• এশিয়া কাপ ২০১৮
  • " />

     

    'বুড়োদের' জয় হোক

    'বুড়োদের' জয় হোক    

    সেদিন জাতীয় দলের বাইরে থাকা এক ক্রিকেটার একটু আক্ষেপ করতেই করতেই বলছিলেন, ‘বুঝলেন একটু বয়স হয়ে গেলে সিলেক্টররা মনে করেন, ওকে নিয়ে আর চলে না।’  ওই ক্রিকেটারের বয়স অবশ্য এমন বেশি কিছু নয়, মাত্র ৩৩। এর মধ্যে ধারাভাষ্যেও প্রতিশ্রুতির আভাস দিয়েছেন। তবে আপাতত সেদিকে খুব উৎসাহী নন, পাছে জাতীয় দলে ফেরার পথটা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়! তাঁর চেয়েও বেশি বয়সে ঘরোয়া লিগে রানের পর রান করে যাচ্ছেন, এমন ক্রিকেটারও আছেন। কিন্তু ওই যে সরাসরি না বললেও বয়সের দিকে ইঙ্গিত করে শীর্ষ কর্তাদের সন্তর্পণ অবজ্ঞা, ‘ওকে দিয়ে আর চলে না।’

    ফজলে রাব্বি মাহমুদকে জিম্বাবুয়ে সিরিজে নেওয়ার পর থেকেই কথাগুলো কেন যেন খুব প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছিল। রাব্বির বয়স ৩০ পেরিয়েছে গত বছর, বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রেক্ষাপটে যাঁকে একটু ঝুঁকি নিয়ে ‘বুড়োই’ বলে ফেলা যায়। তবে ২২ গজে যে মোটেই বুড়িয়ে যাননি, গত কয়েক বছরে সেই প্রমাণ খুব ভালোভাবেই দিয়েছেন। বিশেষ করে আয়ারল্যান্ড এ দলের বিপক্ষে তাঁর পারফরম্যান্সের পর তাঁকে দলে নেওয়াটা ঠিক ‘চমক’ বলাটা অনুচিত। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেটা মোটামুটি বিস্ময় হিসেবেই ধরা হচ্ছে। সেটার কারণ কী? অবশ্যই তাঁর বয়স।

    বাংলাদেশ বলেই আসলে এই ‘চমক’ বা ‘বিস্ময়’ এতোকিছু। ওয়ানডে ইতিহাসেই বাংলাদেশ দলে এখন পর্যন্ত ত্রিশের বেশি বয়সে অভিষেক হয়েছে পাঁচজনের। এঁদের মধ্যে তিন জন খেলেছিলেন অভিষেক ওয়ানডে, আরেকজনও খেলেছেন শুরুর দিকে। শুধু মাহবুবুর রহমানই সত্যিকার অর্থে ত্রিশের বেশি বয়সে সুযোগ পেয়েছেন ওয়ানডে দলে। ১৯৯৯ সালে অভিষেকের সময় তাঁর বয়স ছিল ৩০ বছর দুই মাস।

    ১৯৯৯ সাল থেকে একটু হিসেব করা যাক। এই সময় টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়া ত্রিশের বেশি বয়সে মাত্র একজন অভিষেক হয়েছিল শুধু জিম্বাবুয়েতেই। এই সময়ে অস্ট্রেলিয়ায় ত্রিশোর্ধ্ব ১০ জনের অভিষেক হয়েছে, নিউজিল্যান্ডে ৯ জনের, দক্ষিণ আফ্রিকার সাত জনের, ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ছয়। বয়স নয়, পারফরম্যান্সই যে এসব দেশে আসল মাপকাঠি, সেটা বলে না দিলেও চলে।

    অথচ বাংলাদেশে ত্রিশের আশেপাশে আসলেই জাতীয় দলের বাইরে চলে যাওয়া ক্রিকেটারদের যেন ‘এলপিআর’ দিয়ে দেওয়া হয়। এক তুষার ইমরান ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের পর রান করে যাচ্ছেন। কয়েক দিন আগেও জাতীয় লিগে করলেন জোড়া সেঞ্চুরি। কিন্তু নির্বাচকদের রাডারে যেন বরাবরই তিনি ফ্লাইং সসারে করে আসা ভিনগ্রহের আগন্তুক, যাঁকে কখনো চোখেই পড়ে না। আবদুর রাজ্জাকও এরকম অনেক দিন দৃষ্টির আড়ালে ছিলেন, শেষ পর্যন্ত এই বছর শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তাঁকে না ডেকে আর পারা যায়নি। বুড়িয়ে গেলেও যে ফুরিয়ে যাননি, মিরপুর টেস্টেই তাঁর খানিকটা প্রমাণ দিয়েছিলেন। নাঈম ইসলাম এখনো দারুণ ধারাবাহিক, নাম বললে তালিকাটা শুধু লম্বাই হতে থাকবে। কিন্তু জাতীয় দলে দূরে থাক, অনেককে এ দলেও সুযোগ দিতে নারাজ নির্বাচকেরা। কারণ ওই যে, ‘ওরা চলে না।’

