• ফুটবল

ইনভিকটাস, ১৯৭১

পোস্টটি ১৩১১৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
Some people believe football is a matter of life and death, I am very disappointed with that attitude. I can assure you it is much, much more important than that.”- Bill Shankly
 

ক।

বাবার সামনে দাঁড়ালেই বুক কেঁপে উঠতো কেনো জানি, যে কারণে বাবার কাছে মুখ ফুটে মনের কথা বলা কখনোই হয়নি তার, যত আবদার ছিলো মায়ের কাছে। এর অন্যথা হয়নি কোনদিন।

‘তোর বাবা বলতেছিলো তোকে লন্ডন পাঠায়ে দিবে নাকি আগামী মাসে,’ তূর্যকে বলেছিলেন মা। ‘ এই নিয়ে ফয়েজ চাচার সাথে কথাও হইছে নাকি দুই-একবার।’

এই কথা শুনেই আশঙ্কায় হঠাৎ ভারী হয়ে গিয়েছিলো তূর্যের বুকের ভেতরটা, তবু চেষ্টা করেই গলার স্বরটা কাঠকাঠ করে তুলেছিলো সে। মা’কে বলেছিলো, ‘দ্যাখো আম্মা, ওই লন্ডন-ফন্ডন যাওয়া আমারে দিয়া হবে না। জুয়েলদের সাথে আমার কথা হইছে এর মাঝে, আগরতলায় যাবার রাস্তা খুঁজতেছে ওরা। আমিও ওদের সাথে যাবো ঠিক করছি, যুদ্ধে যাবো। তুমি আব্বারে বইলো।’

মা অবশ্য প্রথমে রাজি হননি বাবাকে এই কথা বলতে। তবে দুইদিন ধরে বাসায় পানি পর্যন্ত মুখে না দেয়ার ফলে মা’র কাছে আর উপায় থাকেনি কোনো। নিচু স্বরে চলা বদ্ধঘরের সেই আলোচনায় কান পেতে তূর্য কেবল শুনেছিলো মা হঠাৎ রেগে গিয়ে বাবাকে বলছেন- ‘আমার ছেলে যুদ্ধে চলে যাইতে চায়- আমার কলেজে পড়া ছেলে- তুমি তারে নিষেধ পর্যন্ত করবা না??’

বহুদূর থেকে তূর্য আব্বার গলা শুনতে পায় যেন, ‘ আমি ওদের কোনমুখে মানা করি, বলো ! আর তোমার ছেলেকে তো চেনো... সে যুদ্ধে না গেলে আর কার ছেলে যাবে বলতে পারো ??  ওর বয়েসী সবাই যুদ্ধে না গিয়ে লন্ডন চলে গেলে দেশটা কী করে স্বাধীন হবে??’...

সে-ই প্রথম তূর্যের মনে হয়েছিলো, তার বাবাকে সে চেনে না- বোঝে না ঠিকই; বাবা তাকে ঠিক বোঝেন, চেনেন।

এরপর বন্ধুদের সাথে নিয়ে ঘর থেকে বেরোতে আর কোন পিছুটান ছিলো না তূর্যের। গন্তব্য সেই আগরতলা। পথে স্বামীবাগ আউটফলের সেই অমানুষিক দৃশ্য। পঁচে ফুলে ওঠা অগণিত মানুষের লাশ। কাপড় আছে কারো শরীরে, কারো নেই- ওদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতোই। গন্ধের চেয়ে বিবমিষায় বেশি- মুখ চেপে ধরে বমি করে দিয়েছিলো সে।...

এরপরে আরো অনেকগুলো স্বামীবাগ পেরিয়ে আসে ওরা, পাঁয়ে হেঁটে, পথ কিংবা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। শেষমেষ সেই আগরতলা ক্যাম্প। সেই বিশাল শরণার্থী শিবির। আর ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দেয়ার কিছুদিন পরেই দেখা ফটো সাংবাদিক তপন চ্যাটার্জীর সাথে। তার মুখেই সে শুনতে পেলো সব। তাকে- তার মতো আরো অনেককেই- দরকার ওদের।

‘কিন্তু যুদ্ধ করতে এসে যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে এভাবে চলে যাবো ??’ বিমূঢ় গলায় -তপন নয়- নিজেকেই যেন প্রশ্ন করেছিলো তূর্য।

‘যোদ্ধারা তো যুদ্ধ কেবল একভাবেই লড়ে না কমরেড,’ তপন বলেছিলো ভারী গলায়। ‘যুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করাটা এখন অস্ত্র ধরার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কম গুরুত্বপূর্ণ নয়  এই যোদ্ধাদের কাছে খাবার আর অস্ত্র পৌছানোর জন্য টাকা সংগ্রহ করাটাও।’

কথাটা মনে ধরেছিলো তূর্যের। তারপরে সেই তপনেরই মাধ্যমে এক মালবাহী বিমানে সোজা কলকাতা, দলের অন্য সদস্যদের অধিকাংশই তখন সেখানেই ছিলো। তার দলে ঢোকা নিয়ে কোন সমস্যাই হলো না। তবে বাবা-মা’র কথা ভেবে নিজের আসল নামটা আর দিলো না সে। লিস্টিতে দলের সবার নাম তুলবার সময় কোচ ননী বসাককে তুর্য বলেছিলো, ‘... উহুঁ, ননীদা- এইটা না। এইটা কাটেন- ঐ নামটা দিমু না। আমার নামটা তূর্য হাজরা লেখেন। ...তূর্য নামে আমারে আম্মা ডাকে।’

আর এখন, শিয়ালদা থেকে ছেড়ে আসা এই কু-ঝিকঝিকে দুলতে দুলতে কাজী সালাউদ্দিন ভাবে- শেষপর্যন্ত পেপারে তূর্য হাজরার নামটা আসেও যদি; আম্মা কি জানবেন যে এই তূর্য হাজরা আর তার তূর্য একই ব্যক্তি??  

