• চ্যাম্পিয়নস লিগ
  • " />

     

    অ্যানফিল্ডে বার্সেলোনার কবর খুঁড়ে ফাইনালে লিভারপুল

    অ্যানফিল্ডে  বার্সেলোনার কবর খুঁড়ে ফাইনালে লিভারপুল    

    অবিশ্বাস্য। অ্যানফিল্ডে শুধু আগের বছরের রোমের স্মৃতিটা ফেরত চায়নি বার্সেলোনা। খুব করে চাওয়াটা কোনো কাজেই আসলো না তাদের। মোহামেদ সালাহ, রবার্তো ফিরমিনোরা ছিলেন না। কিন্তু অ্যানফিল্ড প্রতারণা করেনি লিভারপুলের সঙ্গে। প্রথম লেগে বার্সেলোনার ৩-০ গোলের লিড নিয়ে ছেলে খেলা করলো লিভারপুল। বার্সেলোনার কবর খুঁড়ে দ্বিতীয় লেগে তাদের ৪-০ গোলে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে চলে গেছে ইয়ুর্গেন ক্লপের দল। আর রোমের চেয়ে দুঃসহ আরেক স্মৃতি সঙ্গী করে খালি হাতে ফিরেছেন লিওনেল মেসিরা।

    “হোয়েন ইউ ওয়াক থ্রু আ স্টর্ম, হোল্ড ইওর হেড আপ হাই, অ্যান্ড ডোন্ট বি অ্যাফ্রেইড অফ দ্যা ডার্ক” - রীতি মেনে অ্যানফিল্ডে ম্যাচের আগে বাজল ইউল নেভার ওয়াক অ্যালোন। ৩ গোলে ন্যু ক্যাম্পে হেরে আসার পর আরও ঝড়-ঝঞ্ঝাই অতিক্রম করতে হত লিভারপুলকে। ম্যাচের শুরু থেকে লিভারপুল মাথা উঁচু করে লড়লো, বার্সার চোখ রাঙানিকে পরোয়া করলো না। বিশ্বাস রাখলো নিজেদের ওপর।

    বার্সেলোনাও জানত, শুরুতে গোল হজম করলে আরও একবার চাপে পড়ে যাবে তারা। কিন্তু শুরুতে গোল করলে অ্যানফিল্ডের সমর্থকদের কীভাবে তাঁতিয়ে দেওয়া যায় সেটা লিভারপুলের চেয়ে ভালো অবশ্যই জানা ছিল না তাদের। দরকারটা মেটাতে ৮ মিনিট সময় নিল লিভারপুল।

     

    বামদিকে বলে হেড করতে ভুল করলেন জর্দি আলবা। পজেশন দিয়ে দিলেন প্রতিপক্ষকে। ডিবক্সের ভেতর ঢুকে জর্ডান হেন্ডেরসন করলেন শট, সেটা ঠেকিয়েও দিয়েছিলেন মার্ক আন্দ্রে টের স্টেগান। কিন্তু খানিকটা দূরে গিয়ে রিবাউন্ডে বল গেল ডিভক অরিগির কাছে। সহজ ট্যাপ ইনে গোল। দুই লেগ মিলিয়ে ৩-১ এ পিছিয়ে লিভারপুল।

    সালাহ, ফিরমিনোদের বদলে অরিগির সঙ্গে নেমেছিলেন জের্দান শাকিরি। দ্রুত গোল পেয়ে আরও উজ্জীবিত লিভারপুল বার্সেলোনাকে দম ফেলার সময় দিচ্ছিল না মোটেই। বার্সার নড়বড়ে অবস্থাটা ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছিল তখন। কিন্তু বার্সার জন্য কাজও ছিল সহজ। একটা অ্যাওয়ে গোল পুরে দিলেই টাইয়ের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যেত প্রায়। এক গোল হজম করে তাই সেদিকেই মন দিল বার্সা। লিওনেল মেসির শট ঠেকিয়ে অ্যালিসনও জানান দিলেন, এবার আর নিস্তার নেই। আরেকবার ফিলিপ কৌতিনহোর শট ঠেকিয়ে আরেকটু স্বস্তি দিলেন লিভারপুলকে। লুইস সুয়ারেজ অবশ্য অরগির মতো করে রিবাউন্ডে গোল পেয়ে বসতে পারতেন। কিন্তু অ্যালিসন আরেকটু বিচক্ষণতা দেখালেন ওই সেভে। গোলের সামনে থেকেও হতাশ তাই সুয়ারেজ। আলবা অবশ্য শাপমোচনের সুযোগ পেলেন প্রথমার্ধে। মেসির দারুণ এক পাস ধরে অ্যালিসনের কাছে গিয়ে হার মানলেন তিনিও। রোমে আগের বছর ছিলেন, অ্যালিসন প্রথমার্ধেই জানিয়ে দিয়েছিলেন এবারও তিনিই আছেন বার্সার গোলবারের নিচে।

    বিরতির সময় ১-০ তে এগিয়ে থাকলো লিভারপুল। দারুণ সামাঞ্জস্য খেলায়। বার্সা তখনও পুরোপুরিরং হারায়নি। প্রথম লেগের একাদশটাই নামিয়েছিলেন এর্নেস্তো ভালভার্দে। ক্লপ বদল এনেছিলেন বেশ কয়েকটি। বিরতির পর বদলি করালেন আরেকটি। অ্যান্ড্রু রবার্টসন প্রথমার্ধে ইনজুরিতে না পড়লে হয়ত বদলিটা এতো আগে করাতেন না তিনি। কিন্তু সৌভাগ্য লেখা ছিল ওই ইনজুরিতেই।

