ে ২০২২ এ নেক্সট বিশ্বকাপের পরিকল্পনা শুরু করা বাংলাদেশ আদতে ২০২৪ বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছে পরিকল্পনাহীন ভাবেই। মানহীন প্রিমিয়ার লীগ, পাইপলাইন এ প্লেয়ার না থাকা এ সত্যগুলো যতদিন আপনি স্বীকার না করবেন এবং তার উন্নতি তে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা না নেবেন, ততদিন মিডিয়ায় স্টান্টবাজি করার জন্য টার্গেট নেক্সট বিশ্বকাপ ই বলতে হবে। আর তারপর যতজন আছে তাদের কেই আপনি বিশ্বকাপ পর্যন্ত ঠিকঠাক ইউজ না করেই বিশ্বকাপের এক সিরিজ আগে নতুন প্লেয়ার দেখা শুরু করবেন! এভাবেই চলছে, চলবে। মিডিয়া আছে কোন প্লেয়ার আছে, নেই এ নিয়ে আবেগ ব্যবসা করার। কিন্তু আসল পরিকল্পনার অভাব এর জায়গা টা কখনোই দেখাবে না!
এবার বিশ্বকাপ এও ম্যাচ ডে তে অতিমানবীয় কিছু হলে বাংলাদেশ হয়তো সুপার এইটে যাবে, আর মেন্টালি এমন ডাউন থাকলে হতে পারে একটা ম্যাচ ও জিতবে না! তারপর আবার পরবর্তী বিশ্বকাপ নিয়ে চিল্লাচিল্লি চলতে থাকবে। আবার পরিকল্পনাবিহীন হুটহাট প্লেয়ার পিক করা চলবে। ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে কিছুই হবে না৷
এভাবেই চলুক আর আমরাও বলি, "অদ্ভুত উটের পিঠে চলছে ক্রিকেট!"
- 0 মন্তব্য