তূর্য হাজরা নামের শেষার্ধ্বটা যার কাছ থেকে ধার করা, সেই প্রতাপ শংকর হাজরা বসে আছে কাজী সালাউদ্দিনের ঠিক উলটো দিকে। তার গাঁ ঘেষে জানালার পাশেই বসা নুরুন্নবী, প্রচন্ডে গরমে ঘেমে একাকার হয়ে আছে সে। সালাউদ্দিন যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে মাঠে এলেও নুরুন্নবী তা আসেনি, সে কেবল একদিনের ছুটি নিয়ে এসেছে।

নুরুন্নবীর কাছে মনে হয় সমস্ত কিছুই যেন অতি দ্রুত ঘটে গেছে। গত পরশু বিকেলেই তো অফিসার্স মেসে মেজর আসোয়ান থাপার ঘরে হঠাৎ তলব। ‘নুরুন্নবী, তোমাকে তোমার দেশের দরকার। পরশু মাঠে নামতে হবে তোমায়, গেট রেডি। কালকেই তোমাকে নিয়ে যাওয়া হবে।’

পরের বিশটা ঘন্টা কেবল গেলো যাত্রায়। বনগাঁ থেকে বিগ্রেডিয়ার যোশীর জিপে চেপে বাগডোগরার বিমানঘাঁটি, বিমানে করে ব্যারাকপুর। ব্যারাকপুর থেকে গাড়িতে ফোর্ট উইলিয়াম, সেই অন্ধকার ঘর- সেই পরিচিত শিখ অফিসার। সবশেষে আট নং থিয়েটার রোড, প্রবাসী সরকারের কার্যালয়ে মেজর চৌধুরীর হাস্যজ্জ্বল মুখ। ক্লিয়ারেন্স নিতে হলো সবক’টা জায়গা হতেই। সেই সাথে নিশ্চিত করতে হয়েছে- আগামী কালই ফোর্ট উইলিয়ামে ফিরে রিপোর্ট করবে সে।

ভাবতে ভাবতে নুরুন্নবী আড়মোড়া ভাঙ্গে। এতটা কষ্ট করে আসা কি কাজে লাগবে আজ বিকেলে?? কতদিন প্র্যাকটিস করে না সে, যদি খেলা প্রচণ্ড খারাপ হয় তার?? যদি তার ভুলেই গোল খেয়ে বসে দল আজ??... এইসব দুশ্চিন্তা জোর করে ঠেকিয়ে রাখতে চায় নুরুন্নবী। আসোয়ান থাপার কন্ঠ অনুকরণ করে নিজের মনেই সে নিজেকে বলে, ‘ ওয়েক আপ সোলজার, ওয়েক আপ। জেনে রাখো, এটা শুধুই আরেকটা ফুটবল ম্যাচ না...’

কু-ঝিকঝিক, কু-ঝিকঝিক। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলকে নিয়ে ট্রেন চলেছে কৃষ্ণনগর, নদীয়া।

খ।

আমহার্স্ট স্ট্রিটে প্রতাপ হাজরার বড়দার বাসাতেই গত মাসে এক ঘরোয়া আড্ডায় আলী ইমাম ভাই কথাটা বলেছিলেন তাকে, ‘ বুঝলা পিন্টু- যুদ্ধে বিদেশী জনসমর্থন আদায়ের বিষয়টা আসলে ছোট কইরা দেখার মতো কিছু না। তোমাদের সবাইরে কলকাতায় দেইখা আমার মাথায় একটা আইডিয়া আসছে, বুঝ্‌লা। ... এইখানে তো খালি তোমাগো মোহামেডানেরই অন্ততঃ ৬-৭টা পোলা আছে। ঢাকা লীগের আরো পোলাপান খুঁজলে পাওন যাইবো। তোমাগো সবটিরে নিয়া একটা ফুটবল টিম করার কথা ভাবতেছি আমি- বুঝ্‌ছো। আইএফএ’র কয়েক জায়গায় আলাপও কইরা আসছি, আপত্তির কিছু দেখি নাই অগো মাঝেও। তুমি কি কও?’

আইএফএ মানে ভারতীয় ফুটবল এসোসিয়েশন- জানতো পিন্টু। আপত্তি করার কোন কারণ খুঁজে পায়নি সে, বরং সায় দিয়েছিলো ইমাম ভাইয়ের কথায়। একত্রেই গিয়েছিলো আট নং থিয়েটার রোডে প্রবাসী সরকারের কার্যালয়ে। এবং গিয়ে বেশ অবাকই হয়ে গিয়েছিলো।

প্রবাসী সরকারের কর্মকর্তা শামসুল হক সাহেব বলতে গেলে লাফিয়ে উঠিছিলেন উত্তেজনায়। ‘ভাই, আপনারা একদম ঠিক সময়ে এসেছেন। আমরা অলরেডি চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছিলাম, বুঝলেন ! স্বাধীন বাংলা বেতারে যেমন আমাদের কন্ঠযোদ্ধারা যুদ্ধ করে যাচ্ছেন- ঠিক সেইভাবে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পগুলোতে ট্রেনিং নিতে আসা ফুটবলারদের নিয়ে একটা ফুটবল টিম বানাবার চিন্তা আমাদের মাথায় এসেছে সম্প্রতি। আমরা কেবল আসল মানুষগুলোর সন্ধানে ছিলাম। ... আপনারা কোন চিন্তা করবেন না। কাজ শুরু করে দেন, আমাদের পক্ষে যা যা করা সম্ভব- সবই হবে !’

