আহ! গিল্ডা! (প্রথম পর্ব)
পোস্টটি ২২৫১ বার পঠিত হয়েছে
সাধারণের চোখে তিনি আজও ‘প্রিন্স অব রিও’। ধনীদের চোখে ছিলেন ঈর্ষার পাত্র।
ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি বলে, মাঠের দিনগুলোতে বল ছিলো তার পায়ের দাস। দাসত্ব ছিলো তার মাঝেও, সেটা আবেগের কাছে। ভীষণ মেজাজী ছিলেন। তকমাটা তাই একসময় পাল্টে যায়... 'কার্সড প্রিন্স’— অভিশপ্ত রাজপুত্তুর ! সেই সময় ব্রাজিলিয়ান তন্বী মহলের ঘুম কেড়ে নেয়া রাজপুত্তুর। রোমাঞ্চপ্রিয় তরুণদের রোল মডেল। ব্রাজিলিয়ান লেখক ও সাংবাদিক মার্কোস এদুয়ার্দো নাভাসের ভাষায়, ‘নানকা হাউভে উম হোমেম কমো হেলেনো’। ইংরেজিতে বইটির শিরোনাম—‘দেয়ার ওয়াজ নেভার এ ম্যান লাইক হেলেনো।’
হেলেনোর মতো আর কেউ নেই!
রেশমি চুলের সিঁথি ধরতেন গোমালিনায়। পরনে কাশ্মীরি পশমে তৈরি দামী ইংলিশ স্যূট, যার কাটিং-ফিটিং দেখতেন ডি সিক্কো, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জেতুলিয়ো ভার্হাসের দর্জি! কব্জিতে বিলাসবহুল কার্টিয়ার, তর্জনিতে ক্যাডিলাকের চাবি। হেলেনোকে পাশ কাটানোর সময় দামী ফরাসী সুগন্ধির বিলোল আহবানকে ‘না’ বলার পরীক্ষা দিতে হতো মেয়েদের ! গ্রীক পুরাণে জিউস আর লেডার মেয়ে হেলেনকে ধরা হয় এ গ্রহের সবচেয়ে কাংখিত নারী হিসেবে। ১৯৩৯ থেকে ১৯৫১— এই এক যুগে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে ট্রয়ের সেই হেলেনেরই পুরুষ আদল—হেলেনো ডি ফ্রেইতাস! বোটাফোগোর প্রথম কিংবদন্তি।
ছেলেকে বড় আ্ইনজীবি বানাতে চেয়েছিলেন কফি ব্যবসায়ী বাবা। কিন্তু বোটাফাগোর সেই স্কাউট নেনেম বোয়ার্ড ১৭ বছর বয়সি হেলেনোর মধ্যে দেখেছিলেন, প্রতিভার স্ফুরণ। কোপাকাবানা সৈকতে অনুশীলন করছিলেন হেলেনো। ঠিক কপিবুক নয়, দুটি কমলাকে কায়দা করার চেষ্টা করছিলেন। 'চক্ষু চড়কগাছ' বোয়ার্ড হেলেনোকে নিয়ে যান বোটাফোগোতে। সিনিয়র দলে ডাক মেলে দুই বছর পর।
১৯৩৭ সালে বোটাফোগো সুপারস্টার কারভালহো লেইতের বদলী হিসেবে তার লিগ অভিষেক ঘটে। বাকিটুকু ইতিহাস। চল্লিশ দশকের সেই সময় স্ব্য়ং ব্রাজিলেও ফুটবলকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়ার আগে সবাই দ্বিতীয়বার ভাবতো। তার ওপর সেন্ট বেনেডিক্ট কলেজ থেকে আইনে ডিগ্রি ছিল হেলেনোর। সোনার চামচ মুখে জন্ম হওয়ায় জীবনকে খুব সহজেই আরও একধাপ এগিয়ে নিতে পারতেন তিনি। কিন্তু সে পথে না হেঁটে, ফুটবলকে করলেন জীবনের ধ্রুবতারা। সে নক্ষত্রের পরতে পরতে সাফল্যের আলো যতটা, তার থেকেও বেশি প্রত্যাশা পূর্ণ না হওয়ার হতাশা!