    বিরতির পর দুই মিনিটের ব্যবধানে সেই বদলি নামা জর্জিও ওয়ানাইল্ডাম গোল করলেন দুইবার। প্রথমবার করলেন ৫৪ মিনিটে। অ্যালেক্সান্ডার আর্নল্ড ডানদিক থেকে ক্রস করলেন ডিবক্সের ভেতর। গোল থেকে ১০ গজ দূরে দৌড়ে গিয়ে ডান পায়ে শট মারলেন ওয়ানাইল্ডাম। টের স্টেগান হয়ত আরেকটু ভালো করতে পারতেন। কিন্তু তাতে কী, তার হাত গলে গোল হয়ে গেছে সেই শট।

    সেই গোলের রেশ না কাটতেই ঝড় জয় করা গেল লিভারপুলের। জের্দান শাকিরির বাম দিক থেকে করা ক্রসে লাফিয়ে উঠে হেড করলেন ওয়াইনাল্ডাম। সেটাও পরিণত হলো গোলে।  অ্যানফিল্ডে যখন বিশ্বাসে বস্তু মেলালো, বার্সা তখন অবিশ্বাসে মুখ লুকাচ্ছে। সেই লুকানো অবস্থা থেকে আর ফিরেই আসা হয়নি বার্সার।

    তারপরও ম্যাচে বার্সার সম্ভাবনা ছিল ভালো মতোই। একটা গোল করলে তখনও লিভারপুলকে সেটার বিপরীতে করতে হত দুই গোল। কিন্তু আক্রমণে কী উঠবে বার্সা, তাদেরকে নিজেদের অর্ধেই ব্যস্ত রাখল লিভারপুল। মেসি ফ্রি কিক পেলেন, কিন্তু এবার আর অতিমানব হয়ে ওঠা হলো না তার। আরও কয়েকবার ডিবক্সের বাইরে থেকে মারলেন এলোমেলো শট। আর গোলের সামনে যাওয়ার আগেই তার দলকে হটিয়ে দিচ্ছিল ভ্যান ডাইকরা।

    এদের মধ্যে ভ্যান ডাইক একবার গোলেরও খুব কাছাকাছি গেলেন।  কিন্তু স্টেগানে বাধা পেয়ে গোল পাওয়া হয়নি তার। সেটা ম্যাচ শেষে ডাচ ডিফেন্ডার মনে রাখবেন না। মনে রাখবে না বার্সাও। রোমাঞ্চকর ম্যাচে এসব নস্যি।

    কিন্তু ৭৯ মিনিটে যেটা হলো সেটা মনে রাখবে ফুটবল। বার্সার জন্য সেটা হয়ে থাকবে ভুলে যেতে চাওয়ার স্মৃতি। কিন্তু ভুলতে কি আদৌ পারবে বার্সা? কর্নারটা আদায় করেছিলেন আর্নল্ডই। প্রথমে কর্নার নিতে গেলেন। কিন্তু ফেরত আসলেন। সিক্স ইয়ার্ড বক্সের মাথায় অরিগি জানেন কী হচ্ছে। কিন্তু পিকে, লংলেদের কোনো ধারণাও নেই। তারা খেলা বন্ধ করে বসে আছেন। আর্নল্ড সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে পরেরবার মারলেন কর্নার। অরিগি বল নিয়ন্ত্রণে আনলেন। এরপর শট মারলেন, গোল! বার্সা খেলোয়াড়রা তখনই বুঝে গেছেন, দিনটা তাদের না। বহু বছর পর রোমের স্মৃতি মনে না থাকলেও বার্সার এই দলের কাউকে অ্যানফিল্ড নিয়ে প্রশ্ন করে দেখতে পারেন। এই মুহুর্তটার কথা হয় সবার আগে বলবেন তারা, নয় যাবেন এড়িয়ে।

    মেসি বরাবরের মতো চেহারায় কোনো হতাশার ছাপ দেখালেন না। কিন্তু তার ভেতরে কী চলছিল সেটা আন্দাজ করা যায়। প্রথম লেগেও আধিপত্য ছিল লিভারপুলের। তার জাদুতে বড় জয় পেয়েছিল বার্সা। কিন্তু পরেরবার তিনি সাক্ষী হলেন অ্যানফিল্ডের রূপকথার রাতের। তার জন্য অবশ্য ট্র্যাজেডি। বাকি সময়েও তার দলকে হতাশ করলো লিভারপুল। সপ্তাহের শুরুতে নিউক্যাসেলের বিপক্ষে লিভারপুলের ঘাম ঝরানো জয়, আগের রাতে ভিনসেন্ট কোম্পানির গোলে সিটিকে জিততে দেখার হতাশা বা বার্সেলোনার পুরো এক সপ্তাহের বিশ্রাম- সবকিছুকে প্রতিপক্ষ বানিয়েও শেষদিকে শক্তি সঞ্চার করলো অ্যানফিল্ড। ক্লান্তির ছাপ থাকলো না তাই লিভারপুলের খেলায়। ৫ মিনিট ইনজুরি সময়ের বেশিরভাগ বার্সার কাটলো নিজেদের অর্ধেই। আর ওই স্নায়ুরচাপের মধ্যেও লিভারপুল সমর্থকরা গলা থামালেন না।

    "অ্যাট দ্যা এন্ড অফ দ্যা স্কাই দেয়ার ইজ অ্যা গোল্ডেন স্কাই"…. ফ্লাড লাইটের নিচে আবেগে ভেসে গিয়ে ম্যাচ শেষে সেই গানের সঙ্গে সুর মেলালেন লিভারপুল খেলোয়াড়েরাও। আর অ্যানফিল্ডে হাজির হওয়া বার্সা সমর্থকেরা ফিরলেন চোখের পানি মুছতে মুছতে।