এরপরে দেখতে দেখতে হয়ে গেলো সব, পিন্টুর মনে পড়ে। খুব তাড়াতাড়িই অফিসিয়াল চিঠি চলে এলো- ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি নজরুল ইসলামের সই করা। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠন করা হবে অচিরেই। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচ খেলে বেড়াবে এই দল, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনসমর্থন যোগাড় করবে। অর্থ যদি আসে কিছু, তবে তা জমা হবে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ফান্ডে, অস্ত্র কেনা হবে তা দিয়ে।

সীমান্তের কাছের এক মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের ফিটনেস ইন্সট্রাক্টরের চাকরিটা ছেড়ে বেরিয়ে এলো পিন্টু। ততদিনে শামসুল হক সাহেবেরই প্রতিষ্ঠা করা বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি থেকে এগিয়ে এসেছেন আলী ইমাম, লুতফর রহমান আর সাইদুর রহমান প্যাটেল। ভারতের আকাশবানীতে প্রচারিত হলো একটি বিশেষ বিজ্ঞপ্তি। মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে অবস্থানরত ফুটবলারেরা যেন রিপোর্ট করেন মুজিবনগরে, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল তৈরী হবে।

এরপরে হলো ট্রায়াল। ৪০ জনের মতো খেলোয়াড় থেকে বেছে নেয়া হলো প্রায় ৩০ জন, সালাউদ্দিনের মতো অল্প কয়েকজন এসে যোগ দিলো পরে।

পার্ক সার্কাস এভিনিউর কোকাকোলা বিল্ডিংটাই আবাস এখন পিন্টুদের। প্রতিদিন সকালে কোচ ননীদার হাঁক ডাকে ঘুম ভাঙ্গে ওদের। শৃঙ্খলা বিষয়ে ভয়ানক কড়া লোক ননী বসাক। পান থেকে চুন খসলেই বাড়তি তিন চক্কর, ধুর!! তবে তাই বলে আদরেরও কমতি নেই তার তরফ থেকে।

‘বয়েজ,’ মাটিতে আঁকা পজিশন বুঝিয়ে মার্কিং স্টিক দুলিয়ে দুলিয়ে বলেন ননীদা। ‘দুনিয়াতে বহু লোকে ফুটবল খেলে। তার মাঝে হাজার হাজার লোকে তোমাদের চেয়ে ভালো খেলতেই পারে। কিন্তু একটা কথাই মনে রাখবা বয়েজ, পুরা দুনিয়ায় তোমরা ছাড়া আর এমন কোন ফুটবল দল নাই- যারা নিজের দেশের স্বাধীনতার জন্যে খেলতেসে। ... সো মাইন্ড জাস্ট ওয়ান ড্যাম থিং। ইউ আর নট হিয়ার টু প্লে দা গেম অনলি, ইউ আর হিয়ার টু ফাইট ফর ইউর কান্ট্রি !!’

ননীদার কথায় বুকের ভেতর কেমন যেন লাগে এই ফুটবলারদের। সন্ধ্যায় গলা ছেড়ে সেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথে গলা মেলানোর সময় সবাই যেন একটু বেশি আবেগ দিয়েই গায়, ‘ তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে লড়তে জানি ...’

‘পিন্টু ভাই,’ জানালায় গুণগুনরত পিন্টুর পেছনে গলা শোনা যায় ইস্ট এন্ড ক্লাবের স্টপার আশরাফ আলীর। ‘প্রতাপদারে খায়া নিতে কন। তার নাকি আবার মাথা ধরসে, শুইয়া রইছে।... কয় খাইবো না।’

এই একটা কথাতেই পিন্টু এক মুহুর্তে ভাবরাজ্য ছেড়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয় ১৯৭১ এর জুলাই মাসে। আশরাফ খেয়েছে কি না, সে প্রশ্নটা করে প্রতাপের ঘরের দিকে যায় পা বাড়ায় পিন্টু। মনে মনে দুঃখ হয় তার প্রতাপের জন্যে। বিব্রতও হয়। আবারো কী বলে প্রতাপকে সুস্থির করবে- মাথায় আসছে না তার।

প্রতাপের মানসিক অবস্থা ভালো না গত কয়েকমাস ধরে। ২৫শে মার্চের রাতে তার সামনেই ওদের পাড়ায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলো মিলিটারি। প্রাণ নিয়ে কোনমতে পালিয়ে এলেও প্রতাপের দুঃস্বপ্নে এখনো হানা দিচ্ছে সেই কালো রাত।

পিন্টু পাশের ঘরে যায়, প্রতাপ খাটে শুয়ে রয়েছে উপুড় হয়ে। ‘প্রতাপ, আর দেরী নাই বেশি ম্যাচের। সাড়ে তিনটায় বাইর হইতে হইবো। খাবি না তুই ??’ প্রতাপের পাশে বসতে বসতে বলে পিন্টু।

প্রতাপ মাথা তুলে আস্তে আস্তে সোজা হয়ে শোয়। কেমন একটা ঘোরলাগা গলায় ফিসফিস করে সে বলে, ‘পিন্টু রে, আমার আবার মাথাব্যথা হইতেছে। চোখ বুজলেই সেই আগুনে পোড়ার গন্ধ, সেই মেশিনগানের ক্যাটক্যাট আওয়াজ ফিরে ফিরে আসে রে...সব ক্যামন যেন লাল লাল দেহায় ...’