    এই ‘চলে না’র বড় কারণ মনে করা হয় ফিটনেসের অভাব। এই জাতীয় লিগ থেকে অবশ্য সেই অজুহাতটাও আর ধোপে টিকছে না। বিপ টেস্ট এবার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে সবার জন্য, সেখানে উৎরেই মাঠে নামার অনুমতি পাওয়া গেছে। অনেক সিনিয়র ক্রিকেটার সেখানে বয়সে জুনিয়রদের পেছনে ফেলেছেন। আর এই যুগে ত্রিশ পেরুলে ফিটনেস যে বাধা নয়, সেই প্রমাণ তো জাতীয় দলের পঞ্চপাণ্ডব প্রতিদিনই দিয়ে যাচ্ছেন। আর কিছু না হোক, শুধুমাত্র মাঠে দৌড়ে ঘাম ঝরানোতেই দলের অনেক জুনিয়র ক্রিকেটার তাদের যোজন পেছনে পড়ে থাকবেন।

                             বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছেন আবদুর রাজ্জাক-তুষার ইমরান

    অথচ ক্রিকেটের পৃথিবী যে বদলে যাচ্ছে, সেই বার্তা কিন্তু আসছে চারদিক থেকেই। আজই যেমন ৩৫ বছর বয়সী মালিঙ্গা কাঁপিয়ে দিয়েছেন ইংল্যান্ডকে, পাঁচ উইকেট নিয়ে মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘অভিজ্ঞতা বাজারে কেনা যায় না।’ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সদ্যসমাপ্ত টেস্টে দল থেকে পাকিস্তানে অভিষেক হয়েছে ৩৩ বছর বয়সী বিলাল আসিফের। প্রথম ইনিংসে ছয় উইকেট নিয়ে জানান দিয়েছেন, বয়স তাঁর সামর্থ্যে মরচে ধরাতে পারেনি। মোহাম্মদ হাফিজকে মনে করা হচ্ছিল, টেস্টের জন্য বেশি বুড়িয়ে গেছেন। কিন্তু ৩৭ বছর বয়সে আবার দলে ফিরে পেয়েছেন সেঞ্চুরি, পাকিস্তানের হয়েই তাঁর চেয়ে বেশি বয়সে টেস্ট সেঞ্চুরি আছে দুইজনের। মালিঙ্গাকেও তাদের ক্রিকেট বোর্ড ‘চলে না’ রায় দিয়ে দিয়েছিল, ভাগ্যিস শেষ পর্যন্ত মত বদলেছে তাদের। মিসবাহ, হেরাথদের বুড়ো হাড়ের ভেলকির কীর্তিও বেশি দিনের নয়।

    আমাদের জাতীয় দলের দুই নির্বাচকের কথাই ধরি। হাবিবুল বাশার টেস্ট ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বেশি রান করেছিলেন ২০০৩ সালে, সেসময় তাঁর বয়স ছিল ৩১। আর প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীনকে যখন তুমুল জনদাবির মুখে ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ফেরানো হয়, সেসময় তাঁর বয়স ছিল ৩৪। সুযোগ পাওয়ার পর মিনহাজুল কী করেছিলেন, সেটা বোধ হয় সবারই জানা।

    অবশ্য নির্বাচকদের মনোভাবও সম্ভবত বদলাতে শুরু করেছে। আজকেই যেমন হাবিবুল বাশার বললেন, ‘আগে ৩০ বছরের পর একটা ছেলের ফিটনেস ধরে রাখাও কঠিন ছিল। সেটা থেকে এখন বেরিয়ে এসেছি। অভিজ্ঞতা আসলে কেনা যায় না। সেটা অর্জন করতে হয়। একটা অভিজ্ঞ খেলোয়াড়কে দলে নেয়া কিন্তু সহজ। একজন তরুন ক্রিকেটারকে দলে নেয়া আবার বেশি ঝুঁকি নিতে হয়।’

    বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কথাগুলো বেশ তাৎপর্যপূর্ণই। যে দেশে কুড়িতেই বুড়ি আর চল্লিশে চালশের মতো প্রবাদ চলে, সেখানে ক্রিকেটারদের ত্রিশেই বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়াটা জাতিগত বোধের দৈন্যতাই তুলে ধরে। আশার কথা, দিন বদলাচ্ছে। যেমন বদলাচ্ছে নির্বাচকদের মনমানসিকতা। বয়স নয়, তারা এখন বিবেচনায় আনছেন নিবেদন, পরিশ্রম করার মানসিকতাকে। সেই মানসিকতায় আরও বদল হোক, তুষারদের পথে বয়স নামের উটকো কাঁটা বেছানো না থাকুক।

    বাগানের সব ফুল এক সঙ্গে সৌরভ ছড়াবে, এমন তো কোনো কথা নেই। কিছু ফুল না হয় দেরিতেই ফুটুক!