ক্যারিয়ার জুড়েই নিজের ১.৮২ মিটার উচ্চতার স্বদব্যবহার করেছেন হেলেনো। হেডে এন্তার গোল করলেও সবাইকে মোহগ্রস্থ করেছে তার বল নিয়ন্ত্রণের ঐশ্বরিক ক্ষমতা। ১৯৪৭ সালে ফ্লামেঙ্গোর বিপক্ষে ম্যাচের একটি মুহুর্ত টেনে উরুগুয়ের প্রবাদপ্রতিম লেখক ও সাংবাদিক এদুয়ার্দো গ্যালিয়েনো তার স্বভাবজাত রোমান্টিকতায় লিখেছিলেন ,‘গোলপোস্টের উল্টো দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে হেলেনো। বলটা কোত্থেকে যেন টুপ করে তার কাঁধে এসে পড়লো। হেলেনো ছুটছেন, কিন্তু বলটা ঠায় বসে কাঁধে ! তাঁর শরীর ধনুকের মতো বাঁকছে,কিন্তু বলটা নির্বিকার, নিশ্চল। গোলপোস্ট আর হেলেনোর মাঝে ডিফেন্ডার ও ফ্লামেঙ্গোর এত সমর্থক, যে গোটা ব্রাজিলেও এত মানুষ নেই ! বলটা মাটিতে পড়লেই সে হেরে যাবে। হেলেনো তাই হাঁটতে শুরু করলো। খুব ঠান্ডা মাথায় শত্রুসীমা পেরোনোর পর তার সামনে শুধু্ই গোললাইন। অথচ বলটা তখনো কাঁধে! কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়ে একটু উবু হতেই বলটা টুপ করে নেমে গেল গোললাইনের ওপাশে।'
অথচ, গারিঞ্চা পূর্ববর্তী সময়ে বোটাফোগোর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবজাগানিয়া এ আলভিনিগ্রো স্ট্রাইকারটি তাঁর প্রাণের ক্লাবকে লিগ জেতাতে পারেননি। তাঁর সময়ে ১৯৪৪-৪৭, এই চার বছর লিগ রানার্সআপ হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় বোটাফোগোকে। শেষ মৌসুমে ক্লাবের রানার্সআপ হওয়ার নেপথ্যে তাঁর নিজেরও দায় ছিল। গুরুত্বপূর্ণ এক ম্যাচে পেনাল্টি মিস করেন। ড্রেসিং রুমে ফিরে দেয়ালের ওপর হতাশা ঝেড়ে রক্তাক্ত করেন নিজেকে। বোটাফোগোর কাছ থেকে সেবার কোন পারিশ্রমিক নেননি হেলেনো। তাই বলে ক্লাবটির হয়ে তার ২৩৫ ম্যাচে ২০৯ গোল শুধুই ইতিহাস নয়। জন্ম দিয়েছে অনেক গল্পগাঁথারও।
প্রতিপক্ষ দলের প্রতি সহনীলতার তো প্রশ্নই ওঠেনা, এমনকি সতীর্থদেরও সেভাবে মূল্যায়ন করতেন না হেলেনো। কেউ একটা ভুল পাস খেললেই তার রক্ষে নেই। তেড়ে ফুড়ে আসতেন। চাইতেন, সবাই শুধু তার কাছে পাস খেলুক। কিন্তু ফুটবল তো একার খেলা নয়। আর তাই, ক্লাবের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্কের সুর তাল লয় সবই কেটে যায়।
পরের বছর বোকা জুনিয়র্সে নাম লেখালেও সেটা ছিল মাত্র এক মৌসুমের জন্য। আর্জেন্টিনার শীত সইতো না। অনুশীলন করতেন ওভারকোট পরে। একটু উঞ্চতার জন্য ছু্টে যেতেন আর্জেন্টিনার তত্কালিন প্রেসিডেন্ট হুয়ান পেরনের দ্বিতীয় স্ত্রী ও আর্জেন্টাইন ‘জাতির আধ্যাত্নিক নেতা‘ ইভা পেরনের কাছে! দুজনের পরিণয়ের বিষয়টি আজও দুই দেশের ফুটবল সমর্থকদের রসালো গল্পের খোরাক মেটায়।
মাঠের ভেতর বলকে কথা বলানো ছিল হেলেনোর আত্মার খোরাক। মাঠের বাইরে মেয়েদের বশ মানানো ছিল তার নেশা। এভাবে একদিন তার শরীরে হানা দেয় সিফিলিস। চিকিৎসা করাননি। হিরণ্ময় ক্যারিয়ারের অপমৃত্যু ঘটার ভয় ছিল। কিন্তু ঘটেছে ঠিক সেটাই। রমনীর পাশাপাশি ‘ইথার স্প্রে' ধরেছিলেন হেলেনো। স্যূটের পকেটে সবসময় একটা আলাদা রুমাল রাখতেন। একটু ফুরসত পেলেই রুমালে স্প্রে মেরে তা ধরতেন নাকে। নেশার নীল দুনিয়ার কর্জ হেলেনোকে মেটাতে হয়েছে কপালের লিখন দিয়ে। বোকা জুনিয়র্স থেকে হেলেনো ফিরে আসেন ভাস্কো দ্য গামায়। বোটাফোগোর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বি ক্লাব। প্রথম মৌসুমেই জিতে নেন লিগ চ্যাম্পিয়নশিপ !
(চলবে...)
- 0 মন্তব্য