ঢাকার খেলাপাগল মানুষদের কাছে অতিপরিচিত সেই প্রতাপের মুখটা সেই মুহুর্তেই পিন্টুর কাছে যেন অসহায় এক কিশোরীর মুখ হয়ে যায়। ওয়ারী ক্লাবের হকি মাঠের বাঁধা লেফট ইন প্রতাপ, বকশীবাজার ক্রিকেট ক্লাবের টু-ডাউন ব্যাটসম্যান প্রতাপ, ফুটবল মাঠের মোহামেডানের বাম উইঙে দুরন্ত গতির সেই প্রতাপ - নিজের সমস্ত প্রতাপ হারিয়ে  ছোট্ট একটা শিশুর মতো পিন্টুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে সশব্দে।

পিন্টু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সেটা ফেলা ছাড়া তার অবশ্য আর কিছু করার থাকেও না...

গ।

নদীয়া সীমান্ত দিয়ে নাকি ইতিমধ্যে হাজার পাঁচেক লোক ঢুকেছে সকাল থেকে। আরো আসছে নাকি। জায়গা হবে তো শেষ পর্যন্ত স্টেডিয়ামে?? নদীয়ার ডিসি দীপককান্তি ঘোষ চিন্তায় পড়ে যান। বড়জোর হাজার বিশেক মানুষের জায়গা হতে পারে এই স্টেডিয়ামে, এর বেশি হলেই তো ঝামেলা বাওয়া।

‘ওহে নগেন,’ ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস করে মুখের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি চুলকে নিয়ে বলেন ডিকে ঘোষ। ‘শহরের ভেতরে পোস্টার টানিয়েছো ঠিক মতো ?? এদিকে আমাদের এলাকা থেকেও লোক আসবে তো ঠিকঠাক ??’

টেঁরি কাটা চুলে হাত চালিয়ে নিয়ে নগেন বলে, ‘ কী বলচেন স্যার ! পোস্টার বলে পোস্টার !! শহর ছেয়ে দিয়েছি না এদ্দম পোস্টারে ??... স্বাধীন বাংলা দলের নামকরা স্টার প্লেয়ারদের একেবারে ঠিঁকুজি পযন্ত তুলে দিয়েচি পোস্টারে। বিজ্ঞাপনে স্যার কোনোরকম ঘাটতি পাবেন না। এদিকে মাইকিং করেও জানান দেয়া হয়েচে শহরের ভেতরে।’

‘হুম। বেশ, বেশ।... কিন্তু ওপার থেকে এতো লোক আসচে কী করো বলো তো বাপু।’ ডিকে ঘোষ চিন্তিত গলায় বলেন। ‘সকাল থেকে আসচেই দেকচি। ওই দ্যাখো, পুব গ্যালারী তো জয়বাংলার পতাকায় ছেয়ে গিয়েচে একেবারে!!’

‘ওটা স্যার,’ নগেন বলে। ‘মালুম হচ্চে... ঐ স্বাধীন বাংলা বেতারের কাজ। বেতারে নাকি এই ম্যাচের কতা ফলাও করে বলা হয়েছে স্যার, মানে আমাদের রতন শুনেচে বলছিলো।’

‘যাই বলো, এই স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রটা কিন্তু বেশ দারুণ, বুঝলে!!’ ডিকে ঘোষ দাঁড়ি চুলকানো ভুলে গিয়ে বলেন। ‘ আমি কিন্তু প্রতিদিন সন্ধ্যায় নিয়ম করে শুনি ওদের গানগুলো। খাসা গায় বুঝলে...’

চুনী গোস্বামীকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়, মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া। ‘দীপকদা, ইদিকে এসো তো একটু। ঝামেলা হয়েচে একটা।’

হাত ধরে চুনী গোস্বামী ডিকে ঘোষকে টেনে নিয়ে যান খেলোয়াড়দের কাছাকাছি। স্বাধীন বাংলা আর নদীয়া দলের ফুটবলারদের ভীড়ে ভরে আছে জায়গাটা। রেফারিদেরও দেখা যাচ্ছে পাশেই, স্থানীয় খেলাগুলো চালানো হয় যাদের দিয়ে–ওরাই এসেছেন। প্রচণ্ড কোলাহল চারপাশে। প্রায় হাজার পনেরো লোক এসে বসে গেছে স্টেডিয়ামের গ্যালারীতে। বাঁশি, তালি, হই হট্টগোলে ভরে আছে পুরো এলাকাটা।

‘কি, কি সমস্যা হলো আবার?... সব তো রেডিই মনে হচ্চে। চারটে বেজে গেছে তো। খেলা শুরু করে দিচ্ছো না কেন??’ ডিকে ঘোষ বলেন।

‘আরে ওটাই তো সমস্যা দাদা।’ চুনী গোস্বামী কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলেন। ‘ স্বাধীন বাংলার খেলোয়াড়েরা বলচে মাঠে নামার আগে তাদের জাতীয় সঙ্গীত গাইতে দিতে হবে। আর সাথে ওদের ওই স্বাধীন বাংলার ফ্ল্যাগও উড়াতে দিতে হবে বলচে। নইলে তারা নাকি মাঠে নামবে না।’

ডিকে ঘোষের কপাল কুঁচকে গেলো। ‘সে কী কথা, খেলবে না মানে !! ... আরে ফ্ল্যাগ ওড়ানোটা যা তা ব্যাপার মনে করেছে নাকি এরা। আরে ডিপ্লোমেটিক একটা ব্যাপার আছে না !!’

স্বাধীন বাংলা দলের কোচ ননী বসাকের সাথে আগেই পরিচয় হয়েছে ডিকে ঘোষের। ননী বসাক এগিয়ে এলেন পিন্টুকে সাথে নিয়ে।  ‘ঘোষ বাবু, এই উপকারটা করুন। ফ্ল্যাগটা নিয়ে আমাদের ছেলেদের মাঠে নামতে দিন। দেখছেন তো- এম্নিতেই কত দর্শক মাঠে পতাকা নিয়ে এসেছে।’

ডিকে ঘোষ অস্বস্তিতে আবার দাঁড়ি চুলকালেন। না মানে, দর্শকেরা সাথে পতাকা এনেচে- সে তো অন্য ব্যাপার। কিন্তু, আনুষ্ঠানিক পতাকা তোলা মানে তো ... মানে বোঝেনই তো দাদা। একটা বিষয় আছে না- যুদ্ধকালীন অবস্থায় একটা নিউট্রাল প্রভিন্স থেকে আমি কী করে ... মানে ...’

‘দেখুন ঘোষ বাবু, আমাদের ফুটবল টিমের খেলতে আসার আসল উদ্দেশ্য কিন্তু আপনিও জানেন। আমাদের যুদ্ধের সমর্থনে জনমত গঠন। এখন পতাকা ছাড়া খেলতে কি নামা যায়, বলুন ?? আর যুদ্ধের মাঝে প্লেয়ারদের পতাকা নিয়ে নামাটা বিশাল একটা সাইকোলজিক্যাল বুস্ট হবে কিন্তু তরুণ দর্শকদের জন্যে। উই নিড মোর ফাইটারস্‌ ফ্রম দেম।’ ননী বসাক জোরালো গলায় বলেন।

‘আহা, বাংলাদেশের মানুষের প্রতি কি আমার টান কম দাদা- এসব বলচেন কেন।’ ডিকে ঘোষ  বলেন। ‘কিন্তু পতাকা ওড়ানোর মানেটা তো বোঝেন। এখনো তো আমাদের সরকার কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি আপনাদের। এই সময় পতাকা ওঠানোটা মানে..’

‘স্যার, ’ স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক পিন্টু এগিয়ে এসেছে ততক্ষণে। ‘ বেশি সময় নেবো না আমরা কিন্তু। ... একবার তাকিয়ে দেখুন স্যার, এই মানুষগুলো শুধু খেলা দেখতে তো আসেনি। এদের অনেকেই এসেছে তাদের স্বাধীন দেশের নামটা মাইকে শোনা যাবে, এই আশায়। এই পতাকাটা নিয়ে মাঠে নামলে- এই মানুষগুলো স্যার- ভরসা পাবে। বুঝতে পারবে, আমরা রুখে দাঁড়িয়েছি। প্লিজ স্যার, আর মানা করবেন না স্যার। আমরা এই পতাকাটা ওড়ানো ছাড়া মাঠে নামবো না।’

‘চেপে যান স্যার, ’ টেঁরি কাটা নগেন কখন যেন চলে এসেছে এই কথোপকথন শুনতে। ‘পতাকা ওড়ানোটা বড্ড বেশি ঝুঁকির কাজ হয়ে যাবে। আইএফএ ক্ষেপে যেতে পারে স্যার !!’

ডিকে ঘোষ চুনী গোস্বামীকে নিয়ে দুই পা সরে আছেন পেছনে। ‘ কি বলো হে চুনী, খুব কি একটা ঝামেলা হবে নাকি পতাকা ওড়াতে দিলে ?? কি মনে হয় তোমার ??... সময়ও তো আর বেশি নেই। পাবলিক রেগে যেতে পারে এবার টিমগুলো মাঠে না নামলে...’

‘আমার মনে হয় দিতে পারেন দাদা। ঝুঁকি একটা আছে তা ঠিক, তবে প্রচারের কথাটাও ভাববার মতোই কিন্তু। মুক্তিযুদ্ধে নদীয়া সরকারের সাহায্যের বিষয়টা গণমাধ্যমে আসলে ক্ষতিটা কীসে...’

পিন্টুর হাতের লাল সবুজের মাঝে সোনালী রঙের মানচিত্রটার দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন দীপককান্তি ঘোষ। ‘বেশ, মাইকে প্রচার করতে বলো। প্রথমে দুই দলের জাতীয় সঙ্গীত হবে। এরপরে পতাকা নিয়ে স্বাধীন বাংলার প্লেয়ারেরা মাঠে একটা চক্কর দেবে...। নগেনটা কোথায় গেলো, ওকে বলো ব্যবস্থা করতে।...’

ডিকে ঘোষ জানতেন না, বিনা অনুমতিতে দেশের অভ্যন্তরে অন্য একটি দেশের পতাকা ওড়াতে দেয়ায় আগামীকালই তিনি তার পদ হতে সাসপেন্ড হবেন। এবং ইন্ডিয়ান ফুটবল এসোসিয়েশন থেকে বাতিল করা হবে নদীয়ার সদস্যপদ। সে অন্য আরেক গল্প।

সবই হলো এরপরে। প্রথমে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে নদীয়া একাদশের খেলোয়াড়েরা গাইলো ভারতের জাতীয় সঙ্গীত। এরপরে মাইকে বাজলো রবি ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা...’ আর সবশেষে স্বাধীন বাংলার পতাকা নিয়ে মাঠ প্রদক্ষিণ করতে নামলো পিন্টুদের দল। আর সেই মুহুর্তেই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চীৎকার শোনা গেলো। ‘জয় বাংলা!!’

সে এক অদ্ভূত দৃশ্য। পাগলের মতো ‘বাংলাদেশ! বাংলাদেশ!’ স্লোগানে চতুর্দিক কাঁপিয়ে তুলেছে খেলা দেখতে আসা দর্শকেরা। কুষ্টিয়া থেকে প্রচুর মানুষ এসেছে সীমান্ত পেরিয়ে, তাদের উল্লাসটাই বেশি দেখবার মতো। নদীয়ার লোকেরাও এই অভূতপূর্ব দৃশ্যটি দেখে আবেগ চেপে রাখতে পারছে না, অনেকের চোখেই জল।

‘তুমি দেখো চুনী,’ ফিসফিস করে গলা নামিয়ে বললেন ডিকে ঘোষ। ‘খুব তাড়াতাড়িই ওরা স্বাধীন হয়ে যাবে। খুব তাড়াতাড়িই।’  দীপকবাবুর অবশ্য ফিসফিসিয়ে কথাটা বলবার প্রয়োজন ছিলো না। তাদের সবচেয়ে নিকটবর্তী দর্শকটির চোখজোড়াই তখন ঝাপসা।

ফুটবল মাঠেই মৃত্যু হোক তার- এমন একটা ক্ষ্যাপাটে ইচ্ছা মনের ভেতরে তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে; কিন্তু এই মুহুর্তে পাগলা এনায়েত আর ক্যাপটেন পিন্টুর হাতে ধরা পতাকাটি দেখে ননী বসাকের মনে হচ্ছিলো মৃত্যুর জন্যে এর চেয়ে ভালো উপলক্ষ কেউ কখনো পায় নি। গত তিরিশটা বছর মাঠের সবুজে কাটিয়ে দিলেও এরচেয়ে সুন্দর কোন দৃশ্য ফুটবলে তিনি কখনোই দেখেন নি।

ঘ।

নদীয়ার সেন্টার ফরোয়ার্ডের হেডটা বেরিয়ে গেলো বারের অন্তত পাঁচ হাত ওপর দিয়ে। নুরুন্নবী আরেকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। আরো একবার বাঁচা গেছে, সেইভ করতে হয়নি তাকে।

প্র্যাকটিসের অভাবটা ভোগাচ্ছে, নুরুন্নবী বেশ বুঝতে পারছে। আর খেলার শুরু থেকেই এদিকে ভালো চাপাচ্ছে নদীয়া। পরিস্থিতি আরো কঠিন করে তুলেছে গুমোট গরম, মেঘাচ্ছন্ন আকাশ থেকে বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।

বল কুড়িয়ে আনবার আগে নুরুন্নবী দেখতে পেলো ডাগআউটে বসে থাকা ননী বসাক উঠে দাঁড়ালেন। বোঝাই যাচ্ছে -মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠছে তার। এগিয়ে এসে প্রবল বেগে হাত-পা নেড়ে কী কী সব নির্দেশও দিলেন তিনি পিন্টুকে, দেখা গেলো।

গোলকিক করলো নুরুন্নবী। সেন্টারের পর বিশ মিনিটের মতো কেটেছে। এই পুরো সময়টা হোম টিম দারুণ প্রেস করেছে। পুরো খেলাটা চালাচ্ছে তারাই। স্বাধীন বাংলা দল কুলিয়েই উঠতে পারছে না তাদের সাথে। বিপক্ষের অর্ধেকেরও বেশি খেলোয়াড় তাদের হাফে, মনে হলো নুরুন্নবীর।

নুরুন্নবীর গোলকিক ততক্ষণে নদীয়া দলের মিডফিল্ডারের ফিরতি হেডে এসে পড়েছে তাদের হাফেই। আবার আক্রমণে নদীয়া। আইনুল আর খোকন চেষ্টা করেও আটকাতে পারছে না ওদের দেয়া পাসগুলো। বল চলে এসেছে স্বাধীন বাংলার গোলপোস্টের বাম পাশে, কর্ণার ফ্ল্যাগের কাছে। নুরুন্নবী প্রস্তুত হচ্ছে আরেকটা আক্রমণ ঠেকাতে।

বামপ্রান্ত থেকে ওদের বেঁটে উইঙ্গারটা গোলমুখে ক্রস করবার ঠিক আগের মুহুর্তেই দারুণ ট্যাকলে বল কেড়ে নিলো আশরাফ। জোরালো একটা হাততালি শোনা গেলো দর্শকদের কাছ থেকে। স্বাধীন বাংলা দল মাঠে ভালো কিছু করলেই জোরালো সমর্থন দিচ্ছে ওরা। আবার মোহনবাগানের হয়ে কলকাতা লিগে একসময় নিয়মিত মাঠে নামতো বলে হয়তো তালিটা আশরাফই পেলো, কে জানে- মনে হয় নুরুন্নবীর। আশরাফ ততক্ষণে পাস বাড়িয়েছে এনায়েতকে। সেন্টার সার্কেলের ঠিক নিচ থেকে বলটা ধরলো এনায়েত, তার চারপাশে সম্ভাব্য সকল পজিশনে মার্কার দিয়ে ঘিরে রেখেছে নদীয়া।

ঠিক তখনি, ম্যাজিকের মতোই- ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং এর গত মৌসুমের নতুন তারকা এনায়েত বুঝিয়ে দিলো- কেনো তার ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়া বদমেজাজের খ্যাতি সত্ত্বেও ননীদা তাকে আদর করে ‘পাগলা’ বলে ডাকেন। দারুণ এক ব্যাকভলিতে পেছনের অমলেশের সাথে দুর্দান্ত এক ওয়ান-টু-ওয়ানে বল বের করে নিয়ে মুহুর্তে সে চলে এলো সেন্টার সার্কেলের অপরপ্রান্তে। এরপর দুই ডিফেন্সিভ মিডের মাঝ দিয়ে বাম উইংয়ের তূর্যের দিকে বাড়ালো একটা নিখুঁত পাস। তূর্য হাজরা রুপী ১৭ বছরের কাজী সালাউদ্দিন তীর বেগে ছুটলো পায়ে বল নিয়ে, সামনে তার দক্ষিণ এশিয়ার নবতম দেশটিতে ধর্ষিত মানবতার প্রতি পাশ্চাত্যের অবহেলার এক জমাট অদৃশ্য ডিফেন্স।

নদীয়ার গোললাইনের পেছন দিকে দাঁড়ানো ফটো সাংবাদিক তপন চ্যাটার্জী প্রস্তুত হয়ে ওঠে ক্যামেরা হাতে। সালাউদ্দিনের খেলা সে আগে দেখেছে, এই দৌড় তার চেনা। হবে এবার, একটা কিছু হবেই।

সেই ক্লাস নাইনে পড়ার সময়কার চুন্না ওস্তাদের উপদেশ ভেসে আসে সালাউদ্দিনের কানে, ‘সালাউদ্দিন, তোর হবে। তোর মাঝে ফুটবলটা আছে।’ নদীয়া জেলার আগুয়ান রাইটব্যাকটাকে সেকেন্ডের ভগ্নাশে দারুণ এক স্টেপওভারে ছিটকে দিতে দিতে সালাউদ্দিন বোঝালো, তার আছে - তার হবে। নদীয়ার পোস্টের সামনের কিপার বাদে এই হাফে আর রয়েছে মাত্র তিনজনের বাধা, সালাউদ্দিন বল নিয়ে ছুটছে বাম পাশের টাচলাইন ধরে। ওদিকে মাঝমাঠ থেকে নদীয়ার ডিফেন্সের দিকে দৌড়ানো শুরু করেছে প্রতাপ হাজরা।

সেন্ট্রাল ডিফেন্সের খেলোয়াড়টাকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখেই থেমে গেলো সালাউদ্দিন। দুইজনের ব্যবধান প্রায় পাঁচ গজের মতো থাকতেই বামপায়ে এগিয়ে আসা স্টপারটার মাথার উপর দিয়ে গোলমুখে ক্রস করলো সালাউদ্দিন।

অবাক বিস্ময়ে নুরুন্নবী চেয়ে দেখে - নিখুঁত, একেবারে কাঁটাকম্পাসে মাপা নিখুঁত একটা ক্রস। একটা বড়ম্যাচে একজন স্ট্রাইকারের স্বপ্নের মতো আরাধ্য এই রকম ক্রস, যার পরে ফিনিশিংটা কেবল আনুষ্ঠানিকতাই থাকে। স্ট্রাইকারের মাথার ন্যূনতম ছোঁয়া পেলেই এই বলের গতিরোধ করা অসাধ্য যে কারো।

ডাগআউটে দাঁড়িয়ে থাকা ননী বসাকের মনে হয় তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে এখনি। তপন চ্যাটার্জী ক্যামেরার শাটারে আঙ্গুল রেখে স্থিরমূর্তি, গালের দাঁড়ি চুলকানো বন্ধ করে দিয়ে নিজের অজান্তেই পাশে বসা চুনা গোস্বামীর হাত চেপে ধরেছেন ডিকে ঘোষ। ঠিক এমনি ভাবেই নানা ভঙ্গিতে প্রায় ফেটে পড়তে প্রস্তুত গ্যালারীর হাজারো দর্শক, তাদের অপেক্ষমান চোখ দেখতে চায় কী ঘটলো – কী ঘটবে পরের মুহুর্তটিতে। কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামের হাজার পনেরো দর্শক তাকিয়ে দেখলো ক্লিয়ার করতে লাফিয়ে ওঠা দুই ডিফেন্ডারের মাঝ দিয়ে জ্যা-মুক্ত তীরের মতো হঠাৎ বেরিয়ে এসেছে একটা মাথা, প্রতাপ শংকর হাজরা।

সেই একটি মুহুর্ত যেন প্রতাপ হাজরার কাছে মহাকালের বিস্তৃতি পেলো। উড়ন্ত প্রতাপ জানে তার টাইমিং ছিলো নিখুঁত, জানে- তার একটি স্পর্শই যথেষ্ট তার মাথা থেকে পুরোনো ঢাকার সেই বিভীষিকার স্মৃতি চিরতরে মুছে দিতে। গোল করলেই... 

‘স্মৃতি’ !!

অকস্মাৎ জেগে ওঠা এই একটি নির্দোষ শব্দই থামিয়ে দিলো প্রতাপ হাজরার বাদবাকি সমস্ত কিছু। নিশ্চিত গোলের সামনে দাঁড়ানো গোলকিপারের পাশাপাশি এই শব্দটাই এনে দাঁড় করালো অপরিসীম দ্বিধার জমাট দেয়াল আর প্রতাপের মার্কিংয়ে এনে দিলো শত সহস্র কল্পিত ডিফেন্ডারকে। মুহুর্তেই প্রতাপ শংকর হাজরার মাথায় ফিরে আসে অগণিত গোলাগুলির শব্দ, স্টেডিয়ামের সমস্ত গ্যালারীর আওয়াজ ছেয়ে গিয়ে প্রতাপ হাজরার কানে বাজে কেবল মানুষের আর্তনাদ, প্রতাপ হাজরার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।...

সাদাকালো বলটা কোথায় গেলো?? ওটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না আর। দপদপে লাল আলোর মাঝে প্রতাপ হাজরা হারিয়ে ফেলেছে সেটা।... হয়নি, হেড করা হয়নি। প্রতাপ পারে নি, প্রতাপেরা পারে না।

পুরো কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামকে হতাশায় দাঁড় করিয়ে রেখে পানি চোখে উড়ন্ত প্রতাপ হাজরা নেমে এলো মাটিতে। হতাশায় চীৎকার করে উঠবার পূর্বক্ষণেই তার মনে হলো কিছু একটা ঘটছে। ডানচোখের কোণায় আবছা মতো কিছু একটা নড়তে দেখে ফিরে তাকালো প্রতাপ।

কখন যেন ডান উইং থেকে নীরব দৌড়ে ডি-বক্সে পৌঁছে গেছে শাহজাহান !! প্রতাপ নিজের অজান্তেই ডামি খেলে ফাঁকা করে দিয়েছে তাকে আর সালাউদ্দিনের অবিশেষণসম্ভব ক্রস মাটিতে পড়ে উঠে আসছে শাহজাহানের পায়ে। জোরালো ভলি। গোলকিপারের আওতার বাইরে বামপাশের পোস্টে বাতাস লাগিয়ে জালে জড়ালো সাদাকালো গোলকটা, কয়েক সেকেন্ড আগেও যেটা ছিলো প্রতাপের পৃথিবী।

এক মুহুর্ত নীরব থাকার পরেই হঠাৎ জীবিত হয়ে উঠলো স্টেডিয়ামটা।

গ্যালারীতে উড়তে থাকা লাল-সবুজ-সোনালী মানচিত্রগুলোর দিকে তাকিয়ে ক্যাপ্টেন পিন্টুর মনে হলো সারা পৃথিবীতে যেন এখন ‘বাংলাদেশ’ ‘বাংলাদেশ’ ধ্বনি ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। হবেই তো, পিন্টু জানে- ইতিহাসে এই প্রথমবার স্বাধীনতার জন্যে লড়াইরত একটি দেশের প্রতিনিধিত্বকারী ফুটবল দল প্রতিপক্ষের জালে বল ঢোকাল।

ডাগআউটের আশেপাশে তখন অদ্ভূত প্রতিক্রিয়া সকলের। কেউ হাসছে, কেউ পাগলের মতো লাফাচ্ছে, বয়স্কদের কেউ কেউ কী করবে বুঝতে না পেরে কেঁদেই দিয়েছে হয়তো। ‘জয় বাংলা’ গর্জনে ফেটে পড়া গ্যালারীর উচ্ছ্বাসের মাঝেও ননীদা শান্ত। তার হাত চেপে ধরে লাফাচ্ছেন দলের ম্যানেজার তান্না ভাই। ‘দাদা, কী গোল দিলো দেকসে্‌ন !!’

ননীদা অস্ফুটে বললেন,  ‘আমরা পাঁজর দিয়ে দূর্গঘাঁটি গড়তে জানি !!’

উত্তেজনা এই কথা এড়িয়ে যায় ম্যানেজারের কান। তিনি তখন ব্যস্ত গোল উদযাপনে।...

গলা তুলতেই হয় ডিকে ঘোষকেও। ‘ ওহে নগেন... কোথায় গেলে ?? আরে মাইকের আওয়াজটা বাড়াও। এদিকে যে কিছুই শোনা যাচ্ছে না।’...

... সেই মুহুর্তে পাঁচশো মাইল দূরের ঢাকার ফার্মগেটে তুমুল হট্টগোল। বোমা ফেলেছে গেরিলা বাহিনী। এন্ড ইটস নট কোয়ায়েট অন দ্যা নদীয়া ফ্রন্ট হিয়ার টু। লাল সবুজের জার্সিতে এগারোটা ছেলে সুদূর বারোশো মাইল দূরের একদল সামরিক অফিসারকে পাঠাচ্ছে বার্তা - আমরা লড়ছি। 

... কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামের আকাশে মেঘ কেটে যাচ্ছে, রোদ উঠছে।...

 

বিঃ দ্রঃ

খেলা বর্ণনায় কল্পনার আশ্রয় নেয়া হলেও উপরে বর্ণিত ঐতিহাসিক সমস্ত চরিত্র, স্থান, ঘটনা বাস্তব। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ১৯৭১ সালের ২৪ জুলাই নদীয়া জেলায় তাদের প্রথম প্রীতি ম্যাচটি খেলে। স্বাধীন বাংলা দল প্রথমে গোল করলেও খেলা ২-২ গোলে ড্র হয়েছিলো।


52ae91a237073-Shadin-Bangla-Team-2


তথ্যসূত্রঃ

১। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল- উইকিপিডিয়া

২। গুণীজন কহেন- কাজী সালাউদ্দিন

৩। স্বাধীন বাংলা ফুটবল – মোঃ নুরুন্নবী

(লেখাটি পূর্বে অন্যত্র প্রকাশিত